- বইয়ের নামঃ অনূদিত কবিতা
- লেখকের নামঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
কবি (ওই যেতেছেন কবি কাননের পথ দিয়া)
ওই যেতেছেন কবি কাননের পথ দিয়া,
কভু বা অবাক, কভু ভকতি-বিহ্বল হিয়া।
নিজের প্রাণের মাঝে
একটি যে বীণা বাজে,
সে বাণী শুনিতেছেন হৃদয় মাঝারে গিয়া।
বনে যতগুলি ফুল আলো করি ছিল শাখা,
কারো কচি তনুখানি নীল বসনেতে ঢাকা,
কারো বা সোনার মুখ,
কেহ রাঙা টুকটুক,
কারো বা শতেক রঙ যেন ময়ূরের পাখা,
কবিরে আসিতে দেখি হরষেতে হেলি দুলি
হাব ভাব করে কত রূপসী সে মেয়েগুলি।
বলাবলি করে, আর ফিরিয়া ফিরিয়া চায়,
“প্রণয়ী মোদের ওই দেখ লো চলিয়া যায়।”
সে অরণ্যে বনস্পতি মহান্ বিশাল-কায়া
হেথায় জাগিছে আলো, হোথায় ঘুমায় ছায়া।
কোথাও বা বৃদ্ধবট–
মাথায় নিবিড় জট;
ত্রিবলী অঙ্কিত দেহ প্রকাণ্ড তমাল শাল;
কোথাও বা ঋষির মতো
অশথের গাছ যত
দাঁড়ায়ে রয়েছে মৌন ছড়ায়ে আঁধার ডাল।
মহর্ষি গুরুরে হেরি অমনি ভকতিভরে
সসম্ভ্রমে শিষ্যগণ যেমন প্রণাম করে,
তেমনি করিবে দেখি গাছেরা দাঁড়াল নুয়ে,
লতা-শ্মশ্রুময় মাথা ঝুলিয়া পড়িল ভুঁয়ে।
একদৃষ্টে চেয়ে দেখি প্রশান্ত সে মুখচ্ছবি,
চুপি চুপি কহে তারা “ওই সেই। ওই কবি।”
Victor Hugo
কোনো জাপানি কবিতার ইংরাজি অনুবাদ হইতে (বাতাসে অশথপাতা পড়িছে খসিয়া)
বাতাসে অশথপাতা পড়িছে খসিয়া,
বাতাসেতে দেবদারু উঠিছে শ্বসিয়া।
দিবসের পরে বসি রাত্রি মুদে আঁখি,
নীড়েতে বসিয়া যেন পাহাড়ের পাখি।
শ্রান্ত পদে ভ্রমি আমি নগরে নগরে
বিজন অরণ্য দিয়া পর্বতে সাগরে।
উড়িয়া গিয়াছে সেই পাখিটি আমার,
খুঁজিয়া বেড়াই তারে সকল সংসার।
দিন রাত্রি চলিয়াছি, শুধু চলিয়াছি–
ভুলে যেতে ভুলিয়া গিয়াছি।
আমি যত চলিতেছি রোদ্র বৃষ্টি বায়ে
হৃদয় আমার তত পড়িছে পিছায়ে।
হৃদয় রে, ছাড়াছাড়ি হল তোর সাথে–
এক ভাব রহিল না তোমাতে আমাতে।
নীড় বেঁধেছিনু যেথা যা রে সেইখানে,
একবার ডাক্ গিয়ে আকুল পরানে।
কে জানে, হতেও পারে, সে নীড়ের কাছে
হয়তো পাখিটি মোর লুকাইয়ে আছে।
কেঁদে কেঁদে বৃষ্টিজলে আমি ভ্রমিতেছি–
ভুলে যেতে ভুলিয়ে গিয়েছি।
দেশের সবাই জানে কাহিনী আমার।
বলে তারা, “এত প্রেম আছে বা কাহার!’
পাখি সে পলায়ে গেছে কথাটি না ব’লে,
এমন তো সব পাখি উড়ে যায় চলে।
চিরদিন তারা কভু থাকে না সমান
এমন তো কত শত রয়েছে প্রমাণ।
ডাকে আর গায় আর উড়ে যায় পরে,
এ ছাড়া বলো তো তারা আর কী বা করে?
