স্বামীর ফিরে আসতে দেরি দেখে সোনাইবিবিরি মনে হয়, সায়েব ও মেম দু’জনই বা তাদের একজন অন্তত বেঁচে আছেন এবং নারায়ণগঞ্জেই আছেন। তাঁদের কেউ না থাকলে আরশেদ মোল্লার এত দেরি হওয়ার কথা নয়। সে তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরে আসত।
এদিকে জঙ্গুরুল্লা রোজ দু’বার সকালে ও বিকেলে তোক পাঠিয়ে খবর নিচ্ছে, আরশেদ মোল্লা ফিরে এসেছে কিনা। প্রথম দিন কোরবান ঢালী এসেছিল চার-পাঁচজন লোক নিয়ে। তাদের সে কি হম্বি-তম্বি। তারা আরশেদ মোল্লাকে না পেয়ে জঙ্গুরুল্লার হুকুমে তার মেয়েকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু সোনাইবিবি ঘোমটার আড়াল থেকে কথার আঘাত মেরে তাদের এমন ধুনে দিয়েছিল যে তারা মা-বোনদের মর্যাদাহানিকর কোনো কথা বলতে আর সাহস পায়নি তারপর।
জঙ্গুরুল্লার লোক রোজই জানতে চায়, আরশেদ মোল্লা কোথায় গেছে। একমাত্র সোনাইবিবিই জানে সে কোথায় গেছে। কিন্তু সে একই কথা বলে তাদের বিদেয় করে, কই গেছে বাড়িতে কিছু কইয়া যায় নাই।
দুদিন আগে এদের কাছেই সোনাইবিবি শুনেছে–জঙ্গুরুল্লা ভাগ্যকূল গেছে। সেখান থেকে পীরবাবাকে নিয়ে সে দু-এক দিনের মধ্যেই ফিরে আসবে। পীরবাবা এসে গেলেই রূপজানের সাথে তার বিয়ের শুভকাজটা সম্পন্ন করার জন্য জঙ্গুরুল্লা ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠবে।
কিন্তু পীরবাবার জাদু-টোনায় কোনো কাজই যে হয়নি, কোনো আছরই যে পড়েনি রূপজানের ওপর! পীরের কথা সে শুনতেই পারে না। ফজল জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়ি এসেছে এবং খুনের চর আবার দখল করেছে শুনে সে যে কী খুশি হয়েছে, তা তার চলনে বলনে স্পষ্ট বোঝা যায়। সে আজকাল বিনা সাধাসাধিতেই খায়-দায়-ঘুমায়, মাথা আঁচড়ায়, সাজগোজ করে।
.
বারো দিন পর বাড়ি ফিরে আসে আরশেদ মোল্লা। আসে সারা মুখে খুশির জোছনা মেখে। সায়েব-মেম দুজনেই বেঁচে আছেন এবং ভালো আছেন, কিন্তু বেশ বুড়িয়ে গেছেন। সে নারায়ণগঞ্জে গিয়ে শোনে, সায়েব-মেম দুজনেই কলকাতা গেছেন। তাদের আসার অপেক্ষায় ছিল বলেই তার বাড়ি ফিরতে এত দেরি হয়েছে। কুঠিতে আগেকার বাবুর্চি-খানসামারাই কাজ করছে এখনো। তাদের সাথেই সে ছিল এ কদিন। নিতাইগঞ্জের দুটো গুদাম ছাড়া ল্যাম্ব্যার্ট জুট কোম্পানীর সবগুলো গুদাম এখন মিলিটারির দখলে। তারা সেগুলোর মধ্যে যুদ্ধের রসদ মজুদ করেছে। সোডা-ওয়াটার কারখানাটা দেড় বছর ধরে বন্ধ। ম্যানেজার নাকি অনেক টাকা মেরে নিয়ে উধাও হয়েছে।
আমারে দেইখ্যা, সায়েব-মেম পরথর চিনতেই পারে নাই। আরশেদ মোল্লা বলে।
চিনব ক্যামনে? সোনাইবিবি বলে। তহনতো ওনার দাড়ি আছিল না। দাড়ির লেইগ্যা চিনতে পারে নাই।
হ ঠিকই। নাম বললাম পর তারা এত খুশি অইছে যে কি কইমু! জানো, আমাগ বিচরাইতে সায়েব মানুষ পাডাইছিল বেহেরপাড়া। তারা ফিরত গিয়া সায়েবরে কইছে, বেহেরপাড়া নামে একটা গেরাম আছিল। হেই গেরাম এহন পদ্মার প্যাডের মইদ্যে। গেরামের মানুষ কে যে কুনখানে গেছে কেউ কইতে পারে না।
হ, ঠিক অইত, বেহেরপাড়ারতন গেলাম চাঁচরতলা, হেইখানতন চাকমখোলা। তারপর আইলাম এই নলতা। এতবার গাঙ্গে ভাঙলে মাইনষে বিচরাইয়া পাইব ক্যামনে?
