তয় আর দেরি করণের কাম নাই। ঐ দিগে খবর হুনছে? মোখে কাঁপোড় বাইন্দা তিনডা ব্যাডা হেকমইত্যা চোরার বউরে বাড়িরতন জোর কইরা ধইর্যা লইয়া গেছে। বউডার আর কোনো খোঁজ-খবর নাই। মাইনষে কয় জঙ্গুরুল্লার লোক বউডারে কাইট্যা গাঙ্গে ফালাইয়া দিছে।
ক্যাঁ?
ও, উনিতে হুইন্যা যায় নাই! হেকমইত্যা চোরা আতাইয়া বাইল্যা মাছ ধরতে গেছিল। গদে আত দিয়া আত আর টাইন্যা বাইর করতে পারে নাই। মইর্যা রইছিল পানি তলে। জঙ্গুরুল্লা ঐ লাশ দ্যাহাইয়া খুনের মামলা দিতে চাইছিল ফজলের বিরুদ্ধে। কিন্তু বউডা সত্য কতা কইছে। জঙ্গুরুল্লার কতা মতন দারোগা-পুলিসের কাছে সাক্ষী দেয় নাই বুইল্যা মামলা টিকাইতে পারে নাই। এই রাগে।
এই কয়দিনের মইদ্যে এত কিছু অইয়া গেছে! হোন রূপুর মা, আর দেরি করণ যাইব । রূপুরে মাতবর বাড়ি দিয়া কাইলই আমরা নারায়ণগঞ্জ চাইল্যা যাইমু।
হ, কাইলই যাওন লাগব। উনি এহন আফারে উইট্যা পলাইয়া থাকুক গিয়া।
.
সন্ধ্যার একটু পরেই সাতজন গাট্টাগোট্টা লোক নিঃশব্দে গিয়ে হাজির হয় আরশেদ মোল্লার বাড়ি। তাদের মাথার ফেটা ভুরু পর্যন্ত নামানো। চোখ বাদ দিয়ে সারা মুখ গামছা দিয়া বাঁধা। একজনের মুখমণ্ডল গামছার বদলে সাদা রূমাল দিয়ে বাঁধা। তাদের তিনজনের হাতে ঢাল-শড়কি, দুজনের হাতে ঢাল-রামদা আর দুজনের হাতে লাঠি ও টর্চলাইট। তারা পা টিপে টিপে উত্তর ভিটি ঘরের সামনের দরজার কাছে গিয়ে হাতিয়ারগুলো ঘরের পিড়ার নিচে নামিয়ে রাখে আলগোছে।
ঘরের দরজা বন্ধ। লাল গামছায় মুখ-বাঁধা দলের একজন ডাক দেয়, মোল্লার পো ঘরে আছেন নি?
ক্যাডা? ভেতর থেকে সাড়া দেয় সোনাইবিবি।
জঙ্গুরুল্লা চদরী সাব আমাগ পাইছে।
উনিতো এহনো বাড়িত আহে নাই।
কই গেছে?
কই গেছে, কিছু কইয়া যায় নাই।
হোনেন, আমাগ পাইছে আপনেগ নেওনের লেইগ্যা। পীরবাবা আইয়া পড়ছে। আইজ বোলে ভালো দিন আছে। আইজই কলমা পড়ান লাগব।
উনিতো বাড়ি নাই।
উনি বাড়ি নাই, আপনে তো আছেন। আমাগ কইয়া দিছে, মোল্লার পো না থাকলে আপনেরে লইয়া যাইতে। মাইয়া লইয়া, পোলাপান লইয়া চলেন শিগগির।
না, আমরা যাইতে পারমু না।
হোনেন চাচি, আমরা হুকুমের গোলাম। আমাগ কইছে ভালোয় ভালোয় না গেলে ধইর্যা উকাইয়া লইয়া যাইতে।
গোলামের ঘরের গোলামরা কয় কি। তোগ ঘরে কি মা-বইন নাই?
