ফজল মনে মনে হাসে। মুখে বলে, হ পারুম। তোমরা মনে করছ, তোমাগ কুয়ার মধ্যে নামাইয়া দিয়া, আমি উপরে বইস্যা আতে তালি দিমু। উঁহু, আমিও আছি তোমাগ লগে।
জমিরদ্দি : আপনেও আছেন!
আহাদালী : অ্যাঁ, আপনেও থাকবেন আমাগ লগে!
ফজল : হ-হ-হ, আমিও থাকমু।
আহাদালী : মাতবরের পো জানে এই কথা?
ফজল : এখনো জানে না। তারে জানান লাগব।
আহাদালী : উনি কি রাজি অইব?
ফজল : তারে রাজি করানের ভার আমার উপর।
জমিরদ্দি : উনি যদি রাজি অয়, আর আপনে যদি আমাগ লগে থাকেন, তয় আর ডরাই কারে! কি কও তোমরা?
সকলে : হ, তাইলে আর ডর কি?
ফজল : আমি এখনি বাড়ি যাইতেছি। জমিরদ্দি আর আহাদালী চলো আমার সাথে।
.
এরফান মাতব্বর বিষম ভাবনায় পড়ে যায়। আর সবার মতো তারও সেই একই ভয়। ফজল মাছ বিক্রি করে লুকিয়ে-চুরিয়ে। কাজটা একা করে বলে কেউ জানবার সুযোগ পায় না। কিন্তু যেখানে দশজন নিয়ে কারবার, সেখানে ব্যাপারটা গোপন রাখা কোনো রকমেই সম্ভব নয়।
মাতব্বর বলে, নারে, পরের দিনই মুলুকের মানুষ জাইন্যা ফালাইব।
জানুক, তাতে কী আসে যায়। ফজল বলে।
কী আসে যায়! তখন মাইনষেরে মোখ দেখান যাইব? মাতব্বরের কণ্ঠে রাগ ও বিরক্তি।
একজন তো না যে মুখ দ্যাখাইতে শরম লাগব। বইতে পড়ছি–দশে মিলি করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ। যখন এতজনে একসাথে কাজটা করতে চাই তখন আর লজ্জা-শরম কিসের? এত মাইনষের বদনাম করতে মুখ বেদনা অইয়া যাইব না মাইনষের!
অনেক ভেবে-চিন্তে মাতব্বর শেষে নিমরাজি হয়। ফজল আশ্বাস দেয়–রোজ ভোর রাত্রে মাছ নিয়ে তারা চলে যাবে তারপাশা। সেখানে কেউ তাদের চিনবে না। কেউ জানতে পারবে না মাছ বেচার কথা।
.
দশজন যোগ দিয়েছে ফজলের সাথে। দুজন কেটে পড়েছে। তারা বলে দিয়েছে–না খেয়ে শুকিয়ে মরবে তবু তারা ইজ্জতনাশা কাজ করতে পারবে না।
নৌকা নিয়ে পরের দিনই ফজল হাটে যায়। সাথে যায় দলের কয়েকজন। তারা মাকলা আর তল্লা বাঁশ কেনে গোটা চল্লিশেক। আর কেনে সাত সের নারকেলের কাতা।
কাতা আর বাশগুলো ভাগ করে নেয় সবাই। প্রত্যেককে চারহাত খাড়াই আর পাঁচহাত লম্বাই ছ’খানা করে বানা তৈরি করতে হবে।
মাত্র দুদিন সময় দিয়েছিল ফজল। কিন্তু কাজ অনেক। বাঁশগুলোকে খণ্ড করা, খণ্ডগুলোকে ফেড়ে চটা বের করা, চটাগুলো চেঁচেছুলে এক মাথা চোকা করা, শেষে একটার পর একটা কাতা দিয়ে বোনা। এত ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার তৈরি হয় বানা আর তার জন্য লেগে যায় পুরো চারটে দিন।
