এ সবই জঙ্গুরুল্লার কানে যায়। রাগের চোটে সে দাঁতে দাঁত ঘষে। নিন্দিত পা দুটোকে মেঝের ওপর ঠুকতে থাকে বারবার। তার ইচ্ছে হয়, পা দুটো দিয়ে সে লণ্ডভণ্ড করে দেয় সবকিছু, পদানত করে চারদিকের সব মাটি আর মানুষ। এমনি করেই এক রকমের দিগ্বিজয়ের আকাক্ষা জন্ম নেয় তার মনে। তাই আজকাল আশেপাশে কোনো নতুন চর জাগলেই লাঠির জোরে সে তা দখল করে নেয়। জমির সত্যিকার মালিকেরা উপায়ান্তর না দেখে হাতজোড় করে এসে তার কাছে দাঁড়ায়। দয়া হলে কিছু জমি দিয়ে সে তাদের কোলশরিক করে রাখে।
চরদিঘলির উত্তরে বড় একটা চর জেগেছে–খবর পায় জঙ্গুরুল্লা। চরটা তার এলাকা থেকে অনেক দূরে, আর কারা নাকি ওটা দখল করে বসেছে। এসব অসুবিধের কথা ভেবেও দমে না সে। নানা প্রতিকূল অবস্থার ভেতর পরপর অনেকগুলো চর দখল করে তার হিম্মত বেড়ে গেছে। তাই কোনো রকম অসুবিধাই সে আর অসুবিধা বলে মনে করে না। চর আর চরের দখলকারদের বিস্তারিত খবর আনবার জন্য সে তার মেজো ছেলে হরমুজকে দু’জন কোলশরিকের সাথে নতুন চরের দিকে পাঠিয়েছিল। তারা ফিরে এসে খবর দেয়–চরটার নাম খুনের চর, দখল করেছে এরফান মাতব্বর, ভাঙর ঘর উঠেছে ঊনষাটটা।
সেদিনই জঙ্গুরুল্লা তার বিশ্বস্ত লোকজন ডাকে যুক্তি-পরামর্শের জন্য। তার কথার শুরুতেই শোনা যায় অনুযোগের সুর, কি মিয়ারা, এত বড় একটা চর জাগল, তার খবর আগে যোগাড় করতে পার নাই?
কোলশরিক মজিদ খালাসি বলে, ঐ দিগেত আমাগ চলাচল নাই হুজুর।
ক্যান্?
আমরা হাট-বাজার করতে যাই দিঘিরপাড় আর হাশাইল। হাশাইলের পশ্চিমে আমায় যাওয়া পড়ে না।
যাওয়া পড়ে না তো বোঝলাম। কিন্তুক এদিকে যে গিট্টু লাইগ্যা গেছে।
গিট্টু! কিয়ের গিট্টু? দবির গোরাপি বলে।
হোনলাম, এরফান মাতব্বর চরডা দখল কইরা ফালাইছে।
হ, আগের বার আট-দশ বচ্ছর আগে যহন ঐ চর পয়স্তি অইছিল তহন এরফান মাতব্বরই ওইডা দখল করছিল।
হ, তার বড় পোলা ঐ বারের কাইজ্যায় খুন অইছিল। মজিদ খালাসি বলে।
প্রতিপক্ষ খুবই শক্তিশালী, সেটাই ভাবনার কথা। জঙ্গুরুল্লার কথা-বার্তায় কিন্তু ভাবনার বিশেষ কোনো আভাস পাওয়া যায় না।
সে স্বাভাবিক ভাবেই বলে, খবরডা আগে পাইলে বিনা হ্যাঁঙ্গামে কাম ফতে অইয়া যাইত। যাক গিয়া, তার লেইগ্যা তোমরা চিন্তা কইর্য না। চর জাগনের কথাডা যখন কানে আইছে তখন একটা উল্লাগুল্লা না দিয়া ছাইড়্যা দিমু!
কিন্তু হুজুর, রেকট-পরচায় ঐ চরতো এরফান মাতব্বরের নামে আছে। মজিদ খালাসি বলে।
আরে রাইখ্যা দ্যাও তোমার রেকট-পরচা। চরের মালিকানা আবার রেকট-পরচা দিয়া সাব্যস্ত অয় কবে? এইখানে অইল, লাডি যার মাডি তার।
তবুও কিছু একটা….।
সবুর করো, তারও ব্যবস্থা করতে আছি। ঐ তৌজিমহলের এগারো পয়সার মালিক বিশুগায়ের জমিদার রায়চৌধুরীরা। আমি কাইলই বিশুগাঁও যাইমু। রায়চৌধুরীগ নায়েবরে কিছু টাকা দিলেই সে আমাগ বিরুদ্ধে আদালতে নালিশ করব।
নালিশ করব!
