- বইয়ের নামঃ অনূদিত কবিতা
- লেখকের নামঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
কবি (ওই যেতেছেন কবি কাননের পথ দিয়া)
ওই যেতেছেন কবি কাননের পথ দিয়া,
কভু বা অবাক, কভু ভকতি-বিহ্বল হিয়া।
নিজের প্রাণের মাঝে
একটি যে বীণা বাজে,
সে বাণী শুনিতেছেন হৃদয় মাঝারে গিয়া।
বনে যতগুলি ফুল আলো করি ছিল শাখা,
কারো কচি তনুখানি নীল বসনেতে ঢাকা,
কারো বা সোনার মুখ,
কেহ রাঙা টুকটুক,
কারো বা শতেক রঙ যেন ময়ূরের পাখা,
কবিরে আসিতে দেখি হরষেতে হেলি দুলি
হাব ভাব করে কত রূপসী সে মেয়েগুলি।
বলাবলি করে, আর ফিরিয়া ফিরিয়া চায়,
“প্রণয়ী মোদের ওই দেখ লো চলিয়া যায়।”
সে অরণ্যে বনস্পতি মহান্ বিশাল-কায়া
হেথায় জাগিছে আলো, হোথায় ঘুমায় ছায়া।
কোথাও বা বৃদ্ধবট–
মাথায় নিবিড় জট;
ত্রিবলী অঙ্কিত দেহ প্রকাণ্ড তমাল শাল;
কোথাও বা ঋষির মতো
অশথের গাছ যত
দাঁড়ায়ে রয়েছে মৌন ছড়ায়ে আঁধার ডাল।
মহর্ষি গুরুরে হেরি অমনি ভকতিভরে
সসম্ভ্রমে শিষ্যগণ যেমন প্রণাম করে,
তেমনি করিবে দেখি গাছেরা দাঁড়াল নুয়ে,
লতা-শ্মশ্রুময় মাথা ঝুলিয়া পড়িল ভুঁয়ে।
একদৃষ্টে চেয়ে দেখি প্রশান্ত সে মুখচ্ছবি,
চুপি চুপি কহে তারা “ওই সেই। ওই কবি।”
Victor Hugo
কোনো জাপানি কবিতার ইংরাজি অনুবাদ হইতে (বাতাসে অশথপাতা পড়িছে খসিয়া)
বাতাসে অশথপাতা পড়িছে খসিয়া,
বাতাসেতে দেবদারু উঠিছে শ্বসিয়া।
দিবসের পরে বসি রাত্রি মুদে আঁখি,
নীড়েতে বসিয়া যেন পাহাড়ের পাখি।
শ্রান্ত পদে ভ্রমি আমি নগরে নগরে
বিজন অরণ্য দিয়া পর্বতে সাগরে।
উড়িয়া গিয়াছে সেই পাখিটি আমার,
খুঁজিয়া বেড়াই তারে সকল সংসার।
দিন রাত্রি চলিয়াছি, শুধু চলিয়াছি–
ভুলে যেতে ভুলিয়া গিয়াছি।
আমি যত চলিতেছি রোদ্র বৃষ্টি বায়ে
হৃদয় আমার তত পড়িছে পিছায়ে।
হৃদয় রে, ছাড়াছাড়ি হল তোর সাথে–
এক ভাব রহিল না তোমাতে আমাতে।
নীড় বেঁধেছিনু যেথা যা রে সেইখানে,
একবার ডাক্ গিয়ে আকুল পরানে।
কে জানে, হতেও পারে, সে নীড়ের কাছে
হয়তো পাখিটি মোর লুকাইয়ে আছে।
কেঁদে কেঁদে বৃষ্টিজলে আমি ভ্রমিতেছি–
ভুলে যেতে ভুলিয়ে গিয়েছি।
দেশের সবাই জানে কাহিনী আমার।
বলে তারা, “এত প্রেম আছে বা কাহার!’
পাখি সে পলায়ে গেছে কথাটি না ব’লে,
এমন তো সব পাখি উড়ে যায় চলে।
চিরদিন তারা কভু থাকে না সমান
এমন তো কত শত রয়েছে প্রমাণ।
ডাকে আর গায় আর উড়ে যায় পরে,
এ ছাড়া বলো তো তারা আর কী বা করে?
পাখি গেল যার, তার এক দুঃখ আছে–
ভুলে যেতে ভুলে সে গিয়াছে!
সারা দিন দেখি আমি উড়িতেছে কাক,
সারা রাত শুনি আমি পেচকের ডাক।
চন্দ্র উঠে অস্ত যায় পশ্চিমসাগরে,
পূরবে তপন উঠে জলদের স্তরে।
পাতা ঝরে, শুভ্র রেণু উড়ে চারি ধার–
বসন্তমুকুল এ কি? অথবা তুষার?
