- বইয়ের নামঃ জোছনা ও জননীর গল্প
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, মুক্তিযুদ্ধের-বই, ইতিহাস
পূর্বকথা
পূর্বকথা
মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন আমার বয়স তেইশ। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। কেমিস্ট্রিতে অনার্স থিয়োরি পরীক্ষা দিয়েছি, প্রাকটিক্যাল পরীক্ষার জন্যে অপেক্ষা। সুন্দর সময় কাটছে। আর মাত্র এক বৎসর–M.Sc পাশ করে ফেলব। ইউনিভার্সিটিতে লেকচারার হিসেবে যোগ দেব। পিএইচডি করতে যাব দেশের বাইরে।
গল্প-উপন্যাসে আদর্শ ভালো ছাত্রের কিছু চিত্র আঁকা হয়। আমি ছিলাম। সে রকম একজন। আদর্শ ভালো ছাত্রের বন্ধু-বান্ধব থাকবে না, আমার ছিল না। তাদের সময় কাটবে বই পড়ে – আমারও তাই কাটে। উনসত্ত্বরের গণআন্দোলনের অতি উত্তেজনাময় সময়ে আমি ছিলাম উত্তেজনামুক্ত তরুণ যুবক, যার একমাত্র বিনোদন পাবলিক লাইব্রেরিতে গল্পের বই পড়া। শরিফ মিয়ার ক্যান্টিনে চা খাওয়া, মাঝে-মধ্যে বাংলা একাডেমীতে উঁকি দেয়া। সেখানে প্রায়ই গানের আসর হতো।
যেখানেই থাকি সন্ধ্যার আগে আগে মহসিন হলে নিজের ঘরে ফিরে আসতাম। ভালো ছাত্র হিসেবে সেখানে আমি একটি সিঙ্গেল সিটের রুম পেয়েছিলাম। নানান ধরনের বই দিয়ে রুম ভর্তি করে ফেলেছিলাম। গানের প্রতি আমার প্রবল দুর্বলতা দেখে বাবা আমাকে একটা রেকর্ড প্লেয়ার কিনে দিয়েছিলেন। বাইরে যখন ভয়াবহ আন্দোলন চলছে, তখন আমি দরজা বন্ধ করে গান শুনছি–কেন পান্থ এ চঞ্চলতা?
আমার সাজানো অতি পরিচিত ভুবন পুরোপুরি ভেঙে পড়ল ১৯৭১ সনে। যে পরিস্থিতিতে আমি পড়লাম, তার জন্যে কোনোরকম মানসিক প্ৰস্তুতি আমার ছিল না! ছায়াঘেরা শান্ত দিঘির একটা মাছ কি হঠাৎ যেন নিয়ে যাওয়া হলো চৈত্রের দাবদাহে ঝলসে যাওয়া স্থলভূমিতে। কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা! ভাইবোন নিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পালাচ্ছি। জীবন বাঁচানোর জন্যে মাদ্রাসার ছাত্র হিসেবে ভর্তি হতে গেছি শর্ষিনার পীর সাহেবের মাদ্রাসায়। পাকিস্তান মিলিটারি মাথায় গুলির বাক্স তুলে দিয়েছে। অকল্পনীয় ওজনের গুলির বাক্স মাথায় নিয়ে সৈন্যদের সঙ্গে বারহাট্টা থেকে হেঁটে হেঁটে এসেছি নেত্রকোনা পর্যন্ত। মিলিটারির বন্দিশিবিরে কাটল কিছু সময়। কী ভয়ঙ্কর অত্যাচার! এক সকালে মিলিটারিদের একজন এসে আমার হাতে বিশাল সাইজের একটা সাগরকলা ধরিয়ে দিয়ে বলল, তোমাকে কাল সকালে গুলি করে মারা হবে। এটা তোমার জন্যে ভালো। তুমি যদি নিরপরাধ হও, সরাসরি বেহেশতে চলে যাবে। আর যদি অপরাধী হও, তাহলে মৃত্যু তোমার প্রাপ্য শাস্তি।
এইসব ঘটনা আমি নানান সময়ে নানান পত্র-পত্রিকায় লিখেছি। মুক্তিযুদ্ধের আনন্দ, বেদনা, হতাশা, গ্লানি নিয়ে বেশ কিছু ছোটগল্প লিখেছি। কয়েকটা উপন্যাসও লিখেছি। একসময় মনে হলো, মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় ধরে রাখার জন্যে একটা উপন্যাস লেখা উচিত। মানুষকে যেমন পিতৃঋণ-মাতৃঋণ শোধ করতে হয়, দেশমাতার ঋণও শোধ করতে হয়। একজন লেখক সেই ঋণ শোধ করেন লেখার মাধ্যমে।
লেখা শুরু করলাম। জোছনা ও জননীর গল্প ধারাবাহিকভাবে ভোরের কাগজে ছাপা হতে লাগল। আমি কখনোই কোনো ধারাবাহিক লেখা শেষ করতে পারি না। এটিও পারলাম না। ছয়-সাত কিস্তি লিখে লেখা বন্ধ করে দিলাম। দুবছর পর আবার শুরু করলাম। আবারো কয়েক কিস্তি লিখে লেখা বন্ধ। আর লেখা হয় না। অন্য লেখা লিখি, নাটক বানাই, সিনেমা বানাই, মুক্তিযুদ্ধের লেখাটা আর ধরা হয় না। মাঝে মাঝে খুব খারাপ লাগে–তখন নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দেই যে, লিখব একদিন লিখব। ব্যস্ততা কমলেই লেখা শুরু করব। এখনো সময় আছে। অনেক সময়।
একদিন হঠাৎ টের পেলাম অনেক সময় আমার হাতে নেই। সময় শেষ হয়ে গেছে। জোছনা ও জননীর গল্প আর লেখা হবে না। তখন আমি শুয়ে আছি সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হসপিটালের একটা ট্রলিতে। দুজন নার্সট্রিলি ঠেলে আমাকে অপারেটিং টেবিলে নিয়ে যাচ্ছেন। ওপেন হার্ট সার্জারি হবে। আমাকে একটা ঘুমের ইনজেকশন দেয়া হয়েছে। চোখের পাতা ভারী হতে শুরু করেছে। হাসপাতালের আলোর তীব্ৰতা দ্রুত কমে যাচ্ছে।
যখন অচেতন হতে শুরু করেছি, তখন মনে হলো জোছনা ও জননীর গল্প তো লেখা হলো না। আমাকে যদি আর একবার পৃথিবীতে ফিরে আসার সুযোগ দেয়া হয়–আমি এই লেখাটি অবশ্যই শেষ করব। অচেতন হবার আগ মুহুর্তে হঠাৎ আনন্দে অভিভূত হলাম। কারণ তখনই প্রথম টের পেলাম আমি আসলেই একজন লেখক। মৃত্যুর খুব কাছাকাছি যাবার আগের মুহূর্তে অসমাপ্ত লেখার চিন্তাই ছিল আমার একমাত্র চিন্তা।
দেশে ফিরে লেখায় হাত দিলাম। শরীর খুব দুর্বল। দিনে দুই তিন পাতার বেশি লিখতে পারি না। এইভাবেই লেখা শেষ করেছি। এখন আমার কাছে মনে হচ্ছে, আমি দেশমাতার ঋণ শোধ করার চেষ্টা করেছি। এই আনন্দের কোনো সীমা নেই।
জোছনা ও জননীর গল্প কোনো ইতিহাসের বই না, এটা একটা উপন্যাস। তারপরেও ইতিহাসের খুব কাছাকাছি থাকার চেষ্টা আমি করেছি। সেখানেও ভুল-ভ্রান্তি হতে পারে। হওয়াটাও স্বাভাবিক। উপন্যাস যেহেতু কোনো আসমানী কিতাব না, এইসব ভুল-ভ্ৰান্তি দূর করার উপায় আছে।
উপন্যাসে চরিত্র হিসেবে সেই সময়ের অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু মানুষজন এনেছি। এই স্বাধীনতা একজন ঔপন্যাসিকের আছে। গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের চরিত্র ফুটিয়ে তোলায় কোনো ভুল। যদি করে থাকি, তার জন্যে আগেভাগেই ক্ষমা চাচ্ছি। অতি বিনয়ের সঙ্গে সেই বিখ্যাত উক্তি মনে করিয়ে দিচ্ছি–একজন লেখক যা লিখবেন, সেটাই সত্যি।
সেই সত্য যা রচিবে তুমি, ঘটে যা তা সব সত্য নহে।
কবি, তব মনোভূমি রামের জনম স্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।।
উপন্যাসে বর্ণিত প্ৰায় সব ঘটনাই সত্যি। কিছু নিজের অভিজ্ঞতা থেকে লেখা। কিছু অন্যের অভিজ্ঞতা থেকে ধার নেয়া। প্রকাশিত হবার আগেই এই উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি অনেককে পড়িয়েছি। যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখে নি (এই প্রজন্মের পাঠকদের কথা বলছি)। তারা পড়ার পর বলেছে–উপন্যাসের অনেক ঘটনাই তাদের কাছে কাল্পনিক বলে মনে হচ্ছে, এরকমও কি হয়?
তাদের কাছে আমার একটাই কথা–সে বড় অদ্ভুত সময় ছিল। স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের মিশ্র এক জগৎ। সবই বাস্তব, আবার সবই অবাস্তব। আমি সেই ভয়ঙ্কর সুন্দর সুররিয়েলিস্টিক সময় পার করে এসেছি। তার খানিকটাও যদি ধরে থাকতে পারি, তাহলেই আমার মানবজীবন ধন্য।
জোছনা ও জননীর গল্প বইটি লেখার ব্যাপারে নানান তথ্য দিয়ে যারা আমাকে সাহায্য করেছেন তাদের সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ। মুক্তিযুদ্ধের উপর প্রকাশিত বইগুলি আমাকে খুব সাহায্য করেছে। বিশেষ করে উল্লেখ করছি। রবীন্দ্রনাথ ত্ৰিবেদীর লেখা ৭০১-এর দশমাস গ্রন্থটি। দীর্ঘ দশমাসের প্রতিদিনের ঘটনা তিনি খুব সুন্দর করে সাজিয়েছেন। লেখকলেখিকাদের ডায়েরির মতো লেখা বইগুলিও আমাকে সাহায্য করেছে। ঢাকা শহরে প্রতিদিন কী ঘটছিল ডায়েরি পড়ে তা বোঝা যাচ্ছিল। তবে এই প্রসঙ্গে ছোট্ট একটা খটকার কথাও বলি। ডায়েরি জাতীয় গ্রন্থগুলি পড়ে আমার মনে হয়েছে সেগুলি তখনকার লেখা না। পরে তারিখ দিয়ে সাজানো হয়েছে। কারণ একজন কোনো একটি বিশেষ দিনে লিখছেন–ঢাকা শহরে সকাল থেকেই প্ৰবল বর্ষণ, আরেকজন একই দিনে লিখছেন–কঠিন রোদ। রোদে ঢাকা শহর ঝলসে যাচ্ছে। একজন লিখছেন–এই মাত্র খবর পেলাম প্ৰবাসী সরকার শপথ নিয়েছে। অথচ শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হয়েছে তার দুদিন পরে। ডায়েরি রচনায় রাজনৈতিক মতাদর্শও কাজ করেছে। কারো কারো ডায়রিতে প্রতিদিনকার সমস্ত খুঁটিনাটি আছে, কিন্তু জিয়াউর রহমান নামের একজন মেজর যিনি কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার যুদ্ধে সবাইকে আহবান করেছেন সেই উল্লেখ নেই। তাঁর নামটিও নেই।
জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের বিখ্যাত ভাষণ প্রসঙ্গেও একই ব্যাপার। জাস্টিস মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সাহেবের বিখ্যাত গ্ৰন্থ বাংলাদেশের তারিখ প্রথম সংস্করণে তিনি উল্লেখ করেছেন ভাষণের শেষে শেখ মুজিবুর রহমান বললেন, জয় বাংলা। জিয়ে পাকিস্তান। দ্বিতীয় সংস্করণে তিনি জিয়ে পাকিস্তান অংশটি বাদ দিলেন। কবি শামসুর রহমানের লেখা আত্মজীবনী যা দৈনিক জনকণ্ঠে কালের ধূলোয় লেখা শিরোনামে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে সেখানেও তিনি বলেছেন শেখ মুজিবুর রহমানের শেষ কথা ছিল জিয়ে পাকিস্তান। আরো অনেকের কাছে আমি এ ধরনের কথা শুনেছি, যারা আওয়ামী ভাবধারার মানুষ। সমস্যা হলো আমি নিজে ৮ এবং ৯ মার্চের সমস্ত পত্রিকা খুঁজে এরকম কোনো তথ্য পাই নি। তাহলে একটি ভুল ধারণা কেন প্রবাহিত হচ্ছে?
বঙ্গবন্ধু যদি জিয়ে পাকিস্তান বলে থাকেন তাহলে তাতে দোষের কিছু নেই। তিনি যা বলেছেন। অবশ্যই ভেবে চিন্তেই বলেছেন। পাকিস্তানের সঙ্গে তাঁর আলোচনার পথ খোলা রাখতে হবে। তাকে সময় নিতে হবে। ৭ই মার্চে যুদ্ধ ঘোষণার মতো অবস্থা তাঁর ছিল না। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ গেটেসবার্গ এড্রেসের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি। এখানে কোনো অস্পষ্টতা থাকা বাঞ্ছনীয় না।
বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের দলিলের পনেরো খণ্ডের মধ্যে সাতটি খণ্ড আমি মন দিয়ে পড়েছি। আমার উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের দলিল থেকে সরাসরি অনেক অংশ ব্যবহার করেছি। এই দলিল নিয়েও আমার কিছু খটকা আছে। একটি শুধু বলি–রাজারবাগ পুলিশ লাইনে বন্দি তরুণীদের উপরে নির্যাতনের সাক্ষ্য গ্রন্থাবদ্ধ করা হয়েছে। বলা হচ্ছে তাদেরকে পায়ে দড়ি বেঁধে বুলিয়ে রাখা হতো। যে তরুণীদের রাখা হয়েছে ভোগের জন্যে তাদেরকে এভাবে বুলিয়ে রাখার পেছনের যুক্তি আমার কাছে পরিষ্কার না। তারপরেও ধরে নিলাম। তাই করা হয়েছে। যা আমার কাছে একেবারেই গ্রহণযোগ্য না। তা হলো সাক্ষ্যদানকারী বলছেন এইসব তরুণীদের সঙ্গে বই-খাতা-কলম ছিল। অর্থাৎ স্কুল বা কলেজে যাবার পথে তাদের ধরা হয়েছে। যে ভয়ঙ্কর সময়ের কথা বলা হচ্ছে সে-সময় স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটি সবই বন্ধ। বইখাতা নিয়ে কারো বাইরে যাবার প্রশ্নই উঠে না। আমার ধারণা সাক্ষ্যপ্রমাণমূলক তথ্যগুলি ভালোমতো যাচাই করা হয় নি। তাছাড়া জাতিগতভাবেও আমরা অতিকথন পছন্দ করি।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর কার্যক্রম ছোট করে দেখানোর একটি প্রবণতাও আমাদের আছে। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পর কেউ যদি বাংলাদেশে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস এবং ছোটগল্প পড়ে যুদ্ধ সম্পর্কে ধারণা করতে চায় তাহলে তারা ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিষয়ে কিছুই জানবে না। আমাদের গল্প উপন্যাসে বিদেশী সৈন্যবাহিনীর বিষয় সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। লেখকরা হয়তো ভেবেছেন এতে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের গৌরবের হানি হবে।
ঋণ স্বীকারে অগৌরবের কিছু নেই। মহান জাতি এবং মহান মানুষরাই ঋণ স্বীকার করেন। আমি আমার বইটিতে আমাদের দেশের স্বাধীনতার জন্যে যেসব ভারতীয় সৈন্য প্ৰাণ দিয়েছিল তাদেরে একটি তালিকা দিতে চেয়েছিলাম, যাতে পাঠকরা এই দীর্ঘ তালিকা পড়ে একবার শুধু বলেন–আহারে!
তালিকা শেষপর্যন্ত দিলাম না, কারণ তাতে বইয়ের পৃষ্ঠাসংখ্যা আরো একশ বাড়ত। তাছাড়া এই তালিকা যুক্ত করলে অবশ্যই যুদ্ধে শহীদ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, সেসময়কার ইপিআর (বর্তমান বিডিআর), পুলিশ বাহিনী, আনসার বাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা দিতে হতো। আপনারা শুনে বিক্ষিত হবেন, পূর্ণাঙ্গ তালিকা আমাদের হাতে নেই। এখনো তৈরি হচ্ছে। তেত্রিশ বছর আগে যুদ্ধ শেষ হয়েছে। তালিকা তৈরির কাজ শেষ হয় নি। কবে শেষ হবে?
বীরশ্ৰেষ্ঠ তালিকার দিকে আমি প্রায়ই তাকাই। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলি। এই তালিকায় একজনও বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা নেই। অথচ আমি জানি এবং খেতাব যারা দিয়েছেন তারাও জানেন, বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই অসাধারণ সাহস দেখিয়েছেন। যুদ্ধের ট্রেনিং বা অভিজ্ঞতা ছাড়াই তারা যা করেছেন তার তুলনা হবে না। অথচ এরা কেউ স্বীকৃতি পান না। কেন না?
