০১-০৪. পুর্বের আকাশ ফরসা
পদ্মার পলিদ্বীপ – উপন্যাস – আবু ইসহাক
উৎসর্গ – বড় ভাই মোহাম্মদ ইসমাইল-এর স্মৃতির উদ্দেশে
পদ্মার পলিদ্বীপ সম্পর্কে দেশি-বিদেশী অভিমত
…একখানা উচ্চাঙ্গের উপন্যাস। ইহার অনেক জায়গা একাধিকবার পড়িয়াছি। বিষয়বস্তুর অভিনবত্ব ছাড়িয়াই দিলাম।…এত ব্যাপক, বিস্তৃত, জটিল অথচ সুসংহত এবং স্বচ্ছন্দ কাহিনী কমই পড়িয়াছি।…এই উপন্যাসে নানা কাহিনীর সুষম সমাবেশ হইয়াছে, পদ্মার বিধ্বংসী লীলার যথাযথ বর্ণনা আছে,…। এই বর্ণনা প্রত্যক্ষ, পুঙ্খানুপুঙ্খ অথচ সংযত, অশ্লীল কাহিনীতে কোথাও শ্লীলতার অভাব দেখা যায় না। জরিনা-ফজলের যৌনমিলনের যে চিত্র আঁকা হইয়াছে তাহার মধ্যে জরিনাই অগ্রণী। তাহার ধর্মবোধ তীক্ষ্ণ। সে জানে সামাজিক রীতি ও ধর্মীয় নীতির দিক দিয়া সে পাপিষ্ঠা, কিন্তু মাইকেল মধুসূদনের ভাষায় বলা যাইতে পারে, পর্বত গৃহ ছাড়ি বাহিরায় যবে নদী সিন্দুর উদ্দেশে, কার সাধ্য রোধে তার গতি। ব্যভিচারের এমন পুঙ্খানুপুঙ্খ, অথচ সংযত বর্ণনা আর কোথাও পড়িয়াছি বলিয়া মনে হয় না।
ইতিহাস মানুষের কাহিনী বলে, যে কাহিনী ঘটিয়া গিয়া স্তব্ধ হইয়া গিয়াছে। সাহিত্য জীবন্ত, তাহার প্রধান গুণ উধ্বমুখী অভীপ্সা এবং তাহার প্রাণ আইডিয়া। চরের প্রজারা জমিদার ও তাহার সাঙ্গোপাঙ্গোদের দ্বারা অপমানিত হয়। হেকমত সমস্ত জীবন মহাজনের ঋণ শোধ করিতেই চুরি করিয়া বেড়ায়। ফজল ছেলেমানুষ, কিন্তু জমিদারের নায়েব যে তাহার পিতাকে যথেষ্ট মর্যাদা দেয় নাই তাহার যথাযোগ্য প্রত্যুত্তর সে দিয়াছে। রূপজান কিছুতেই ইচ্ছার বিরুদ্ধে পীরসাহেবের বিবি হইতে চায় নাই। জরিনা ধর্মভীরু। কিন্তু যে শাস্ত্র তাহার হৃদয়ের অন্তরতম সত্যকে উপলব্ধি করে নাই তাহাকে সে মানে নাই আর আদর্শবাদী বিপ্লবী এই উপন্যাসকে নূতন আলোকে উদ্ভাসিত করিয়াছে।
ড. সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত, প্রাক্তন অধ্যক্ষ, ইংরেজী বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা।
১৯ জুন, ১৯৯১ তারিখে আবু ইসহাককে লিখিত তাঁর পত্রের কিছু অংশ।
সম্পূর্ণ পত্রটি জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র-এর মাসিক মুখপত্র ‘বই’ নভেম্বর, ১৯৯১-এ প্রকাশিত।
.
…পদ্মার পলিদ্বীপ প্রতিভার সৃষ্টি। …এই উপন্যাসের জরিনার মত চরিত্র এক শরচ্চন্দ্র আঁকিতে পারিতেন। একাধিক বার পড়ার পরও আমি এই চরিত্রটির রহস্য অনুধাবন করার চেষ্টা করি। বারংবার প্রশ্ন জাগে–যদি হেকমত জীবিতাবস্থায় ফিরিয়া আসিত তাহা হইলে এই ধীর স্থির অবিচলিত রমণী কি উত্তর দিত।
আবু ইসহাক-এর নিকট ২৮ জুলাই, ১৯৯১ তারিখে ড. সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত-এর লিখিত পত্র থেকে উদ্ধৃতি।
.
