বোবা লোকটি এগিয়ে যায়। অন্য একজন লাঠির বাড়ি দিয়ে রূপজানের হাত থেকে দাটা ফেলে দেয়। সে এবার পেছনের দরজা খুলে নদীর দিকে দৌড় দেয়।
টর্চের আলো অনুসরণ করছে রূপজানকে। সাতজনই এবার তার পেছনে ধাওয়া করে।
শাড়ির আঁচলে পা আটকে রূপজান মাটিতে পড়ে যায়। তার ওপর টর্চের আলো ফেলে। সবুজ গামছাধারী বলে, ও বোবা মিয়াভাই, ধরেন জলদি। আমাগ তো আবার ধরন মানা।
বোবা লোকটি রূপজানকে ধরে ফেলে।
অ্যাই গোলামের ঘরের গোলাম, খবরদার আমার গায়ে আত দিস না।
আরে বাবা মিয়াভাই, পাতালি কোলে কইর্যা উড়াইয়া ফালান।
বোবা লোকটা রূপজানকে পাজাকোলা করে নদীর দিকে এগিয়ে যায়।
রূপজান হাত-পা ছুঁড়ছে, গালাগাল দিচ্ছে, আর দুহাত দিয়ে খামচে দিচ্ছে বোবা লোকটার শরীর। সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে সে এগিয়েই যাচ্ছে। যেতে যেতে সে আঁ-আঁ আঁ শব্দ করে মাথা নেড়ে কিছু একটা ইশারা দেয়।
ইশারার ভাষা বুঝতে পেরে লাল গামছাধারী বলে, আপনেরা নায় উইট্যা বহেন। আমি আরশেদ মোল্লারে দাওয়াত দিয়া আহি।
রূপজানকে কোলে নিয়ে যোবা লোকটা নৌকায় ওঠে। কিন্তু রূপজানের আর সড়া পাওয়া যাচ্ছে না এখন। সে মূৰ্ছিত হয়ে পড়েছে।
লোকটা তাকে শুইয়ে দেয় পাটাতনের ওপর। স্খলিত আঁচল টেনে শরীর ঢেকে দেয়।
কিছুক্ষণ পর লাল গামছাধারী ফিরে এলে দুটো ডিঙি তাদের নিয়ে রওনা হয়।
অন্ধকারের মধ্যে কে একজন বলে ওঠে, অ্যাই তোরা এইবার মোখের কাপড় খুইল্যা ফ্যাল। আন্ধারে আর কেও দ্যাখব না। তারা তো ঢাল নিতে চাস নাই। ঢাল না নিলে আইজ উপায় আছিল না।
হ, শিশি-বোতল যেমনে উদ্দ মারতে আছিল, মাথা একজনেরও আস্ত থাকত না। আর একজন বলে।
হ মাথা ফাঁইট্টা চৌচির অইয়া যাইত। অন্য একজন বলে ।
অন্ধকার কেটে ডিঙি দুটো এগিয়ে যায়। বোবা লোকটা সস্নেহে হাত বুলায় রূপজানের গালে, কপালে, মাথায়।
অল্প সময়ের মধ্যেই ডিঙি দুটো গন্তব্যস্থানে পৌঁছে যায়। বোবা লোকটা রূপজানকে কোলে নিয়ে নৌকা থেকে নেমে এগিয়ে যায় একটি বাড়ির দিকে। ঘরের কাছে গিয়ে বোবাটা হঠাৎ কথা বলে ওঠে, ও মা, কই তুমি? শিগগির দরজা খোেল। তোমার গয়নার মানুষটারে লইয়া আইছি।
বরুবিবি দরজা খুলে দেয়। ফজল রূপজানকে শুইয়ে দেয় চৌকির বিছানায়।
আরে, এক্কেরে মাইরা লইয়া আইছস দেহি। ভীত কণ্ঠ বরুবিবির।
ও কিছু না। বেশ অইয়া গেছে। মোখে পানির ছিডা দ্যাও।
ও আমিনা, জলদি পানি আন, দাঁত লাইগ্যা গেছে। ও আমার সোনার চানরে, তোর কি অইলরে!