আমার এই বইটির অসম্পূর্ণতার মধ্যে একটি হলো আমি পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা অত্যাচারিত নারীদের বিষয়টি আনতে পারি নি। বিষয়টি এতই স্পর্শকাতর এবং এতই কষ্টকর যে কিছুতেই লিখতে পারলাম না। আশা করছি। অন্যরা লিখবেন। তাদের কলমে এইসব হতভাগ্য তরুণীর অশ্রুজল উঠে আসবে।
এখন নিতান্তই ব্যক্তিগত একটি বিষয় উল্লেখ করি, আজ থেকে প্রায় কুড়ি বছর আগে আমার জন্মদিনে গুলতেকিনে আমাকে একটা খাতা উপহার দিয়েছিল। স্পাইরেল বাইন্ডিং করা পাঁচশ পৃষ্ঠার নীল মলাটের খাতা। তার অনুরোধ ছিল প্রতিদিন এক পৃষ্ঠা করে হলেও যেন আমি খাতাটায় মুক্তিযুদ্ধের একটা বড় উপন্যাস লিখি।
সারা জীবনই গুলতেকিনকে অসুখী করেছি। মনে হয় আজ সে খুশি হবে। পরম করুণাময় আমাকে এই গ্রন্থটি লেখার সুযোগ করে দিয়েছেন। তাঁর প্রতি জানাচ্ছি। আমার অসীম কৃতজ্ঞতা। দল-মত-ধর্ম সবকিছুর উর্ধে একটি সুখী সুন্দর বাংলাদেশের কামনা করে পূর্বকথা শেষ করছি।
হুমায়ূন আহমেদ
নুহাশপল্পী, গাজীপুর
দ্বিতীয় সংস্করণের শুদ্ধি অভিযান
জোছনা ও জননীর গল্প নির্ভুল করার চেষ্টা হিসেবে শুদ্ধি অভিযান চালানো হয়েছে। এ ব্যাপারে আমাকে সবচে বেশি সাহায্য করেছেন মুক্তিযোদ্ধা, গবেষক ও লেখক মেজর (অব) কামরুল হাসান ভূইয়া। আমি জানতাম না যে ৩৬তম ডিভিশন হয় না। তম বাদ যাবে, কিংবা আর্মড পুলিশ ব্যাটেলিয়ান হবে না। ব্যাটেলিয়ান স্বাধীনতার পরে হয়েছে। শুদ্ধ পাঠ হবে আর্মড পুলিশ। মেঘালয়ের বাংলাদেশ হাসপাতাল হবে না। হবে ত্রিপুরায় বাংলাদেশ হাসপাতাল। এই ভুলটি বেশ বড় ভুল। হারুন হাবীবের লেখায় ডা. সিতারা বেগম বীর প্রতীকের আত্মজৈবনিক অংশে তিনি লিখেছেন মেঘালয়ে বাংলাদেশ হাসপাতাল। আমি সরাসরি সেই লেখা উদ্ধৃত করেছি বলে ভুলটি হয়েছে। ৩ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বেতার টেলিভিশনে যে ভাষণ দিয়েছেন বলে আমি লিখেছি সেটাও ভুল। তিনি কোনো ভাষণ দেন নি, তাঁর বিবৃতি পাঠ করা হয়েছে। যদিও রবীন্দ্রনাথ ত্ৰিবেদী তীর বহুল পঠিত গ্রন্থে ভাষণের কথা বলেছেন। সূত্র হিসেবে দৈনিক পাকিস্তান উল্লেখ করেছেন। আমি রবীন্দ্রনাথ ত্ৰিবেদীর ভাষাটাই নিয়েছিলাম।
প্ৰথম দফা শুদ্ধি অভিযানের পর আমি আরো একটি শুদ্ধি অভিযানের জন্যে অপেক্ষা করছি।
আমার ছোটভাই ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বইটিতে বৈজ্ঞানিক তথ্যের একটি ভুল বের করেছে। যে সময়ের কথা বইটিতে আছে সে সময়ে আকাশে কালপুরুষ থাকে না। এই ভুলটি শুদ্ধ করলাম না। কালপুরুষে যে রহস্যময়তা আছে। অন্য তারামণ্ডলীতে সেই রহস্যময়তা নেই।
থাকুক কিছু ভুল। খাদবিহীন গয়নায় অলংকার হয় না। চাঁদের সৌন্দর্যের একটি কারণ তার কলঙ্ক।
হুমায়ূন আহমেদ
নুহাশপল্পী, গাজীপুর
মাওলানা ইরতাজউদ্দিন কাশেমপুরী
নীলগঞ্জ হাইস্কুলের আরবি শিক্ষক মাওলানা ইরতাজউদ্দিন কাশেমপুরী কমলাপুর রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর বয়স প্রায় ষাট। স্থূলকায় বেঁটেখাটো মানুষ। মুখভর্তি দাড়ি। দাড়ির রঙ সাদাও না কালোও না। সাদাকালোর মাঝামাঝি। মাথা সম্পূর্ণ কামানো। জুম্মাবার সকালে নাপিত এসে তাঁর মাথা কামিয়ে দিয়ে যায়। কামানো মাথায় না-কি পাগড়ি পরতে সুবিধা। শুক্রবারে তিনি পাগড়ি পরেন। চোখে সুরমা দেন। কানের লতিতে সামান্য আন্তর দেন। জানু পর্যন্ত লম্বা পিরান। পরে জুম্মার নামাজে ইমামতি করতে যান। গত পনেরো বছর ধরেই তিনি এই কাজ করছেন। নীলগঞ্জ জুমা মসজিদের আলাদা ইমাম আছে। শুধু জুম্মার নামাজের দায়িত্ব তিনি পালন করেন।
ইরতাজউদ্দিন কাশেমপুরীর হাতে ধবধবে সাদা রঙের একটা রাজহাঁস। তিনি ডান হাতে রাজহাঁসের গলা চেপে ধরে আছেন। রাজহাঁস ছটফট করছে, পাখা ঝাপটাচ্ছে। কাশেমপুরীর মুখ থমথম করছে, কারণ ট্রেন থেকে নামার সময় এই বিশাল পক্ষী ঠোকর দিয়ে তাঁর কনুই থেকে রক্ত বের করে দিয়েছে। তাঁকে ঘিরে ছােটখাটো ভিড়। জনতা কৌতূহল নিয়ে অপেক্ষা করছে। কাশেমপুরী ও তার রাজহঁ ন জনতার মধ্যে একধরনের আনন্দ মিশ্ৰিত আগ্ৰহ জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে।
ইরতাজউদ্দিন গম্ভীর গলায় বললেন, ব্যাপারটা কী? আপনারা রাজহাঁস। এর আগে দেখেন নাই? যান যান, কাজে যান। অকাজে সময় নষ্ট করছেন কেন? আপনাদের কোনো কাজ নাই?
কাজে যাওয়ার প্রতি কারো কোনো আগ্রহ দেখা গেল না, কিংবা কারো হয়তো কোনো কাজ নেই। তারা ইরতাজউদ্দিনকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রইল। তাদের সঙ্গে আবো কয়েকজন যুক্ত হলো। এই পর্যায়ে রাজহাঁস আরেকবার ঠোকর দিল। সেই আগের জায়গায়, বা হাতের কনুইয়ে। ইরতাজউদ্দিন বাপ রে! বলে প্রায় লাফিয়ে উঠলেন। জনতার আনন্দের সীমা রইল না। তাদের প্রতীক্ষ্ণ বৃথা যায় নি। এতক্ষণে দেখার মতো ঘটনা ঘটেছে। ইরতাজউদ্দিন বিস্মিত হয়ে ভাবলেন, মানুষ তার নিজ প্রজাতির দুঃখ-কষ্টে এত আনন্দিত হয় কেন? তিনি ব্যথা পেয়েছেন। এতে অন্যরা আনন্দিত হবে কেন? এর মধ্যে রহস্যটা কী? ঠাণ্ডা মাথায় ব্যাপারটা নিয়ে একসময় ভাবতে হবে। এখন কিছুই ভাবা যাবে না। মাথা গরম হয়ে আছে। এর মধ্যে একজন উপদেশ দিতে এগিয়ে এলো। গম্ভীর গলায় উপদেশ দিল। জাতি হিসেবে বাঙালির উপদেশগ্ৰীতি আছে।
চাচামিয়া, ঠোঁট চাইপ্যা ধরেন। ঠোঁট চাইপ্যা ধরলে আর ঠোকর দিব না।
ইরতাজউদ্দিন ক্লান্ত গলায় বললেন, আমার যা করার আমি করব। এ নিয়ে আপনাকে মাথা ঘামাতে হবে না। আপনি কথা বলবেন না।
উপদেশদাতার উৎসাহ তাতে কমল না। সে জনতার দিকে তাকিয়ে বলল, জোড়া সাথে না থাকনে এই অবস্থা। জোড়া সাথে থাকলে রাজহাঁস শান্ত থাকে। মাওলানা সাব, এর জোড়াটা কই?
ইরতাজউদ্দিন কটমট করে তার দিকে তাকালেন। জবাব দিলেন না।
ফাল্লুন মাসের শুরু। রাত এগারোটার মতো বাজে। গ্রামে এই সময়ে শীত থাকে। নীলগঞ্জে তাঁকে কাঁথা গায়ে দিয়ে ঘুমুতে হয়। এখানে ভ্যাপসা গরম। আকাশে মেঘ আছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ফাল্লুন মাসে এরকম ভ্যাপসা গরম থাকার কথা না। আকাশে মেঘ থাকার জন্যেই বোধহয় এই অস্বাভাবিক উত্তাপ। বিদ্যুৎ যেভাবে চমকাচ্ছে তাতে মনে হয় বৃষ্টি নামবে। বৃষ্টি নামলেও সমস্যা। তিনি ছাতা আনেন নি। বাইরে বের হলে তিনি সবসময় ছাতা সঙ্গে রাখেন। এবারই ভুল করে ছাতা আনেন নি। বয়স যে হচ্ছে এটা তার লক্ষণ। বয়সকালেই মানুষ ছোটখাটো ভুল করতে থাকে। ছোটখাটো ভুল করা যখন অভ্যাস হয়ে যায়। তখন করে বড় ভুল।
ইরতাজউদিনের গায়ে তসরের গলাবন্ধ কোটি। গলায় মাফলার। গরমে তার গা ঘেমে যাচ্ছে। কে জানত ঢাকা শহরে ফায়ুন মাসের শুরুতে শীত থাকে না। শহরে মানুষ বেশি হয়ে গেছে। মানুষের শরীরের গরমে শহর গরম। কত লক্ষ লোক এখন এই শহরে বাস করছে কে জানে! সংখ্যাটা জানা থাকা দরকার।
তাঁর পানির পিপাসা হচ্ছে। পানি কোথায় পাওয়া যায় ইরতাজউদ্দিন জানেন না। এরা এত বড় স্টেশন বানিয়ে রেখেছে কিন্তু পানির ব্যবস্থা রাখে নি। পুটলা-পুটলি, পানির পিপাসা এবং কনুইয়ে হাঁসের কামড় নিয়ে তিনি বড়ই বিব্রত বোধ করছেন। তাকে যেতে হবে মালিবাগ। ১৮/৬ পশ্চিম মালিবাগ, গলির ভেতর বাসা। আগে একবার মাত্র এসেছেন, এখন খুঁজে পাবেন কিনা কে জানে। ঢাকা শহরের সব গলি তাঁর কাছে একরকম লাগে। শুধু গলি কেন, এই শহরের মানুষগুলিও একরকম লাগে। মানুষ তো না, যেন মানুষের ছায়া। মানুষের সঙ্গে মানুষের তফাত করা যায়, ছায়ার সঙ্গে ছায়ার তফাত করা যায় না। ঢাকা হলো ছায়ামানুষের দেশ। ছায়ানগরী।
কমলাপুর থেকে মালিবাগ এক টাকা ভাড়ায় ইরতাজউদ্দিন একটা রিকশা জোগাড় করে ফেললেন। রিকশাওয়ালা তাঁকে ঠকালো কিনা। তিনি বুঝতে পারছেন না। ঢাকা শহরে তাঁর আসা হয় না। রিকশা ভাড়া সম্পর্কে তাঁর ধারণা নেই। তিনি কাউকে ঠকাতে চান না। কারো কাছ থেকে ঠকাতেও চান না। শহরের মানুষ অন্যকে ঠকাতে ভালোবাসে।
রিকশাওয়ালা ভাই, আপনার নাম কী?
বদরুল।
শুনেন ভাই বদরুল, এক টাকার বদলে আমি আপনাকে দুই টাকা দেব, আপনি বাসাটা খুঁজে বের করে দেবেন। আমার কাছে ঠিকানা আছে— ১৮/৬ পশ্চিম মালিবাগ। রাজি আছেন? রাজি থাকলে বলেন, আলহামদুলিল্লাহ। রাজি না থাকলে কোনো কথা বলার প্রয়োজন নাই।
বাসা রেল গেইটের লগে?
এইসব আমার কিছুই মনে নাই। একবার মাত্র এসেছিলাম। শুধু মনে আছে বাসার সঙ্গে একটা ছাতিম গাছ আছে। মরা গাছ। ছাতিম হলো পল্লী গ্রামের গাছ। এরা শহরে বাঁচে না বলেই মরা।
উঠেন দেহি আল্লাহ ভরসা।
আপনাকে আলহামদুলিলাহ বলতে বলেছিলাম, বলেন আলহামদুলিল্লাহ।
রিকশাওয়ালা বিস্মিত গলায় বলল, আলহামদুলিল্লাহ।
রাত কম হয় নি। অথচ দোকানপটি খোলা, রাস্তায় প্রচুর লোক, চায়ের দোকানে গান বাজছে। এর মানে কী? এরকম কি সারারাতই চলবে? এরা রাতে ঘুমুবে না? কিছুদূর যেতেই তাঁর রিকশা একটা মিছিলের মধ্যে পড়ে গেল। বড় কিছু না, পঁচিশ-ত্রিশজনের মিছিল। তবে তাদের সবার হাতেই মশাল। মশাল থেকে আলো যত না বের হচ্ছে তারচে বেশি বের হচ্ছে ধোয়া। প্রত্যেকের মুখ ঘামে চকচক করছে। তাদের গলা তত জোরালো না। মনে হয় অনেকক্ষণ মিছিল করে তারা ক্লান্ত।
বদরুল রাস্তার একপাশে রিকশা দাঁড় করিয়ে কৌতূহলী চোখে মিছিলের দিকে তাকিয়ে রইল। তারা একটাই স্লোগান দিচ্ছে–জ্বলো জ্বলো আগুন জ্বলো। ইরতাজুদ্দিন ভুরু কুঁচকে ভাবতে লাগলেন–এটা কেমন স্লোগান? জ্বলো জ্বলো আগুন জ্বলো কেন? শ্লোগান হওয়া উচিত শান্তিবিষয়ক—নেভাও নেভাও আগুন নেভাও।
মিছিল দেখে রাজহাঁস উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। লাফ দিয়ে নেমে পড়তে চাচ্ছে। ইরতাজউদ্দিন বিরক্তমুখে হাঁসের গলা চেপে ধরে বসে আছেন। রাজহাঁস অবাক হয়ে মিছিলের মশাল দেখছে। তার জীবন কেটেছে কুপি এবং চাঁদের আলোর আশপাশে। মশালের আলোয় সে ইরতাজউদ্দিন সাহেবের মতোই অভ্যস্ত নয়। মাঝে মাঝেই সে ডানা ঝাপটাচ্ছে।
মিছিল হুট করে একটা গলির ভেতর ঢুকে গেল। হঠাৎ চারদিক শান্ত হয়ে গেল। রিকশাওয়ালা রিকশা চালাতে শুরু করল। খুশি খুশি গলায় বলল, রাজহাঁসটার দাম কত হইছে ছার?
ইরতাজউদ্দিনের মন খারাপ হয়ে গেল। শহরের মানুষ সবকিছু বিবেচনা করে দাম দিয়ে। ভালো কিছু দেখলে প্রথমেই সে দাম জিজ্ঞেস করবে।
থাকে মালিবাগে, তার জন্য নিয়ে যাচ্ছি। না, ঠিক তার জন্য না। তার একটা মেয়ে আছে, এপ্রিল মাসে তার বয়স হবে চার। তার জন্য নিয়ে যাচ্ছি। শিশুরা পশুপাখি পছন্দ করে।
ও।
শহর বন্দরে থাকে, এইসব জিনিস তো দেখে না।
ইরতাজউদ্দিন সাহেব লক্ষ করলেন তাঁর ক্ষুধাবোধ হয়েছে। নানান উদ্বেগ ও উত্তেজনায় তাঁর ক্ষুধার কথা এতক্ষণ মনে হয় নি, এখন ক্ষুধা জানান দিচ্ছে। সন্ধ্যায় কিছু খাওয়া হয় নি। রাত হয়েছে মেলা। বারোটার কম না। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষিধে সহ্য করার ক্ষমতাও মানুষের কমে যায়। বয়সে শুধু যে শরীর ভাঙে তাই না, শরীরের ভেতরে যে আত্মা বাস করে সেই আত্মাও ভাঙতে থাকে। আত্মা ক্ষতিগ্ৰস্ত হবার কারণে বুড়োরা নিজের অজান্তেই ভ্ৰান্তির জগতে চলে যায়। তিনি নিজেও চলে গিয়েছেন। কিনা কে জানে। একমাত্র সত্যবাদীতাই ভ্ৰান্তির জগতে প্রবেশে বাধা দেয়। তিনি এই কারণেই সত্য কথা বলেন। গত কুড়ি-পঁচিশ বছরে তিনি মিথ্যা বলেছেন–এরকম মনে পড়ে না।
মালিবাগে অনেকক্ষণ ধরেই রিকশা ঘুরছে। বাসা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। নাম্বারের কোনো ঠিকািঠকানা নেই। এই তেরো নম্বর বাড়ি, পরেরটাই একশ এগারো। মাঝখানের নম্বরগুলি গেল কোথায়? পশ্চিম মালিবাগ যদি থাকে তাহলে পূর্ব মালিবাগও থাকার কথা। পূর্ব মালিবাগ বলে কিছু নেই। আশ্চর্য কথা। গলিতে লোকজন তেমন নেই, মাঝে মাঝে যে দুএকজনকে পাওয়া যাচ্ছে তারা এই পৃথিবীতে বাস করে বলেই মনে হয় না। ১৮/৬ বাসাটা কোথায়?–জিজ্ঞেস করার পর অবাক হয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে, তারপর হাই তোলে। বিস্মিত মানুষ হাই তুলতে পারে না। এদের বিস্ময় যেমন মেকি, হাইটাও তেমনি মেকি। শহরের সবকিছুই মেকি।
এতক্ষণ ধরে মাফলার পরে থাকায় গলা চুলকাচ্ছে। দুটা হাতই বন্ধ, গলা চুলকানো সম্ভব না। মানুষের তিনটা করে হাত থাকলে ভালো হতো। তিন নম্বর হাতটা সময়ে অসময়ে কাজে লাগত। এই ধরনের অদ্ভুত চিন্তা মাথায় আসায় ইরতাজউদ্দিন মনে খুবই দুঃখ পেলেন। আল্লাহপাক অনেক চিন্তা-ভাবনা করে মানুষ বানিয়েছেন। তিনি যদি মনে করতেন মানুষের তিনটা হাত প্রয়োজন, তিনি তিনটাই দিতেন। ইরতাজউদ্দিন মনে মনে তিনবার বললেন, তওবা আস্তাগাফিরুল্লাহ।
রাজহাঁসটা বড়ই যন্ত্রণা করছে। তিনি গলা চেপে ধরে আছেন এই অবস্থাতেও কামড়াতে চেষ্টা করছে। দুটা হাঁস আনেন নি। তাঁর দুটা আনারই পরিকল্পনা ছিল। একটাকে ধরা গেল না। মেয়ে-হাঁসটা ধরা পড়ল। তার পুরুষ সঙ্গী ঝাঁপিয়ে পড়ল পুকুরে। বেচারা এখন বোধহয় সঙ্গিনীকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। জোড় ভেঙে একটাকে আনা ঠিক হয় নি। ইরতাজউদিনের মন খারাপ লাগছে। বোবা প্ৰাণী মনের কষ্টের কথা কাউকে বলতে পারবে না। একজন আরেকজনকে খুঁজবে। মানুষের নিষ্ঠুরতায় ব্যথিত হবে। তারপরেও তাকে বাস করতে হবে মানুষের সঙ্গে। এই তাদের নিয়তি।
বাসা শেষপর্যন্ত পাওয়া গল। এই তো লেখা–১৮/৬। এই তো ছাতিম গাছ। আগে যেমন মরা মরা ছিল, এখনো মরা মরা। ইরাতাজউদ্দিন সাহেব; রিকশাওয়ালাকে দুই টাকার বদলে অতিরিক্ত একটা আধুলি দিলেন। তাঁর ইচ্ছা! করছে এক টিন মুড়িও দিয়ে দিতে। শাহেদের কথা মনে করে এনেছেন বলে দিতে পারছেন না।
বদরুল মিয়া।
জি ছার। আপনি অনেক কষ্ট করেছেন। আমি আপনার জন্য খাস দিলে দোয়া করব।
বদরুল গামছা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল, আপনি আজিব লোক।
আজিব কেন?
বখশিশ দিলেন। আবার দোয়া করলেন। কেউ এমুন করে না।
ইরতাজউদ্দিন দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে বললেন, আমরা সবাই আজিব। আমি যেমন আজিব, আপনিও আজিব। আল্লাহপাক আজিব পছন্দ করেন বলেই এই দুনিয়ায় আজিবের ছড়াছড়ি।
বাসার সবাই ঘুমে।
ঘর অন্ধকার। গেট তালাবন্ধ। ইরতাজউদ্দিন বিরক্ত হচ্ছেন। শহরের লোকজনের অবিশ্বাস দেখে বিরক্ত। গেটে তালা দেওয়ার দরকার কী?
অনেকক্ষণ গেট ধরে ধাক্কাধাব্ধি এবং উচু গল্পায় শাহেদ শাহেদ বলে চিৎকারের পর ঘরের ভেতরে বাতি জুলল। অপরিচিত একজন লোক দরজা খুলে বের হয়ে এসে বললেন, কে?
লোকটা লম্বা ও ফর্সা। গলার স্বর মেয়েলি। গলার স্বর শুনে বোঝা যাচ্ছে তিনি ভয় পেয়েছেন।
আপনি কে?