তাঁর প্রথম উপন্যাসের মতো এটাও পল্লীজীবন ভিত্তিক, এখানেও জীবনবোধ তীক্ষ্ণ, বাস্তব জীবনের পরিবেশন অকৃত্রিম ও সত্যনিষ্ঠ। তবে সূর্য-দীঘল বাড়ী–র চাইতে বর্তমান উপন্যাসের পরিমণ্ডল বৃহত্তর, জীবন সগ্রামের চিত্র এখানে আরো দ্বন্দ্বমুখর ও তীব্র নাটকীয়তা তা অধিকতর উজ্জ্বল। এবং কাহিনীর পটভূমি-পরিবেশও ভিন্নতর।…উপন্যাসটিতে লেখক একই সঙ্গে গভীরতা ও বিস্তার এনে একে এপিকধর্মী করার প্রয়াস পেয়েছেন।
দীর্ঘদিন পরে তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস প্রকাশিত হলেও আবু ইসহাক ‘পদ্মার পলিদ্বীপ উপহার দিয়ে বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক হিসেবে তাঁর পূর্বখ্যাতিকে শুধু অমলিন রাখেননি, আমার বিবেচনায় তাকে আরো সম্প্রসারিত করেছেন।
অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : বেতার বাংলা, ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৭.
.
আবু ইসহাকের এই উপন্যাসটিও সাহিত্য-রসাস্বাদক। প্রতিটি ব্যক্তির কাছে চ্যালেনজ রাখার সাহস রাখে। টানাপোড়েন সমাজ-জীবনের জলজ্যান্ত নিখুঁত ছবিতে উপন্যাসটি ভরিয়ে তোলায় লেখক আরেকবার প্রমাণ করলেন নিছক কাহিনী নয়, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের পারিপার্শ্বিক সমাজব্যবস্থা, জীবনসগ্রাম, প্রেম, যা আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপকে ভাবায়, প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়, কাদায়, সেগুলোই সাহিত্যের আসল মূলধন। এই মূলধনকে সাহিত্য করে তোলায় আবু ইসহাকের ক্ষমতা অপরিসীম। তাই এই রচনা সমাজের রসকষহীন প্রিনটেড ডকুমেন্ট হয়ে ওঠেনি।
… একথা স্বীকার করতেই হয়, আবু ইসহাক পাঠককে টেনে রাখার জাদু জানেন। গ্রাম্য সেন্টিমেন্টের সঙ্গে ত্রিকোণ প্রেম, ত্রিকোণ প্রেমের সঙ্গে বাস্তব বোধ, বাস্তব বোধের সঙ্গে গ্রাম্য রাজনীতি সব মিলিয়ে একটি আদর্শ উপন্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চতুরঙ্গ : কলকাতা : এপ্রিল, ১৯৮৭.
.
প্রাণবন্ত, যথাযথ আঞ্চলিক ভাষার বলিষ্ঠ ব্যবহার উপন্যাসকে খুবই আকর্ষণীয় করেছে; বলাবাহুল্য, পড়তে শুরু করলেই বই শেষ না করে থাকা সম্ভব নয়’–কথাটা আক্ষরিক অর্থেই সত্য। একই কারণে বইয়ের প্রতিটি চরিত্রই বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে।…জরিনার চরিত্রটি নায়ক ফজল ও নায়িকা রূপজানের চরিত্রের চাইতেও বেশি জীবন্ত মনে হয়েছে। যেন টলস্টয়ের বিখ্যাত নায়িকা আনা কারেনিনার গ্রাম-বাংলার চর অঞ্চলের অতি চেনা সংস্করণ।
দীপঙ্কর : মাসিক সাহিত্য পত্রিকা, ঢাকা : বৈশাখ, ১৩৯৪.