দুঃসংবাদটা আর চেপে রাখা ঠিক নয় ভেবে জঙ্গুরুল্লা বলে, হেকমতের মা, তোমরা মনেরে শক্ত করো। যা অইয়া গেছে তার লেইগ্যা কান্দাকাডি করলে আর ফায়দা অইব না।
ক্যান, কি অইছে? আমার হেকমত বাঁইচ্যা নাই? ও আমার বাজানরে। নাজুবিবি ডুকরে কেঁদে ওঠে।
শোন, কাইন্দ না। তোমার পোলারে মাইর্যা পানির মইদ্যে ঔজাইয়া থুইয়া গেছে।
নাজুবিবি এবার গলা ছেড়ে বিলাপ করতে শুরু করে দেয়, ও আমার হেকমতরে বাজা। তোরে কোন নির্বইংশায় মাইরা থুইয়া গেছে রে, বা’জানরে আ-মা–র।…
জরিনা স্তব্ধ হয়ে গেছে। সে ফুকরে কাঁদতে পারে না। মাথায় লম্বা ঘোমটা না থাকলে দেখা যেত তার দুগাল বেয়ে অশ্রুর ধারা গড়িয়ে তার গলা ও বুক ভিজিয়ে দিচ্ছে।
শোন হেকমতের মা, আর কাইন্দা কি করবা? কাইন্দা কি আর পুত পাইবা? নাজুবিবির বিলাপ মাঝে মাঝে থামে। আর থামার সাথে সাথেই এক সাথে অনেক অশ্রু ঝরঝর করে ঝরে পড়ে। কিছুক্ষণ পর বুকের ভেতরটা আবার মোচড় দিয়ে ওঠে। বুকের ব্যথা অসহ্য হতেই সে আবার শুরু করে দেয় বিলাপ।
জঙ্গুরুল্লা তার বিলাপের বিরতির অপেক্ষায় থাকে। তার বিলাপ থামতেই জঙ্গুরুল্লা বলে, কে মারছে আমরা জাইন্যা ফালাইছি। সাক্ষীও পাইছি।
ও আমার বেসাতরে, আমা-আ-র। তোরে না যেন কে না যে মাইরা থুইয়া গেছেরে, তার কইলজা ভরতা কইর্যা খাইমুরে বাজা-আ-ন আমা-আ-র। বংশের চেরাগ প্যাডে থুইয়া ক্যামনে চইল্যা গেলি, বাজানরে আমা-আ-র।…
পানসিটা ঘটনাস্থলে এসে থামে। লোকজন নৌকার মাথির কাছে এসে ভিড় করে। তারা নানা প্রশ্ন করে জঙ্গুরুল্লাকে। কারো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শুধু বলে, নয়াকান্দির হেকমতরে খুন কইর্যা ঐখানে পানির মইদ্যে জাইয়া থুইয়া গেছে।
কে? কে? কে খুন করছে? এক সাথে অনেক লোকের প্রশ্ন।
হেইডা পুলিসে বাইর করব। তোমরা কিন্তু পানিতে নাইম্যা না। লাশে আত দিও না। পুলিস আইয়া লাশ উডাইব। আমরা থানায় যাইতে আছি। তোমরা দুইজন দাঁড় টানার মানুষ দিতে পারবানি? ত্বরাত্বরি যাওন লাগব। উচিত পয়সা দিমু, খাওন দিমু। আবার বকশিশও দিমু।
ভিড়ের মাঝ থেকে চার-পাঁচজন হাত উঁচিয়ে নৌকায় কাজ করার ইচ্ছে প্রকাশ করে। তাদের মাঝ থেকে দু’জনকে বেছে নেয় জঙ্গুরুল্লা।
সে নাজুবিবির দিকে ফিরে বলে, ও হেকমতের মা, ঐ যে দেইখ্যা লও। তোমার পোলারে মাইর্যা ঐ খানে গুঁজাইয়া থুইছে। পুলিস আইয়া না উড়াইলে দ্যাখতে পাইবা না।
নাজুবিবি বিলাপ করতে করতে দাঁড়ায়। তার হাত ধরে দাঁড়ায় জরিনাও। পানির নিচে যেখানে লাশ রয়েছে সেদিকে তাকিয়ে নাজুবিবি আরো জোরে বিলাপ করতে শুরু করে।