পাখি গেল যার, তার এক দুঃখ আছে–
ভুলে যেতে ভুলে সে গিয়াছে!
সারা দিন দেখি আমি উড়িতেছে কাক,
সারা রাত শুনি আমি পেচকের ডাক।
চন্দ্র উঠে অস্ত যায় পশ্চিমসাগরে,
পূরবে তপন উঠে জলদের স্তরে।
পাতা ঝরে, শুভ্র রেণু উড়ে চারি ধার–
বসন্তমুকুল এ কি? অথবা তুষার?
হৃদয়, বিদায় লই এবে তোর কাছে–
বিলম্ব হইয়া গেল, সময় কি আছে?
শান্ত হ’রে, একদিন সুখী হবি তবু–
মরণ সে ভুলে যেতে ভোলে না তো কভু!
আষাঢ়, ১২৮৮
তারা ও আঁখি (কাল সন্ধ্যাকালে ধীরে সন্ধ্যার বাতাস)
কাল সন্ধ্যাকালে ধীরে সন্ধ্যার বাতাস
বহিয়া আনিতেছিল ফুলের সুবাস।
রাত্রি হ’ল, আঁধারের ঘনীভূত ছায়ে
পাখিগুলি একে একে পড়িল ঘুমায়ে।
প্রফুল্ল বসন্ত ছিল ঘেরি চারি ধার
আছিল প্রফুল্লতর যৌবন তোমার,
তারকা হাসিতেছিল আকাশের মেয়ে,
ও আঁখি হাসিতেছিল তাহাদের চেয়ে।
দুজনে কহিতেছিনু কথা কানে কানে,
হৃদয় গাহিতেছিল মিষ্টতম তানে।
রজনী দেখিনু অতি পবিত্র বিমল,
ও মুখ দেখিনু অতি সুন্দর উজ্জ্বল।
সোনার তারকাদের ডেকে ধীরে ধীরে,
কহিনু, “সমস্ত স্বর্গ ঢাকলো এর শিরে!”
বলিনু আঁখিরে তব “ওগো আঁখি-তারা,
ঢালো গো আমার পরে প্রণয়ের ধারা।”
Victor Hugo
বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ১ (মধুর সূর্যের আলো, আকাশ বিমল)
মধুর সূর্যের আলো, আকাশ বিমল,
সঘনে উঠিছে নাচি তরঙ্গ উজ্জ্বল।
মধ্যাহ্নের স্বচ্ছ করে
সাজিয়াছে থরে থরে
ক্ষুদ্র নীল দ্বীপগুলি, শুভ্র শৈলশির।
কাননে কুঁড়িরে ঘিরি
পড়িতেছে ধীরি ধীরি
পৃথিবীর অতি মৃদু নিশ্বাসসমীর।
একই আনন্দে যেন গায় শত প্রাণ–
বাতাসের গান আর পাখিদের গান।
সাগরের জলরব
পাখিদের কলরব
এসেছে কোমল হয়ে স্তব্ধতার সংগীত-সমান।
২
আমি দেখিতেছি চেয়ে সমুদ্রের জলে
শৈবাল বিচিত্রবর্ণ ভাসে দলে দলে।
আমি দেখিতেছি চেয়ে
উপকূল-পানে ধেয়ে
মুঠি মুঠি তারাবৃষ্টি করে ঢেউগুলি।
বিরলে বালুকাতীরে
একা বসে রয়েছি রে,
চারি দিকে চমকিছে জলের বিজুলি।
তালে তালে ঢেউগুলি করিছে উত্থান–
তাই হতে উঠিতেছে কী একটি তান।
মধুর ভাবের ভরে
হৃদয় কেমন করে,
আমার সে ভাব আজি বুঝিবে কি আর কোনো প্রাণ।
৩
হায় মোর নাই আশা, নাইকো আরাম–
ভিতরে নাইকো শান্তি, বাহিরে বিরাম।
নাই সে সন্তোষধন
জ্ঞানী ঋষি যোগীগণ।
ধ্যানসাধনায় যাহা পায় করতলে–
আনন্দ-মগন-মন
করে তারা বিচরণ,
বিমল মহিমালোক অন্তরেতে জ্বলে।
নাই যশ, নাই প্রেম, নাই অবসর–
পূর্ণ করে আছে এরা সকলেরি ঘর।
সুখে তারা হাসে খেলে,
সুখের জীবন বলে–
আমার কপালে বিধি লিখিয়াছে আরেক অক্ষর।
৪
কিন্তু নিরাশাও শান্ত হয়েছে এমন
