পুলিস সুপার বাধা দিয়ে বলেন, ওয়াজেদ, লেট হার স্পীক। ও বুড়ি, কি হয়েছে বলো।
নাজুবিবি কাঁদতে কাঁদতে কি বলছে সবটা বুঝতে পারেন না পুলিস সুপার। জঙ্গুরুল্লা নাজুবিবির পাশেই ছিল জরিনাকে নিয়ে। সে নাজুবিবির হয়ে কথা বলতেই পুলিস সুপার বলেন, হু আর ইউ? আপনি কে?
আমার নাম জঙ্গুরুল্লা চৌধুরী। আমি চরের মাতব্বর।
আচ্ছা, বলুন কি হয়েছে।
জঙ্গুরুল্লা ঘটনার বিবরণ দিতে শুরু করে।
জঙ্গুরুল্লার কাছ থেকে কিছুটা শুনেই পুলিস সুপার বুঝতে পারেন–হেকমত নামের একটা লোককে ফজল নামের কোনো লোক বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেছে এবং তার লাশ পানির নিচে লুকিয়ে রেখে গেছে। তিনি বড় দারোগাকে ডাকেন, ওয়াজেদ, দিস ইজ আ কেস অব কাপ্যাল হোমিসাইড। তুমি এদের নিয়ে লঞ্চে ওঠো। লঞ্চের কেবিনে বসেই এজাহার নেবে। আমি কেসটা সুপারভাইস করে ওখান থেকেই চলে যাব। তোমার নৌকা লঞ্চের সাথে বেঁধে দাও।
মাঝিকে তার পানসিটা লঞ্চের সাথে বাঁধবার নির্দেশ দিয়ে নাজুবিবি ও জরিনাকে নিয়ে বড় দারোগা লঞ্চে ওঠেন।
জঙ্গুরুল্লা হাতের ইশারায় কেরামতকে ঘটনাস্থলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে নিজে তিনজন সাক্ষী নিয়ে লঞ্চে ওঠে। তাদের দেখে বড় দারোগা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস কনে, এরা কারা?
ওরা সাক্ষী।
বড় দারোগা জঙ্গুরুল্লার কার্যকলাপ সম্বন্ধে ভালো করেই জানেন। এ ব্যাপারটায় তার উৎসাহ-উদ্যোগ দেখে তার সন্দেহ জাগে। তিনি বলেন, ওদের আমার পানসিটায় উঠিয়ে দিন। আর আপনি সারেং এর কাছে গিয়ে বসুন। তাকে আপনিই পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবেন।
শিকলে-বাঁধা উত্তেজিত কুকুরের মতো। ঘঁউ-ঘঁউ-ঘঁউৎ’ শব্দে সিটি বাজিয়ে লঞ্চ রওনা হয়।
এজাহার নেয়ার আগে বড় দারোগা লঞ্চের দু’নম্বর কেবিনে বসে প্রথমে নাজুবিবি ও পরে জরিনাকে আলাদা করে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। ঘটনার বর্ণনায় মৃত হেকমতের মা যে বিবরণ দিচ্ছে, তার সাথে একেবারেই মিল খাচ্ছে না মৃতের স্ত্রীর বিবরণ। তিনি পুলিস সুপারের কেবিনে গিয়ে বলেন, স্যার আসল ঘটনাটা কী, বুঝতে পারছি না। শাশুড়ি বলছে এক রকম আর বউ বলছে আর এক রকম। দু’রকম ঘটনা পাচ্ছি।
কি রকম?
মা বলছে–গতকাল সন্ধ্যার কিছু পরে সের কয়েক চাল নিয়ে হেকমত বাড়ি যায়। তার কিছুক্ষণ পরই এরফান মাতব্বরের ছেলে ফজল মাতব্বর ও আরো দু’জন হেকমতকে ডেকে নিয়ে যায়। ছেলের জন্য ভাত রান্না করে সে আর তার ছেলের বউ সারারাত জেগে প্রতীক্ষা করে। কিন্তু সে আর ঘরে ফেরেনি। ভোরে লোকজনের কাছে খবর পায়, গুনগার খাড়ির মধ্যে হেকমতের লাশ পড়ে আছে। আর বউ বলছে–হেকমত গতকাল সন্ধ্যার কিছু পরে সের তিনেক কাকর-মেশানো চাল নিয়ে বাড়ি আসে। ঘরে ভাতের সাথে খাওয়ার কিছু না থাকায় সে একটা মাছ রাখার জাল নিয়ে শুধু হাতে গর্তের বেলে মাছ ধরার জন্য নদীতে যায়। বউ আর শাশুড়ি চালের কাঁকর বেছে ভাত রান্না করে বসে থাকে সারা রাত। কিন্তু হেকমত আর ঘরে ফিরে আসে না। ভোরে জঙ্গুরুল্লা এসে বউ আর শাশুড়িকে তার পানসিতে তুলে গুনগার খাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে সে একটা জায়গা দেখিয়ে বলে, হেকমতকে কারা খুন করে ঐ জায়গায় লুকিয়ে রেখেছে।
হেকমতকে কে মার্ডার করেছে সে সম্বন্ধে কিছু বলছে বউটা?