আমি ইরতাজউদ্দিন। নীলগঞ্জ থেকে আসছি। এসিসটেন্ট হেডমাস্টার, আরবি ও ধর্ম শিক্ষক। নীলগঞ্জ হাইস্কুল।
কাকে চান?
শাহেদের কাছে এসেছি। আমি শাহেদের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা। আপনাকে সালাম দিতে ভুলে গেছি। গোস্তাকি মাফ হয়। আসসালামু আলায়কুম।
লোকটি এতক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। এখন দরজার আড়ালে চলে গেলেন। তবে দরজা খোলা, লোকটাকে এখনো দেখা যাচ্ছে। যে-কোনো কারণেই হোক তিনি ভয় পাচ্ছেন। তাকে দেখেও লোকজন ভয় পেতে পারেএই চিন্তাটা ইরতাজউদ্দিনকে পীড়িত করছে। কী করে তিনি লোকটার ভয় ভাঙাবেন তাও বুঝতে পারছেন না। লোকটা সালামের জবাব দেয় নাই। এটা তো ঠিক না। সালাম হচ্ছে শান্তির আদান-প্ৰদান।
শাহেদ নামে কেউ এই বাড়িতে থাকেন না।
থাকেন না মানে?
উনি চলে গেছেন। আমি নতুন ভাড়াটে।
কোথায় গেছে জানেন?
না।
কেউ কি জানে?
আমি জানি না কেউ জানে কি-না।
ভদ্রলোক দরজা বন্ধ করার উপক্রম করেছেন। ইরতাজউদ্দিন ক্লান্ত গলায় বললেন, ভাইসাহেব, আপনি একটু আসবেন। এদিকে। গোটটা খুলবেন?
কেন?
আমার সঙ্গে একটা রাজহাঁস ছিল, ঐটা আপনাকে দিয়ে যেতাম।
রাজহাঁস?
শাহেদের বাচ্চার জন্যে এনেছিলাম। এত রাতে এই হাঁস নিয়ে কোথায় ঘুরব? হাঁসটা আপনি গ্রহণ করলে আমার উপকার হয়।
অন্যের হাঁস। আমি খামাখা রাখব কেন?
আপনার ঘরেও নিশ্চয়ই বাচ্চা-কাচ্চা আছে, তারা খুশি হবে।
ভদ্ৰলোক দরজার আড়াল থেকে বের হয়ে এলেন। দরজার ফাঁকে তার স্ত্রীর মুখ দেখা যাচ্ছে। তিনিও কৌতূহলী চোখে তাকাচ্ছেন হাঁসটার দিকে। ইরতাজউদ্দিন ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, এই রাজহাঁসটা আর জিনিসগুলি রাখলে আমি খুশি হবো। অস্বস্তি বোধ করার কিছুই নেই! হাঁসটা নিয়ে আমি বিপদে পড়েছি।
দরজার ফাঁকে চৌদ্দ-পনেরো বছরের অপরূপ রূপবতী একটি কিশোরীর মুখ দেখা গেল। মেয়েটির নাম রত্নেশ্বরী, সে ভিকারুন নিসা নুন স্কুলে ক্লাস টেন-এ পড়ে; রত্নেশ্বরী বড়ই অবাক হয়েছে। তার জীবনে এমন বিস্ময়কর ঘটনা আর ঘটে নি। রাতদুপুরে সাধু সাধু চেহারার এক লোক এসে তাদের রাজহাঁস দিতে চাচ্ছে। আগামীকাল ক্লাসে গল্পটা কীভাবে বলবে, তা ভেবেই তার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। গল্পটা অনেকেই হয়তো বিশ্বাস করতে চাইবে না। সন্ন্যাসী ধরনের এই লোকটার একটা ছবি তুলে রাখতে পারলে ভালো হতো!
রত্নেশ্বরী ফিসফিস করে তার মাকে বলল, মা, এই হাঁসটা কি আমরা রাখব?
রত্নেশ্বরীর মা নিচু গলায় বললেন, জানি না। দেখি তোর বাবা কী বলেন।
ভদ্রলোক কে মা?
জানি না।
ইরতাজউদ্দিন সাহেব রত্নেশ্বরীর বাবার দিকে তাকিয়ে আনন্দিত গলায় বললেন, ছোট মেয়েটা কি আপনার কন্যা? বড়ই মিষ্টি চেহারা। কী নাম তোমার মা?
রত্নেশ্বরী জবাব দেয়ার আগেই তার বাবা বললেন, আপনি এখন যান। আমরা হাঁস-ফাস কিছু রাখব না।
ইরতাজউদ্দিন ক্লান্ত গলায় বললেন, আচ্ছা না রাখলেন, গোটটা খুলুন। আমার বাথরুমে যাওয়া বিশেষ প্রয়োজন।
রত্নেশ্বরীর বাবা বললেন, গেট খোলা যাবে না। আমার কাছে গেটের চাবি নাই।
কথা সত্যি না। চাবি ঘরেই আছে–ওয়ারড্রোবের উপর রাখা আছে। রত্নেশ্বরীর মা ফিসফিস করে বললেন, খুলে দাও না। বেচারা বুড়ো মানুষ। রত্নেশ্বরীর বাবা চাপা গলায় বললেন, যা বুঝো না তা নিয়ে কথা বলতে এসো না। যাও, ভেতরে যাও। স্ত্রী-কন্যাকে ভেতরে ঢুকিয়ে তিনি শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দিলেন।
বারান্দার বাতির সুইচ ভেররে। ভেতর থেকে সুইচ নিভিয়ে দিয়ে বারান্দা অন্ধকার করে দেয়া হলো। ইরতাজউদ্দিন দাঁড়িয়ে রইলেন। ব্যথা ও বিস্ময়ে তিনি খানিকটা কাতর। এরা এমন করল কেন? মানুষের প্রতি মানুষের সামান্য মমতা থাকবে না!
গেটের উপর দিয়ে তিনি রাজহাঁসটা ভেতরে ছুঁড়ে দিলেন। হাঁসটা থাকুক। মুড়ির টিন পুটলা-পুটলি সঙ্গে নিয়েই বা কী হবে? রিকশাওয়ালাটা থাকলে তাকে দিয়ে দেয়া যেত। থাকুক পুটলা-পুটলি গেটের সামনে। অভাবী লোকজন এসে নিয়ে যাবে। বন্ধ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার কোনো অর্থ হয় না। তবু ইরতাজউদ্দিন দাঁড়িয়ে আছেন। তার কেন জানি মনে হচ্ছে বন্ধ দরজা আবার খুলে যাবে। পরীর মতো দেখতে কিশোরী মেয়েটা তাকে বলবে, আপনি ভেতরে আসুন। মা আপনাকে ভেতরে আসতে বলেছে।
রাজহাঁসটা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। তিনি হাঁসটাকে বললেন, যাই রে। রাজহাঁস কুৎসিত একধরনের শব্দ করল। সম্ভবত তাকে যাবার অনুমতি দিল। ইরতাজউদিনের মনে হলো, যে পাখি যত সুন্দর তার কণ্ঠস্বর তত কুৎসিত। যেমন ময়ূর। সে দেখতে সুন্দর কিন্তু তার কণ্ঠস্বর কর্কশ। একমাত্র ব্যতিক্রম কাক। সে নিজে অসুন্দর, তার কণ্ঠস্বরও অসুন্দর।
টিপটপ করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। অসহ্য গরমের পর বৃষ্টিটা ভালো লাগছে। ইরতাজউদ্দিন বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে এগুচ্ছেন। বৃষ্টির মধ্যে কেমন যেন আঠালো ভাব। শরীরের যে জায়গায় পড়ছে। সেখানটাই আঠা আঠা হয়ে যাচ্ছে।
তিনি গলি থেকে বের হলেন, বৃষ্টিও থেমে গেল। বড় রাস্তায় আবারো একটা মশাল মিছিল। এই মিছিলটিা আগেরটার চেয়ে ছোট। না-কি আগের মিছিলটাই ঘুরে এসেছে? ইরতাজউদ্দিন মিছিলের সঙ্গে হাঁটতে শুরু করলেন। যেন তিনি মিছিলের একজন। এই মিছিল কোন দিকে যাচ্ছে তিনি জানেন না। তিনি নিজে কোথায় যাবেন তাও জানেন না। পল্লী অঞ্চল হলে যে-কোনো একটা বাড়িতে গিয়ে বিপদের কথা বললেই আশ্রয় পাওয়া যেত। তারা অজ্বর পানি দিত। ভাত-ডালের ব্যবস্থা করত। গরম ধোঁয়া উঠা ভাতের সঙ্গে ডাল। একটা ঝাল কাঁচামরিচ, একটা পেয়াজ। ইরতাজউদিনের পেট মোচড় দিয়ে উঠল। এতটা ক্ষিধে পেয়েছে তিনি বুঝতেই পারেন নি। ধোঁয়া উঠা ভাতের ছবি মাথা থেকে যাচ্ছেই না।
মিছিলের সঙ্গে তিনি কোথায় যাচ্ছেন? কেনই বা যাচ্ছেন? তার উচিত রাতের জন্যে একটা আশ্রয় খুঁজে বের করা। এত রাতে কোনো হোটেল খুঁজে বের করা সম্ভব না। তাছাড়া হোটেলে রাত কাটাবার মতো সঙ্গতিও তাঁর নেই। সবচে ভালো হয় কমলাপুর রেলস্টেশনে চলে যাওয়া। কোনো একটা বেঞ্চিতে শুয়ে রাতটা পার করে দেয়া। স্টেশনের আশেপাশে অনেক ভাতের দোকান আছে। প্রথমেই হাত-মুখ ধুয়ে কিছু খেতে হবে।
একজন মশালিধারী ইরতাজউদিনের কাছে চলে এসেছে। পাশাপাশি হাঁটছে এবং কৌতূহলী চোখে তাকে দেখছে। ইরতাজউদ্দিনের ইচ্ছা হচ্ছে তাঁকে বলেন, মশাল শব্দটা আরবি, এটা জানেন? জ্ঞান জাহির করার জন্যে বলা না। আলাপ আলোচনা শুরুর জন্যে বলা। আলাপ শুরু হলে তাকে জিজ্ঞেস করতে পারতেন—মধ্যরাতে মশাল মিছিল কেন হচ্ছে? ইলেকশন হয়ে গেছে। জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টা আসনের মধ্যে ১৬৭টা পেয়েছে আওয়ামী লীগ। পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলি ভুট্টো পেয়েছে ৮৩টা। হয়েই তো গেছে, আর কী? এখন কেন মধ্যরাতে জালো জ্বলো আগুন জ্বলো? হাতে মশাল আছে বলেই কি আগুনের কথা মনে আসছে?
হাতে মশাল থাকলেই আগুন জ্বালাতে ইচ্ছা করে। হাতে তলোয়ার থাকলে কোপ বসাতে ইচ্ছা করে। বন্দুক থাকলে ইচ্ছা করে গুলি করতে। মানবচরিত্র বড়ই অদ্ভুতা! আচ্ছা কারোর হাতভর্তি ফুল দিয়ে দিলে সে কী করবে? ফুল বিলাতে শুরু করবে?
ইরতাজউদ্দিন থমকে দাঁড়ালেন, কী আশ্চৰ্য্য, তিনি শাহেদের আগের বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। মিশ্ৰীক্ষণ চক্রাকারে ঘুরছে। তাকে এনে ফেলেছে আগের জায়গায়। গেটের সামনে রাখা মুড়ির টিন দুটা নেই, তবে গেটের ভেতরে রাজহাঁসটাকে দেখা যাচ্ছে। ঘরের এক কোনায় অন্ধকারে ঘাপটি মেরে আছে। এরাও বোধহয় মানুষের শরীরের গন্ধ চেনে। রাজহাঁস গোপন আশ্রয় ছেড়ে ডানা মেলে ছুটে আসছে ইরতাজউদ্দিনের দিকে। কী অপূর্ব দৃশ্য!
ইরতাজউদ্দিন ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে হাঁটতে শুরু করলেন। এখন গন্তব্য ঠিক করা–কমলাপুর রেলস্টেশন। রাজহাঁসটা ঘাড় ঘুরিয়ে ইরতাজউদ্দিনকে দেখছে। সে কি বিস্মিত হচ্ছে? বিস্মিত হবার ক্ষমতা কি এদের দেয়া হয়েছে?
শাহেদের ঠিকানা বের করতে ইরতাজউদ্দিন সাহেবের প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা লেগেছে। এই চব্বিশ ঘণ্টা বলতে গেলে তার পথে পথেই কেটেছে। রাত কাটিয়েছেন। কমলাপুর রেলস্টেশনে। স্টেশনের কাছেই এক মসজিদে ফজরের নামাজ পড়ে শাহেদের খোজে বের হলেন। সেই অনুসন্ধানের ইতি হলো রাত নটা পঁচিশ মিনিটে। রায়েরবাজারের গলির ভেতর পুরনো ধরনের দোতলা বাড়ি। একতলায় বাড়িওয়ালা থাকেন। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার এই বাড়ির সামনেও একটা ছাতিম গাছ। তবে এই গাছটা সতেজ। শাহেদ কি ঠিক করেছে। ছাতিম গাছ নেই এমন কোনো বাড়ি সে ভাড়া করবে না?
ইরতাজউদিনের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। শাহেদকে খুঁজে বের করার পরিশ্রমে মনে হয় তার বয়স বেড়ে গেছে। চোখ টকটকে লাল। প্ৰচণ্ড গরমেও তার শীত শীত লাগছে, জ্বরের পূর্বলক্ষণ।
শাহেদ বিস্মিত হয়ে বলল, ভাইজান, আপনার এ-কী অবস্থা? এরকম দেখাচ্ছে কেন আপনাকে, শরীর খারাপ নাকি?
ইরতাজউদ্দিন ক্লান্ত গলায় বললেন, শরীর ঠিকই আছে। পরিশ্রম হয়েছে। তোমার বাসা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। শেষপর্যন্ত অফিসে গেলাম। আজ যে অফিস ছুটি তাও জানতাম না।
বাসার ঠিকানা পেলেন কী করে?
অফিসের দারোয়ানের কাছ থেকে তোমার এক কলিগের ঠিকানা পেলাম, রহমান সাহেব। তিনি থাকেন বাসাবো নামের একটা জায়গায়। তাকে খুঁজে বের করলাম। তিনি আবার তোমার ঠিকানা জানেন না। তবে অন্য একজনকে চিনেন যে তোমার ঠিকানা জানে। সে এক লম্বা গল্প। শুনে লাভ নেই। বাসার লোকজন কোথায়? রুনি, রুনির মা?
শাহেদ ইতস্তত করে বলল, আসমানী তার মার বাসায় গেছে। আপনি আসার কিছুক্ষণ আগে গেল। আমার শাশুড়ির শরীর খারাপ, খবর পেয়ে গেছে।
তুই যাস নি কেন? শাশুড়ি হলেন মাতৃসম। তার সেবা করলে মাতৃঋণ শোধ হয়। তোর জন্মের পর পর মা মারা গেলেন। তুই তো আর মাতৃঋণ শোধ করার সুযোগ পাস নাই। পিতৃঋণ শোধ না করলে চলে, মাতৃঋণ শোধ করতে হয়। যাইহোক, তোদের বাথরুম কোনদিকে? গোসল করব। অনেক নামাজ কাজা হয়েছে। ঘরে জায়নামাজ আছে?
শাহেদ লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, জি-না। পরিষ্কার চাদর আছে, বিছিয়ে দিচ্ছি। ইরতাজউদ্দিন গম্ভীর গলায় বললেন, নামাজ পড়িস। আর না পড়িস মুসলমানের ছেলে এই কারণেই ঘরে একটা জায়নামাজ, একটা তসবি, একটা টুপি এইসব থাকা দরকার।
ভাইজান, গরম পানি লাগবে? পানি গরম করে দেই?
গরম পানি লাগবে না।
আপনি কি খেয়ে এসেছেন ভাইজান?
না। তবে রাতে কিছু খাব না। জ্বর জ্বর লাগছে। উপাস দেব। উপাস হলো জ্বরের একমাত্র ওষুধ।
জ্বর গায়ে গোসল করবেন?
বললাম না। শরীর অশুচি হয়ে আছে। গোসল না করলে নামাজ পড়তে পারব না।
শাহেদের ইচ্ছা করছে তার ভাইয়ের গায়ে হাত দিয়ে জ্বর দেখতে। সাহসে কুলাচ্ছে না। তাদের ভাইয়ে ভাইয়ে দূরত্ব অনেক বেশি। ইরতাজউদ্দিনের জন্মের পর আরো পাঁচ ভাইবোনের পরের জন শাহেদ। বিস্ময়কর ঘটনা হলো, তাদের মাঝখানের পাঁচ ভাইবোন জন্মের এক মাসের ভেতর মারা গেছে। সবারই একই অসুখ–হাত-পা ঠাণ্ড হয়ে শরীরে খিচুনি। নিঃশ্বাসের কষ্ট। জন্মের পনেরো দিনের দিন শাহেদেরও এই রোগ হলো। হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। প্রবল খিচুনি। শাহেদের বাবা আধাপাগলের মতো হয়ে গেলেন। তিনি মসজিদে ছুটে গিয়ে ইমাম সাহেবকে বললেন, আমি আমার জীবনে একটা ভয়ঙ্কর পাপ করেছি। আমার পুত্রকন্যারা মারা যাচ্ছে–তার কারণ আর কিছু না, পাপের শাস্তি। আমি সবার সামনে অপরাধ স্বীকার করব, আল্লাহ যেন আমার পুত্রের জীবন রক্ষা করে।
জানা গেল। তিনি একটা খুন করেছেন। অপরাধ স্বীকার করে তিনি পুলিশের কাছে ধরা দেন। বিচারে তার যাবজীবন হয়। তিনি হাসিমুখে জেল খাটতে যান। কারণ তার কনিষ্ঠ পুত্রটির জীবন রক্ষা হয়। শাহেদের বাবার মৃত্যু হয়। জেলখানাতে। ইরতাজউদ্দিন অতি অল্পবয়স থেকেই সংসারের দায়িত্ব কাঁধে নেন। ছোটভাইকে প্ৰায় কোলে করেই তিনি বড় করেন। অনেক বয়স পর্যন্ত শাহেদ ইরতাজউদ্দিনের বুকে না শুয়ে ঘুমুতে পারত না। ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় শাহেদের একবার টাইফয়েড হলো। একুশ দিনের জ্বরের আটদিন ইরতাজউদ্দিন তার ভাইকে কোলে নিয়ে বসে থাকলেন। কোল থেকে নামালেই সে চিৎকার করতে থাকে। কোলে তুলে নিলেই শান্ত। শাহেদের সঙ্গে ইরতাজউদিনের সম্পর্ক ভাই-ভাই সম্পর্ক না। অনেকটাই পিতা-পুত্র সম্পর্ক।
শাহেদ বলল, ভাইজান, আপনি এক কাজ করুন। বাসার দরজা বন্ধ করে গোসল করতে যান। আমি আসমানীকে নিয়ে আসছি। বেশিক্ষণ লাগবে না। আমি যাব। আর আসব।
ইরতাজউদ্দিন বিরক্ত গলায় বললেন, সে গেছে তার অসুস্থ মাকে দেখতে, তুই তাকে নিয়ে আসবি কেন? এটা আবার কী রকম কথা?
