পুলিস সুপারের মনে আর কোনো সন্দেহ নেই। তিনি পরিষ্কার বুঝতে পারেন, বাড়ি যাওয়ার জন্য হেকমত দিঘিরপাড় থেকে ফজলদের নৌকায় ওঠে। পথের কাঁটা সরাবার এটাই সুযোগ মনে করে ফজল ওকে চুরির বা অন্য কিছুর প্রলোভন দেখায়। হেকমত রাজি হয়ে চাল রেখে আসার জন্য বাড়ি যায়। ওর ফিরে আসতে দেরি দেখে ফজল ওর বাড়ি গিয়ে ওকে ডেকে নিয়ে আসে। তরপরই এ হত্যা। তিনি বড় দারোগাকে নাজুবিবির কথা মতো এজাহার নেয়ার আদেশ দেন।
.
লঞ্চ ঘটনাস্থলে পৌঁছে। পুলিস সুপার ও বড় দারোগা কেবিন থেকে বেরিয়ে দেখেন, পাড়ে বহু লোকরে ভিড়। এ-চর ও-চর থেকে বহুলোক হেঁটে, নৌকা করে জমায়েত হয়েছে।
ভিড়ের মাঝ থেকে কয়েকজন বলে ওঠে, উই যে পাও দ্যাহা যায়।
এখন পুরো ভাটা। লাশের দুটো পায়ের পাতা জেগে উঠেছে।
ঐ হানে ধানখেতের মইদ্যে একটা কালা গঞ্জি পইড়া রইছে। আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলে কয়েকজন।
বড় দারোগা দু’জন সেপাই নিয়ে পাড়ে নামেন। জঙ্গুরুল্লাও নামে তাদের সাথে । ধানখেতের এক ধানছোপের ওপর পাওয়া যায় দলামুচড়ি করা একটা কালো গেঞ্জি। ওটার প্যাঁচ ছাড়িয়ে কাগজের একটা ছোট পুটলিও পাওয়া যায়। পুটলির ভেতর কিছু সাদা গুড়ো।
বড় দারোগা গুঁড়োর কিছুটা দুই আঙুলে তুলে ডলা দিয়ে চেনবার চেষ্টা করছেন জিনিসটা কি। তার চেনার আগেই ভিড়ের মাঝ থেকে কয়েকজন বলে, ওগুলা খাওইন্যা সোড়া। শূলবেদনার লেইগ্যা হেকমত খাইত।
ওগুলো দেখে পুলিস সুপারের ঠোঁটের কোণে কৌতুকের মৃদু হাসি ফুটে ওঠে। তিনি তার কথায় রসান দিয়ে বলেন, খুবই ভালো আলামত। খুনিদের তো বেশ বিবেক-বিবেচনা আছে হে। কি বলো ওয়াজেদ?
জ্বী স্যার। গেঞ্জি আর সোডা ভিজে নষ্ট হতে দেয়নি খুনিরা। কষ্ট করে গেঞ্জিটা খুলে যত্ন করে রেখে দিয়েছে। কৌতুকের হাসি তারও মুখে।
এ বিবেক-বিবেচনার জন্য খুনিদের পুরস্কার পাওয়া উচিত, কি বলো?