যেমন বাতাস এই, সলিল যেমন
মনে হয় মাথা থুয়ে
এইখানে থাকি শুয়ে
অতিশয় শ্রান্তকায় শিশুটির মতো।
কাঁদিয়া দুঃখের প্রাণ
করে দিই অবসান–
যে দুঃখ বহিতে হবে,বহিয়াছি কত।
আসিবে ঘুমের মতো মরণের কোল,
ধীরে ধীরে হিম হয়ে আসিবে কপোল।
মুমূর্ষু শ্রবণতলে
মিশাইবে পলে পলে
সাগরের অবিরাম একতান অন্তিম কল্লোল।
Shelley
শ্রাবণ, ১২৯১
বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ১০ (কেমনে কী হল পারি নে বলিতে)
কেমনে কী হল পারি নে বলিতে,
এইটুকু শুধু জানি–
নবীন কিরণে ভাসিছে সে দিন
প্রভাতের তনুখানি।
বসন্ত তখনো কিশোর কুমার,
কুঁড়ি উঠে নাই ফুটি,
শাখায় শাখায় বিহগ বিহগী
বসে আছে দুটি দুটি।
কী যে হয়ে গেল পারি নে বলিতে,
এইটুকু শুধু জানি–
বসন্তও গেল, তাও চলে গেল
একটি না কয়ে বাণী।
যা-কিছু মধুর সব ফুরাইল,
সেও হল অবসান–
আমারেই শুধু ফেলে রেখে গেল
সুখহীন ম্রিয়মাণ।
Christina Rossetti
কার্তিক, ১২৮৮
বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ১১ (রবির কিরণ হতে আড়াল করিয়া রেখে)
রবির কিরণ হতে আড়াল করিয়া রেখে
মনটি আমার আমি গোলাপে রাখিনু ঢেকে–
সে বিছানা সুকোমল, বিমল নীহার চেয়ে,
তারি মাঝে মনখানি রাখিলাম লুকাইয়ে।
একটি ফুল না নড়ে, একটি পাতা না পড়ে–
তবু কেন ঘুমায় না, চমকি চমকি চায়–
ঘুম কেন পাখা নেড়ে উড়িয়ে পালিয়ে যায়?
আর কিছু নয়, শুধু গোপনে একটি পাখি
কোথা হতে মাঝে মাঝে উঠিতেছে ডাকি ডাকি।
ঘুমা তুই, ওই দেখ বাতাস মুদেছে পাখা,
রবির কিরণ হতে পাতায় আছিস ঢাকা–
ঘুমা তুই, ওই দেখ তো চেয়ে দুরন্ত বায়
ঘুমেতে সাগর-‘পরে ঢুলে পড়ে পায় পায়।
দুখের কাঁটায় কি রে বিঁধিতেছে কলেবর?
বিষাদের বিষদাঁতে করিছে কি জরজর?
কেন তবে ঘুম তোর ছাড়িয়া গিয়াছে আঁখি?
কে জানে, গোপনে কোথা ডাকিছে একটি পাখি।
শ্যামল কানন এই মোহমন্ত্রজালে ঢাকা,
অমৃতমধুর ফল ভরিয়ে রয়েছে শাখা,
স্বপনের পাখিগুলি চঞ্চল ডানাটি তুলি
উড়িয়া চলিয়া যায় আঁধার প্রান্তর-‘পরে–
গাছের শিখর হতে ঘুমের সংগীত ঝরে।
নিভৃত কানন-‘পর শুনি না ব্যাধের স্বর,
তবে কেন এ হরিণী চমকায় থাকি থাকি।
কে জানে, গোপনে কোথা ডাকিছে একটি পাখি।
Swinburne
কার্তিক, ১২৮৮
বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ১২ (দেখিনু যে এক আশার স্বপন)
দেখিনু যে এক আশার স্বপন
শুধু তা স্বপন, স্বপনময়–
স্বপন বই সে কিছুই নয়।
অবশ হৃদয় অবসাদময়
হারাইয়া সুখ শ্রান্ত অতিশয়–
আজিকে উঠিনু জাগি
কেবল একটি স্বপন লাগি!