শাহেদ লজ্জিত গলায় বলল, আমার শাশুড়ি ভালো আছেন ভাইজান, আপনাকে মিথ্যা কথা বলেছিলাম। আসমানী আমার সঙ্গে রাগারগি করে চলে গেছে।
ইরতাজউদ্দিন বিরক্ত চোখে ছোট ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। স্ত্রীর সঙ্গে রাগারগি, এ কেমন কথা? মেয়েরা হচ্ছে জন্মদাত্রী জননী। হাজার ভুল করলেও এদের উপর রাগ করতে নেই। এদের উপর রাগ করাটাই কাপুরুষতা। অক্ষম এবং দুর্বল পুরুষরাই শুধু স্ত্রীর সঙ্গে রাগারগি করে।
ভাইজান, বেশিক্ষণ লাগবে না, একটা বেবিট্যাক্সি নিয়ে যাব। আর চলে আসব।
আচ্ছা।
আসমানীর সঙ্গে শাহেদের ঝগড়ার কারণ অতি তুচ্ছ। মজার ব্যাপার হলো, তাদের সব বড় বড় ঝগড়াই তুচ্ছ কারণে হয়েছে। আজকের ঝগড়ার বিষয়বস্তু বাথরুমের ছিটিকিনি। ছিটিকিনি খুলে পড়ে গেছে। আসমানী কয়েক দিন ধরেই বলছে তিনটা আধা ইঞ্চি পেরেক আনতে। শাহেদ রোজই বলছে নিয়ে আসব কিন্তু আনছে না।
এই ছিটিকিনি নিয়েই শাহেদের সঙ্গে আসমানীর ঝগড়া হয়ে গেল। ভয়াবহ ধরনের ঝগড়া। আজ সন্ধ্যাবেলা শাহেদ মোহাম্মদপুর বাজার থেকে চাল-ডাল কিনে ফিরেছে। ঘরে ঢোকা মাত্র আসমানী বলল, পেরেক এনেছ?
শাহেদ পাঞ্জাবি খুলতে খুলতে বলল, পেরেক পেরেক করে তুমি দেখি আমার মাথা খারাপ করে ফেললে। কানু বিনে গীত নেই। তোমারও দেখি পেরেক ছাড়া কথা নেই। মাথার মধ্যে একটা জিনিস ঢুকলে আর বের হয় না।
আসমানী বলল, তার মানে তুমি আনো নি?
না।
আনো নি কেন?
ভুলে গেছি। এই জন্যে আনি নি। সবার স্মৃতিশক্তি তো আর তােমার মতো না। সবাই তো আর হাতি না যে সব কিছু মনে থাকবে।
তার মানে কি এই যে তুমি কোনোদিনই আনবে না?
শাহেদ গম্ভীর মুখে বলল, এখনই তোমার পেরেক এনে দেব। এটা নিয়ে আর কথা শুনতে চাই না।
এমন কী কথা আমি তোমাকে বললাম?
যা বলেছ। যথেষ্টই বলেছ।
শাহেদ হন।হন করে বের হয়ে গেল। যাওয়ার সময় দরজাটা ধড়াম করে লাগিয়ে রাগ দেখিয়ে গেল। আসমানীর মনটা খারাপ হয়ে গেল। বেচারা বাজার নিয়ে ফিরেছে। এর মধ্যেই পেরেকের ব্যাপারটা না তুললেও হতো। বাড়িওয়ালার শালা মজনুকে একটা টাকা দিলে সে এনে দিত। শাহেদের যখন মনে থাকে না, তখন শুধু শুধু তাকে বিরক্ত করা কেন? আসমানীর নিজের উপরই রাগ লাগছে। সে ঠিক করে ফেলল, শাহেদ এলে সে এমন কিছু করবে: যেন সে রাগ ভুলে আচমকা খুশি হয়ে উঠে। শাহেদকে হঠাৎ খুশি করার একটা পদ্ধতি সে জানে। সমস্যা হলো পদ্ধতিটা ব্যবহার করতে তার খুব লজ্জা লাগে।
তিনটা পেরেক হলেই হয়, শাহেদ এক কেজি পেরেক নিয়ে ফিরল। পেরেকের সঙ্গে হাতুড়ি, স্কুড্রাইভার। নিজেই খুটাখুটি করে বাথরুমের ছিটিকিনি লাগাল। আসমানীকে বলল, যাও, তোমার বাথরুম ঠিক হয়েছে। এখন ছিটিকিনি লাগিয়ে বাথরুমে গিয়ে বসে থাক। ঘড়ি দেখে দুঘণ্টা বসে থাকবে। দুঘন্টার আগে যদি বের হও তোমার খবর আছে।
আসমানী আহত গলায় বলল, আমাকে বাথরুমে বসে থাকতে হবে কেন?
বসে থাকতে হবে কারণ পেরেক এনে ছিটিকিনি লাগানো হয়েছে। পেরেক, পেরেক, পেরেক! আমার জীবন অতিষ্ঠা করে তুলেছে। দেশের কী অবস্থা! বেতন হবে কি হবে না, অফিস থাকবে কি থাকবে না—-এসব নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। পেরেক পেরেক পেরেক। আমার লাইফটাকে কয়লা বানিয়ে ফেললে।
আমি তোমার জীবন কয়লা বানিয়ে ফেলেছি?
হ্যাঁ।
আসমানীর চোখে পানি এসে গেল। চোখের এই পানি শাহেদকে কোনোক্রমেই দেখানো যায় না। সে অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, আমার জন্য তোমার জীবন যেন কয়লা না হয়। সেই ব্যবস্থা করছি। এখন থেকে তোমার জীবন হবে চন্দনকাঠ।
বলেই রান্নাঘরে ঢুকে পড়ল। শাহেদ সামনে থাকলে সে দেখে ফেলবে আসমানী কাঁদছে। এটা হতে দেয়া যায় না। কাঁদতে কাঁদতেই আসমানী ডাল চড়াল, ডিমের ঝোল রান্না করল। রাত নটায় সহজ গলায় বলল, আমি যাচ্ছি।
শাহেদ বিস্মিত হয়ে বলল, কোথায় যাচ্ছ?
কলাবাগানে মার কাছে যাচ্ছি। এখন থেকে মার জীবন কয়লা বানাব। তোমার মূল্যবান চন্দনকাঠ জীবন কয়লা করব না।
আসমানী, তোমার কি মনে হয় না। তুমি বাড়াবাড়ি করছ?
না, আমার সে-রকম মনে হচ্ছে না। আলমারির চাবি ড্রেসিং টেবিলে রেখে গেলাম। রুনির জামা-কাপড় পাঠিয়ে দিও। আমার কোনো কিছু পাঠাতে হবে না।
তার মানে কি পুরোপুরি বিদায়?
হ্যাঁ।
রুনি মায়ের কোলে। গলা জড়িয়ে ধরে ঘুমুচ্ছে। এমনিতে সে রাত এগারোটা পর্যন্ত জেগে থাকে, আজ নটা বাজতেই ঘুম। রুনি জেগে থাকলে আসমানীর যাওয়া এত সহজ হতো না। রুনি কিছুতেই বাবাকে ছেড়ে যাবে না। শাহেদ শুকনো গলায় বলল, যেতে চাও যাবে। রাতদুপুরে যাবার দরকার দেখি না। সকাল হোক তারপর যাবে।
আসমানী বলল, কোনো অসুবিধা নেই। মজনু আমাকে পৌঁছে দেবে। ওকে রিকশা আনতে বলে এসেছি।
ওকে আবার কখন বললে?
আধঘণ্টা আগে বলে এসেছি। তোমার সামনে দিয়েই গিয়েছি। তুমি খবরের কাগজ পড়ছিলে বলে দেখ নি।
আসমানীর গলার স্বরে কোনো রাগ নেই। যেন তাদের মধ্যে কোনো ঝগড়া হয় নি। সবকিছু স্বাভাবিক আছে।
শাহেদ দ্রুত চিন্তা করছে। এই মুহুর্তে ঠিক কী করা উচিত? ক্ষমা প্রার্থনা করা যেতে পারে। সেটাই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে। ক্ষমা প্রার্থনা করলেই যে লাভ হবে তাও মনে হচ্ছে না। আসমানী প্রচণ্ড রেগে গেছে। এই রাগ সহজে যাবে না। ভোগাবে। সবচেয়ে ভালো হবে রাগ কমানোর জন্যে সময় দিলে। দুদিন পর কলাবাগানে মুখ কালো করে উপস্থিত হলেই আসমানীর রাগ অনেকটা কমে যাবে। যেতে হবে গভীর রাতে, সাড়ে এগারোটা-বারোটার দিকে। গভীর রাতে যাওয়ার সুবিধা হলো, আসমানী তাকে এত রাতে একা একা বাসায় ফিরতে দেয় না।
কাজেই এই মুহূর্তে রাগ কমানোর জন্যে ব্যস্ত হবার কোনো প্রয়োজন নেই। বরং নিজের রাগ খানিকটা দেখানো যেতে পারে। শাহেদ রাগ দেখানোর জন্যে কঠিন চোখে আসমানীর দিকে তাকিয়ে রইল। চেষ্টা করল পলক না ফেলে তাকিয়ে থাকতে। আসমানী স্বামীর সর্পদৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সহজ গলায় বলল, আমি যাচ্ছি। দরজা লাগিয়ে ঘুমুবে।
দরজা লাগিয়ে ঘুমাই না খোলা রেখে ঘুমাই সেটা আমার ব্যাপার। তোমাকে উপদেশ দিতে হবে না। তুমি যাও, তোমার মায়ের কোলে গিয়ে ঘুমিয়ে থাক।
দয়া করে চব্বিশ ঘণ্টা পার না হতেই আমাকে ফিরিয়ে আনার জন্যে রাতদুপুরে উপস্থিত হবে না।
এত শখ আমার নাই। তুমি বিয়ের পাঁচ বছরের মধ্যে আমার সব শখ মিটিয়ে ফেলেছি।
শাহেদ আরো কঠিন কিছু বলতে যাচ্ছিল, সেই সুযোগ পাবার আগেই আসমানী বের হয়ে গেল। শাহেদ পরের পাঁচ মিনিট বিম ধরে বসে থাকল। তার মাথায় ভালো একটা আইডিয়া এসেছে। আসমানী রিকশা করে গিয়েছে। সে যদি দ্রুত বের হয়ে একটা বেবিট্যাক্সি নিয়ে কলাবাগানে চলে যায়, তাহলে মজা মন্দ হয় না। আসমানী রিকশা থেকে নেমে দেখবে–শাহেদ বারান্দায় বসে। গম্ভীরমুখে খবরের কাগজ পড়ছে। হাতে চায়ের কাপ।
পরিকল্পনা কাজে লাগানো গেল না, কারণ শাহেদ যখন বেবিট্যাক্সির সন্ধানে যাবে বলে ঠিক করেছে তখন ইরতাজউদ্দিন কাশেমপুরীর গলা শোনা গেল, শাহেদ আছ? শাহেদ? এটা বিষ শাহেদের বাসা?
ইরতাজউদ্দিন সাহেব কাজা নামাজ শেষ করলেন। একঘণ্টার মতো লাগল নামাজ শেষ করতে। নিজেই খবরের কাগজ খুঁজে বের করে পড়লেন। খবরের কাগজের কোনো কিছুই বাদ দিলেন না! শুধুই মিটিং-মিছিলের খবর। অফিসআদালত কলকারখানা শেখ সাহেবেয়া আঙুলের ইশারায় চলছে। মেয়েরা গেরিলা ট্রেনিং নিচ্ছে। রেডিও-টিভিতে জাতীয় সঙ্গীত প্রচার বন্ধ করা হয়েছে। কাগজ পড়ে আরো আধা ঘণ্টা গেল। শাহেদ ফিরল না, ইরতাজউদ্দিন সাহেব খুবই বিরক্ত হলেন। যাবে আর আসবে বলে কেউ দেড় ঘণ্টার জন্যে উধাও হয়? কথায়-কাজে মিল থাকতে হয়। গোসলের পর তার ক্ষুধা বোধ হচ্ছে। যে জ্বর আসব আসব করছিল তা মনে হয়। আপাতত সরে গেছে। ইরতাজউদ্দিন সাহেব একফাঁকে রান্নাঘর থেকে ঘুরে এলেন। খাবার থাকলে খেয়ে নেবেন। ডিমের ঝোল আছে, ডাল আছে, কিন্তু ভাত নেই। চারটা চাল তিনি নিজেই চড়িয়ে দিতে পারেন। নিজের রান্না তিনি নিজে করেন। কয়েক মুঠ চাল সিদ্ধ করা কোনো ব্যাপারই না। কিন্তু আসমানী ব্যাপারটা পছন্দ করবে না। মুখে প্রকাশ না করলেও বিরক্ত হবে। মেয়েরা কোনো এক বিচিত্র কারণে বাড়ির পুরুষদের রান্নাঘরে দেখলে বিরক্ত হয়।
ইরতাজউদ্দিনের সময় কাটছে না। তিনি বাস্ত্রান্দায় চলে এলেন। ছোট বারান্দা। দুটা বেতের চেয়ার পাশাপাশি সাজানো। বারান্দা থেকে রাস্তার খানিকটা দেখা যায়। তিনি চেয়ারে বসলেন।
বারান্দায় কিছু হাওয়া আছে। বসার চেয়ারটাও আরামদায়ক। বসে থাকতে ভালো লাগছে। ঘুম ঘুম পাচ্ছে। ঘুমিয়ে পড়াটা ঠিক হবে না। শাহেদ এত দেরি করছে কেন? রাত বেশি হয়ে গেলে আসমানীকে সঙ্গে নিয়ে ফেরা ঠিক হবে না। ইরতাজউদ্দিন ঝিমুতে লাগলেন। ঘুমটা কাটানো দরকার। রুনি এসে দেখবে তার বড় চাচা বারান্দায় চেয়ারে বসে হা করে ঘুমাচ্ছে। বিকট শব্দে তার নাক ডাকছে। এই দৃশ্য তার ভালো লাগবে না। সে সারাজীবন মনে করে রাখবে। বড় চাচার কথা মনে হলেই এই দৃশ্য তার চোখে ভেসে উঠবে। একটা কোনো জিনিস শিশু অবস্থায় মাথায় ঢুকে গেলে আর বের হয় না।
ইরতাজউদ্দিন ঘুম তাড়াবার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। তিনি তাঁর বিয়ের দিনের কথা মনে করলেন। ঘুম তাড়াবার এটা হলো অব্যর্থ ওষুধ, কোরামিন ইনজেকশান। বিয়ের স্মৃতি একবার মনে হলে কোথায় যাবে ঘুম! তিনি কল্পনায় দেখতে পাচ্ছেন–বরযাত্রী নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন বড়লেখা গ্রামে। সুন্দর করে সাজানো বিয়েবাড়ি। কলাগাছ দিয়ে একটা গেট করা হয়েছে। গেটে লেখাস্বাগতম। বানানটা ভুল, আকার বাদ পড়েছে। কিন্তু বিয়েবাড়ি কেমন যেন ঝিম ধরে আছে। কন্যাপক্ষ কারো মুখে কোনো কথা নেই।
চারদিকে ফিসফাস। কানাকানি। কিছুক্ষণের মধ্যে জানা গেল কন্যার কলেরা হয়েছিল। সকাল থেকে ভেদবমি হয়ে আছরের নামাজের ওয়াক্তে মারা গেছে। তারপর শোনা গেল–এখনো মারা যায় নি, বেঁচে আছে। চিকিৎসার জন্যে তাকে সদরে নেয়া হয়েছে। তবে বাচার আশা ক্ষীণ। আসল খবর জানা গেল অনেক পরে। মেয়ের কলেরা হয় নি, তাকে সদরেও নেয়া হয় নি। সে পালিয়ে গেছে। তার এক দূরসম্পর্কের খালাতো ভাইয়ের সঙ্গে শেষরাতের ট্রেনে কোথায় যেন চলে গেছে।
ইরতাজউদ্দিন আর বিয়ে করেন নি। তাঁকে বুঝিয়ে সুজিয়ে বিয়েতে রাজি করানোর তেমন চেষ্টাও কেউ করে নি। তাঁর মুরুবি কেউ ছিল না।
ভোররাতে যে মেয়েটি পালিয়ে গিয়েছিল, তাকে ইরতাজউদ্দিন মাঝে মাঝে স্বপ্নে দেখেন। স্বপ্নে সে তার স্ত্রীর মতোই আচরণ করে। স্বপ্ন দেখার সময় ইরতাজউদ্দিন লজ্জা পান। স্বপ্ন ভেঙে যাবার পরেও লজ্জা পান। স্বপ্ন ভেঙে যাবার পর তিনি আল্লাহপাকের কাছে করুণ গলায় বলেন–হে পারোয়ার দিগার! তুমি আমাকে নিয়ে কেন এই খেলা খেলছ? আমি তো খুবই নাদান বান্দা। আমি যখন মেয়েটিকে পুরোপুরি ভুলে যাই, তখন স্বপ্নে আবার তাকে আমার কাছে নিয়ে আসা কেন? এই ধরনের হৃদয়হীন খেলা শুধু শিশুরাই খেলে। তুমি কি শিশু?
ইরতাজউদ্দিন বেতের চেয়ারে কাত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। ঘুমিয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি স্বপ্নে মেয়েটিকে দেখলেন। এইবার মেয়েটির কোলে চার-পাঁচ বছরের একটি শিশু। শিশুটি দেখতে রুনির মতো। তবে খুবই রোগা। মনে হয় অসুস্থ।
মেয়েটি কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, তুমি এখনো ঘুমাচ্ছ? বাইরে কী অবস্থা তুমি জানো না? বাড়িঘর সব জ্বলিয়ে দিচ্ছে। মিলিটারিরা সমানে গুলি করছে। নাও, ওকে কোলে নাও, চল পালাই।
ইরতাজউদ্দিন সঙ্গে সঙ্গে বুঝে ফেললেন তিনি স্বপ্ন দেখছেন। ঘুম ভাঙলেই এই দৃশ্য মিলিয়ে যাবে; তিনি চেষ্টা করলেন জেগে উঠতে, চেষ্টা তেমন জোরালো না। কারণ স্বপ্নটা দেখতে তাঁর ভালো লাগছে। মেয়েটার (নাম আসমা বেগম)। ভীত মুখ দেখে মজা লাগছে। কারণ তিনি জানেন যা ঘটছে স্বপ্নে ঘটছে। ভয় পাবার কিছু নেই।
এ কী, তুমি এখনো বসে আছ মেয়েটাকে কোলে নাও। তার জ্বর।
ইরতাজউদ্দিন লজ্জিত গলায় বললেন, মেয়েটার নাম কী?
আসমা অত্যন্ত বিরক্ত হলো। এই ভয়ঙ্কর সময়ে তুমি তামশা করছি? নিজের মেয়ের নাম তুমি জানো না?
এই বলেই সে চুপ করে মেয়েটাকে ইরতাজউদিনের কোলে ফেলে দিল। তখন বাইরের হৈচৈ প্ৰবল হলো। লোকজন আগুন আগুন করছে। চারদিকে ছোটাছুটি করছে। মেশিনগানের একটানা গুলির শব্দও শোনা যাচ্ছে। ইরতাজউদ্দিন মেয়েটাকে কোলে নিয়ে ছুটে রাস্তায় নেমে এলেন। রাস্তায় শত শত মানুষ। সবাই একসঙ্গে দৌড়াচ্ছে। আসমা শক্ত করে ইরতাজউদ্দিনের বাঁ হাত ধরে আছে। একজন রূপবতী তরুণী তার হাত ধরে দৌড়াচ্ছে—এটা একটা লজ্জাজনক দৃশ্য। অত্যন্ত দৃষ্টিকটু এবং ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তবে একটা সুবিধা হয়েছে, কেউ তাদের দিকে ফিরে তাকাচ্ছে না। রোজ-হাসরের মতো অবস্থা। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। সবাই ইয়া নফসি ইয়া নফসি করছে। মহাবিপদের আশঙ্কায় সবাই ভীত।
বিপদের উপর বিপদ, লোকজন যে দিকে যাচ্ছে ঠিক সেই দিক থেকেই আরো একদল মানুষ দৌড়াতে দৌড়াতে আসছে। তারা জয় বাংলা জয় বাংলা বলে চিৎকার করছে। তাদের চিৎকারে ইরতাজউদিনের ঘুম ভেঙে গেল। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন–সত্যি সত্যি বিশাল মিছিল বের হয়েছে। রাস্তায় শত শত মানুষ। তাদের হাতে লাঠিসোটা, বর্শা। তারা আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করছে।–জয় বাংলা জয় বাংলা। মিছিলের সঙ্গে একটা ঠেলাগাড়িও যাচ্ছে। ঠেলাগাড়ির মাঝখানে একজন পা ছড়িয়ে বসে আছে। তার হাতে একটা তলোয়ার।
ইরতাজউদ্দিন মিছিলের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার ভুরু কুঁচকে আছে। জয় বাংলা বাক্যটা তার ভালো লাগছে না। জয় বাংলা এসেছে জয় হিন্দ থেকে। এটা ঠিক না। তাছাড়া লাঠিসোটা, বল্লম দিয়ে কিছু হয় না। একশ বছর আগেও বাঁশের কেল্লা দিয়ে তিতুমীর কিছু করতে পারে নি। শুধু শুধুই পরিশ্রম। এটা একটা আফসোস যে বাঙালি জাতি কাজে পরিশ্রম করতে পারে না, অকাজে পারে।
শাহেদ রাত বারোটার দিকে শুকনো মুখে ফিরল। সঙ্গে কেউ নেই। সে একা ফিরেছে। ইরতাজউদ্দিন বললেন, কিরে এত দেরি? শাহেদ মাটির দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বলল, ওদের পেলাম না ভাইজান।
পেলি না মানে কী?