দ্যাহেন, গালাগালি দিয়েন না। ভালো অইব না।
এক শত্ বার দিমু। তোগ মা-বইনের নিয়া নিকা দে পীরের লগে। আরেক জনের বিয়াতো বউরে ক্যামনে আবার বিয়া দিতে চায় পা-না-ধোয়া শয়তান।
আরেকজন তো তালাক দিয়া দিছে।
না, জোর কইর্যা তালাক লইছে। ঐডা তালাক অয় নাই।
আমরা কিছু হুনতে চাই না। মাইয়া বাইর কইর্যা দ্যান। আপনেও চলেন পোলাপান লইয়া। পীরবাবা বিয়ার পাগড়ি মাতায় দিয়া বইয়া রইছে।
না, আমরা যাইমু না।
শিগগির দরজা খোলেন। নাইলে লাইথ্যাইয়া দরজা ভাইঙ্গা ফালাইমু।
লাল গামছাধারীর নির্দেশে নিজ নিজ হাতিয়ার হাতে নেয় সবাই।
পশ্চিম ভিটি ঘরের বাতি নিবে যায় হঠাৎ
সবুজ গামছাধারী একজন দরজায় লাথি মেরে দরজা খুলে ফেলে। কয়েকটি ছোট ছেলে-মেয়ে কেঁদে ওঠে ভয়ে।
একজন টর্চ হাতে আর একজন রামদা হাতে ঘরে ঢোকে। টর্চ মেরে তারা রূপজানের খোঁজ করে।
সোনাইবিবি বলে, মাইয়া নাই। জামাই আইয়া লইয়া গেছে।
মিছা কথা কওনের আর জায়গা পাওনা বেডি!
মিছা কতা কিরে। রামদা দেখেও সে ঘাবড়ায় না এতটুকু। তার ঘোমটার ভেতর থেকে গালাগালের ভিমরুল ছুটে আসে। কিন্তু লোকগুলো তা গ্রাহ্যের মধ্যেই নেয় না। তারা টর্চ মেরে চৌকির তলা, ধানের ডোল ইত্যাদি খুঁজতে থাকে।
হৈ-চৈ শুনে ডাকাত পড়েছে মনে করে আশপাশের লোক এগিয়ে আসছে এদিকে। যারা বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল তারা চারদিকে টর্চের আলো ফেলে। একজন চিৎকার দিয়ে বলে, খবরদার! এই দিগে আইলে গুলি মাইরা দিমু। যার যার বাড়ি যাও। দরজা বন্দ কইর্যা হুইয়া পড় গিয়া।
আফারে উঠবার ফাঁকা জায়গা দিয়ে টর্চের আলো ফেলতেই আরশেদ মোল্লা বুঝতে পারে, আর লুকিয়ে থাকা সম্ভব নয়। সে আফার থেকে বলে, খবরদার মাইয়া লোকের গায় আত দিও না। আমি আইতে আছি।
সে নিচে নেমে বলে, মাইয়া বাড়িত নাই। জামাই আইয়া লইয়া গেছে। আইছেন যহন বিচরাইয়া দ্যাহেন।
সবুজ গামছাধারী টর্চ মেরে তন্নতন্ন করে খোঁজে। আফারে উঠে তালাশ করে, কিন্তু রূপজানকে পাওয়া যায় না।
বাইরে থেকে লাল গামছাধারী বলে, আরে তোরা আইয়া পড়। কুনখানে আছে বোঝতে পারছি।
তারা পশ্চিমভিটি ঘর ঘিরে ফেলে। ঘরের দুটো দরজাই ভেতর থেকে বন্ধ। ঘরে কে আছে, দরজা খোলো।
কেউ দরজা খুলছে না দেখে লাল গামছাধারী দমাদম লাথি মারে দরজার ওপর। অর্গল ভেঙ্গে দরজা খুলে যায় আর অমনি ভেতর থেকে শিশি, বোতল, খোঁড়া, বাটি ছুটে আসে লোকগুলোর দিকে। তারা ঢাল দিয়ে সেগুলো ফিরিয়ে আত্মরক্ষা করে। টর্চের আলোয় দেখা যায় রূপজান মরিয়া হয়ে হাতের কাছে যা পাচ্ছে তাই ছুঁড়ে মারছে।
আরে বোবা মিয়াভাই, ধরেন শিগগির। লাল গামছাধারী বলে। আমাগো মাথা ভাইঙ্গা ফালাইব।
মুখে সাদা রুমাল-বাঁধা লোকটা ঢাল দিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে এগিয়ে যায়।
রূপজান চিৎকার দিয়ে ওঠে, খবরদার আউগ্গাই না। দাও দ্যাখছস, জবাই কইরা ফালাইমু।