বীণাটি আমার নীরব হইয়া
গেছে গীতগান ভুলি,
ছিঁড়িয়া টুটিয়া ফেলেছি তাহার
একে একে তারগুলি।
নীরব হইয়া রয়েছে পড়িয়া
সুদূর শ্মশান-‘পরে,
কেবল একটি স্বপন-তরে!
থাম্ থাম্ ওরে হৃদয় আমার,
থাম্ থাম্ একেবারে,
নিতান্তই যদি টুটিয়া পড়িবি
একেবারে ভেঙে যা রে–
এই তোর কাছে মাগি।
আমার জগৎ, আমার হৃদয়–
আগে যাহা ছিল এখন তা নয়
কেবল একটি স্বপন লাগি।
Christina Rossetti
কার্তিক, ১২৮৮
বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ১৩ (নহে নহে এ মনে মরণ)
নহে নহে এ মনে মরণ।
সহসা এ প্রাণপূর্ণ নিশ্বাসবাতাস
নীরবে করে যে পলায়ন,
আলোতে ফুটায় আলো এই আঁখিতারা
নিবে যায় একদা নিশীথে,
বহে না রুধিরনদী, সুকোমল তনু
ধূলায় মিলায় ধরণীতে,
ভাবনা মিলায় শূন্যে, মৃত্তিকার তলে
রুদ্ধ হয় অময় হৃদয়–
এই মৃত্যু? এ তো মৃত্যু নয়।
কিন্তু রে পবিত্র শোক যায় না যে দিন
পিরিতির স্মিরিতিমন্দিরে,
উপেক্ষিত অতীতের সমাধির ‘পরে
তৃণরাজি দোলে ধীরে ধীরে,
মরণ-অতীত চির-নূতন পরান
স্মরণে করে না বিচরণ–
সেই বটে সেই তো মরণ!
Hood
বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ২ (সারাদিন গিয়েছিনু বনে)
সারাদিন গিয়েছিনু বনে
ফুলগুলি তুলেছি যতনে।
প্রাতে মধুপানে রত
মুগ্ধ মধুপের মতো
গান গাহিয়াছি আনমনে।
এখন চাহিয়া দেখি, হায়,
ফুলগুলি শুকায় শুকায়।
যত চাপিলাম মুঠি
পাপড়িগুলি গেল টুটি–
কান্না ওঠে, গান থেমে যায়।
কী বলিছ সখা হে আমার–
ফুল নিতে যাব কি আবার।
থাক্ বঁধু, থাক্ থাক্,
আর কেহ যায় যাক,
আমি তো যাব না কভু আর।
শ্রান্ত এ হৃদয় অতি দীন,
পরান হয়েছে বলহীন।
ফুলগুলি মুঠা ভরি
মুঠায় রহিবে মরি,
আমি না মরিব যত দিন।
Mrs. Browning
শ্রাবণ, ১২৯১
বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ৩ (আমায় রেখো না ধরে আর)
আমায় রেখো না ধরে আর,
আর হেথা ফুল নাহি ফুটে।
হেমন্তের পড়িছে নীহার,
আমায় রেখো না ধরে আর।
যাই হেথা হতে যাই উঠে,
আমার স্বপন গেছে টুটে।
কঠিন পাষাণপথে
যেতে হবে কোনোমতে
পা দিয়েছি যবে।
একটি বসন্তরাতে
ছিলে তুমি মোর সাথে–
পোহালো তো, চলে যাও তবে।
Ernest Myers
শ্রাবণ, ১২৯১
বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ৪ (প্রভাতে একটি দীর্ঘশ্বাস)
প্রভাতে একটি দীর্ঘশ্বাস
একটি বিরল অশ্রুবারি
ধীরে ওঠে, ধীরে ঝরে যায়,
শুনিলে তোমার নাম আজ।
কেবল একটুখানি লাজ–
এই শুধু বাকি আছে হায়।
আর সব পেয়েছে বিনাশ।
এক কালে ছিল যে আমারি
গেছে আজ করি পরিহাস।
Aubre De Vere
শ্রাবণ, ১২৯১
বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ৫ (গোলাপ হাসিয়া বলে, আগে বৃষ্টি যাক চলে)
১
গোলাপ হাসিয়া বলে, “আগে বৃষ্টি যাক চলে,
দিক দেখা তরুণ তপন–
তখন ফুটাব এ যৌবন।’
গেল মেঘ, এল উষা, আকাশের আঁখি হতে
মুছে দিল বৃষ্টিবারিকণা–
সে তো রহিল না।
কোকিল ভাবিছে মনে, “শীত যাবে কত ক্ষণে,
গাছপালা ছাইবে মুকুলে–
তখন গাহিব মন খুলে।’
কুয়াশা কাটিয়া যায়, বসন্ত হাসিয়া চায়,
কানন কুসুমে ভরে গেল–
সে যে মরে গেল!