আমার শাশুড়ির এক দূরসম্পর্কের বোন থাকেন। ভূতেরগলিতে। ওরা দল বেঁধে ঐ বাড়িতে গিয়েছে। এতক্ষণ অপেক্ষা করলাম। যদি ফেরে। ফেরে নি। মনে হয় থেকে যাবে। মাঝে মাঝে ওরা সেখানে থেকে যায়। ঐ মহিলা রুনিকে খুব আদর করেন। ওদের কোনো বাচ্চাকাচ্চা নেই তো, রুনিকে নিজের মেয়ের মতো দেখেন। বলতে গেলে উনিই জোর করে রেখে দিয়েছেন।
ইরতাজউদিনের মন আবারো খারাপ হলো। শাহেদ মিথ্যা কথা বলছে। হড়বড় করে মিথ্যা বলছে। বউ আসতে রাজি হয় নি, এটা বললেই হয়। বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বলার দরকার কী? মিথ্যা এমন জিনিস যে কয়েকবার বললেই অভ্যাস হয়ে যায়। তখন কারণ ছাড়াই মিথ্যা বলতে ইচ্ছা করে।
ভাইজান, আপনি কি শুয়ে পড়বেন? রাত অনেক হয়েছে। শুয়ে পড়াই ভালো। বিছানা করে দেই?
দে।
খালি পেটে ঘুমুবেন? ক্ষুধা হয় নি?
ক্ষুধা হয়েছে তারপরেও ইরতাজউদ্দিন বললেন, না। মিথ্যা বলা হলো। তিনি যদি বলতেন। ক্ষুধা হয়েছে, তাহলে ভাত রাধার ব্যাপার চলে আসবে। শাহেদ বিব্রত হবে। সে তার বড় ভাইকে ভাত রাঁধতে দেবে না। নিজেই রাধতে গিয়ে ছেড়াবেড়িা করবে। এরচেয়ে মিথ্যা বলাই ভালো। উপকারী মিথ্যা। তারপরেও মিথ্যা মিথ্যাই। অপকারী মিথ্যা যেমন দূষণীয়, উপকারী মিথ্যাও তেমনি দূষণীয়। ইরতাজউদ্দিন ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোকে ক্ষুধা হয় নি বলেছিলাম এটা ঠিক না, মিথ্যাচার করেছি; ক্ষুধা হয়েছে। তবে কিছু খাব না। শুয়ে পড়ব। বিছানা করে দে। মশারি খাটাবি না।
মশারি না খাটালে ঘুমুতে পারবেন না। খুব মশা।
থাকুক। মশা। মশারির ভেতর আমার ঘুম আসে না। দমবন্ধ দমবন্ধ লাগে।
শাহেদ বসার ঘরে তার ভাইয়ের জন্য বিছানা করল। খুঁজে-পেতে একটা হাতপাখাও বের করল। ইব্রতাজউদ্দিন শোবার সময় অবধারিতভাবে সিলিং ফ্যান বন্ধ করে দেবেন। কারণ, ফ্যানের বাতাসেও তিনি ঘুমুতে পারেন না। ফ্যানের বাতাসে না-কি তার শরীর চিড়বিড় করে।
মশা আসলেই বেশি। চারদিকে পিনপিন করছে। বাতি নেভালে কী অবস্থা হবে কে জানে। হাতো এই গবমেও চাদর মুড়ি দিয়ে শুতে হবে। ইরতাজউদ্দিন যেসব কারণে ঢাকা আস৩ে চান না মশা তার একটি। তিনি ছোটভাইকে বললেন, তুই শুধু শুধু জেগে আছিস কেন? শুয়ে পড়।
শাহেদের কিছুক্ষণ গল্প করতে ইচা করছে। দেড়টা-দুটার আগে সে কখনো ঘুমায় না। এখন বাজছে মাত্র সাড়ে বারটা। তা ছাড়া শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে তার মেজাজ খারাপ হয়েছে। তার বড়ভাই এসেছেন–এটা জানার পরেও আসমানী তার সঙ্গে আসবে না, এটা ভাবাই যায় না। শাহেদ খুবই করুণ গলায় বলেছে, ভাইজান এসেছে। আস, প্লিজ আস। তার উত্তরে আসমানী বলেছে, তোমার ভাইজান এসেছে, তুমি তাকে কোলে নিয়ে বসে থাক। আমি কী জন্যে যাব?
আসমানী এধরনের কথা বলতে পারে তা শাহেদের কল্পনার মধ্যেও ছিল না। তার খুবই মনখারাপ হয়েছে। ভাইয়ের সঙ্গে গল্প করে সে মনখারাপ-ভাবটা কাটাতে চাচ্ছে। কিন্তু ইরতাজউদ্দিনের মনে হয় গল্প করার মতো অবস্থা না।
শাহেদ বলল, ভাইজান, ঢাকায় কোনো কাজে এসেছেন? না-কি বেড়াতে এসেছেন?
কাজে এসেছি। তোদের দেখতে এসেছি, এটাও তো একটা কাজ। কাজ না?
জি কাজ।
ভালো আতর কিনব। আন্তর শেষ হয়ে গেছে।
আমি আতর কিনে দেব।
তোকে কিনতে হবে না। আতরের ভালো-মন্দ তুই কী বুঝিস! আমিই কিনব। আর স্কুলের জন্যে একটা পতাকা কিনতে হবে। আগেরটার রঙ রোদে জুলে গেছে।
শাহেদ বিস্মিত হয়ে বলল, কী পতাকা কিনবেন?
ইরতাজউদ্দিন বিরক্ত গলায় বললেন, জাতীয় পতাকা। এছাড়া আর কী * পতাকা আছে!
ভাইজান, পতাকা কেনোটা ঠিক হবে না।
কেন ঠিক হবে না?
দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে–নতুন পতাকা আসবে।
হুজুগের কথা আমার সঙ্গে বলবি না। দেশ স্বাধীন হয়েই আছে। নতুন করে আবার স্বাধীন কীভাবে হবে?
শাহেদ নরম গলায় বলল, ভাইজান, আপনি পরিস্থিতিটা বুঝতে পারছেন না!
ইরতাজউদ্দিন ভাইকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, পরিস্থিতি তোরা বুঝতে পারছিস না। জয় বাংলা জয় বাংলা বলে চোঁচালেই দেশ স্বাধীন হয় না। পাকিস্তানি মিলিটারি যখন একটা ধাক্কা দিবে, তখন কোথায় যাবে জয় বাংলা!
শাহেদ বলল, ভাইজান, আমি দুএকটা কথা বলি?
ইরতাজউদ্দিন বিরক্ত গলায় বললেন, কথা বলার দরকার নাই। যা, ঘুমুতে যা। সকালে কথা হবে। সিলিং ফ্যান বন্ধ করে দিয়ে যা।
ঢাকায় কতদিন থাকবেন?
কাল সকালে চলে যাব ইনশাল্লাহ।
কালকের দিনটা থেকে যান।
কালকের দিনটা থেকে গেলে কী হবে?
শাহেদ জবাব দিতে পারল না। ইরতাজউদ্দিন সাহেব প্রশ্নের উত্তর দেন। পাল্টা প্রশ্ন দিয়ে। সেইসব প্রশ্ন আচমকা চলে আসে বলে তার জবাব চট করে দেওয়া যায় না। ইরতাজউদ্দিন হাই তুলতে তুলতে বললেন, থেকে যেতাম, রুনি কত বড় হয়েছে দেখার শখ ছিল। উপায় নেই, স্কুল খোলা। স্কুল কামাই দিয়ে তো আর শখ মেটানো যায় না। আগে স্কুল, তারপর অন্য কিছু। মানুষকে কম্পাসের মতো হতে হয় বুঝলি। কম্পাসের কাটা যেমন একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে স্থির হয়ে থাকে, মানুষকেও সে-রকম থাকতে হয়। মনের কােটাটাকে আমি স্কুলের দিকে ঠিক রেখে বাকি কাজকর্মগুলো করি।
ইরতাজউদ্দিনের মনে হলো তিনি ক্লাসে বক্তৃতা দিচ্ছেন। এই এক সমস্যা হয়েছে। কথা বলতে গেলেই বক্তৃতার ভঙ্গি চলে আসে। দীর্ঘদিন মাস্টারি করার কুফল। সবাইকে ছাত্ৰ মনে হয়।
শাহেদ।
জি।
ঘরে চিড়ামুড়ি জাতীয় কিছু আছে? এখন কেমন জানি ক্ষিধেটা বেশি লাগছে।
শাহেদ শুকনো মুখে উঠে গেল; কারণ সে মোটামুটি নিশ্চিত ঘরে কিছু নেই। আর থাকলেও সে খুঁজে পাবে না। চিড়ামুড়ি তো নিশ্চয়ই নেই। চানাচুর থাকতে পারে। সেই চানাচুর রান্নাঘরের অসংখ্য কৌটার কোনটায় আছে কে বলবে? একজন ক্ষুধার্তা মানুষকে ছাতা পড়া বাসি চানাচুর দেওয়া যায় না।
পিরিচে ঢাকা দেওয়া আধাগ্রাস দুধ পাওযা গেল। দুধ থেকে কেমন টকটক গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। নষ্ট হয়ে গেছে কি-না কে বলবে। শাহেদ লজ্জিত ভঙ্গিতে দুধের গ্লাস নিয়ে ভাইয়ের সামনে রাখল। বিব্রত গলায় বলল, আর কিছু পেলাম না ভাইজান।
ইরতাজউদ্দিন একচুমুকে দুধটা খেয়ে ফেললেন। খেতে গিয়ে টের পেলেন দুধটা নষ্ট। না খেলে শাহেদ মনে কষ্ট পাবে বলেই গ্রাসের তলানি পর্যন্ত শেষ করে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ।
শাহেদ বলল, ভাইজান, দুধটা কি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল?
না।
আবারো একটু মিথ্যা বলতে হলো। শাহেদের মনে কষ্ট দিয়ে লাভ কী। কিন্তু মিথ্যার আশ্রয় নেওয়াটা কি ঠিক হলো? না, ঠিক হয় নি। সত্যের জন্য কেউ যদি মনে কষ্ট পায় তাহলে পাক। ইরতাজউদ্দিন বললেন, দুধটা টিকে গেছে। তবে খেতে খারাপ লাগে নি।
দুধ খেতে গিয়ে তার একটা মজার স্মৃতি মনে পড়ল। গতবছর জুন মাসে শান্তাহার স্টেশনে তিনি দুধ খাওয়ার একটা দৃশ্য দেখেছিলেন। তিনি যাবেন বগুড়া। ট্রেনের জন্য শান্তাহারে তাকে চারঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। ট্রেন বিকেল পাঁচটায়। স্টেশনের ওয়েটিং রুমের একটা ইজিচেয়ারে তিনি শুয়ে পড়লেন এবং একসময় ঘুমিয়ে পড়লেন। হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখেন ওয়েটিং রুম ভর্তি মানুষ। চারদিক গমগম করছে। মনে হচ্ছে বিরাট জলসা। আসরের মধ্যমণি হয়ে যিনি বসে আছেন তাকে চেনা-চেনা মনে হচ্ছে কিন্তু ঠিক চেনা যাচ্ছে না। হৃষ্টপুষ্ট একজন মানুষ, মাথায় গোল টুপি । মুখভর্তি সফেদ দাড়ি। তার হাতে কে একজন কানায় কানায় ভর্তি একগ্লাস দুধ এনে দিল। বিনীত ভঙ্গিতে বলল, আমার নিজের গাইয়ের দুধ। হুজ্বরের জন্য এনেছি। মাওলানা ধরনের মানুষটা দুধের গ্লাস হাতে নিয়ে বললেন, দুধ খেতে ইচ্ছা করতেছে না। তবে দুধ এবং মধু এই দুই তরল খাদ্যদ্রব্য আমাদের আখেরি নবির বড়ই পছন্দের পানীয়। কাজেই খাচ্ছি। বলেই তিনি একচুমুকে গ্লাস শেষ করে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ। খুবই ভালো দুধ। কালো গাইয়ের দুধ?
যে লোক দুধ এনেছিল সে বিনয়ে নিচু হয়ে বলল, জি হুজুর।
দুধে চুমুক দিয়েই বুঝেছি। কালো গাইয়ের দুধ ছাড়া দুধ এত মিষ্টি হয় না।
ইরতাজউদ্দিন তখনি মাওলানা সাহেবকে চিনলেন–ইনি মাওলানা ভাসানী। পত্রিকায় কত ছবি দেখেছেন। এই প্ৰথম সামনাসামনি দেখা।
ইরতাজউদ্দিন তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিলেন। মাওলানা ভাসানী তার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, ঘুম ভালো হয়েছে? যেন কতদিনের চেনা মানুষ।
ইরতাজউদ্দিন বিনয়ের সঙ্গে বললেন, জি।
আপনার ঘুমের ব্যাঘাত করেছি, কিছু মনে করবেন না।
ইরতাজউদ্দিন আরো লজ্জার মধ্যে পড়ে গেছেন। এরকম একজন বিখ্যাত মানুষের সামনে ইজিচেয়ারে শুয়ে থাকা যায় না। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। মাওলানা তখন অন্যপ্রসঙ্গে চলে গেছেন। সুট পরা রোগামতো এক ভদ্রলোককে বলছেন— দেশের অবস্থা শুনবা? পাঁচটা গ্রামে ঘুরে আমি একটা পঞ্চাশ টাকার নোট ভাঙাতে পারি নাই। এই হলো দেশের অবস্থা। কিছু একটা করা দরকার। কিছু করো। মাছি আর কত মারবা? অনেক তো মাছি মারলা।
মাওলানা ভাসানী ওয়েটিং রুমেই আছরের নামাজ পড়লেন। বিরাট জামাত হলো। ইরতাজউদ্দিন সেই জামাতে সামিল হলেন। জামাতে সামিল হওয়ার জন্য তিনি ট্রেন ফেল করলেন। কারণ মাওলানা দীর্ঘ দোয়া শুরু করলেন। সেই দোয়া চল্লিশ মিনিট স্থায়ী হলো। এর মধ্যে ইরতাজউদ্দিন সাহেবের গাড়ি ছেড়ে দিল। একবার ইরতাজউদ্দিন ভাবলেন, দোয়া ছেড়ে দৌড়ে গিয়ে গাড়ি ধরে ফেলেন। শেষপর্যন্ত তিনি তা করলেন না। দোয়ার মাঝখানে উঠে যাওয়া যায় না, সেটা অভদ্রতা হয়। এতবড় একজন মানুষের সঙ্গে তিনি অভদ্রতা করতে পারেন না। ট্রেন ফেল করা এমন কোনো বড় ব্যাপার না। একটা ফেল করলে আরেকটা পাওয়া যায়। এই ধরনের মানুষের সঙ্গ সবসময় পাওয়া যায় না।
নষ্ট দুধ খেতে দিয়ে শাহেদ কেমন মনমরা হয়ে আছে। মাওলানা ভাসানীর গল্পটা বলে তার মনমরা ভাবটা কাটাবেন কি-না ইরতাজউদ্দিন তা ধরতে পারলেন না। শাহেদ বলল, ভাইজান, শুয়ে পড়েন। তিনি শুয়ে পড়লেন।
ফ্যানটা বন্ধ করে দে।
ফ্যান থাকুক-না ভাইজান। গরম খুব বেশি।
ফ্যানের বাতাসে ঘুম হয় না–এটা কতবার বলব!
শাহেদ ফান বন্ধ করে দিল।
ইরতাজউদ্দিন সাহেব ক্লান্ত হয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লেন। এক ঘুমে রাত পার করে দিলেন। এত তৃপ্তি করে তিনি অনেকদিন ঘুমুন নি। ঘুম ভেঙে তিনি বিস্ময়ের সঙ্গে দেখলেন, তার উপরে মশারি খাটানো আছে এবং ফুল স্পিডে ফ্যান ঘুরছে। তার ঘুমের মধ্যেই শাহেদ এই কাজটি করেছে। এতে তাঁর ঘুমের কোনো অসুবিধা হয় নি। বরং অন্য দিনের চেয়েও অনেক তৃপ্তি করে ঘুমিয়েছেন। মশারি এবং ফ্যান সম্পর্কে তার এতদিনের ধারণায় কিছু ভুল আছে। এই ভুল শোধরাতে হবে। মানুষমাত্রই ভুল করে, তবে তার সুবিধা হচ্ছে সে ভুল শোধরাবার সুযোগ পায়।
শাহেদের অফিস মতিঝিলে
শাহেদের অফিস মতিঝিলে। আধুনিক কেতার ছিমছাম অফিস বলতে যা বোঝায়, এই অফিস মোটেই সে-রকম না। আউলা ঝাউলা অফিস। অফিসের কর্মচারীদের টেবিল চেয়ারের পাশেই গাদা করে রাখা মালামাল। যদিও মালামাল রাখার জন্যে নিচে গোডাউন আছে। কোনো অফিস ঘরেই খাটিয়া থাকার কথা না, এই অফিসে খাটিয়া পাতা আছে। প্রায়ই সেখানে কাউকে না। কাউকে গড়াগড়ি করতে দেখা যায়। কেউ কিছু মনে করে না। আশপাশের সাত-আট তলা দালানের মাঝখানে কটকটা হলুদ রঙের (শাহেদের ভাষায় গু–কালার) দোতলা দালান। বারো হাত কাকুড়ের সাড়ে পনেরো হাত বিচির মতো বিশাল এক সাইনবোর্ড। সেখানে লেখা–United Commercial. সাইনবোর্ডের কয়েকটা অক্ষর মুছে গেছে। তাতেও কারো কোনো গরজ নেই।
সাড়ে বত্রিশ ভাজা অফিস। ইন্সুরেন্স, ইনডেনটিং, শেয়ার বিজনেস। অফিসের মালিকের নাম মইন আরাফী। মুর্শিদাবাদ বাড়ি। দেশ বিভাগের সময় দুইশ রূপেয়া, একটা রুপার হুক্কা এবং একটা দামি শাল নিয়ে চলে এসেছিলেন। শাল বিক্রি করে প্রথম তিনি ফলের ব্যবসা শুরু করেন। রুপার হুক্কাটা অনেক কষ্টে রক্ষা পায়। সেই হুক্কা তিনি অফিসে ব্যবহার করেন। মইন আরাফী সাহেবের ধারণা, হুক্কা টানার সময় হুক্কা কথা বলে। কাজকর্ম যখন থাকে না তখন না-কি হুক্কার কথা শুনতে ভালো লাগে। মইন আরাফী সাহেব এখন লক্ষপতির উপরে যা আছে সেই পতি। ভদ্রলোকের মাথায় যখন যে বিজনেস এসেছে তিনি করেছেন এবং টাকা এসেছে জলের মতো।
ভদ্রলোকের বয়স ষাট। বেটে গাটাগুট্টা চেহারা। টকটকে গৌরবর্ণের মানুষ। মাথায় কোনো চুল নেই, কিন্তু বাদামি রঙের বাহারি গোফ আছে। অফিসের কর্মচারীদের সঙ্গে তার ব্যবহার অত্যন্ত অমায়িক। কোনো কর্মচারীকে যখন তার প্রয়োজন হয়, তিনি তাকে ডেকে পাঠান না। নিজে তার কাছে উপস্থিত হন। সবার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলেন। এবং একটা পর্যায়ে বলেন, Be happy man! Be happy!