বানা তৈরি করতেই যা ঝঞ্ঝাট। ও দিয়ে মাছ ধরা এমন কিছু কঠিন কাজ নয়। ভরা জোয়ারের পর ভাটার টান লাগার কিছুক্ষণ আগে বানা পুঁতে বেড় দিতে হয়। ধনুকের আকারে সে বানা ঘিরে থাকে অনেক জায়গা। ভাটার সময় পানি নেমে যায় আর মাছ আটকা পড়ে বেড়ের ভেতর। আড়, বোয়াল, বেলে, বাটা, ট্যাংরা, টাটকিনি, পাবদা, চিংড়ি ইত্যাদি ছোট-বড় নানা রকমের মাছ। রাত্রের বেড়ে দু-চারটে রুই-কাতলা-মৃগেল-বাউসও পাওয়া যায়। পানির মাছ ডাঙায় পড়ে লাফালাফি ছটকাছটকি করে।
ফজল আর তার সঙ্গীরা হৈ-হুঁল্লোড় করে হাত দিয়ে ধরে সে মাছ। অনেক সময় পানি নেমে যাওয়ার অপেক্ষাও করে না তারা। অল্প পানির মধ্যে গোলাগুলি করে, আছাড় পাছাড় খেয়ে মাছ ধরায় আনন্দ বেশি, উত্তেজনা, বেশি। এজন্য অবশ্য মাঝে মাঝে বাতাশি, বজুরি আর ট্যাংরা মাছের কাঁটার জ্বলুনি সইতে হয়, চিংড়ি আর কাঁকড়ার চেঙ্গি খেয়ে ঝরাতে হয় দু-চার ফোঁটা রক্ত।
একবার দিনের বেলা প্রকাণ্ড এক রুই মাছ আটকা পড়েছিল বেড়ে। এত বড় মাছ দিনের বেলা তো দূরের কথা, রাত্রেও কদাচিৎ আসে অগভীর পানিতে। বোধহয় শুশুকের তাড়া খেয়ে কিনারায় এসেছিল মাছটা। ভাটার সময় বেড়ে বাধা পেয়েই ওপর দিয়ে লাফ মেরেছিল। লাফটা কায়দা মতো দিতে পারলে বানা ডিঙ্গিয়ে বেরিয়ে যেতে পারত। আরেকবার লাফ দেয়ার আগেই ফজল সবাইকে নিয়ে ওটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারপর সে যে কি পাছড়া পাছড়ি! পানির জীবকে পানির ভেতর কাবু করা কি এতই সোজা! ধস্তাধস্তির সময় মাছের গুঁতো খেয়ে কয়েকজনের শরীরে জায়গায় জায়গায় কালশিরা পড়ে গিয়েছিল।
পঁচিশ সের ওজন ছিল মাছটার। বেচার সময় মাপা হয়েছিল। দাম পাওয়া গিয়েছিল আট টাকা।
রাতদিন চব্বিশ ঘণ্টায় জোয়ার-ভাটা খেলে দু’বার। এ দু’বারই শুধু বানা পুঁতে বেড় দিয়ে মাছ ধরা যায়। দিনের জোয়ারে খুব বেশি সুবিধে হয় না। সুবিধে হয় রাত্রের জোয়ারে।
দিনে বেড় দিয়ে যে মাছ পাওয়া যায় তার কিছুটা খাবার জন্য ফজল ও তার সাথীরা ভাগ করে নেয়। মাঝে মাঝে চরের আর শরিকদেরও দেয়া হয় কিছু কিছু। বাকিটা বড় বড় চাই-এর মধ্যে ভরে পানির ভেতর জিইয়ে রাখে। রাত্রে ধরা মাছের সাথে সেগুলো নিয়ে তারা ভোর রাত্রে চলে যায় তারপাশা।
চিংড়ি আর বড় মাছ কেনে মাছের চালানদাররা। তারা কাঠের বাক্সে ভরে বরফ দিয়ে সে মাছ চালান দেয় কলকাতায়। এদের কাছ থেকে ভালো দাম পাওয়া যায়। ছোট মাছগুলো সস্তায় বেচে দিতে হয় নিকারি-কৈবর্তের কাছে।
মাছ বিক্রি করে তারা ভোর আটটা-সাড়ে আটটার মধ্যে ফিরে আসে। জমিরদ্দিন সরু ডিঙি সাত বৈঠার টানে ছুটে চলে বাইচের নৌকার মতো। উজান ঠেলে মাত্র ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তারা পৌঁছে যায় তারপাশা। সেখান থেকে ভাটি পানিতে ফিরে আসতে আধঘণ্টাও লাগে না। রোজ পনেরো-বিশ টাকা আসে মাছ বেচে। এভাবে আরো পনেরোটা দিন চালাতে পারলে যোগাড় হয়ে যাবে দশ জনের খাজনার টাকা।