খিচুড়ি রান্না শেষ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ।
মাতব্বর বলে, এই হানে খাওনের হেঙ্গামা করলে দেরি অইয়া যাইব। এক কাম করো, খিচুড়ির ডেগটা নায় উড়াইয়া লও। নাও চলতে চলতে যার যার নায়ের মইদ্যে বইয়া খাইয়া লইও।
রমিজ মিরধা বলে, হ এইডাই ভালো। খাইতে খাইতে যদি দিন কাবার অইয়া যায় তয় কোনো কাম অইব না।
লোকজন খিচুড়ির ডেগটা ধরাধরি করে মাতব্বরের ছই-বিহীন ঘাসি নৌকায় তোলে। কলাপাতাগুলো লোক অনুসারে প্রত্যেক নৌকায় ভাগ করে দেয় ফজল। বাঁশ-খোঁটা, লাঠি শড়কি, ঢাল-কাতরা আগেই নৌকায় উঠে গেছে। এবার লোকজনও যার যার নৌকায় উঠে যায়।
নূরু এসে ফজলকে ডাকে, ও দুদু, দাদি তোমারে বোলায়।
ফজল উঠানে গিয়ে দেখে, তার বাবা আর মা ঝগড়া লাগিয়ে দিয়েছে।
মাতব্বর বলে, জুয়ান পোলা দশজনের লগে যাইব না, এইডা কেমুন কথা! মাইনষে হুনলে কইব কি? বাঘের ঘরে মেকুর পয়দা অইছে।
কইলে কউক। আমার পোলা আমি যাইতে দিমু না।
যাইতে দিবা না, তয় কি মুরগির মতন খাঁচায় বাইন্দা রাখতে চাও?
মাইনষের কি আকাল পড়ছে নি? দুইডা না, তিনডা না, একটা পোলা আমার। ও না গেলে কি অইব?
কি অইব, তুমি যোবা না। আমার দিন তো ফুরাইয়া আইল, আমি চউখ বুজলে ও-ই অইব মাতব্বর। আপদে-বিপদে মাইনষের আগে আগে চলতে না হিগলে মাতবরি-সরদারি করব কেমন কইর্যা?
থাউক, আমার পোলার মাতবরি-হরদারি করণ লাগব না।
ফজল এগিয়ে গিয়ে মা-কে বাধা দেয়, তুমি চুপ অওতো মা। কি শুরু করছ?
তারপর সে তার পিতার দিকে চেয়ে বলে, বাজান, বেবাক জিনিস নায়ে উইট্যা গেছে। আপনে ওঠলেই এখন রওনা দিতে পারি।
বরুবিবি এবার ফজলকে বলে, অ ফজু, বাজানরে তুই যাইস না।
ক্যান যাইমু না?
ক্যান্ যাইমু না, হায় হায়রে আবার উল্ডা জিগায় ক্যান্ যাইমু না। তয় যা-যা তোরা বাপে পুতে দুইজনে মিল্যা আমার কল্ডাডা কাইট্যা থুইয়া হেষে যা।
মাতব্বর কাছে এসে ধীরভাবে বলে, ও ফজুর মা, হোন। আমরা তো কাইজ্যা করতে যাইতে আছি না। এইবার আর কাইজ্যা অইব না। চেরাগ আলী ঐ বচ্ছর যেই চুবানি খাইছে, এই বচ্ছর আর চরের ধারে কাছে আইতে সাহস করব না।
তয় ফজুরে নেওনের কাম কি?
