কিন্তু বাড়ি ফেরার পথেই সে পাকড়াও করে জঙ্গুরুল্লাকে জুতা খুলে মারতে যায়। আর সবাই না ঠেকালে হয়তো জুতার বাড়ি দু-একটা পড়ত জঙ্গুরুল্লার পিঠে।
সোহরাব মোড়ল রাগে গজগজ করে, শয়তান, ওর কি এট্টু আক্কেল-পছন্দ নাই? ও আধোয় পায়ে ক্যামনে গিয়া ওঠল অমন ফরাসে। দেশ-কুলের তারা আমাগ কি খামাখা নিন্দে? খামাখা কয় চরুয়া ভূত?
দুলার ফুফা হাতেম খালাসি বলে, এমুন গিধড় লইয়া ভর্দ লোকের বাড়িতে গেলে কইব কি ছাইড়া দিব? আমাগ উচিত আছিল বাছা বাছা মানুষ যাওনের।
ঠিক কথাই কইছ, এইবারতন তাই করতে অইব।
আইচ্ছা, ওর ঘাড়ের উপরে দুইটা চটকানা দিয়া জিগাও দেহি, ওর চরণ দুইখান পানিতে চুবাইলে কি ক্ষয় অইয়া যাইত?
বরযাত্রীদের একজন বলে, কারবারডা অইছে কি, হোনেন মোড়লের পো। জুতাতে বাপ-বয়সে পায়ে দেয় নাই কোনো দিন। নতুন রফটের জুতা পায়ে দিয়া ফোস্কা পড়ছে। নায়েরতন নাইম্যা খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে কিছুদূর আইছিল। হেরপর খুইল্যা আতে লয়। বিয়াবাড়ির কাছে গিয়া ঘাসের মইদ্যে পাও দুইখান ঘইষ্যা রাত্বরি জুতার মইদ্যে ঢুকাইছিল।
ছিঃ-ছিঃ-ছিঃ! জাইতনাশা কুত্তা! ওর লেইগ্যা পানির কি আকাল পড়ছিল? কই গেল পা-না-ধোয়া শয়তানডা?
একটা হাসির হল্লা বরযাত্রীদের এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। সবাই খোঁজ করে জঙ্গুরুল্লার, কইরে পা-না-ধোয়া জঙ্গুরুল্লা? কই? কই গেল পা-না-ধোয়া গিধড়?
জঙ্গুরুল্লাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি সেখানে। অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে সে পেছন থেকে সরে পড়েছিল।
কিন্তু সরে পড়লে কি হবে? দশজনের মুখে উচ্চারিত সেদিনকার সেই পা-না-ধোয়া বিশেষণটা তার নামের আগে এঁটে বসে গেছে। নামের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিরাজ করছে সেদিন থেকে। নামের সঙ্গে এ বিশেষণটা যোগ না করলে তাকে চেনাই যায় না আর।
পা-না-ধোয়া বললে প্রথম দিকে খেপে যেত জঙ্গুরুল্লা। মারমুখী হয়ে উঠত। কিন্তু তার ফল হতো উল্টো। সে যত বেশি চটত তত বেশি করে চটাত পাড়া-প্রতিবেশীরা। শেষে নিরুপায় হয়ে নিজের কর্মফল হিসেবেই এটাকে মেনে নিতে সে বাধ্য হয়।
চার বছর পর ঘোপচর নদীতে ভেঙে যায়। জঙ্গুরুল্লা চণ্ডীপুর মামুর বাড়ি গিয়ে আশ্রয় নেয়। এ কাজে সে কাজে সাতঘাটের পানি খেয়ে সে যখন জীবিকার আর কোনো পথ পায় না তখন ঘড়িশার কাছারির নায়েবের কথা মনে পড়ে তার।