হৃদয়, বিদায় লই এবে তোর কাছে–
বিলম্ব হইয়া গেল, সময় কি আছে?
শান্ত হ’রে, একদিন সুখী হবি তবু–
মরণ সে ভুলে যেতে ভোলে না তো কভু!
আষাঢ়, ১২৮৮
তারা ও আঁখি (কাল সন্ধ্যাকালে ধীরে সন্ধ্যার বাতাস)
কাল সন্ধ্যাকালে ধীরে সন্ধ্যার বাতাস
বহিয়া আনিতেছিল ফুলের সুবাস।
রাত্রি হ’ল, আঁধারের ঘনীভূত ছায়ে
পাখিগুলি একে একে পড়িল ঘুমায়ে।
প্রফুল্ল বসন্ত ছিল ঘেরি চারি ধার
আছিল প্রফুল্লতর যৌবন তোমার,
তারকা হাসিতেছিল আকাশের মেয়ে,
ও আঁখি হাসিতেছিল তাহাদের চেয়ে।
দুজনে কহিতেছিনু কথা কানে কানে,
হৃদয় গাহিতেছিল মিষ্টতম তানে।
রজনী দেখিনু অতি পবিত্র বিমল,
ও মুখ দেখিনু অতি সুন্দর উজ্জ্বল।
সোনার তারকাদের ডেকে ধীরে ধীরে,
কহিনু, “সমস্ত স্বর্গ ঢাকলো এর শিরে!”
বলিনু আঁখিরে তব “ওগো আঁখি-তারা,
ঢালো গো আমার পরে প্রণয়ের ধারা।”
Victor Hugo
বিদেশী ফুলের গুচ্ছ – ১ (মধুর সূর্যের আলো, আকাশ বিমল)
মধুর সূর্যের আলো, আকাশ বিমল,
সঘনে উঠিছে নাচি তরঙ্গ উজ্জ্বল।
মধ্যাহ্নের স্বচ্ছ করে
সাজিয়াছে থরে থরে
ক্ষুদ্র নীল দ্বীপগুলি, শুভ্র শৈলশির।
কাননে কুঁড়িরে ঘিরি
পড়িতেছে ধীরি ধীরি
পৃথিবীর অতি মৃদু নিশ্বাসসমীর।
একই আনন্দে যেন গায় শত প্রাণ–
বাতাসের গান আর পাখিদের গান।
সাগরের জলরব
পাখিদের কলরব
এসেছে কোমল হয়ে স্তব্ধতার সংগীত-সমান।
২
আমি দেখিতেছি চেয়ে সমুদ্রের জলে
শৈবাল বিচিত্রবর্ণ ভাসে দলে দলে।
আমি দেখিতেছি চেয়ে
উপকূল-পানে ধেয়ে
মুঠি মুঠি তারাবৃষ্টি করে ঢেউগুলি।
বিরলে বালুকাতীরে
একা বসে রয়েছি রে,
চারি দিকে চমকিছে জলের বিজুলি।
তালে তালে ঢেউগুলি করিছে উত্থান–
তাই হতে উঠিতেছে কী একটি তান।
মধুর ভাবের ভরে
হৃদয় কেমন করে,
আমার সে ভাব আজি বুঝিবে কি আর কোনো প্রাণ।
৩
হায় মোর নাই আশা, নাইকো আরাম–
ভিতরে নাইকো শান্তি, বাহিরে বিরাম।
নাই সে সন্তোষধন
জ্ঞানী ঋষি যোগীগণ।
ধ্যানসাধনায় যাহা পায় করতলে–
আনন্দ-মগন-মন
করে তারা বিচরণ,
বিমল মহিমালোক অন্তরেতে জ্বলে।
নাই যশ, নাই প্রেম, নাই অবসর–
পূর্ণ করে আছে এরা সকলেরি ঘর।
সুখে তারা হাসে খেলে,
সুখের জীবন বলে–
আমার কপালে বিধি লিখিয়াছে আরেক অক্ষর।
৪
কিন্তু নিরাশাও শান্ত হয়েছে এমন
যেমন বাতাস এই, সলিল যেমন
মনে হয় মাথা থুয়ে
এইখানে থাকি শুয়ে
অতিশয় শ্রান্তকায় শিশুটির মতো।
কাঁদিয়া দুঃখের প্রাণ
করে দিই অবসান–
যে দুঃখ বহিতে হবে,বহিয়াছি কত।
আসিবে ঘুমের মতো মরণের কোল,
ধীরে ধীরে হিম হয়ে আসিবে কপোল।
মুমূর্ষু শ্রবণতলে
মিশাইবে পলে পলে
সাগরের অবিরাম একতান অন্তিম কল্লোল।
Shelley
শ্রাবণ, ১২৯১