২
এত শীঘ্র ফুটিলি কেন রে!
ফুটিলে পড়িতে হয় ঝরে–
মুকুলের দিন আছে তবু,
ফোটা ফুল ফোটে না তো আর।
বড়ো শীঘ্র গেলি মধুমাস,
দু দিনেই ফুরালো নিশ্বাস।
বসন্ত আবার আসে বটে,
গেল যে সে ফেরে না আবার।
Augusta Webster
শ্রাবণ, ১২৯১
বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ৬ (হাসির সময় বড়ো নেই)
হাসির সময় বড়ো নেই,
দু দণ্ডের তরে গান গাওয়া।
নিমেষের মাঝে চুমো খেয়ে
মুহূর্তে ফুরাবে চুমো খাওয়া।
বেলা নাই শেষ করিবারে
অসম্পূর্ণ প্রেমের মন্ত্রণা–
সুখস্বপ্ন পলকে ফুরায়,
তার পরে জাগ্রত যন্ত্রণা।
কিছু ক্ষণ কথা কয়ে লও,
তাড়াতাড়ি দেখে লও মুখ,
দু দণ্ডের খোঁজ দেখাশুনা–
ফুরাইবে খুঁজিবার সুখ।
বেলা নাই কথা কহিবারে
যে কথা কহিতে ফাটে প্রাণ।
দেবতারে দুটো কথা ব’লে
পূজার সময় অবসান।
কাঁদিতে রয়েছে দীর্ঘ দিন–
জীবন করিতে মরুময়,
ভাবিতে রয়েছে চিরকাল–
ঘুমাইতে অনন্ত সময়।
P. B. Marston
শ্রাবণ, ১২৯১
বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ৭ (বেঁচেছিল, হেসে হেসে)
বেঁচেছিল, হেসে হেসে
খেলা করে বেড়াত সে–
হে প্রকৃতি, তারে নিয়ে কী হল তোমার!
শত রঙ-করা পাখি,
তোর কাছে ছিল না কি–
কত তারা, বন, সিন্ধু, আকাশ অপার!
জননীর কোল হতে কেন তবে কেড়ে নিলি!
লুকায়ে ধরার কোলে ফুল দিয়ে ঢেকে দিলি!
শত-তারা-পুষ্প-ময়ী
মহতী প্রকৃতি অয়ি,
নাহয় একটি শিশু নিলি চুরি ক’রে–
অসীম ঐশ্বর্য তব
তাহে কি বাড়িল নব?
নূতন আনন্দকণা মিলিল কি ওরে?