না স্যার। সে জানে না, এমন কি সন্দেহও করে না, কে তার স্বামীকে মার্ডার করেছে।
ঐ যে চৌধুরী, কি চৌধুরী যেন নাম?
জঙ্গুরুল্লা চৌধুরী। কিন্তু লোকে বলে, পা-না-ধোয়া জঙ্গুরুল্লা।
পা-না-ধোয়া জঙ্গুরুল্লা! সেটা আবার কি রকম নাম?
চৌধুরী খেতাব নিজে নিয়েছে। আগে নাকি সে অন্যের জমিতে কামলা খাটত। সে সময়ে এক বিয়ের মজলিসে পা না-ধুয়ে ফরাসের ওপর গিয়ে বসেছিল। আর তাতে পায়ের ছাপ পড়েছিল ফরাসে। সেই থেকে তার নাম হয়েছে পা-না-ধোয়া জঙ্গুরুল্লা।
ভেরী ইনটারেস্টিং। পা-না-ধোয়া লঞ্চে এসেছে তো?
হ্যাঁ স্যার। লোকটা মিথ্যা মামলা সাজাতে ওস্তাদ।
ডাকো তাকে।
জঙ্গুরুল্লা এসে পুলিস সুপার জিজ্ঞেস করেন, কি মিয়া চৌধুরী, মামলাটা সাজিয়ে এনেছেন, তাই না?
না হুজুর, সাজাইয়া আনমু ক্যান!
শাশুড়ি বলছে–হেকমতকে ফজল মাতব্বর ঘর থেকে ডেকে নিয়ে মার্ডার করেছে। আর বউ বলেছে, সে হাতিয়ে মাছ ধরতে গিয়েছিল। সে বলতে পারে না, কে তার স্বামীকে মার্ডার করেছে।
তালিম দেয়ার সময় বউটা চুপচাপ ছিল। এত সাবধান করা সত্ত্বেও, এত ভয় দেখানো সত্ত্বেও সে তার নিজের ইচ্ছে মতো যা-তা আবোল-তাবোল বলেছে। জঙ্গুরুল্লার ভেতরটা জ্বলে ওঠে রাগে। মনের আক্রোশে মনেই চেপে সে বলে, হুজুর, ঐ ফজল আছিল বউডার পরথম সোয়ামি। তার লগে এখনো ওর পিরিত আছে। ওর লগে যুক্তি কইরাই ফজল হেকমতরে খুন করছে।
অ্যাঁ তাই?
হ, হুজুর, ঐ মাগিডারেও অ্যারেস্ট করন লাগব। ফজলের নৌকায় কাইল হেকমতরে দ্যাখা গেছে। সাক্ষীও আছে।
কোথায় সাক্ষী?
হুজুর, এইখানেই আছে। ডাক দিমু তাগো?
হ্যাঁ, তাদের ডেকে নিয়ে আসুন।
সারেংকে পথের নির্দেশ দিয়ে ঘাট-মাঝি ও আরো দু’জন সাক্ষীকে জঙ্গুরুল্লা এনে হাজির করে।
এক এক করে সাক্ষীদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন পুলিস সুপার নিজে। তিনজন সাক্ষীই বলে, তারা ফজল, চান্দু ও বক্করের সাথে হেকমতকে নৌকায় করে বাড়ির দিকে যেতে দেখেছে। তারা আরো বলেহেকমত সিঁদকাটা দাগি চোর। সে যে দাগি চোর তা থানার রেকর্ডে আছে বলে বড় দারোগাও জানান।