- বইয়ের নামঃ জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল হাইস্কুল
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অনন্যা
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
শ্রাবণ মাসের শেষ
“হে মানব সন্তান, সহ শৃঙ্খলে আবদ্ধ হইয়া তুমি মুক্তির স্বাদ পাইবে। ইহাই তোমার নিয়তি।“
(প্রাচীন শিলালিপি। মায়া সভ্যতা)
০১.
শ্রাবণ মাসের শেষ।
ভ্যাপসা গরম পড়েছে। গত পনেরো দিনে এক ফোঁটা বৃষ্টি হয়নি। সারাদিন ঝাঁঝালো রোদ যায়। সূর্য ডোবার পর গরম আরো বাড়ে। গরমে অতিষ্ঠ হয়ে যখন-তখন সাপ বের হয়ে পড়ে। এ পর্যন্ত দুজনকে সাপে কেটেছে।
জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুলের টিচার্স কমনরুমে সাপ নিয়ে গল্প হচ্ছিল। ইংরেজির মাহবুব স্যার কাল রাতে কিভাবে অল্পের জন্য বেঁচেছেন সেই গল্প করছেন। খুব আগ্রহ নিয়ে করছেন, তবে কেউ মন দিয়ে শুনছে৷ বলে মনে হচ্ছে না। মাহবুব সাহেব গল্প ভাল বলতে পারেন না। কিছু দূর বলার পরই খেই হারিয়ে ফেলেন, তখন গলা খাকাড়ি দিয়ে বলেন, বুঝলেন কি-না, বুঝলেন কি-না। গল্প আবার নতুন করে শুরু হয়। এইভাবে গল্প শুনে আরাম নেই। তারপরেও সবাই শুনছে, কারণ কিছু করার নেই। হেডস্যার সবাইকে ক্লাসের পরে থাকতে বলেছেন। খুব জরুরী।
জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুলের হেডমাষ্টার ফজলুল করিম এম, এ, (ডবল) বিটি (প্রথম শ্রেণী) কে সবাই সমীহ করে চলেন। ভদ্রলোকের বয়স পাঁচপঞ্চাশের মত। রোগা পাতলা মানুষ। হাঁটেন খানিকটা কুজো ভঙ্গিতে। হাঁটার সময় চোখ থাকে তার নিজের পায়ের পাতার উপর। সামনে কে আসছে বা কে পাশ দিয়ে যাচ্ছে তার চেয়েও তার পায়ের পাতা কোথায় পড়ছে তা তাঁর কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। কথা বলেন নরম গলায়। তবে প্রতিটি শব্দ খুব স্পষ্ট করে বলেন। ১৯৬৮ সালে হেডমাস্টার হিসেবে এই স্কুলে এসেছিলেন। এখনো আছেন। তার সবচে বড় গুণ এবং সবচে বড় ত্রুটি হচ্ছে স্কুলের বাইরে তিনি কিছু চিন্তা করতে পারেন না।
মাহবুব সাহেব গলা খাকাড়ি দিয়ে বলছেন, বুঝলেন কি-না গরমষ্টা কেমন পড়েছে কাল রাতে। বুঝলেন কি-না যাকে বলে তালপাকা গরম। রাতে ভাত হতে দেরি হচ্ছে, আমি আমার মেয়েটাকে বললাম, উঠোনে পাটি পেতে দে, বিশ্রাম করি। সে দিল। তারপর বললাম, দে মা, একটা বালিশও দে, শুয়ে থাকি। রান্না হলে ডেকে দিস। সে বেশ একটা বিছানার মত করে দিল। বুঝলেন কি-না আমি একটা তালপাখা নিয়ে শুতে গেছি, হঠাৎ দেখি বালিশের কাছে এক গোছা পাটের কোষ্ঠা। বুঝলেন কি-না আসলে সাপ। চাঁদের আলোয় পাটের কোষ্ঠার মত লাগছে। আমি তো আর সাপ যে সেটা জানি না। আমি শুয়ে পড়েছি, তখন একটা গন্ধ পেলাম। মিষ্টি গন্ধ।
