কয়েকজন গেছে কাশ আর চুইন্যা ঘাস কাটতে। ভাওর ঘর তুলতে দরকার হবে এসব ঘাস-পাতার। এগুলোর গোড়ার দিকটা দিয়ে হবে বেড়া আর আগার দিকটা দিয়ে ছাউনি। খুঁটির বাঁশে টান পড়বে। তাই কয়েকজন চলে গেছে নদীর উত্তর পাড়। বানরি ও হাশাইল গ্রাম থেকে বাঁশ কিনে তারা সোজা গিয়ে চরে উঠবে।
লোক এসেছে একশরও বেশি। এত লোকের জন্য থালা-বাসন যোগাড় করা সোজা কথা নয়। ফজল কলাপাতা কাটতে লেগে যায়। কঞ্চির মাথায় কাস্তে বেঁধে সে কলাগাছের আগা থেকে ডাউগ্গা কাটে। তারপর এক একটাকে খণ্ড করে চার-পাঁচটা।
খেতের আল ধরে নূরু আসছে। ধানগাছের মাথার ওপর দিয়ে ওর মাথা দেখা যায়।
ওকে দেখেই ফজলের পাতা কাটা বন্ধ হয়ে যায়। তার বুকের ভেতরটা দুলে ওঠে।
ইস, আবার টেরি কাটছে মিয়াসাব। নূরুর দিকে চেয়ে অস্ফুট স্বরে বলে ফজল।
কাছে এলে সে আবার লক্ষ্য করে, শুধু পরিপাটি করে চুলই আঁচড়ায়নি নূরু, তেলে চকচক করছে চুল। চোখে সুরমাও লাগিয়েছে আবার। গায়ের জামা আর লুঙ্গিটাও তত বেশ পরিষ্কার মনে হচ্ছে। তার বুঝতে বাকি থাকে না, এসব কাজে কার হাত লেগেছে।
বাড়ির কাছে আসতেই ফজল ডাক দেয়, এই নূরু, এই দিগে আয়।
কাছে এলে সে কপট রাগ দেখায়, কিরে তোরে না বারহায় বারহায় কইয়া দিছিলাম জদি কইর্যা আইয়া পড়িস। ইস্কুলে যাইতে অইব।
চাচি আইতে দিল না যে।
ফজলের অনুমান ঠিকই হয়েছে। সে আবার জিজ্ঞেস করে, আইতে দিল না ক্যান্?
চাচি কয়, এদ্দিন পরে আইছস, না খাইয়া যাবি কই?
ও তুমি প্যাট তাজা কইর্যা আইছ?
না খাইয়া আইতে দিল না যে! আবার কইছিল, আইজ থাইক্যা কাইল যাইস।
ইস্ আদরের আর সীমা নাই। কি খাওয়াইলরে?
বেহানে গিয়া খাইছি কাউনের জাউ আর আন্তেশা পিডা। দুফরে পাঙাশ মাছ ভাজা, পাঙাশ মাছের সালুন, ডাইল। হেষে দুধ আর ক্যালা।
ক্যালা কস ক্যারে? ইস্কুলে পড়স, কলা কইতে পারস না? মুচকি হেসে আবার বলে সে, কলা কইতে পারে না, জাদু আমার ট্যাড়া সিঁথি কাটছে, হুঁহ!
নূরু লজ্জা পেয়ে হাতের এক ঝটকায় চুলগুলো এলোথেলো করে দিয়ে বলে, আমি বুঝি কাটছি, চাচি আঁচড়াইয়া দিছে।
ফজল নূরুকে হাত ধরে পরম স্নেহে কাছে টেনে নেয়। আঙুলের মাথা দিয়ে বিস্রস্ত চুল দু’দিকে সরিয়ে সিঁথিটা ঠিক করতে করতে বলে, তোর চোখে সুরমা লাগাইয়া দিছে কে রে?
চাচি।
লুঙ্গি আর জামাডাও বুঝি তোর চাচি ধুইয়া দিছে?
হ।
তোর চাচি কিছু জিগায় নাই?
হ জিগাইছে, তোর দাদা কেমুন আছে? তোর দাদি কেমুন আছে?
আর কারো কথা জিগায় নাই?
হ জিগাইছে, তোর চাচা কেমুন আছে?
তুই কি কইছস? কইছি বেবাক ভালো আছে।
আর কি কইছে?