অফিসে তাঁর নাম বি হ্যাপি স্যার। অফিসের সমস্ত কর্মচারী মানুষটিকে সত্যিকার অর্থেই পছন্দ করে। বিবাহ বার্ষিকী, ছেলের জন্মদিন, মেয়ের পানচিনিতে বি হ্যাপি স্যারের দাওয়াত হয়। ভদ্রলোক যান বা না যান, একটা উপহার পাঠান। বেশ দামি উপহার।
শাহেদ অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার মেজাজ যথেষ্ট পরিমাণ খারাপ। ঘড়িতে নটা বাজছে। দশটা থেকে অফিস। সে একঘণ্টা আগে চলে এসেছে। দেরি করে অফিসে আসার নানান কারণ থাকে। একঘণ্টা আগে অফিসে আসার কারণ একটাই–বেকুবি। শাহেদ বেকুব না। আসমানীর সঙ্গে রাগ দেখাতে গিয়ে সে কাজটা করেছে। এই রাগটা না দেখালে একঘণ্টা আগে অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো না।
আসমানী চারদিন বাবার বাড়িতে পার করে আজ সকালে হাসিমুখে হাতে একটা ছােট্ট টিফিন কেরিয়ার ঝুলিয়ে উপস্থিত হয়েছে। শাহেদের সঙ্গে কোনো সমস্যাই হয় নি–এরকম ভঙ্গি করে বলেছে, এই রিকশা ভাড়াটা দিয়ে এসো তো। আমার কাছে ভাংতি নেই। নাশতা করেছ? আমি নাশতা নিয়ে এসেছি।
শাহেদ জবাব না দিয়ে রিকশা ভাড়া দিতে গেল। একবার ভাবল রিকশা ভাড়া দিয়েই সে দিলবাগ রেস্টুরেন্টে চলে যাবে। সেখানে পরোটা বুন্দিয়া নাশতা খেয়ে সোজা অফিস। এতে রাগ দেখানো হবে। কাজটা করতে পারল না, কারণ রুনিকে আদর করা হয় নি। চারদিন মেয়ের সঙ্গে দেখা হয় নি। তার কাছে মনে হচ্ছে চার বছর।
পত্রিকা দিয়ে গেছে। শাহেদ পত্রিকা হাতে ঘরে ঢুকল। সে ঠিক করেছে, আসমানীর কোনো প্রশ্নেরই জৈবাব দেবে না। মুখের সামনে পত্রিকা ধরে রাখবে। শাহেদ বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করল, আসমানী খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ঘর ঠিকঠাক করছে। তারচেয়েও বিস্ময়কর রুনির ব্যবহার। সে কাগজে ছবি আঁকছে। একবারও বাবার দিকে তাকাচ্ছে না। যেন সে বাবাকে চিনতেই পারছে না।
আসমানী বলল, এই কদিন কোথায় খেয়েছ? নিজে রান্না করেছ, না হোটেলে?
শাহেদ গম্ভীর গলায় বলল, হোটেলে।
ভাইজান কবে গেছেন?
চেপে রেখে বলল, যেদিন এসেছেন তার পরদিনই চলে গেছেন।
আমি উনাকে চিঠি লিখেছিলাম আমচুর নিয়ে আসতে। এনেছেন?
শাহেদ জবাব দিল না। সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে, এইসব হচ্ছে আসমানীর খাতির জমানো কথা। খেজুড়ে আলাপ। এই আলাপে যাবার কোনো মানে হয় না।
আসমানী বলল, তোমাকে নাশতা দিয়ে দেই? চালের আটার রুটি আর কবুতরের মাংস।
কবুতর খাই না।
কবুতর খাও না কেন?
কেন খাই না। এত ব্যাখ্যা তো দিতে পারব না। খাই না মানে খাই না।
কবুতরের মাংস ছাড়া অন্য কোনো মাংস হলে খাবে?
শাহেদ বিরক্ত চোখে তাকাল। আসমানীর চোখে-মুখে চাপা হাসি। আসমানী বলল, তুমি কবুতরের মাংস খাও না, আমি জানি। মা কবুতরের মাংস রান্না করেছিল। আমি ফ্রিজের বাসি গরুর মাংস নিয়ে এসেছি। গরম করে দিচ্ছি, তুমি খাও।
শাহেদ কিছু বলল না। গভীর মনোযোগে পত্রিকা পড়তে লাগল। তার মেজাজ খারাপ হচ্ছে রুনির দিকে। মেয়েটা বাবাকে চিনতে পারছে না–এই ঢং কোখেকে শিখেছে? নিশ্চয়ই মার কাছ থেকে। কাগজে কাকের ঠ্যাং, বকের ঠ্যাং আঁকাটা কি এখন এতই জরুরি? তার উপর দেখা যাচ্ছে তার বা হাতের একটা আঙুলে ব্যান্ডেজ বাধা। কী করে ব্যথা পেয়েছে এটাও সে বলবে না?
আসমানী বলল, হ্যালো রাগ কুমার! তুমি যদি ভাবো। আমি তোমার কাছে সরি বলব, তাহলে ভুল করেছ। তোমার উপর রাগ করে আমি যে চারদিন মায়ের কাছে ছিলাম, আমি ঠিকই করেছি। তবে ভাইজানের সঙ্গে দেখা করতে আসি নি–এটা খুবই বড় ভুল হয়েছে। এই ভুলের জন্যে আমি বড় ভাইজানের কাছে ক্ষমা চাইব। তোমার কাছে ক্ষমা চাইব কেন?
শাহেদ বলল, আমি তো তোমাকে ক্ষমা চাইতে বলছি না। কেন এত কথা दब्लछ?
আসমানী বলল, তুমি যদি স্বাভাবিকভাবে আমার সঙ্গে কথা না বলো, তাহলে আমি কিন্তু আবার মার কাছে চলে যাব।
যেতে চাইলে যাবে। মাংস গরম করে এনেছি, খেতে এসো। আচ্ছা আমি ভুল করেছি। সরি। এখন পায়ে ধরতে পারব না। রাতে পায়ে ধরব। সত্যি পায়ে ধরব।
এই কথার পর শাহেদের উচিত ছিল স্বাভাবিকভাবে খেতে বাসা। ঝোল ঝোল মাংস, চালের আটার রুটি তার খুবই পছন্দের খাবার। আসমানী নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করার জন্যেই বোধহয় হঠাৎ শাহেদের রাগ বেড়ে গেল। সে খবরের কাগজ ছুঁড়ে ফেলে গাঁটগট করে বের হয়ে গেল। তার রাগটা কমে গোল রিকশায় উঠার সঙ্গে সঙ্গে। তখন আর ফেরা যায় না। রিকশাওয়ালা রিকশা টানতে শুরু করেছে।
শাহেদ দাঁড়িয়ে আছে অফিসের সামনে। অফিস খুলেছে। সে ইচ্ছা করলেই তার চেয়ারে বসতে পারে। অফিসের পাশেই ছাপড়া রেস্টুরেন্টের মতো আছে। রেস্টুরেন্টের মালিক বিহারি, সে সকালে রুমালি রুটি এবং মুরগির লটপট নামে একটা খাদ্য তৈরি করে। অতি সুস্বাদু। অফিসের পিওন পাঠিয়ে সেখান থেকে নাশতা আনা যায়। ভালো ক্ষিধে লেগেছে। ক্ষিধের চোটে বুক জ্বালা করছে। কিন্তু শাহেদের অফিসে ঢুকতে ইচ্ছা করছে না। তার ইচ্ছা করছে বাসায় ফিরে যেতে।
কেমুন আছেন Young man?
শাহেদ চমকে তাকাল। বি হ্যাপি স্যার ঠিক তার পিছনেই দাঁড়িয়ে আছেন। এই ভদ্রলোকের শরীর ভারী কিন্তু তিনি হাঁটেন নিঃশব্দে।
অফিসে এখন এমুন কী কঠিন কাজ যে Early আসতে হোবে?
স্যার, ভালো আছেন?
অফকোর্স ভালো আছি। আপনার ছোট বাচ্চাটা কেমুন আছে–Little baby?
স্যার, ভালো আছে।
Be happy young man, Be happy
বলেই আরাফী সাহেব শাহেদের কাধে হাত রাখলেন। শাহেদ জানে, ভদ্রলোক কাঁধ থেকে হাত সরাবেন না। এইভাবেই অফিসে ঢুকবেন। ভদ্রলোকের ব্যবহার কতটুকু আন্তরিক এবং কতটুকু ভান কে জানে! বেস জাতীয় মানুষদের কাছ থেকে ভালো ব্যবহার পাওয়া যায় না। যখন পাওয়া যায়। তখন মনে হয় কোথাও বোধহয় সমস্যা আছে।
শাহেদ সাব।
জি স্যার।
ব্যবসা তো সব বন্ধ। জয় বাংলা বলে চিৎকার করলে তো পেটে দানাপানি আসবে না। ঠিক বুলেছি?
বসদের সব কথাতেই হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়তে হয়। শাহেদ তাই নাড়ল।
মইন আরাকী হাসিমুখে বললেন, বি হ্যাপি ইয়াং ম্যান। বি হ্যাপি।
শাহেদ মনে মনে ঠিক করল কোনো একদিন সুযোগ পেলে সে জিজ্ঞেস করবে–বি হ্যাপি বলা তিনি কবে থেকে শুরু করেছেন? প্রথম তিনি কাকে বলেছিলেন, বি হ্যাপি?
ঢিলাঢালাভাবে অফিস শুরু হয়েছে। অফিসের লোকজনও সব আসে নি। চারদিক ফাঁকা ফাকা। এই অফিস আগে গামগম করত। নানান ধরনের লোকজন নানান ধান্ধায় ঘুরত। একতলার গোডাউন সেকশনে হৈহল্লা হতো। মারামারি মাথা ফাটাফাটি হতো। এখন সব ফাঁকা। গোডাউনে কোনো মাল নেই। অফিসের লোকজনেরও কোনো কাজকর্ম নেই। আগে যেখানে হেড ক্যাশিয়ার আসগর আলি দেওয়ান এক হাজার ভাউচারে সই করতেন, সেখানে উনি এখন পনেরো-বিশটার বেশি ভাউচার সই করেন না। হাতের কাজ শেষ হয়ে যায় দুপুরের আগেই। তখন তিনি আরাম করে পান খান এবং এই দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলাপ করেন। এই বিষয়ে গল্প করতে তার ভালো লাগে। তার ধারণা এই দেশের কপালে আল্লাহপাক বোল্ড লেটারে লিখে দিয়েছেন–Closed, রেস্টুরেন্টে যেমন Closed সাইনবোর্ড কুলায় সে-রকম। তাঁর ধারণা এই দেশের অতীতে কিছু হয় নি, ভবিষ্যতেও কিছু হবে না। কেউ তাঁর কথার বিবোধিতা করলে তিনি ঠাণ্ডা গলায় বলেন, আপনার পুরা নামটা যেন কী? আব্দুল গনি না? এখন থেকে নামের শেষে শিশু টাইটেল লাগায়ে দেন। বর্তমানে আপনার নাম আব্দুল গনি শিশু। আপনার চিন্তাশক্তি শিশু লেভেলে। বুঝেছেন?
দেওয়ান সাহেবের আশপাশে কেউ যায় না। আগ বাড়িয়ে শিশু টাইটেল নেয়ার দরকার কী?
দুপুর বারোটার দিকে দেওয়ান সাহেব পান-জর্দা নিয়ে বসলেন। শাহেদের দিকে হাত ইশারা করে বললেন, একটু শুনে যান।
শাহেদ বলল, দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথাবার্তা শুনতে ইচ্ছা করছে না।
দেওয়ান সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, কাছে আসেন। অন্য ব্যাপার। মুখোমুখি না বসলে বলা যাবে না। জরুরি ব্যাপার।
শাহেদ নিতান্ত অনিচ্ছায় উঠে এসে দেওয়ান সাহেবের সামনের চেয়ারে বসল।
দেওয়ান সাহেব বললেন, পান খাবেন না-কি?
শাহেদ বলল, আমি পান খাই না।
খান না বলেই তো খাবেন। টেষ্ট কী রকম দেখবেন।
জরুরি ব্যাপারটা কী বলেন।
দেওয়ান সাহেব পান চিবুতে চিবুতে বললেন, ছটফট করছেন কেন? হাতে কোনো কাজ নাই। ছটফট কবরও কিছু নাই। আপনার একটা চিঠি আছে আমার কাছে।
কী চিঠি?
কাল তো আপনি অফিসে আসেন নাই। গৌরাঙ্গ বাবু আপনাকে খুব ব্যস্ত হয়ে খোজ করছিলেন। একটা চিঠি আমার কাছে দিয়ে গেলেন। খামের উপরে লেখা—জরুরি।
শাহেদ বলল, চিঠিটা দিন।
দেওয়ান সাহেব বললেন, দিচ্ছি। এত অস্থির হচ্ছেন কেন? দেশ কোন দিকে যাচ্ছে কিছু বুঝতে পারছেন?
না।
দেশেব ইকনমি টোটালি ধ্বংস হয়ে গেছে, কেউ কিছু বুঝতে পারছে না। শেষ ভরসা আমেরিকা। পিএল ফোর এইটির পশম; গম যাবে আমরাও যাব।
শাহেদ বলল, ও আচ্ছা।
দেওয়ান সাহেব গলা নিচু করে বললেন, আমাদের অফিস যে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে এটা জানেন?
জানি না তো।
আমাদের নি। হ্যাপি স্যার, আপনাদের সবার চোখে আদর্শ মানব, তলে তলে সব বিক্রি করে দিচ্ছেন। ক্যাশ নিয়ে চলে যাবেন করাচি। ফ্যামিলি চলে গেছে। তিনি থেকে গেছেন। আগামী মাসে বেতন হবে না। বুড়ো আঙুলে সামান্য চিনি মাখিয়ে চুষতে হবে। যাদের ডায়াবেটিস আছে, তারা চুষবে শুধু বুড়ো আঙুল।
শাহেদ বলল, আপনাকে কে বলেছে। অফিস বিক্রি হয়ে যাচ্ছে?
দেওয়ান সাহেব বললেন, এইসব গোপন কথা কি কেউ আগ বাড়িয়ে বলে? হাবে ভাবে বুঝেছি। তবে স্যারের ফ্যামেলি যে করাচি চলে গেছে এইটা জানি। তাদের পিআইএর টিকিট আমি কেটেছি।
বাড়িতে কি স্যার একা থাকেন?
একা থাকেন, না-কি দোকা থাকেন আমি জানি না। তবে স্যারের ফ্যামিলি যে ফুড়ুৎ করে চলে গেছে এইটা জানি। বি হ্যাপি স্যারের নাম এখন হওয়া উচিত বি স্যাড স্যার।
শাহেদ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, চিঠিটা দিন, চলে যাই।
দেওয়ান সাহেব বললেন, কথা শুনতে ভালো লাগছে না? সত্য কথার প্রধান সমস্যা হলো, সত্য কথা শুনতে ভালো লাগে না। যে বলে তাকেও ভালো লাগে না। মিথ্যা কথা শুনতে ভালো লাগে। যে বলে তাকেও বড় আপন মনে যা হোক, আমার সঙ্গে কথা বলতে না চাইলে নাই। এই দিন গৌরাঙ্গ বাবুর চিঠি।
গৌরাঙ্গের সঙ্গে শাহেদের খুব যে মাখামাখি পরিচয় তা-না। গৌরাঙ্গ এবং শাহেদ একই দিনে এই অফিসে চাকরিতে জয়েন করেছিল। কাকতালীয়ভাবে দুজনের পরনেই ছিল ঘিয়া রঙের পাঞ্জাবি। গৌরাঙ্গ সেদিন অবাক হয়ে বলেছিল, শাহেদ ভাই, আমাদের কোইনসিডেন্সটা দেখেছেন? পয়েন্টে পয়েন্টে মিলে যাচ্ছে।
তারচেয়েও বড় মিল যেটা পাওয়া গেল— দুজনেরই প্রথম সন্তান কন্যা। একজনের নাম রুনি, আরেকজনের রুনু।।
গৌরাঙ্গ এই মিল দেখে অফিসের শেষে ক্যান্টিনে চা খেতে খেতে বললআমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। এর মধ্যে ঈশ্বরের একটা খেলা আছে। দেখবেন আমাদের জীবনে একজনের ঘটনার সঙ্গে আরেকজনের ঘটনা মিলে যাবে। আমি যেদিন অফিসে নীল শার্ট পরে আসব দেখা যাবে আপনিও নীল শার্ট পরে এসেছেন। আমার পরিবারে যেদিন আনন্দের কোনো ঘটনা ঘটবে, আপনার পরিবারেও ঘটবে। আমার ঠাকুরমা যেদিন মারা যাবে, দেখা যাবে আপনার দাদিও সেদিন মারা যাবে।
শাহেদ হেসে ফেলল।
গৌরাঙ্গ বলল, হাসছেন কেন?
শাহেদ বলল, কোনো কারণ ছাড়াই হাসছি।
গৌরাঙ্গ আহত গলায় বলল, আমি সিরিয়াস একটা বিষয় নিয়ে কথা বলছি, আপনি হেসে দিলেন কেন?
সরি।
না, এরকম করবেন না। এতে আমি মনে কষ্ট পাই।
কিছুদিনের মধ্যেই শাহেদ লক্ষ করল গৌরাঙ্গের স্বভাবই হলো তুচ্ছ সব কারণে মনে কষ্ট পাওয়া। যেমন একদিন গৌরাঙ্গ এসে শাহেদের টেবিলে বসতে বসতে বলল, আজ থেকে আমি আপনাকে তুই করে বলব। আপনিও আমাকে তুই করে বলবেন। দিস ইজ ফাইনাল।
শাহেদ অবাক হয়ে বলল, কেন?
গৌরাঙ্গ আহত গলায় বলল, কারণ আমরা বন্ধু, এই জন্যে। আপনি কখনো শুনেছেন দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু একে অন্যকে আপনি করে বলছে?
শাহেদ কিছু বলল না।
গৌরাঙ্গ বলল, তুই রাজি না?
শাহেদ বলল, একমাসও হয় নি আমাদের পরিচয়, এর মধ্যে হঠাৎ করে একদিন দুজন দুজনকে তুই বলছি–এটা চোখে লাগবে না?
গৌরাঙ্গ বলল, কার চোখে লাগবে?