আরবী ও ইসলামিয়াত শিক্ষক মওলানা ইরতাজ উদ্দিন হাই তুলতে তুলতে বললেন, মিষ্টি গন্ধ পেলেন কেন? সাপ কি সেন্ট মেখে এসেছিল।
এই কথায় সবার হেসে উঠা উচিত, কিন্তু কেউ হাসল না। দুএকজন অবশ্যি মুখ ফিরিয়ে হাসি চাপার চেষ্টা করল। এই স্কুলে মাহবুব সাহেবকে নিয়ে কেউ হাসাহাসি করে না। মওলানা ছাড়া আর কারো এত সাহস নেই। মাহবুব সাহেব ক্ষমতাবান ব্যক্তি। এবার চেয়ারম্যান ইলেকশনে দাঁড়াবেন এরকম শোনা যাচ্ছে। স্কুলে শুধু না, এই অঞ্চলে থাকতে হলেও তাকে তোয়াজ করে চলতে হয়। মওলানা নতুন এসেছেন তিনি এই ব্যাপারটা হয়। এখনো জানেন না কিংবা জানলেও না জানার ভান করছেন।
মাহবুব সাহেব কল্পনা করেননি তার এমন ভয়াবহ গল্প নিয়ে কেউ রসিকতা করবে। তিনি কিছুক্ষণ অবাক হয়ে মওলানার দিকে তাকিয়ে রইলেন। নিজেকে সামলালেন। তারপর শান্ত গলায় বললেন, মওলানা সাহেব, আপনি বোধহয় জানেন না ভাদ্র-আশ্বিন মাসে সাপের শরীরে গন্ধ। হয়, তখন সাপ খোলস ছাড়ে। অনেকটা বাসি বকুল ফুলের গন্ধের মত গন্ধ।
আমি জানতাম না, আমার ধারণা ছিল শীতকালে খোলস ছাড়ে। এই নিয়ে পরে আপনার সঙ্গে বাহাস করা যাবে, আপাতত গল্পটা শেষ করুন। সাপটা কি করল, খোলস ছাড়ার জন্যে আপনার কাছে গেল?
মাহবুব সাহেব মওলানার সাহস দেখে অবাক হলেন। তিনি কিছু বললেন না। ঠাণ্ডা চোখে তাকিয়ে রইলেন। তার মুখে থুথু জমে যাচ্ছে। তিনি মনে মনে বললেন, হারামজাদা মওলানা।
অংক-স্যার বিনয় বাবু পরিস্থিতি সামলাবার জন্যে বললেন, চা খাওয়া যাক, কি বলেন? হরিপদকে বলি চা-পাতা আর ভেলি গুড় নিয়ে আসুক। ভেলি গুড়ের চা ভাল হয়। কি বলেন আপনারা ডাকি হরিপদকে?
কেউ হ্যাঁ বা না কিছু বলল না। হা বললেই খরচ দেয়ার একটা প্রশ্ন চলে আসে। কে খরচ দেবে?
মাহবুব সাহেব পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা কুড়ি টাকার নোট বের করে টেবিলে রাখতে রাখতে বললেন, আনতে বলুন, চা আর একটা করে সিঙ্গাড়া। আমরা মানুষ কজন?
বিনয় বাবু উৎসাহের সঙ্গে বললেন, হেডস্যারকে নিয়ে বার বারটা সিঙ্গাড়া আনিতে বলি, কি বলেন?
মাহবুব সাহেব বললেন, আমাকে বাদ দিয়ে হিসাব করুন। আমি সিঙ্গাড়া-ফিঙ্গাড়া খাই না।
তিনি ভেবেছিলেন, সবাই একসঙ্গে বলে উঠবে, আপনি খাবেন না মানে? আপনাকে বাদ দিয়ে আমরা খাব না-কি? তিনি বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলেন, কেউ কিছুই বলল না। গল্প অনেকটুকু বলা হয়েছে, বাকিটুকু শোনার প্রতিও কারো আগ্রহ নেই। মাহবুব সাহেবের ভুরু কুঞ্চিত। আশ্চর্য! একটা গল্পের শেষটুকু বলা যাবে না। আসল মজাইতো গল্পের শেষে
মওলানা সাহেব বললেন, চা আসুক, এরমধ্যে আসরের নামাজটা পড়ে ফেলি। সময়মত নামাজ পড়ার বদঅভ্যাস কি আর কারো আছে? থাকলে আসুন। জামাত ছাড়া নামাজ পড়ে আরাম পাওয়া যায় না।