আর কইছে তোগ লাল গাইডা বিয়াইছে নি?
আর …?
নূরু তার পকেট থেকে একটা ছোট মোড়ক বের করে। কাগজের মোড়কটা ফজলের হাতে দিয়ে সে বলে, চাচি কইছে, এইডার মইদ্যে একখান তাবিজ আছে। পীরসাবের
তাবিজ।
হ তোমারে এইডা মাজায় বাইন্দা রাখতে কইছে।
ক্যান?
চাচি কইছে, বালা-মসিবত আইতে পারব না। আর অজু না কইর্যা এইডা খুলতে মানা করছে চাচি।
ক্যান, খুললে কি অইব?
খুললে বোলে চউখ কানা অইয়া যাইব।
ফজল মনে মনে হাসে। রূপজানের চাল ধরে ফেলে সে। নূরু যাতে খুলে না দেখে, সে-জন্যই সে চোখ কানা হওয়ার ভয় দেখিয়েছে।
ফজল মোড়কটা পকেটে পুরে বলে, আইচ্ছা যা তুই।
নূরু কিছুদূর যেতেই ফজল ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করে, কিরে তোর নানাজান আইল না?
হে বাড়িতে নাই, গরু কিনতে মুনশিরহাট গেছে।
নূরু চোখের আড়াল হতেই ফজল কলাগাছের ঝাড়ের মধ্যে গিয়ে ঢোকে। পকেট থেকে বের করে মোড়কটা। সুতা দিয়ে ওটাকে আচ্ছামতো পেঁচিয়ে দিয়েছে রূপজান। সুতার প্যাঁচ খুলে সে মোড়কটার ভেতরে পায় একটা সাদা রুমাল আর ভাঁজ করা একটা কাগজ। রুমালটার এক কোণে এমব্রয়ডারি করা ফুল ও পাতা। তার নিচে সুচের ফোর দিয়ে লেখা, ভুলনা আমায়।
ফজল রুমালটা গালের সাথে চেপে ধরে। তারপর ওটাকে পকেটে রেখে সে ভাঁজ করা কাগজটা খুলে পড়ে।
প্রাণাধিক,
হাজার হাজার বহুত বহুত সেলাম পর সমাচার এই যে আমার শত কোটি ভালবাসা নিও। অনেক দিন গুজারিয়া গেল তোমারে দেখি না। তোমারে একটু চউখের দেখা দেখনের লেইগ্যা পরানটা খালি ছটফট করে। তুমি এত নিষ্ঠুর। একবার আসিয়া আমার খবরও নিলা না। বাজান তোমার উপরে রাগ হয় নাই। সে রাগ হইছে মিয়াজির উপরে। সে আমার গয়না বেচিয়া খাইছে। সেই জন্যই বাজান রাগ হইছে। কিন্তু আমি গয়না চাই না। তুমিই আমার গয়না, তুমিই আমার গলার হার। তুমিই আমার পরানের পরান। যদি তোমার পরানের মধ্যে আমারে জায়গা দিয়া থাক তবে একবার আসিয়া চউখের দেখা দিয়া যাইও। তোমার লেইগ্যা পথের দিগে চাহিয়া থাকিব।
নূরুর কাছে শোনলাম, খুনের চর জাগছে। তোমার আল্লার কিরা, চরের কাইজ্যায় যাইও না। ইতি।
অভিগানী
রূপজান
ফজল কাগজটা উল্টে দেখে, সেখানে একটা পাখি আঁকা। তার নিচে লেখা রয়েছে, যাও পাখি বলো তারে, সে যেন ভোলে না মোরে।
তারও নিচে লেখা আছে একটা পরিচিত গানের কয়েকটা লাইন–
যদি আমার পাখারে থাকত,
কে আমারে ধরিয়া রাখত,
উইড়া যাইতাম পরান বন্ধুর দ্যাশেরে ॥
ফজল চিঠিটা আবার প্রথম থেকে পড়তে শুরু করে।
ফজু কই রে? অ ফজু…
জ্বী আইতে আছি। পিতার ডাকে সাড়া দিয়ে ফজল তাড়াতাড়ি চিঠিটা পকেটে পোরে। সে আরো কিছু কলাপাতা কেটে বাড়ির উঠানে গিয়ে দাঁড়ায়। সেখানে লোকজনের সাথে কথাবার্তা বলছে এরফান মাতব্বর।