শাহেদ বলল, সবার।
গৌরাঙ্গ বলল, ঠিক আছে, আপনাকে তুই বলতে হবে না। আমিও বলব না। কথা দিচ্ছি। প্রয়োজন ছাড়া আমি আপনার সঙ্গে কথাও বলব না।
গৌরাঙ্গ নিজের টেবিলে ফিরে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে দেখা গেল আরেক সহকমীরি সঙ্গে কথা বলে সে জায়গা বদল করছে। আগের জায়গাটা ছিল শাহেদের মুখোমুখি, এখনেরটা দূরে। এই অবস্থায় চার-পাঁচ দিন কাটাবার পর গৌরাঙ্গ আবার আগের জায়গায় চলে এলো। বিকেলে অফিস শেষ করে জোব করে ক্যান্টিনে চা খাওয়াতে নিয়ে এলো শাহেদকে।
হাস্যকর যেসব ছেলেমানুষী গৌরাঙ্গের মধ্যে আছে তার কিছু কিছু শাহেদের বেশ ভালো লাগে, আবার কিছু কিছু খুবই বিরক্তিকর।
সবচে বিরক্তিকর হলো, গৌরাঙ্গের বাড়িতে নিমন্ত্রণ খেতে যাওয়া। যে রাতে নিমন্ত্রণ সেই রাতে অবধাবিতভাবে গৌরাঙ্গ কিছু মদ্যপান করবে। দুপেগ খাওয়ার পর বদ্ধ মাতাল। তখন কথাবাতাঁর ঠিক ঠিকানা নেই। এই হাসছে, এই কাদছে, এই পা ধরতে আসছে। খাওয়াদাওয়া শেষ করার পর বাড়িতে ফেরার নাম নেয়া যাবে না। গৌরাঙ্গ কিছুতেই বাড়ি ফিরতে দেবে না। তাকে থাকতেই হবে। একটা পৰ্যায় আসে যখন গৌরাঙ্গের স্ত্রী নীলিমা এসে করুণ গলায় বলে, ভাই, আপনি থেকে যান। আপনি চলে গেলে সে বড় যন্ত্রণা করবে। কাঁদবে, জিনিসপত্র ভাঙবে। শাহেদকে অতি অনগ্রহের সঙ্গে রাতে থেকে যেতে হয়।
গৌরাঙ্গের চিঠি হাতে নিয়ে শাহেদ বসে আছে। চিঠি খুলতে ভরসা পাচ্ছে না। সে নিশ্চিত চিঠিতে কোনো একটা নিমন্ত্রণের ব্যাপার আছে।
গৌরাঙ্গ লিখেছে–
প্রিয় মিতা,
আমার জীবনে দুইটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হইয়াছে। অতীব অতীব গুরুত্বপূর্ণ, যাহা পত্র মারফত বলা সম্ভব নহে। আমি অফিসে আসিয়া আপনাকে না পাইয়া হতাশ হইয়া বাসায় ফিরিয়া গেলাম। মিতা, পত্র পাওয়া মাত্র যেখানে যে অবস্থায় আছেন আমার বাড়িতে চলিয়া আসিবেন। যদি না আসেন, ঈশ্বরের দোহাই বাকি জীবন আমি আপনার সহিত কোনো বাক্যব্যয় করিব না। আমি তিন দিনের আর্নড লিভ নিয়া বাড়িতে বসিয়া আছি আপনার
অপেক্ষায়।
ইতি
গৌরাঙ্গ
শাহেদ মনে মনে বলল, অসম্ভব টু দা পাওয়ার টেন। যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। চারদিন হয়েছে সে তার মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে পারে নি। আজ পুরনো ঢাকায় গৌরাঙ্গের সঙ্গে দেখা করার অর্থ রাতে ফেরা যাবে না। মেয়ের সঙ্গে আরো একদিন কথা হবে না।
অফিস ছুটি হয় পাঁচটায়, তিনটা বাজতেই দেখা গেল কর্মচারীরা উঠতে শুরু করেছে। বি হ্যাপি স্যার লাঞ্চের সময় চলে গেছেন। ব্যবসা সংক্রান্ত কী একটা কাজে (চিটাগাং পোর্টে জাহাজে মাল খালাস বিষয়ক কাজ) তিনি চিটাগাং যাচ্ছেন। ফিরবেন দুদিন পর। কর্মহীন অফিসে পাঁচটা পর্যন্ত বসে থাকার অর্থ হয় না।
শাহেদ চারটার দিকে উঠল। দেওয়ান সাহেব একা বসে আছেন। তিনি কখনো অফিস শেষ হবার আগে চেয়ার ছেড়ে উঠেন না। তিনি শাহেদকে বললেন, আরো কিছুক্ষণ থাকুন না। দুই ভাই একসঙ্গে বের হই।
শাহেদ বলল, কাজ আছে।
দেওয়ান সাহেব বললেন, বাঙালির এখন কাজ কী? বর্ষার ঘোেতা ব্যাঙের মতো গলা ফুলিয়ে শ্লোগান দেয়া–জয় বাংলা, জয় বাংলা। এখন আমাদের কী স্লোগান হওয়া উচিত জানেন? আমাদের স্লোগান হওয়া উচিত–নয় বাংলা, নয় বাংলা। অর্থাৎ বাংলা না, অন্য কিছু। শুনেন শাহেদ সাহেব, এখনো সময় আছে। আমরা যদি বাঁচতে চাই আমাদের খোল নলচে সব বদলাতে হবে। পোশাক চেঞ্জ করতে হবে। লুঙ্গি শাড়ি চলবে না। ফুড হ্যাবিট বদলাতে হবে। No Fish. No Rice. বাংলা ভাষা বাতিল। কথা বলতে হবে অন্য ভাষায়–উর্দু, হিন্দি, পাঞ্জাবি চলতে পারে। বুঝতে পারছেন, না-কি পারছেন না?
আপনি আগে ভালোমতো বুঝে নিন।
চা খাবেন না-কি? আসুন আপনাকে এক কাপ বিদায়ী চা খাওয়াই।
চা খাব না।
তাহলে আর আপনাকে আটকে রেখে কী হবে! চলে যান। নয়। বাংলা।
বাসায় ফেরার পথে শাহেদ মরণাচাদের দোকান থেকে এক সেরা রসগোল্লা কিনল। রসগোল্লা আসমানীর পছন্দের মিষ্টি। রসগোল্লা খাওয়ার কায়দাটাও তার অন্যরকম। প্রথমে চিপে রস বের করে রসহীন রসগোল্লা খায়। পরে চুমুক দিয়ে খায় রসটা। সব বয়স্ক মানুষদের কর্মকাণ্ডেই কিছু ছেলেমানুষী থাকে। আসমানার রসগোল্লা খাওয়ার মধ্যে ছেলেমানুষীটা আছে। তার একটা পছন্দের মিষ্টি নিয়ে বাসায় ফেরার অর্থই হচ্ছে আসমানীকে নিঃশব্দে বলা–আই অ্যাম সরি। বেচারি। আজ সকালে কষ্ট করে খাবার গরম করে টেবিলে দিয়েছে, সে রাগ দেখিয়ে চলে এসেছে–এটা ঠিক হয় নি।
ইত্তেফাক অফিসের সামনে মাঝে মধ্যে পাখিওয়ালা বসে। খাঁচায় বন্দি পাখি বিক্রি হয়। টিয়া, মুনিয়া, কালিম পাখি, ঘুঘু। রুনির জন্যে একটা পাখি কিনে নিলে হুলুস্কুল ঘটনা হবে। খাঁচা হাতে সারা বাড়িতে ছোটাছুটি করবে। পাখি কেনা নিতান্তই বাজে খরচ। এই পাখি কয়েক দিন পরেই ছেড়ে দিতে হবে। যে মেয়ের সঙ্গে চারদিন কথা হচ্ছে না, সেই মেয়ের আনন্দের জন্যে কয়েকটা সস্তার মুনিয়া পাখি কেনা যেতে পারে। শাহেদ রিকশা নিয়ে পাখিওয়ালার খোজে। ইত্তেফাক অফিসের সামনে গেল। সে পাঁচটা মুনিয়া পাখি কিনল দেড় টাকা দিয়ে। খাঁচাটা ফ্রি।
এক হাতে মিষ্টি অন্য হাতে পাখির খাঁচা নিয়ে শাহেদ বাসায় ফিরল। বিকেল পাঁচটায়। অমঙ্গল আশঙ্কার মতো তার মনে হচ্ছিল বাসায় ফিরে দেখবে কেউ নেই। দরজায় তালা ঝুলছে। তালার ফাঁকে গুজে রাখা নোট–চলে গেলাম। ভোরবেলা নাশতা না খাওয়া এবং রাগ দেখানোর শাস্তি আসমানী দেবে নাতা হবে না।
দরজায় তালা নেই। হঠাৎ শাহেদের মন আনন্দে পূর্ণ হলো। নিজের ছোট্ট বাসাটাকে মনে হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের ধন নয় মান নয় এতটুকু বাসা। তার কাছে মনে হলো শুধু বেঁচে থাকার জন্যে হলেও দীর্ঘকাল বেঁচে থাকা যায়।
আসমানী তাকে দেখে খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, এখন চা খাবে, না-কি গোসল করে চা খাবে? (অফিস থেকে ফিরে শাহেদ গরম পানি দিয়ে গোসল সেরে চা খায়।) শাহেদ বলল, এখন এক কাপ খাব। গোসল সেরে আরেক কাপ খাব। আসমানী বলল, আবার পাখি এনেছ? এইগুলাকে কে দেখবো? দুদিন পর রুনির শখ মিটে যাবে, তারপর কী হবে?
শাহেদ কিছু না বলে হাসল। হাসি দিয়ে জানান দেয়া–এখন আর আমাদের মধ্যে কোনো ঝামেলা নেই।
আসমানী বলল, চুলায় গরম পানি আছে, বালতিতে ঢেলে দিচ্ছি।
শাহেদ বলল, আমি ঢেলে নেব। রুনি কোথায়?
আসমানী বলল, ও বাসায় নেই। ও মার বাসায় চলে গেছে।
শাহেদ বলল, তার মানে?
আসমানী বলল, মেয়ে তার নানির বাসায় গেছে, এর আবার মানে কী? তার ছোট মামা এসেছিল, সে তার ছোট মামার সঙ্গে চলে গেছে।
শাহেদ বলল, ও আচ্ছা।
সে কিছুতেই রাগ সামলাতে পারছে না। পরিষ্কার বুঝতে পারছে সকালে নাশতা নিয়ে সে যে কাণ্ডটা করেছে, আসমানী তার শোধ তুলেছে। মেয়েকে নানির বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে। খুব কঠিন কিছু কথা আসমানীকে বলতে পারলে ভালো হতো। বলতে ইচ্ছা করছে না।
আসমানী চা এনে সামনে রাখল। শাহেদ বলল, রুনিকে একা পাঠিয়ে দিলে কেন? তুমিও সঙ্গে যেতে।
আসমানী বলল, আমিও যাব। আমি তোমার ফেরার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। এই তো এখন যাব।
তুমিও যাচ্ছ?
হ্যাঁ।
কেন জানতে পারি?
তোমার সঙ্গে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঝগড়া করতে ইচ্ছা করছে না বলে চলে যাব। নিরিবিলি কয়েকটা দিন থাকব। বই পড়ব, গান শুনিব। রিল্যাক্স করব।
শাহেদ বলল, আচ্ছা ঠিক আছে।
আসমানী বলল, বাথরুমে গরম পানি দিয়ে এসেছি। গোসল করতে চাইলে করে।
গোসল সেরে এসে শাহেদ দেখে, আসমানী বাসায় নেই। সত্যি সত্যি চলে গেছে। শাহেদ রাত আটটা পর্যন্ত বারান্দার চেয়ারে বসে থাকল। তারপর ঠিক করল গৌরাঙ্গের বাড়িতে যাবে। রাতটা সেখানেই কাটাবে। সে সঙ্গে করে আসমানীর জন্যে কেনা রসগোল্লার হাঁড়িটা নিয়ে নিল। আরেক হাতে নিল খাঁচার মুনিয়া পাখি। আসমানীর উপর সে যতটা রেগেছে, মেয়ের উপর ঠিক ততটাই রেগেছে। তার কাছে মনে হচ্ছে রুনিকে পাখি উপহার দেবার কোনো মানে হয়। না। পাখিগুলি সে দেবে গৌরাঙ্গের মেয়েকে।
গৌরাঙ্গের বাড়ি পুরনো ঢাকার বংশাল রোডে। গলির ভেতর গলি, তার ভেতর গলি। শেষ গলিটা এতই সরু যে রিকশা চলার কথা না, তারপরেও রিকশা চলে। ফিতার মতো সরু গলির দুদিকেই নর্দমা। নর্দমায় মরা বেড়াল, মুরগির নাড়িভুঁড়ি থাকবেই। ঠিকই গন্ধ আসবে। মনে হবে এখানে কেন এসেছি? এই রাস্তায় হাঁটার অভ্যাস না থাকলে নর্দমায় পা পড়বেই।
গৌরাঙ্গ যে বাড়িতে থাকে সেটা তিনতলা। বাড়ির প্রথমতলায় সিমেন্ট রডের দোকান। দোতলায় থাকে গৌরাঙ্গ। তিনতলায় গৌরাঙ্গের শ্বশুর হরিভজন সাহা। সাহা সম্প্রদায়ের মানুষজন মিষ্টভাষী হয়ে থাকে। এই ভদ্রলোক সন্দেহ বান্তিকগ্ৰস্ত। তিনি কারো সঙ্গেই সহজভাবে কথা বলেন না। ধুতি পরার চল এই দেশ থেকে উঠে গেছে, হরিভজন সাহা এখনো ধুতি পরেন। শ্বশুরের সঙ্গে গৌরাঙ্গের সম্পর্ক খুবই খারাপ। কথাবার্তা প্ৰায় বন্ধ। গৌরাঙ্গ স্ত্রীর অগোচরে শ্বশুরকে ডাকে চামচিকা বাবাজি। বাড়িটা গৌরাঙ্গের শ্বশুরের। প্রতি মাসে বাড়ি ভাড়া বাবদ গৌরাঙ্গের তার শ্বশুরকে পঞ্চাশ টাকা দেয়ার কথা। সে কিছুই দেয় না।
শাহেদ গৌরাঙ্গের বাড়ি পৌঁছল। রাত নটায়। দরজা খুলে দিল নীলিমা। সে আনন্দিত গলায় বলল, আপনি তাহলে এসেছেন!! আপনার বন্ধুর তো মাথা খারাপের মতো হয়ে গেছে। আপনি না এলে কী যে করত কে জানে! সন্ধ্যা থেকে গ্লাস নিয়ে বসেছে। বুঝতেই পারছি আজ একটা কাণ্ড হবে।
পটে আঁকা ছবি বলে যে কথাটি প্রচলিত আছে তা নীলিমার জন্যে খুবই প্রযোজ্য। শাহেদের ধারণা সে তার সারা জীবনে এত রূপবতী কোনো তরুণীকে দেখে নি; ভবিষ্যতে দেখ,–সে সম্ভাবনাও ক্ষীণ। প্রথমবার দেখে সে হকচাকিয়ে গিয়েছিল। এর পরে অনেকবারই দেখা হয়েছে। শাহেদ প্রতিবারই হকচাকিয়েছে। আজ নিশ্চয়ই কোনো উৎসব। নীলিমা সাজগোজ করেছে। খোপায় গন্ধরাজ ফুল গুজেছে। পরনের তাতের শাড়িটা দামি। নতুন শাড়ি, আজই পরেছে। শাড়ি থেকে নতুন নতুন গন্ধ আসছে। শাহেদের মনে হলোএই মেয়ের সাজ করার দরকার কী?
ঘরের ভেতর থেকে গৌরাঙ্গ ভারি গলায় বলল, নীলু, শাহেদ এসেছে? (মদ খেলে গৌরাঙ্গের গলা ভারি হয়ে যায়।)
নীলিমা কিছু বলার আগেই গৌরাঙ্গ দরজা খুলে বাইরে চলে এলো। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাকে তো বলেছি। শাহেদ আসবে। বলেছি, না-কি বলি নাই?
বলেছ।
গৌরাঙ্গ রাগী গলায় বলল, তাহলে কেন বললে সে আসবে না?
নীলিমা বলল, রাত বেশি হয়ে গেছে বলে বলেছি। এত রাত করে উনি আসবেন ভাবি নি।
অবশ্যই সে রাত করে আসবে। রাত একটা বাজিলেও সে আসবে। আমি তাকে আসতে বলেছি, সে আসবে না–আমার বন্ধু সম্পর্কে এটা তুমি কী ভাবলে?
নীলিমা চাপা গলায় বলল, চিৎকার করছ, কেন?
তুমি আমার বন্ধু সম্পর্কে উল্টাপাল্টা কথা বলবে, আর আমি চিৎকার করব না! অবশ্যই চিৎকার করব। তিনতলায় তোমার বাবা থাকে বলে আমি কি ভয় পাই না-কি? চামচিকা বাবাজিকে গৌরাঙ্গ… দিয়েও পুছে না। (গৌরাঙ্গ অবলীলায় কুৎসিত কথাটা বলল। নীলিমা বিব্রত ভঙ্গিতে শাহেদের দিকে তাকাল। বেচারি খুবই লজ্জা পাচ্ছে।)
নীলিমা বলল, ভাই, আপনি আপনার বন্ধুকে সামলান। এই জিনিস সহ্য করতে পারে না, তারপরেও রোজ খাওয়া চাই। কী যে যন্ত্রণা!
গৌরাঙ্গ হঠাৎ খুবই বিস্মিত হয়ে বলল, খাঁচাতে করে কী এনেছিস? পাখি? (সামান্য মদ্যপান করার পরই সে শাহেদকে তুই করে বলে।)
শাহেদ বলল, হ্যাঁ।
গৌরাঙ্গ বলল, তুই নীলিমাকে জিজ্ঞেস করে দেখ– আমি কিন্তু তাকে বলেছি। শাহেদ আজ পাখি নিয়ে আসবে। সন্ধ্যার সময় হঠাৎ করে মনে হলো। প্রথমে আমি বললাম রুনুকে, তারপর বললাম তার মাকে। তোর তো বিশ্বাস হচ্ছে না। তুই রুনুকে প্রথম জিজ্ঞেস কর, তারপর রুনুর মাকে জিজ্ঞেস করা। তোর চোখ দেখেই মনে হচ্ছে তুই বিশ্বাস করছিস না।
শাহেদ বলল, বিশ্বাস হবে না কেন? বিশ্বাস হচ্ছে।
তারপরেও তুই জিজ্ঞেস করা। তোকে জিজ্ঞেস করতে হবে।
নীলিমা বলল, ভাই, আপনি জিজ্ঞেস করে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলুন তো। জিজ্ঞেস না করা পর্যন্ত সে একই কথা বলতে থাকবে। আপনি যে পাখি নিয়ে আসবেন এটা সে সত্যি বলেছে। আমার কথাটা বিশ্বাস করুন। আপনি বিশ্বাস না করা পর্যন্ত সে হৈচৈ করতেই থাকবে।
গৌরাঙ্গ বলল, তোমার কি ধারণা আমি মাতাল হয়ে গেছি?
নীলিমা বলল, হ্যাঁ।
গৌরাঙ্গ আহত গলায় বলল, তুমি আমার বন্ধুর সামনে আমাকে মাতাল বললে? তুমি? আজকের এই very specialday-তে?
শাহেদ বলল, আজকের দিনটা কী? ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি?
নীলিমা বলল, এইসব কিছু না। ও শুধু শুধু হৈচৈ করছে।
গৌরাঙ্গ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, আমার বন্ধু আজ রাতে থাকবে। আগে তার ঘর ঠিক করা। তার রাতে একটু পর পর জল খাওয়ার অভ্যাস। জলের ব্যবস্থা রাখা। একটা জগ আর গ্লাস।
নীলিমা বলল, উনি যদি থাকেন তাহলে কী দিতে হবে দিতে হবে না তা আমি জানি।
গৌরাঙ্গ বলল, তুমি কিছুই জানো না। তুমি যা পার তার নাম কটকট করে কথা বলা। তুমি কটকটি রানী। এর বেশি কিছু না। কটকটি, তুমি এখন আমার সামনে থাকবে না। তোমাকে দেখলেই আমার রাগ লাগছে। তুমি আমার বন্ধুর রাতে থাকার ব্যবস্থা করো।
যে-কারণে আজ শাহেদের নিমন্ত্রণ সেই কারণ জানা গেল। গৌরাঙ্গের শ্বশুর। তাকে নগদ আঠারো হাজার টাকা দিয়েছেন। গৌরাঙ্গ নিচু গলায় বলল, চামচিকার ভীমরতি হয়েছে। সে ইন্ডিয়া চলে যাচ্ছে। বুড়ার মাথায় বুদ্ধির ছিটাফোটা নাই। দেশ জয় বাংলা হয়ে যাচ্ছে। আমরা তখন আর সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন থাকব না। আমাদের অবস্তা হবে–নিজের দেশের মাটি দাবাদবাইয়া হাঁটি টাইপ। তুই এখন কেন চলে যাচ্ছিস? ইন্ডিয়া গিয়ে তুই করবি কী? তোর পাকা… ছিড়বি?
