একটু থেমে তিনি আবার বলেন, চৌধুরীর মাঝি-মাল্লা আর ঐ বুড়িকে ভালো করে জিজ্ঞাসাবাদ করো। ওদের ধমক দিয়েই জঙ্গুরুল্লার সব কারসাজি বেরিয়ে পড়বে।
পুলিস সুপার লঞ্চে ওঠেন।
লঞ্চটা ‘ঘঁউ-ঘঁউ-ঘঁউৎ’ সিটি বাজিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে।
.
৩২.
খুনের চর থেকে অপমানের বোঝা মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরেই বিছানা নিয়েছিল আরশেদ মোল্লা। অপমানের গ্লানির চেয়ে ভবিষ্যতের ভাবনা তাকে আরো বেশি মুসড়ে দিয়েছিল।
বেচকচরে বিঘা সাতেক জমি ছিল তার। গত বর্ষার আগের বর্ষায় বিঘা তিনেক পদ্মার জঠরে বিলীন হয়ে গেছে। বাকি চার বিঘা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে গত বর্ষায়। খুনের চরে জঙ্গুরুল্লা তাকে কুড়ি নল–প্রায় এগারো বিঘা জমি দিয়েছিল। অনেক আশা নিয়ে সে রুয়েছিল কনকতারা ধান। সেই চরও বেদখল হয়ে গেছে। বসতভিটা ছাড়া আর এক কড়া জমিও তার নেই। এদিকে চালের দাম দিন দিন বেড়েই চলেছে। বউ-ছেলে-মেয়ে নিয়ে সে যে কোথায় যাবে, কি করবে, কি খাবে তার কুল-কিনারা করতে পারছিল না, বাঁচবার কোনো পথই খুঁজে পাচ্ছিল না সে।
সোনাইবিবিই শেষে তাকে একটা পথের সন্ধান দেয়। তার সাবেক মনিব ল্যাম্বার্ট সায়েব হয়তো এখনো আছেন নারায়ণগঞ্জে। তাঁর কাছে গেলে তিনি হয়তো তাঁর কুঠিরে বা পাটের গুদামে কোনো একটা কাজে লাগিয়ে দিতে পারেন।
আশা-নিরাশায় দ্বিধাগ্রস্ত মন নিয়ে আরশেদ মোল্লা নারায়ণগঞ্জ চলে গেছে আজ দশ দিন। এখনো সে ফিরে আসছে না কেন বুঝতে পারে না সোনাইবিবি।
সন্দেহের দোলায় দুলছে তারও মন। সায়েব কি তাদের এ দুর্দিনে মুখ ফিরিয়ে থাকবেন? কোনো সাহায্যই কি করবেন না?
সায়েব ও মেমসায়েব দু’জনই তাকে খুব স্নেহ করতেন। মালীর মেয়ে বলে এতটুকু ঘৃণা বা অবজ্ঞা করতেন না। তাঁদের চোখের সামনেই সে বড় হয়ে উঠছিল। খঞ্জন পাখির মতো সে লাফিয়ে বেড়াত সারা বাড়ি। দোলনায় দোল খেত। তাদের পোষা ময়নার সাথে কথা বলত। ফুল-পাতা ছিঁড়ে ফুলদানি সাজাত। কলের গান বাজাত। তার বিয়েতে তাঁরা অনেক টাকা খরচ করেছিলেন। বরকে যৌতুক দিয়েছিলেন নগদ দু’হাজার টাকা।
সোনাইবিবির স্পষ্ট মনে আছে, চাঁদ রায়-কেদার রায়ের কীর্তি রাজবাড়ির মঠ যেদিন পদ্মার উদরে বিলীন হয়ে যায়, তার ঠিক চারদিন আগে আরশেদ মোল্লা তাকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছিল বেহেরপাড়া। তার চোখের সামনেই সে মঠটা কাত হয়ে নদীতে পড়তে দেখেছে। পড়ার সাথে সাথে বিশাল উত্তাল ঢেউ উঠেছিল। মঠবাসী হাজার হাজার পাখি উড়ছিল আর আর্তচিৎকার করছিল।