ও না গেলে মানুষ-জনেরে খাওয়াইব কে? আর হোন, কাইজ্যা লাগলে ওরে কাইজ্যার কাছে যাইতে দিমু না। তুমি আর ভাবনা কইর্য না। চলরে ফজু, আর দেরি করণ যায় না।
বাপের পেছনে পেছনে ছেলে রওনা হয়। নূরু বরুবিবির কাছেই দাঁড়ানো ছিল। তাম্শা দেখবার জন্য সে-ও নৌকাঘাটার দিকে রওনা হয়। বরুবিবি খপ করে তার হাত ধরে ফেলে। তারপর তাকে কোলের মধ্যে নিয়ে সে বিলাপ করতে শুরু করে দেয়, ও আমার রশুরে, বাজান তোরে না যে ভোলতে না যে-পা-আ-আ-রি, সোনার চান ঘরে থুইয়া কেমনে চইল্যা গে-এ-এ-লি, বাজানরে-এ-এ-এ, আ-মা–র।
এরফান মাতব্বর নৌকায় উঠেই তাড়া দেয়, আর দেরি কইর্য না। এইবার আল্লার নাম লইয়া রওনা দ্যাও।
লোকজন যার যার নৌকা খুলে রওনা হয়। মেহের মুনশি হাঁক দেয়, আল্লা-রসুল বলো ভাইরে ম-মী-ঈ-ঈ-ন…
আল্লা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুনশির কথার শেষ ধরে বাকি সবাই জাক্কইর দেয়।
মাতব্বরের ঘাসি নৌকার আগে-পিছে তেইশখানা নৌকা চলছে। কোনোটায় চারজন, কোনোটায় বা পাঁচজন করে তোক। কিছুদূর গিয়েই ফজল খিচুড়ি পরিবেশন করতে লেগে যায়। সে ইরি হাতে ডেগের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। চলতে চলতে এক একটা ডিঙি এসে নৌকার সাথে ভিড়ে। ফজল লম্বা হাতলওয়ালা কাঠের ইযারি দিয়ে ডেগ থেকে খিচুড়ি তুলে কলাপাতার ওপর ঢেলে দেয়।
এরফান মাতব্বর লোকজনদের উদ্দেশে চেঁচিয়ে বলে, যার যার প্যাট ভইরা খাইও মিয়ারা। রাইতে কিন্তু খাওয়ার যোগাড় করণ যাইব না।
এরফান মাতব্বর সকলের ওপর দিয়ে গাছ-মাতব্বর। তার সাথে ঘাসি নৌকায় বসে আলাপ-আলোচনা করছে পুলকি-মাতব্বর রমিজ মিরধা, জাবেদ লশকর, মেহের মুনশি আর কদম শিকারি। পুলকি অর্থাৎ সদ্য উদ্গত গাছের শাখার মতোই তারা কচি মাতব্বর। তাদের চারপাশে বসেছে সাত-আটজন কোলশরিক।
তারা পরামর্শ করে ঠিক করে, চরের উত্তর দিকটা পাহারা দেয়ার জন্য জাবেদ লশকর ও তার লোকজন ভাওর ঘর তুলবে। এভাবে দক্ষিণদিকে কদম শিকারি, পশ্চিমদিকে রমিজ মিরধা আর পুবদিকে মেহের মুনশি তাদের লোকজন নিয়ে পাহারা দেবে। যদি কেউ চর দখল করতে আসে তবে পুবদিক দিয়ে আসার সম্ভাবনাই বেশি। তাই এরফান মাতব্বর ও তার আত্মীয়-স্বজন পুবদিকটায় ভাওর ঘর তুলবার মনস্থ করে।
সবগুলো ডিঙির লোকজন খাওয়া শেষ করেছে। এবার মাতব্বর ঘাসি নৌকার সবার সাথে খেতে বসে। খেতে খেতে সবাই তারিফ করে খিচুড়ির। রমিজ মিরধা বলে, চাচির আতের খিচুড়ি যে খাইছে, হে আর ভেলতে পারব না কোনোদিন।
রান্নার প্রশংসা শুনে মাতব্বর খুশি হয়। কিন্তু সবার অজান্তে সে একটা দীর্ঘশ্বাসও ছাড়ে। আর মনে মনে ভাবে, এ তারিফ যার প্রাপ্য সে আর মাতব্বর বাড়ি নেই এখন।
আসুলির ভাল মাইনষের ঘরের মেয়ে ক’টা বছরের জন্য এসে মাতব্বর বাড়ির রান্নার ধরনটাই বদলে দিয়ে গেছে। হাজেরা এই বাড়িতে বউ হয়ে আসার পর বরুবিবি তার হাতেই রসুইঘরের ভার ছেড়ে দিয়েছিল। হাজেরা বাপের বাড়ি নাইয়র গেলে মুশকিল বেঁধে যেত। স্ত্রীর হাতের রান্না খেয়ে মাতব্বর মুখ বিকৃত করে বলত, নাগো, ভাল্ মাইনষের মাইয়ার রান্দা খাইতে খাইতে জিব্বাডাও ভাল মানুষ অইয়া গেছে। তোমাগ আতের ফ্যাজাগোজা আর ভাল লাগে না।