হরিপদ?
আজ্ঞে?
ঘণ্টাতো ঠিকই আছে। শব্দ এরকম হয় কেন?
হাতুড়ি চুরি গেছে স্যার। এই জন্যে শব্দ কম হয়।
ফজলুল করিম সাহেব বিস্মিত চোখে তাকালেন। কি ভয়ংকর কথা। হাতুড়ি চুরি গেছে। আজ হাতুড়ি গেলে, কাল যাবে ঘণ্টা।
কখন চুরি গেছে?
কাইল থাইক্যা পাই না।
তুমি তো অসম্ভব কথা বলছ হরিপদ। স্কুলের প্রাণ হল তার ঘণ্টা। ঘণ্টা হাতুড়ি থাকে তোমার দায়িত্বে। সেই হাতুড়ি চলে গেল তুমি খবর পর্যন্ত দিলে না। তুমি ঘোরর অন্যায় করেছ। তোমাকে আরো দুটাকা ফাইন করা হল। ঘণ্টার হাতুড়ি চুরি হবার মত কোন বস্তু না। নিশ্চয়ই কোথাও আছে। খুঁজে বের কর।
জ্বে আজ্ঞে।
মাহবুব সাহেব গম্ভীর ভঙ্গিতে ঢুকলেন। মনে হচ্ছে তাকে ডেকে আনায় তিনি বিরক্ত। তিনি হেডমাস্টার সাহেবের সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, ডেকেছেন?
মাহবুব সাহেব আজকের ফাস্ট পিরিয়ড মিস করেছেন।
কাজ ছিল।
কাজ থাকলে আগে ভাগে ছুটি নেবেন যাতে আমরা বিকল্প ব্যবস্থা রাখতে পারি।
হঠাৎ কাজ পড়ে গেল, আগে জানানো সম্ভব ছিল না। ময়মনসিংহ-এর ডিসি সাহেব হঠাৎ চলে এসেছেন। উঠেছেন ডাকবাংলায়…… সকালে তাঁর সঙ্গে চা খেতে বললেন। তাকে তো আর বলতে পারি না–চা খাব না।
সেটা কেন বলবেন? চা খেতে ডেকেছে চা খাবেন। আবার আপনার জন্যে ছাত্ররা যাতে অসুবিধায় না পড়ে সেই দিকেও লক্ষ্য রাখবেন। ডিসি সাহেবের সঙ্গে চায়ের চেয়ে ছাত্রদের ক্লাশ অনেক জরুরী। আপনি শিক্ষক মানুষ। এই ব্যাপারটা আপনি ছাড়া কে বুঝবে?
মাহবুব সাহেব চোখ মুখ কঠিন করে বসে রইলেন। ফজলুল করিম সাহেব বললেন, আচ্ছা যান, এইটা বলার জন্যই ডেকেছিলাম। শুধু যে আজই আপনি ক্লাস মিস করেছেন তাই না। গতকালও স্কুলে এসেছেন টিফিন টাইমের পরে।
গতকাল স্কুলের কাজেই বাইরে ছিলাম। বাজার কমিটির সাথে একটা সভা ছিল। বাজার কমিটির চাদা ছাড়া তো স্কুল চলবে না। না-কি চলবে?
বাজার কমিটির টাকা আমাদের অবশ্যই দরকার। কিন্তু এদের মিটিং এমনভাবে ফেলতে হবে যেন স্কুল এফেকটেড না হয়। ছুটির দিনে মিটিং করবেন কিংবা সন্ধ্যাবেলা করবেন।
মাহবুব সাহেবের মুখে খুব কঠিন কিছু কথা এসে গিয়েছিল সেই সব কথা তিনি সামলে নিলেন। কঠিন কথা বলার সময় পাওয়া যাবে। প্রচন্ড রাগ নিয়ে কঠিন কথা ঠিক না। কঠিন কথা বলতে হয় ঠাণ্ডা মাথায়। খুব ঠাণ্ডা মাথায়।
মাহবুব সাহেব।
জ্বি স্যার।
আমাদের স্কুলের সায়েন্স টিচার আসবেন পরশু সন্ধ্যায়। বিদেশী মানুষ, তাঁর থাকা খাওয়ার একটা ব্যবস্থা তো করতে হয়…।
দেখি, একটা ব্যবস্থা করব।
কি ব্যবস্থা করবেন আমাকে জানাবেন। ষ্টেশনে কাউকে পাঠাতেও হবে উনাকে আনার জন্যে। আমি নিজেই যেতাম। আমার শরীরটা খারাপ রাতে ভাল ঘুম হচ্ছে না। শরীর ভাল লাগলে নিজেই যাব।
মাহবুব সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়াতে দাঁড়াতে বললেন সার আমি তাহলে উঠি?
আচ্ছা। মাহবুব সাহেব!