তারা রূপুর কথা বারবার জিগাইছে। রূপু কত বড় অইছে। যহন বললাম, ওর বিয়া দিয়া দিছি, তহন দুইজনের কী রাগ! মেমসাহ কয়–আমারে এই খবরও দিলি না, নিমকহারাম। কার লগে বিয়া দিছস? যহন কইলাম, বড় একজন মাতবরের পোলার লগে বিয়া দিছি। জামাই নিজেই এহন মাতবর, তহন রাগটা এট্টু কমছে। মেমসাব আরো কইছে– বিয়ার খবর পাইলে ওর বিয়ার খরচ-পাত্তি সোনা-গয়না আমিই দিতাম। রূপুরে আর জামাইরে বেড়াইতে যাইতে কইছে। ওগ যাওনের ভাড়া দুইশ ট্যাহা দিয়া দিছে। ওরা গেলে মনে অয় অনেক ট্যাহা-পয়সা দিব, সোনা-গয়না দিব।
ইস। মাইনষের কী লোভ। কিন্তুক মিথ্যা কতা কইয়া আইছে ক্যান? মাইয়ার তালাক লইছে, হেই কতা ক্যান্ কয় নাই?
হোন রূপুর মা, তোমারে তো কই নাই। রূপুরে মাতবর বাড়ি দিয়া আইমু–এই ওয়াদা কইর্যা আইছিলাম খুনের চর ছাইড়া দিয়া আহনের সময়। তুমি কাইল ওরে লইয়া যাইও মাতবর বাড়ি। বিয়াই বাইচ্যা থাকলে আমিই যাইতাম।
কিন্তুক তালাক লওয়া মাইয়া ক্যামনে আবার দিয়া আইমু?
হোন, জোর কইর্যা তালাক নিছিলাম। ঐ তালাক জায়েজ অয় নাই। আমি মুনশি মৌলবিগ জিগাইছিলাম।
কিন্তু পা-না-ধোয়া গোঁয়ারডা কি এমনে এমনে ছাইড়া দিব! হে পীরবাবারে আনতে গেছে। লইয়াও আইছে মনে অয়। দিনের মইদ্যে দুইবার ওনার খবর লইতে আছে তার মানুষজন। আরেটু পরেই আবার আইয়া পড়ব।
হোন, আমি ঘরের মইদ্যে পলাইয়া থাকমু। ওরা আইলে কইও উনি এহনো আহে নাই। তারপর কাইল রাইত থাকতে তুমি রূপুরে সাথে লইয়া দিয়া আইও মাতবর বাড়ি। তুমি ফির্যা আইলে ঘরে তালা দিয়া আমরা কাইলই চইল্যা যাইমু নারায়ণগঞ্জ। জঙ্গুরুল্লা আর আমাগ কিছু করতে পারব না।
নারায়ণগঞ্জ যাইব, কিন্তুক কাম-কাইজের কতাত কিছু হুনলাম না।
কাম ঠিক অইয়া গেছে। ঐ সোডা-ওয়াটার কারখানা আমারে চালু করতে কইছে সায়েব। উনিই টাকা-পয়সা দিব। এহন ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ বিদেশী সৈন্যে ভইরা গেছে। তাগো সরাব খাইতে সোডার পানি লাগে, সায়েব কইছে সোডারপানি এহন খুব চলব। সায়েব কইছে লাভের অর্ধেক আমার। আমাগ থাকনের লেইগ্যা ঘরও ঠিক কইরা দিছে। যাওনের খরচ দিছে তিনশ ট্যাহা। আরো দুইশ দিছে রূপু আর জামাইর যাওনের খরচ।