কোনো চিন্তা কইর্যা না। আমরা অ্যাকটা ফুলের টোকাও দেই নাই। ও-ই আমাগ মারছে।
ক্যান, আইতে চায় নাই?
জঙ্গুরুল্লার বাড়ি যাইতে চায় নাই। আমরাতো পা-না-ধোয়ার বাড়ি লইয়া যাইতে চাইছিলাম।
নূরুর দিকে ফিরে সে বলে, কয়েকটা লটার ডাণ্ডি লইয়া আয় গরুর বাথান তন।
নূরু বেরিয়ে গেলে গলা খাদে নামিয়ে সে আমিনাকে বলে, তুই লটা হেঁইচ্যা রস বাইর কর। ঘায়ে লাগইতে অইব। তোর ভাবিসাব আমারে খামচাইয়া কিছু রাখে নাই।
বেশ কিছুক্ষণ পর রূপজানের জ্ঞান ফিরে আসে। চোখ খুলেই তার মাথার কাছে উবু হয়ে বসা বরুবিবিকে দেখে সে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর মাথা উঠিয়ে দু’হাত বাড়িয়ে সে জড়িয়ে ধরে শাশুড়িকে।
.
রাত অনেক হয়েছে। ফজলের শিথিল বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে রূপজান বিছানা ছেড়ে ওঠে। বেশ-বাস ঠিক করে। হারিকেনের আলো বাড়িয়ে দেয়।
আমি বাইরে গেলাম। রূপজান বলে। দরজা কিন্তুক খোলা রইল।
যাও, আমি চাইয়া রইছি। ফজল বলে। গাঙ্গের ঘাটে কিন্তু যাইও না, জিনে ধইর্যা লইয়া যাইব।
কিছুক্ষণ পর রূপজান ফিরে এসে দেখে, ফজল চিত হয়ে শুয়ে আছে।
ঐ তাকের উপরে দ্যাখো বাটির মইদ্যে লটার রস আছে। ফজল বলে। ঐ রস ঘায়ে লাগাইয়া দ্যাও দেখি।
রূপজান বকের পালক ভিজিয়ে ফজলের হাত ও গলার নখের আঁচড়গুলোয় রস লাগাতে লাগাতে বলে, ইস! খামচি লাইগ্যা কি অইছে! তোমারে যদি চিনতে পারতাম, তয় কি এমুন কইর্যা খামচাইতাম!
খামচিতো আমারে দ্যাও নাই। খামচি দিছ জঙ্গুরুল্লার মানুষরে। তোমার খামচি খাইতে তখন এমুন মজা লাগতে আছিল, কি কইমু তোমারে। তোমার গালাগালিগুলাও বড়ই মিঠা লাগতে আছিল।
খামচি বোলে আবার মজা লাগে! গালাগালি বোলে আবার মিঠা লাগে!
হ, আমিতো তখন জঙ্গুরুল্লার মানুষ। তখন মনে অইতে আছিল, আরো জোরে খামচি দ্যায় না ক্যান, কামড় দ্যায় না ক্যান? আরে গালাগালি দ্যায় না ক্যান?
একটু থেমে ফজল আবার বলে, জোরজবরদস্তি কইর্যা তালাক নেওনের সময় তোমার বাপ, জঙ্গুরুল্লা, পুলিসের হাওয়ালদার আর ঐ সাক্ষী হারামজাদারা কইছিল–তুমি আমার ঘর করতে রাজি না। সেই কথা যাচাই করণের লেইগ্যা জঙ্গুরুল্লার মানুষ সাইজ্যা গেছিলাম। তুমি যদি বুইড়্যা পীরের লগে বিয়া বইতে রাজি অইয়া আমাগ নায় উঠতা, তয় কি করতাম জানো?
কি করতা?
মাঝ গাঙ্গে নিয়া ঝুপপুত কইর্যা ফালাইয়া দিতাম পানিতে।
রূপজান ফজলের বুকের ওপর ঢলে পড়ে। ফজল তার দুই সবল বাহু দিয়ে তাকে অপার স্নেহে, পরম প্রীতিতে জড়িয়ে ধরে বলে, আমরা জোড়াবান্দা কইতর-কইতরি। এই দুনিয়া জাহানের কেও আমাগো জোড়া ভাঙতে পারব না, কোনো দিন পারব না।