চণ্ডীপুর আসার মাস কয়েক পরের কথা। ঘড়িশার কাছারির নায়েব শশীভূষণ দাস স্টিমার ধরবার জন্য নৌকা করে সুরেশ্বর স্টেশনে গিয়েছিলেন। খুব ভোরে অন্ধকার থাকতে তিনি প্রাতঃকৃত্যের জন্য নদীর পাড়ে কাশঝোঁপের আড়ালে গিয়ে বসেছিলেন। ঐ সময়ে জঙ্গুরুল্লা ঝকিজাল নিয়ে ওখানে মাছ ধরছিল। জালটা গোছগাছ করে সে কনুইর ওপর চড়িয়েছে এমন সময় শুনতে পায় চিৎকার। জালটা ঐ অবস্থায় নিয়েই সে পেছনে ফিরে দেখে একটা পাতিশিয়াল এ্যাকখ্যাক করে একটা লোককে কামড়াবার চেষ্টা করছে। লোকটা চিৎকার করছে, পিছু হটছে আর লোটা দিয়ে ওটাকে ঠেকাবার চেষ্টা করছে। জঙ্গুরুল্লা দৌড়ে গিয়ে জাল দিয়ে খেপ মারে পাতিশিয়ালের ওপর। পাতিশিয়াল জালে জড়িয়ে যায়। লোকটার হাত থেকে লোটা নিয়ে সে ওটার মাথার ওপর মারে দমাদম। ব্যস, ওতেই ওর জীবনলীলা সাঙ্গ হয়ে যায়।
ডাক-চিৎকার শুনে বহু লোক জমা হয়েছিল সেখানে। তাদের কাছে জানা যায়–আগের দিন ঐ এলাকার পাঁচ জনকে পাগলা শিয়ালে কামড়িয়েছে। সবাই বুঝতে পারে–ওটাই সেই পাগলা শিয়াল।
জঙ্গুরুল্লার বুদ্ধি ও সাহসের প্রশংসা করে সকলেই। নায়েব তাকে দশ টাকা বখশিশ দিয়ে বলেন, যদি কখনো দরকার পড়ে, আমার ঘড়িশার কাছারিতে যেও।
দুঃসময়ে নায়েবের কথা মনে পড়তেই সে চলে গিয়েছিল ঘড়িশার কাছারিতে। নায়েব তাকে পেয়াদার চাকরিতে বহাল করে নেন। মাসিক বেতন তিন টাকা। বেতন যাই হোক, এ চাকরির উপরিটাই আসল। আবার উপরির ওপরে আছে ক্ষমতা যাকে জঙ্গুরুল্লা বলে ‘পাওর’। এ কাজে ঢুকেই জঙ্গুরুল্লা প্রথম প্রভুত্বের স্বাদ পায়। সাড়ে তিন হাত বাঁশের লাঠি হাতে সে যখন মহালে যেত তখন তার দাপটে থরথরিয়ে কাপত প্রজারা। নায়েবের হুকুমে সে বকেয়া খাজনার জন্য প্রজাদের ডেকে নিয়ে যেত কাছারিতে। দরকার হলে ধরেও নিত। কখনো তাদের হাত-পা বেঁধে চিৎ করে রোদে শুইয়ে রাখত, কখনো কানমলা বাঁশডলা দিয়ে ছেড়ে দিত।
একবার এক প্রজাকে ধরতে গিয়েছিল জঙ্গুরুল্লা। লোকটা অনেক কাকুতি-মিনতি করে শেষ সম্বল আট আনা এনে দেয় তার হাতে। কিন্তু কিছুতেই জঙ্গুরুল্লার মন গলে না। শেষে লোকটা তার পা জড়িয়ে ধরে।
চমকে ওঠে জঙ্গুরুল্লা। অনেকক্ষণ থম ধরে দাঁড়িয়ে থাকে সে। শেষে বলে, যা তোরে ছাইড়া দিলাম। পাট বেইচ্যা খাজনার টাকা দিয়া আহিস কাছারিতে।
তারপরেও এ রকম ঘটনা ঘটেছে কয়েকবার। প্রত্যেকবারই মাপ করে দেয়ার সময় তার অন্তরে আকুল কামনা জেগেছে, সোহরাব মোড়লরে একবার পায়ে ধরাইতে পারতাম এই রহম!
শুধু কামনা করেই ক্ষান্ত হয়নি জঙ্গুরুল্লা। সোহরাব মোড়লকে বাগে পাওয়ার চেষ্টাও অনেক করেছে সে। তার চেষ্টা হয়তো একদিন সফল হতো, পূর্ণ হতো অন্তরের অভিলাষ। কিন্তু পাঁচটা বছর–যার বছর দুয়েক গেছে ওত-ঘাত শিখতে–পার হতে না হতেই তার পেয়াদাগিরি চলে যায়। প্রজাদের ওপর তার জুলুমবাজির খবর জমিদারের কানে পৌঁছে। তিনি জঙ্গরুল্লাকে বরখাস্ত করার জন্য পরোয়ানা পাঠান নায়েবের কাছে। জমিদারের পরোয়ানা। না মেনে উপায় কি? নায়েব জঙ্গুরুল্লাকে বরখাস্ত করেন বটে, তবে কৃতজ্ঞতার প্রতিদান হিসেবে নতুনচর বালিগাঁয়ে তাকে কিছু জমি দেন।