তার বছর তিনেক পর তার মা চন্দ্রভানের মৃত্যুর খবর পেয়ে সে স্বামীর সাথে নারায়ণগঞ্জ গিয়েছিল। সেখানে গিয়ে শুনতে পায় ল্যাম্বার্টদের একমাত্র সন্তান স্টিফেন বাপ মায়ের সাথে রাগ করে উড়োজাহাজে চাকরি নিয়েছিল। উড়োজাহাজ চালিয়ে সাগর পাড়ি দেয়ার সময় সে সাগরে ডুবে মারা গেছে। একটা অব্যক্ত বেদনায় সোনাভানের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠেছিল।
দুবছরের রূপজানকে কোলে নিয়ে সোনাভান মেমসায়েবের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। তিনি শিশুটির দিকে পলকহীন দৃষ্টিতে চেয়েছিলেন কিছুক্ষণ। তারপর ওকে সস্নেহে কোলে তুলে নিয়েছিলেন। তক্ষুনি ড্রাইভার পাঠিয়ে ওর জন্য দোকান থেকে দামি কাপড় ও খেলনা আনিয়েছিলেন। ওর মুখে শরীরে পাউডার লাগিয়ে দিয়েছিলেন। নিজের চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ে দিয়েছিলেন। নতুন ফ্রক পরিয়ে তাকে কোলে নিয়ে গিয়েছিলেন সায়েবের ঘরে। অনেকক্ষণ পর ফিরে এসে বলেছিলেন, মা, সোনাই, তোর মেইয়াটা আমাকে দিয়া দে। আমি পালবো। আমার তো আর কেউ নাইরে, মা!
সোনাভান চুপ করে ছিল। শোকার্ত মায়ের অন্তরের আকুতিকে সে মুখের ওপর ‘না’ বলে রূঢ় আঘাত হানতে পারেনি। মেমসায়েব তার মুখ দেখে ঠিকই বুঝেছিলেন, তার মৌনতা সম্মতির বিপরীত লক্ষণ। তাই এ সম্বন্ধে আর কিছু না বলে তিনি শুধু বলেছিলেন, তোর সোয়ামিরে লইয়া কাল ভোরে আমার সঙ্গে দেখা করিস।
সোনাভান আশঙ্কা করেছিল, আগামীকালও এই একই প্রস্তাব আসতে পারে। প্রস্তাবের সাথে আসতে পারে অনেক টাকার প্রলোভনও। আরশেদ মোল্লা যে রকম টাকার লোভী, সে কিছুতেই এ সযোগ পায়ে ঠেলে দেবে বলে তার মনে হয়নি। তাই সে স্বামীর কাছে কিছুই বলেনি। তাকে তাড়া দিয়ে সেদিনই রাতের স্টিমারে রওনা দিয়ে পরের দিন তারা রাজবাড়ি স্টেশনে এসে নেমেছিল।
মেমসায়েব তার এ অবাধ্য আচরণে নিশ্চয়ই খুব রুষ্ট হয়েছিলেন, বুঝতে পেরেছিল সোনাভান। তার মনে পুষে রাখা সে রাগ কি এতদিনেও মরে যায়নি।
তারও সাত-আট বছর পর আর একবার সে স্বামীকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জ গিয়েছিল তার বাপের মৃত্যুর সময়। সেবার সে রূপজানকে সাথে নিয়ে যায়নি। এমন কি সায়েবের কুঠিতেও যায়নি। যেমন চুপিচুপি গিয়েছিল তেমনি চুপিচুপি তারা আবার ফিরে এসেছিল। তার মনে সব সময় একটা ভয় ছিল–মেমসায়েব হয় তো রূপজানকে নিজের কাছে রাখার জন্য জোরাজুরি করবেন।
তারপর অনেক বছর পেরিয়ে গেছে। সেদিনের সোনাভান বয়সের ভারে এখন সোনাইবিবি হয়েছে। সে হিসেব করে দেখে রূপজানকে নিয়ে মেম সায়েবের কাছ থেকে চলে আসার পর ষোল বছর পার হয়ে গেছে। সায়েব-মেম বেঁচে আছেন, না মরে গেছেন, নারায়ণগঞ্জে আছেন, না বিলেত চলে গেছেন–কোনো খবরই তারা রাখে না।