জ্বী স্যার, অবিশ্যি পাওয়া উচিত।
বড় দারোগার নির্দেশে দু’জন কনস্টেবল ও একজন মাঝি পানিতে নামে। কোমর সমান পানি। পা, বুক ও পেটের তলায় হাত দিয়ে তারা লাশটা ওপরে তুলবার চেষ্টা করে। পা থেকে বুক পর্যন্ত সহজেই ওপরেই উঠছে। কিন্তু মাথার দিকটা বেশি উঠছে না। হাত দিয়ে হাতড়াতে হাতড়াতে তারা বুঝতে পারে, একটা হাত পাড়ের মাটির ভেতর ঢুকে আছে। পানিতে জাবড়ি দিয়ে একজন পা ধরে ও দু’জন হাত ধরে জোরে টান দিতেই হাতটা গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে। লাশটা ওপর দিকে তুলতেই দেখা যায়, ওর দৃঢ়মুষ্টির ভেতর একটা পেট-গলে-যাওয়া মরা বেলে মাছ।
খুন অইছে ক্যাড়া কয়? ব্যাডাতো গদে আত দিছিল। ভিড়ের মাঝ থেকে একজন বলে।
আরে হ খুনই অইছে। আজরাইলে খুন করছে। আর একজন বলে।
হ ঠিকই, গদের মইদ্যেরতন আজরাইলে আত টাইন্যা ধইর্যা রাখছিল। অন্য একজন বলে।
আহারে, বাইল্যা মাছ ধরতে আইয়া ক্যামনে মানুষটা মইর্যা গেল। কার মরণ যে ক্যামনে লেইখ্যা থুইছে আল্লায়, কেও কইতে পারে না। আফসোস করে আরো একজন বলে।
পুলিস সুপার বড় দারোগাকে নিয়ে পানসিতে নেমে কাছে থেকে লাশ ওঠানো দেখছিলেন। লোকজনের কথাবার্তা তার কানে যায়। তিনি মনে মনে বলেন, লোকগুলো ঠিকই বলছে, সঠিক রায়ই দিয়েছে।
লাশটাকে তুলে পানসির আগা-গলুইয়ে পাটাতনের ওপর রাখা হয়।
দু’জন পুলিস অফিসারই তন্নতন্ন করে দেখেন লাশের কোথাও আঘাতের চিহ্ন আছে কিনা। কিন্তু আঘাতের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায় না।
হঠাৎ কোমরের তাগায় বাঁধা এক টুকরো সুতলি দেখতে পান বড় দারোগা।
স্যার এই দ্যাখেন। এইটের সাথে বাঁধা ছিল মাছ রাখার জালটা। বউটা ঠিকই বলেছিল, মাছ রাখার জাল নিয়ে হেকমত হাতিয়ে বেলে মাছ ধরতে গিয়েছিল।
ইয়েস, ইউ আর রাইট। বেলে মাছের জন্য লোকটা গর্তে হাত দিয়েছিল। পানি আর বাতাসের চাপে ‘চোড় হয়ে যাওয়ায় সে আর হাতটা টেনে বার করতে পারেনি। ভেরি ভেরি আনফরচুনেট! মনে হয়, ও যখন জোর করে হাত বার করার চেষ্টা করছিল তখন মুঠোর চাপে মাছটার পেট গলে যায়। মরা মাছটা ডেথক্লাচ-এর ভেতর আটকে থাকে ডিউ টু ক্যাডাভেরিক স্প্যাজম্।
জ্বী স্যার। মেডিক্যাল জুরিসপ্রুডেন্স-এ পড়েছি।
বড় দারোগা নিচুস্বরে আবার বলেন, স্যার এইবার জালটা উদ্ধারের চেষ্টা করতে হয়। মনে হয় সুতলিটা কেটে জালটা কেউ নিয়ে নিয়েছে বা ফেলে দিয়েছে।
হ্যাঁ, তাই মনে হয়। ডাকো চৌধুরীকে। তাকে এবার জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করো।
চৌধুরী গেলেন কোথায়? বড় দারোগা হাঁক দেন। এদিকে আসুন জলদি।
সবাই এদিক-ওদিক তাকায়।
আরে! পা-না-ধোয়া চৌধুরী গেল কোথায়? বড় দারোগা চারদিকে তাকান।
ভিড়ের লোকজন এতক্ষণে বুঝতে পারে, বড় দারোগা কোন লোকের খোঁজ করছেন। তারা সবাই জঙ্গুরুল্লার খোঁজ করে। কিন্তু তাকে আর ধারে-কাছে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না।
ভিড়ের ভেতর থেকে দু-একজন গালাগাল দিয়ে বলে, হালার ভাই হালায় পলাইছে।
ততক্ষণে জঙ্গুরুল্লার পানসি এসে পৌঁছে। বড় দারোগা পানসি তল্লাশি করে ডওরার এক খোপ থেকে মাছ রাখার জালটা উদ্ধার করেন।
পুলিস সুপার বলেন, এটা পরিষ্কার ইউ.ডি.কেস। অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে লোকটার। তুমি সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে। কিন্তু পোস্ট মর্টেম না করে মাটি দেয়া যাবে না। পা না-ধোয়া চৌধুরীকে ২১১ ধারায় প্রসিকিউট করার ব্যবস্থা করো। এ কেসের জন্যই লাশাটার ময়না তদন্ত হওয়া দরকার। নয় তো লাশটা মাটি দেয়ার অর্ডার দিয়ে যেতে পারতাম। তুমি লাশটা সাবডিভিশনাল হসপিটালে পাঠাবার ব্যবস্থা করো।