অথচ তোমারি মতো বিশাল মায়ের হিয়া
সব শূন্য হয়ে গেল একটি সে শিশু গিয়া।
Victor Hugo
শ্রাবণ, ১২৯১
বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ৮ (নিদাথের শেষ গোলাপ কুসুম)
নিদাথের শেষ গোলাপ কুসুম
একা বন আলো করিয়া,
রূপসী তাহার সহচরীগণ
শুকায়ে পড়েছে ঝরিয়া।
একাকিনী আহা, চারি দিকে তার
কোনো ফুল নাহি বিকাশে,
হাসিতে তাহার মিশাইতে হাসি
নিশাস তাহার নিশাসে।
বোঁটার উপরে শুকাইতে তোরে
রাখিব না একা ফেলিয়া–
সবাই ঘুমায়, তুইও ঘুমাগে
তাহাদের সাথে মিলিয়া।
ছড়ায়ে দিলাম দলগুলি তোর
কুসুমসমাধিশয়নে
যেথা তোর বনসখীরা সবাই
ঘুমায় মুদিত নয়নে।
তেমনি আমার সখারা যখন
যেতেছেন মোরে ফেলিয়া
প্রেমহার হতে একটি একটি
রতন পড়িছে খুলিয়া,
প্রণয়ীহৃদয় গেল গো শুকায়ে
প্রিয়জন গেল চলিয়া–
তবে এ আঁধার আঁধার জগতে
রহিব বলো কী বলিয়া।
Moore
আষাঢ়, ১২৮৮
বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ৯ (ওই আদরের নামে ডেকো সখা মোরে)
ওই আদরের নামে ডেকো সখা মোরে!
ছেলেবেলা ওই নামে আমায় ডাকিত–
তাড়াতাড়ি খেলাধুলা সব ত্যাগ করে
অমনি যেতেম ছুটে,
কোলে পড়িতাম লুটে।
রাশি-করা ফুলগুলি পড়িয়া থাকিত।
নীরব হইয়া গেছে যে স্নেহের স্বর–
কেবল স্তব্ধতা বাজে
আজি এ শ্মশান-মাঝে
কেবল ডাকি গো আমি “ঈশ্বর ঈশ্বর’!
মৃত কণ্ঠে আর যাহা শুনিতে না পাই
সে নাম তোমারি মুখে শুনিবারে চাই।
হাঁ সখা, ডাকিয়ো তুমি সেই নাম ধরে–
ডাকিলেই সাড়া পাবে,
কিছু না বিলম্ব হবে,
তখনি কাছেতে যাব সব ত্যাগ করে।
Mrs. Browning
আষাঢ়, ১২৮৮
বিসর্জন (যে তোরে বাসেরে ভালো, তারে ভালোবেসে বাছা)
যে তোরে বাসেরে ভালো, তারে ভালোবেসে বাছা,
চিরকাল সুখে তুই রোস্।
বিদায়! মোদের ঘরে রতন আছিলি তুই,
এখন তাহারি তুই হোস্।
আমাদের আশীর্বাদ নিয়ে তুই যা রে
এক পরিবার হতে অন্য পরিবারে।
সুখ শান্তি নিয়ে যাস্ তোর পাছে পাছে,
দুঃখ জ্বালা রেখে যাস্ আমাদের কাছে।
হেথা রাখিতেছি ধরে, সেথা চাহিতেছে তোরে,
দেরী হ’ল, যা’ তাদের কাছে।
প্রাণের বাছাটি মোর, লক্ষ্মীর প্রতিমা তুই,
দুইটি কর্তব্য তোর আছে।
একটু বিলাপ যাস আমাদের দিয়ে,
তাহাদের তরে আশা যাস সাথে নিয়ে;
এক বিন্দু অশ্রু দিস আমাদের তরে,
হাসিটি লইয়া যাস তাহাদের ঘরে।
Victor Hugo
সম্মিলন (সেথায় কপোত-বধূ লতার আড়ালে)
সেথায় কপোত-বধূ লতার আড়ালে
দিবানিশি গাহে শুধু প্রেমের বিলাপ।
নবীন চাঁদের করে একটি হরিণী
আমাদের গৃহদ্বারে আরামে ঘুমায়।
তার শান্ত নিদ্রাকালে নিশ্বাস পতনে
প্রহর গণিতে পারি স্তব্ধ রজনীর।
সুখের আবাসে সেই কাটাব জীবন,
দুজনে উঠিব মোরা, দুজনে বসিব,
নীল আকাশের নীচে ভ্রমিব দুজনে,
বেড়াইব মাঠে মাঠে উঠিব পর্বতে
সুনীল আকাশ যেথা পড়েছে নামিয়া।
অথবা দাঁড়াব মোরা সমুদ্রের তটে,
উপলমণ্ডিত সেই স্নিগ্ধ উপকূল
তরঙ্গের চুম্বনেতে উচ্ছ্বাসে মাতিয়া
থর থর কাঁপে আর জ্বল’ জ্বল’ জ্বলে!