আর দেরি করা ঠিক নয়। জঙ্গুরুল্লার নির্দেশে পানসি দিঘিরপাড়ের দিকে রওনা হয়। সেখান থেকে আরো সাক্ষী যোগাড় করে যেতে হবে থানায়।
ভাটি পানি, তার ওপর চার দাড়ের টান। পানসিটা ছুটে চলে।
হেকমতের মা ও বউকে তার খাস খোপে বসিয়ে জঙ্গুরুল্লা তালিম দেয়, থানায় গিয়ে কি বলতে হবে।
অল্প সময়ের মধ্যেই তারা দিঘিরপাড় নৌকাঘাটায় গিয়ে পৌঁছে। খাস খোপ থেকে বেরুবার আগে জঙ্গুরুল্লা নাজুবিবি ও জরিনাকে আর একবার সাবধান করে দেয়, কি কইছি, কানে গেছে তো? যেম্বায় যেম্বায় কইয়া দিছি, হেষায় হেম্বায় কইবা। আমিতো ওয়াদা করছিই, ঠিকঠিক মতন কাম ফতে অইলে কুড়ি নল জমি দিমু তোমাগ। কুড়ি নলে অনেক জমি, পরায় এগারো বিঘা। তোমরা ঠ্যাঙ্গের উপরে ঠ্যাঙ দিয়া রাজার হালে থাকতে পারবা। আর যদি উল্ট-পান্ডা কও, বোঝলানি, তয় আর তোমায় আড়ি আঁকখানও বিচরাইয়া পাওয়া যাইব না, কইয়া দিলাম।
জঙ্গুরুল্লা পানসি থেকে নামে। ঘাটের পুবদিকে একটা লঞ্চ দেখা যায়। ওটার পাশেই রয়েছে একটা পানসি। ঘাটের এক পান-বিড়ির দোকানদারকে জিজ্ঞেস করে সে জানতে পারে, ঐ ‘কুত্তা জাহাজে’ জেলার পুলিস সাব গতকাল দিঘিরপাড় এসেছেন। মূলচরের এক বাড়িতে কয়েক দিন আগে ডাকাতি হয়েছে। ডাকাতদের হাতে তিনজন খুনও হয়েছে। সেই মামলার তদন্তের তদারক করতে এসেছেন জেলার পুলিস সাব। থানার বড় দারোগাও এসেছেন।
এটাও আল্লার মেহেরবানি বলে মনে করে জঙ্গুরুল্লা। থানা পর্যন্ত তাকে আর কষ্ট করে যেতে হবে না।
জঙ্গুরুল্লা ঘাটমাঝির সাথে কথা বলে। সে-ও মাতব্বরের সাথে ডিঙিতে চড়ে হেকমতকে যেতে দেখেছে গতকাল বিকেল বেলা। খোঁজ করে এরকম আরো দু’জন সাক্ষী পাওয়া যায়।
ব্যস। আর দরকার নেই। জঙ্গুরুল্লা তিনজন সাক্ষীর নাম, পিতার নাম ও ঠিকানা একজনকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়।
.
গতকাল দুপুরের পর থেকেই তদন্তের তদারক শুরু করেছেন জেলার পুলিস সুপারিনটেনডেন্ট। মামলার দু’জন প্রধান সাক্ষীকে গতকাল পাওয়া যায়নি। আজ ভোরেই তাদের জবানবন্দি শুনে তিনি তার তদারকের কাজ শেষ করেন।
বেলা প্রায় দশটা। সশস্ত্র পুলিস-প্রহরী-বেষ্টিত পুলিস সুপার এবং তার পেছনে বড় দারোগা ও স্থানীয় কিছু গণ্যমান্য লোক লঞ্চের দিকে আসছেন। তারা লঞ্চের কাছে আসতেই নাজুবিবি হাত জোড় করে কান্না-জড়ানো কণ্ঠে বলে, হুজুর আমি ইনসাফ চাই। আমার পোলারে খুন কইর্যা ফালাইছে।
সে আর কিছু না বলে বিলাপ করতে শুরু করে দেয়। বড় দারোগা এগিয়ে এসে নাজুবিবিকে বলেন, এই বুড়ি সরো, সরো, সরে দাঁড়াও সামনে থেকে। আমিই তোমার নালিশ শুনব একটু পরে।