জ্বি স্যার।
অনেক কঠিন কথা বলে ফেললাম। কিছু মনে করবেন না। মেজাজও খুব খারাপ, হাতুড়ি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কি রকম অব্যবস্থা–স্কুলের হাতুড়ি চুরি গেছে। ডাষ্টার দিয়ে ঘণ্টা পিটাচ্ছে…। আচ্ছা যান। আপনার ক্লাসের সময় হয়ে গেল।
ফিফথ পিরিয়ড শুরু হচ্ছে। ফজলুল করিম সাহেব ঘণ্টার শব্দ শুনছেন। হাতুড়ি পাওয়া যায় নি। ঘণ্টার শব্দ থেকেই বোঝা যাচ্ছে হাতুড়ি পাওয়া যায়নি। ফজলুল করিম সাহেব স্কুলের প্যান্ডে হরিপদের জরিমানা সংক্রান্ত নোটিশ লিখতে শুরু করলেন। সব কিছুর রেকর্ড থাকা দরকার। ফজলুল করিম সাহেব লিখলেন বিষয়ঃ কর্তব্য কার্যে গুরুতর অবহেলা।
সন্ধ্যাবেলা হরিপদ এসে জানালো হাতুড়ি খুঁজে পাওয়া যায় নি। হেডমাস্টার সাহেব তাকে জরিমানার চিঠি ধরিয়ে দিলেন। হরিপদ বিনয়ে নিচু হয়ে রইল। কিছু বলল না।
ফজলুল করিম সাহেব বললেন, শেক্সপিয়ারের একটা কথা আছে আই হ্যাভ টু বি ক্রুয়েল ওনলি টু বি কাইন্ড। অর্থাৎ তোমার প্রতি নিষ্ঠুর হচ্ছি, তৈমাকে করুণী প্রদর্শনের জন্যেই। বুঝছি
জ্বে আজ্ঞে।
আচ্ছা যাও। আমি আরো কিছুক্ষণ থাকব। রাতে এক জায়গায় দাওয়াত আছে। কাজেই রাত আটটা পর্যন্ত স্কুলে থাকব। তোমার থাকার কোন দরকার নেই। তুমি চলে যাও।
জ্বে আজ্ঞে।
যাবার আগে হারিকেনে তেল ভরে দিয়ে ঠিকঠাক করে দিয়ে যেও।
তেল কিনতে হবে স্যার। তেল নাই।
ফজলুল করিম সাহেব দশটাকার একটা নোট বের করে দিলেন।
বোতল নিয়ে যাও ছটাকার কেরোসিন আনবে।
জ্বে আজ্ঞে।
হেডমাস্টার সাহেব ঠিক করে রেখেছেন যে চারটাকা ফেরত আসবে সেই টাকাটা তিনি রাখবেন না এতে দুটাকা দুটাকা করে যে চার টাকা ফাইন হয়েছিল সেটা হরিপদ সামলে ফেলতে পারবে। বোকা মানুষ বলে সে ব্যাপারটা বুঝতে পারবে না।
ফজলুল করিম সাহেবের ঘরে হারিকেন জ্বলছে। হরিপদ বারান্দায় জবুথবু হয়ে বসে আছে। হেড স্যারকে ফেলে সে যেতে পারে না। এটা সম্ভব না।
আজো বৃষ্টি পড়ছে। কাল যেমন বৃষ্টি পড়ছিল আজ তারচেয়েও বেগে বৃষ্টি নেমেছে। এইবার বন্যা না হয়েই যায় না। লাইব্রেরী ঘরের দিকে খটখট শব্দ হচ্ছে। শব্দ শুনে মনে হয় কারা যেন চেয়ার টেবিল টানাটানি করছে। হরিপদের গা সামান্য ছমছম করতে লাগল। স্কুলে একটা গুজব প্রচলিত আছে লাইব্রেরী ঘরে স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা জীবন বাবুকে মাঝে মধ্যে দেখা যায়। ব্যাপারটা পুরোপুরি গুজবও নয়। হরিপদ নিজেও একবার দেখেছে। তিন বছর আগের কথা। শীতকাল, সে স্কুল লাইব্রেরী বারান্দা দিয়ে যাচ্ছিল–হঠাৎ শুনে খটমট শব্দ। লাইব্রেরী দরজা তালা দেয়া, সে ঘুলঘুলি ফাঁক করে তাকিয়েই চমকে উঠল। চেয়ারে জীবন বাবু বসে আছেন। খালি গা-ধবধবে ফর্সা শরীর, মোটা একটা বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছেন। হরিপদকে তাকাতে দেখে তিনি চোখ তুললেন। কি কঠিন সেই চোখের দৃষ্টি। হরিপদের বুক হিম হয়ে গেল। জীবন বাবু ধমকে উঠলেন–কি চাও? হরিপদ ছুটে চলে এল। এই ঘটনার কথা সে কাউকে বলেনি। এইসব ব্যাপার বলতে নেই।