যত সুখ আছে সেথা আমাদের হবে,
আমরা দুজনে সেথা হব দুজনের,
অবশেষে বিজন সে দ্বীপের মাঝারে
ভালোবাসা, বেঁচে থাকা, এক হ’য়ে যাবে।
মধ্যাহ্নে যাইব মোরা পর্বতগুহায়,
সে প্রাচীন শৈল-গুহা স্নেহের আদরে
অবসান রজনীর মৃদু জোছনারে
রেখেছে পাষাণ কোলে ঘুম পাড়াইয়া।
প্রচ্ছন্ন আঁধারে সেথা ঘুম আসি ধীরে
হয়তো হরিবে তোর নয়নের আভা।
সে ঘুম অলস প্রেমে শিশিরের মতো।
সে ঘুম নিভায়ে রাখে চুম্বন-অনল
আবার নূতন করি জ্বালাবার তরে।
অথবা বিরলে সেথা কথা কব মোরা,
কহিতে কহিতে কথা, হৃদয়ের ভাব
এমন মধুর স্বরে গাহিয়া উঠিবে
আর আমাদের মুখে কথা ফুটিবে না।
মনের সে ভাবগুলি কথায় মরিয়া
আমাদের চোখে চোখে বাঁচিয়া উঠিবে!
চোখের সে কথাগুলি বাক্যহীন মনে
ঢালিবে অজস্র স্রোতে নীরব সংগীত,
মিলিবেক চৌদিকের নীরবতা সনে।
মিশিবেক আমাদের নিশ্বাসে নিশ্বাসে।
আমাদের দুই হৃদি নাচিতে থাকিবে,
শোণিত বহিবে বেগে দোঁহার শিরায়।
মোদের অধর দুটি কথা ভুলি গিয়া
ক’বে শুধু উচ্ছ্বসিত চুম্বনের ভাষা।
দুজনে দুজন আর রব না আমরা,
এক হয়ে যাব মোরা দুইটি শরীরে।
দুইটি শরীর? আহা তাও কেন হল?
যেমন দুইটি উল্কা জ্বলন্ত শরীর,
ক্রমশ দেহের শিখা করিয়া বিস্তার
স্পর্শ করে, মিশে যায়, এক দেহ ধরে,
চিরকাল জ্বলে তবু ভস্ম নাহি হয়,
দুজনেরে গ্রাস করি দোঁহে বেঁচে থাকে;
মোদের যমক-হৃদে একই বাসনা,
দণ্ডে দণ্ডে পলে পলে বাড়িয়া বাড়িয়া,
তেমনি মিলিয়া যাবে অনন্ত মিলন।
এক আশা রবে শুধু দুইটি ইচ্ছার
এই ইচ্ছা রবে শুধু দুইটি হৃদয়ে,
একই জীবন আর একই মরণ,
একই স্বরগ আর একই নরক,
এক অমরতা কিংবা একই নির্বাণ,
হায় হায় এ কী হল এ কী হল মোর!
আমার হৃদয় চায় উধাও উড়িয়া
প্রেমের সুদূর রাজ্যে করিতে ভ্রমণ,
কিন্তু গুরুভার এই মরতের ভাষা
চরণে বেঁধেছে তার লোহার শৃঙ্খল।
নামি বুঝি, পড়ি বুঝি, মরি বুঝি মরি।
Shelley
সূর্য ও ফুল (মহীয়সী মহিমার আগ্নেয় কুসুম)
মহীয়সী মহিমার আগ্নেয় কুসুম
সূর্য, ধায় লভিবারে বিশ্রামের ঘুম।
ভাঙা এক ভিত্তি-‘পরে ফুল শুভ্রবাস,
চারি দিকে শুভ্রদল করিয়া বিকাশ
মাথা তুলে চেয়ে দেখে সুনীল বিমানে
অমর আলোকময় তপনের পানে,
ছোটো মাথা দুলাইয়া কহে ফুল গাছে–
“লাবণ্য-কিরণ ছটা আমারো তো আছে।”
Victor Hugo