হ, কয়েক বচ্ছরের বকেয়া খাজনার লেইগ্যা নালিশ করব। আমরাও তখন খাজনা দিয়া চেক নিমু। তারপর এরফান মাতব্বরও যেমুন রাইয়ত, আমরাও তেমুন।
কি কইলেন হুজুর, বোঝতে পারলাম না। মজিদ খালাসি বলে।
থাউক আর বেশি বুঝাবুঝির দরকার নাই। যদি জমিন পাইতে চাও, তবে যার যার দলের মানুষ ঠিক রাইখ্য। ডাক দিলেই যেন পাওয়া যায়। কারো কাছে কিন্তু ভাইঙ্গা কইও না, কোন চর দখল করতে যাইতে লাগব। এরফান মাতব্বরের দল খবর পাইলে কিন্তু হুঁশিয়ার অইয়া যাইব।
কবে নাগাদ যাইতে চান হুজুর? দবির গোরাপি জিজ্ঞেস করে।
তা এত ত্বরাত্বরির কি দরকার? আগে নালিশ অউক, খাজনার চেক-পত্র নেই, আর ওরাও ধান-পান লাগাইয়া ঠিকঠাক করুক। এমুন বন্দোবস্ত করতে আছি, দ্যাখবা মিয়ারা, তোমরা ঐ চরে গিয়া তৈয়ার ফসল ঘরে উডাইতে পারবা।
লোকজন খুশি মনে যার যার বাড়ি চলে যায়।
০৫-০৮. আশ্বিন মাসের শেষ পক্ষ
আশ্বিন মাসের শেষ পক্ষ। চরটার কোনো কোনো অংশ ভাটার সময় জেগে ওঠে। জোয়ারের সময় সবটাই ডুবে যায় আবার। এ পানির মধ্যে বাঁশের খুঁটি ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি ঝুপড়ি। টুঙ্গির মতো অস্থায়ী ঐ ঝুপড়িগুলোরই নাম ভাওর ঘর। মাতব্বরের জন্য উঠেছে তিনখানা ভাওর ঘর। চরের চারপাশ ঘিরে ভাওর ঘরগুলো পাহারা দিচ্ছে, চোখ রাখছে চারদিকে।
জোয়ারের সময় ঝুপড়ির মধ্যে এক বিঘত, আধা বিঘত পানি হয়। পানির সমতলের হাতখানেক ওপরে বাঁশের মাচান বেঁধে নেয়া হয়েছে। যারা মাচান বাঁধতে পারেনি, তারা অন্য চর থেকে নৌকা বোঝাই করে নিয়ে এসেছে লটাঘাস। পানির মধ্যে সে ঘাসের স্থূপ সাজিয়ে উঁচু করে নিয়েছে। এরই ওপর হয়েছে শোয়া-থাকার ব্যবস্থা। শরীরের ভারে পিষ্ট হয়ে ঘাস যখন দেবে যায় তখন পানি উঁকি দেয়। তাই কয়েকদিন পর পরেই আরো ঘাস বিছিয়ে উঁচু করে নিতে হয়।
প্রথম কয়েকদিন এরফান মাতব্বরের বাড়ি থেকে সবার জন্য খিচুড়ি এসেছিল। এক গেরস্তের পক্ষে এত লোকের খাবার যোগাড় করা সম্ভব নয়। তাই শরিকরা নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরাই করে নিয়েছে। যাদের বাড়ি ধারেকাছে, তাদের খাবার আসে বাড়ি থেকে। বাকি সবাই ছোট-ছোট দলে ভাগ হয়ে ভাওর ঘরেই রান্নার ব্যবস্থা করেছে। আলগা চুলোয় একবেলা বেঁধে তারা দুবেলা খায়। নিতান্ত সাদাসিধে খাওয়া। কোনো দিন জাউ আর পোড়া মরিচ, কোনো দিন ভাত আর জালে বা বড়শিতে ধরা মাছভাজা। আর বেশির ভাগ সময়েই ডালে-চালে খিচুড়ি।