শাহেদ বলল, প্রথম সুসংবাদটা তো শুনলাম। দ্বিতীয়টা কী?
গৌরাঙ্গ বলল, দ্বিতীয়টা ফালতু।
ফালতুটাই শুনি।
নীলু রেডিও অডিশনে পাস করেছে। রবীন্দ্রসঙ্গীত। সি গ্রেড পেয়েছে।
শাহেদ বিস্মিত হয়ে বলল, ভাবি গান জানেন–তা তো জানতাম না!
গৌরাঙ্গ বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, রবীন্দ্রসঙ্গীত আবার গাইতে জানতে হয় নাকি? রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে হলে হাঁপানি থাকতে হয়, আর না-কি সুরে গলা টানতে হয়। তোর বৌদির হাঁপানি আছে। আর নাকেও সে কথা বলতে পারে।
শাহেদ বলল, ভাবির গান শুনব না।
গানের নামও মুখে আনবি না। তোর বৌদির হাঁপানির টান আমার অসহ্য। আমার সিক্সথ সেন্স কেমন প্রবল হয়েছে সেটা বল। কী সুন্দর। এডভান্স বলে দিলাম–তুই পাখি নিয়ে আসবি। পয়েন্টে পয়েন্টে মিলেছে কি-না বল।
মিলেছে।
আমি এডভান্স অনেক কিছু বলতে পারি। ঐ চামচিকা ইন্ডিয়াতে পৌঁছেই খাবি খেয়ে মারা যাবে, এটাও তোকে এডভান্স বলে দিচ্ছি। মিলিয়ে নিস।
গৌরাঙ্গ গ্লাসে লম্বা করে চুমুক দিয়ে দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ল।
শাহেদ রাতের খাওয়া খেল একা। নীলিমা বলল, আপনাকে একা খেতে হচ্ছে। আমি খুবই লজ্জা পাচ্ছি। রুনুও বাসায় নেই। ও থাকলে আপনার সঙ্গে বসত।
রুনু কোথায়?
সে উপরেরতলায় ওর দিদিমার কাছে। তার শরীরটা ভালো না। জ্বর এসেছে। আমি আপনার পাখির খাঁচা তাকে দিয়ে এসেছি। খুব খুশি। ও আচ্ছা! ভাই, আপনাকে একটা কথা বলা দরকার–আপনি আজ পাখি নিয়ে আসবেন এরকম কোনো কথা রুনুর বাবা বলে নি। মদ বেশি খেয়ে ফেলেছে বলে যা মনে আসছে বলছে। ভাই, আপনাকে একটা অনুরোধ করব, আপনি কি রাখবেন?
শাহেদ বলল, অবশ্যই রাখব।
আপনার বন্ধু আপনাকে এতই পছন্দ করে যে সে আপনার কোনো কথা ফেলবে না। আপনি কি তাকে একটু বলবেন মদটা ছেড়ে দিতে? আমি নিশ্চিত আপনি একবার বললে সে আর এই জিনিস খাবে না।
ভাবি, আমি বলব।
রাত দুটায় হৈচৈ-এর শব্দে শাহেদের ঘুম ভাঙল। হৈচৈ-এর কারণ গৌরাঙ্গের ঘুম ভেঙেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে সে স্ত্রীর হাত ধরে শাহেদের ঘরে ঢুকল। গম্ভীর গলায় বলল, তুই গান শুনতে চেয়েছিলি, ওকে নিয়ে এসেছি।
শাহেদ বলল, বেচারি সারাদিন খাটাখাটনি করেছে। এখন রাত দুটা। আরেকদিন এসে গান শুনব।
গৌরাঙ্গ বলল, আরেকদিন কী? আজই গান হবে। আমি তবলা হারমোনিয়াম নিয়ে আসছি।
শাহেদ বলল, তবলা কে বাজাবে?
গৌরাঙ্গ বলল, আমি বাজাব। আর কে বাজাবে?
নীলিমা গান করছে। শাহেদ অবাক হয়ে কিন্নর কণ্ঠ শুনল। মনে হচ্ছে অনেক দূর থেকে কেউ অতি সুরেলা গলায় গান করছে—
ওপারে মুখর হলো কেকা ঐ
এপারে নীরব কেন কুহু হায়
পুলিশ ইন্সপেক্টর মোবারক হোসেন
পুলিশ ইন্সপেক্টর মোবারক হোসেন গত দুবছরে সকাল হওয়া দেখেন নি। তিনি ঘুমুতে যান রাত দেড়টার দিকে। তাঁর ঘুমের সমস্যা আছে। শোয়ামাত্র ঘুম আসে না। এপাশ ওপাশ করতে করতে কোনোদিন রাত তিনটাও বেজে যায়। যে রাত তিনটায় ঘুমুতে যায়, সে সুবেহসাদেক দেখবে এরকম আশা করা অন্যায়। তবে আজ তিনি বাড়ির ছাদে উঠে সকাল হওয়া দেখলেন। সোবহানবাগে তাঁর একতলা পাকাবাড়ির ছাদটা সুন্দর। ছাদে উঠলে মনে হয় গ্রামে চলে এসেছেন। চারদিকে প্রচুর গাছপালা থাকায় উপর থেকে কেমন জঙ্গল জঙ্গল লাগে। গাছপালার মাথায় রাত কেটে সকাল হওয়ার দৃশ্য অপূর্ব, যে-কেউ মোহিত হবে। মোবারক সাহেব এই দৃশ্য দেখলেন, মোহিত হলেন, এরকম বলা যায় না। কোনো কিছু দেখে মোহিত হওয়া তার চরিত্রের মধ্যে নেই। তাঁর মন অসম্ভব খারাপ। শরীরও খারাপ, প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। এই অবস্থায় প্রকৃতির শোভায় মন বসে না।
তার স্ত্রীর সন্ধ্যা থেকে প্ৰসব ব্যথা শুরু হয়েছে। পানি ভেঙেছে রাত একটার দিকে। তখন থেকেই খিচুনির মতো হচ্ছে। লক্ষণ ভালো না, তবে মোবারক হোসেন তার জন্য খুব চিন্তিতও বোধ করছেন না। মেয়েছেলের প্রাণ, কই মাছের প্রাণের চেয়েও শক্ত। যাই যাই করবে। কিন্তু যাবে না। ঘরে অভিজ্ঞ ধাই আছে। এর হাতেই তার আগের তিনটি সন্তান হয়েছে। তিনটাই মেয়ে। খুবই আফসোসের ব্যাপার। এবারেরটা ছেলে হবার সম্ভাবনা আছে। আজমির শরিফের সুতা এনে পরানো হয়েছে। শাহজালাল সাহেবের দরগায়ে তিনি নিজে গিয়ে সিন্নি চড়িয়ে এসেছেন। সময়ের অভাবে শাহ পরাণের মাজারে যেতে পারেন নি। এটা একটা ভুল হয়েছে। শাহ পরাণ শাহ জালাল সাহেবের ভাগ্নে। মামা-ভাগ্নে দুজনের কবর জিয়ারত না করলে মনের বাসনা পূর্ণ হয় নাএরকম কথা প্ৰচলিত আছে।
এবার যে তার স্ত্রীর প্রসব ব্যথা জটিল আকার ধারণ করেছে–এটা একটা শুভ লক্ষণ। পুত্রসন্তান প্রসবে যন্ত্রণা বেশি হয়। জমিলার ব্যথার নমুনা দেখে আশা করা যাচ্ছে শুভ সংবাদ পাওয়া যাবে। তবে মানুষ সব সময় যা আশা করে তা হয় না, এটাই চিন্তার কথা।
তার এখন খারাপ সময় যাচ্ছে। ছিলেন আইবিতে, সাদা পোশাক থেকে হঠাৎ বদলি করে দিল ইউনিফর্মে। তাঁর খুশি হওয়ারই কথা। পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা পুলিশ ইন্সপেক্টর হলো ডাল বরাবর। তাদের দেখায় প্রাইভেট কলেজের বাংলার প্রফেসরের মতো। বাজারে গেলে মাছওয়ালাও ফিরে তাকায় না। পুলিশের চাকরির আসল মজা ইউনিফর্মে। দেখামাত্র সবাই সমীহ করে তাকাবে। কিন্তু এমনই তাঁর কপাল, খাকি পোশাকটা পরার পর থেকেই শুরু হলো যন্ত্রণা। পোশাকটা পরার পর থেকে বলতে গেলে রোজই হাঙ্গামা হুজ্জত হচ্ছে। বাঙালি অদ্ভুত এক জাতি। যাদের বিশ্বাস করে তাদের সব কথা বিশ্বাস করে। তারা যদি বলে–চিলে কান নিয়ে গেছে— কান নিয়েছে কি নেয় নি। যাচাই করে না। গালের পাশে হাত দিলেই বুঝবে কান এখনো আছে। জুলপির পাশে ঝুলছে। তারপরেও লাঠিসোটা নিয়ে দলবেঁধে ছুটতে থাকে চিলের পিছনে। আবার যাদের অবিশ্বাস করে তাদের কোনো সত্য কথাও বিশ্বাস করে। না। তথ্যমন্ত্রী সাহাবুদিন সাহেব বললেন, রবীন্দ্রসঙ্গীত ইসলাম এবং পাকিস্তানের ঐতিহ্যের পরিপন্থী বলে রেডিও-টেলিভিশনে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচারিত হবে না। এতেই লেগে গেল ধুন্ধুমার কাণ্ড। ধরোরে, মারোরে, জ্বালাওরে, পোড়াওরে। একটা লোক একটা কথা বলেছে তাতেই এই? রবীন্দ্রসঙ্গীত এমন কী রসগোল্লা? প্যানপ্যানানি ছাড়া আর কী? তথ্যমন্ত্রী তো ভুলও বলেন নি। ইসলামি কোনো গান কি রবীন্দ্ৰনাথ লিখেছেন? তার কোনো গানে কি মা আমিনার কথা আছে? নজরুল তো অনেক হিন্দু-গান লিখলেন। শ্যামাসঙ্গীত। রবীন্দ্রনাথ দুএকটা ইসলামি গান তো লিখতেও পারতেন। যে গান লিখতে পারে, সে হিন্দু গান মুসলমান গান সবই লিখতে পারে। লিখলেন না কেন? দাড়ি রাখার সময় তো এক হাত লম্বা দাড়ি রেখে ফেললেন। কুর্তা যেটা পরেন। সেটাও তো ইসলামি কুর্তা। তিনি যদি দুএকটা ইসলামি গান লিখতেন, তাহলে এই সমস্যা হতো না।
মিটিং মিছিল, লাঠি চার্জ, কাদানি গ্যাস। সামান্য গানের জন্যে কী অবস্থা!
সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হামিদুর রহমান সাহেব একটা কথার কথা বলেছেন। সেটা নিয়েও কত কাণ্ড! সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি তো আর ঘাস খেয়ে হয় না। এরা যখন কথা বলে অনেক চিন্তা-ভাবনা করে বলে। ভদ্রলোক আরবি হরফে বাংলা লেখার কথা বলেছেন। কথা যে খুব খারাপ বলেছেন তাও তো না। গ্রামের অনেক মানুষ আছে, যারা বাংলা জানে না। কিন্তু কোরান শরীফ পড়তে পারে। তারা তখন বাংলাও পড়তে পারবে। এটা খারাপ কী? আরবি হরফে বাংলা লিখলে বাংলার ইজ্জত কমে না। ইজ্জত বাড়ে। নবিজীর ভাষায় বাংলা লেখা হচ্ছে এটা কি কম কথা? কত বড় ইজত! আচ্ছা তারপরেও তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম এটা খারাপ। যদি খারাপ হয়ও এত হৈচৈ করার কী আছে? অদ্ভুত একটা জাতি। শান্তি চায় না, চায় অশান্তি। অশান্তি ছাড়া তাদের ভালো লাগে না। আয়ুব খানের মতো নেতাকে পছন্দ না। ভোট দিতে হবে খুড়গুড়ি বুড়ি ফাতেমা জিন্নাহকে। মেয়েছেলে হবে দেশের প্রধান। কথা হলো? হাদিস-কোরানে আছে মেয়েছেলেকে রাষ্ট্রপ্রধান করা যাবে না। সেই ফাতেমা জিন্নাহকে ভোট দেওয়ার জন্য লাফাচ্ছে মাওলানা ভাসানী। হাদিসকোরান জানা একজন মানুষ। নামের আগে মাওলানা। তাকে ভোট দিলে তোমার লাভটা কী? দেশে অশান্তি হয় এটাই লাভ । কী আশ্চর্য দেশ! কী আশ্চর্য দেশের নেতা!
নতুন একটা জিনিস শুরু হয়েছে–দফা। আজ ছয় দফা। কাল এগারো দফা। তারপরের দিন চৌদ্দ দফা। দফাই যে দেশের দফা রফা করবে। এই সাধারণ জ্ঞানটা যে জাতির নাই, সে জাতির ভবিষ্যৎ তো অন্ধকার।
মোবারক হোসেনের ধারণা আগরতলা মামলাটা প্রত্যাহার করা আয়ুব খানের জন্য খুব বড় বোকামি হয়েছে। আয়ুব খান বোকা না, সে এত বড় বোকামি করল কেন? এই কাজটায় তার দুর্বলতা প্ৰকাশ পেয়েছে। বাঙালি জাতি দুর্বলতার গন্ধ পেলে লাফিয়ে ওঠে। এখন শুরু করেছে। লাফ-বাপ। শেখ মুজিবুর রহমান হিরো বনে গেছেন; আয়ুব খানের উচিত ছিল ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া। দশ-বারোটাকে ফাঁসিতে ঝোলালে সব ঠাণ্ডা হয়ে যেত। বাঙালি গরমের ভক্ত নরমের যম। একটু নরম দেখলে আর উপায় নেই–ঝাঁপ দিয়ে পড়বে। তারা যত বাপ দেবে পুলিশ তত বিপদে পড়বে। বাঙালি জাতির যত রাগ খাকি পোশাকের দিকে। পুলিশের দিকে ঢ়িল মারতে পারলে তারা আর কিছু চায় না। আসাদুজ্জামানের মৃত্যুর পর পর কী অবস্থা! মানুষ দেখতে দেখতে ক্ষেপে গেল। তার নিজের জীবন নিসে টানাটানি। আরেকটু হলে মারাই পড়তেন। আস্ত একটা ইট এসে পড়ল বা হাতের কনুইতে। মট করে শব্দ। হাত যে ভেঙে গেছে তখনো বোঝেন নি। বোঝার কথা না। মাথা ছিল পুরোপুরি আউলা। ভাঙা হাত জোড়া লাগলেও পুবোপুরি সারে নি। অমাবশ্যা-পূর্ণিমায় ব্যথা হয়। হাতে জোর বলতে কিছু নেই। পানিভর্তি গ্লাস পর্যন্ত এই হাতে তুলতে পারেন না।
মোবারক হোসেন বিষণ্ণ মুখে ছাদ থেকে নেমে এলেন।
বাড়ির ভেতর থেকে তখনো কোনো খবর আসে নি। লেডি ডাক্তারের খোজে। একজন গিয়েছে। পাশের বাড়ির ভদ্রমহিলা এসেছেন। ভদ্রমহিলা খুব পর্দা মানেন। আজ দেখা গেল পর্দার বরখেলাপ করেই মোবারক হোসেনের সঙ্গে কথা বললেন। কথার বিষয়বস্তু হচ্ছে; রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া।
মোবারক হোসেন বললেন, আচ্ছা, দেখি। জ্ঞার মেজাজ আরো খারাপ হলো। রোগী আবার কী! গৰ্ভবতী মহিলা সন্তান প্রসব করছে। সাধারণ একটা ব্যাপার। হাসপাতাল-ফাসপাতাল আবার কী!
সকাল আটটার দিকে জমিলার অবস্থা আরো খারাপ হলো। খিচুনি বেড়ে গেল। তিনি ক্লান্ত গলায় তার মাকে ডাকতে লাগলেন। সেই মা অনেককাল আগে মারা গেছেন। কন্যার অসহনীয় কষ্টের সময় তিনি পাশে থাকতে পারবেন। না। তাঁর কন্যা বারবার ডাকতে লাগল, মাইজি ও মাইজি।
দুপুর একটায় জমিলা একটি পুত্রসন্তান প্রসব করে মারা গেলেন।
মোবারক হোসেন স্ত্রীর মৃত্যুতে দুঃখিত হলেন ঠিকই, সেই দুঃখের মধ্যেও কিছু আনন্দ লেগে থাকল। পরপর তিনটি কন্যাসন্তানের পর তার এবার পুত্ৰ হয়েছে। গায়ের রঙ সুন্দর, ধবধবে সাদা। নাক খাড়া, মেয়েগুলোর নাকের মতো উপজাতীয় টাইপ থ্যাবড়া নাক না।
তিনি ছেলের নাম রাখলেন, ইয়াহিয়া।
একজন নবির নামে নাম, তবে এই নামকরণের শানে-নুযুল অন্য। তাঁর ছেলের জন্ম ১৯৬৯ সনের ২৫ মার্চ। ঐ দিন জেনারেল ইয়াহিয়া ক্ষমতায় যান এবং দেশে সামরিক শাসন জারি করেন। সঙ্গে সঙ্গেই দেশের অবস্থা ঠাণ্ডা। জ্বালাও-পোড়াও, মারামারি, কাটাকাটি বন্ধ। জাগো জাগো, বাঙালি জাগো বন্ধ। শহরে মিলিটারি নেমে গেল। ভীতু বাঙালি বলতে গেলে ভয়ে গর্তে ঢুকে গেল। পুলিশরা ইজ্জত ফিরে পেল। এখন আর খাকি পোশাক দেখলে কেউ বলে না— ঠেলা।।
মোবারক হোসেন ইয়াহিয়া নামক যে জেনারেলের কারণে এই ঘটনা ঘটল, তাকে সম্মান করেই ছেলের নাম ইয়াহিয়া রাখলেন। ছেলের জন্যে আকিকা করলেন শাহজালাল সাহেবের দরগায়।
আয়ুব খানের লেখা যে-চিঠিতে এই বিস্ময়কর ঘটনা ঘটল, মোবারক হোসেন সেই চিঠি যত্ন করে পত্রিকা থেকে কেটে রেখে দিলেন।
আয়ুব খান সাহেব জেনারেল ইয়াহিয়াকে লিখলেন—
প্রিয় জেনারেল ইয়াহিয়া,
অতীব দুঃখের সহিত আমাকে এই সিদ্ধান্তে আসিতে হইয়াছে যে, দেশের সমুদয় বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা ও নিয়মতান্ত্রিক কর্তৃত্ব সম্পূর্ণ অচল হইয়া পড়িয়াছে। বর্তমান উদ্বেগজনক অবস্থার যদি অবনতি ঘটিতে থাকে, তাহা হইলে দেশের অর্থনৈতিক জীবনধারা তথা সভ্য জীবনের অস্তিত্ব বজায় রাখা সম্পূর্ণ অসম্ভব হইয়া পড়িবে।
এমতাবস্থায় ক্ষমতার আসন থেকে নামিয়া যাওয়া ছাড়া আমি কোনো গত্যন্তর দেখিতেছি না। তাই আমি পাকিস্তান দেশরক্ষা বাহিনীর হস্তে দেশের পূর্ণ কর্তৃত্ব ন্যস্ত করিয়া যাওয়ার সাব্যস্ত করিয়াছি, কেননা সামরিক বাহিনীই দেশের আজিকার একমাত্র কর্মক্ষম ও আইনানুগ যন্ত্র।
আয়ুব খান
পুত্ৰ ইয়াহিয়া আশীৰ্বাদ হিসেবে জন্ম নিয়েছে–এই বিশ্বাস মোবারক হোসেনের মনে শিকড় গেড়ে বসে গেল। ভালো যা হয় তাই তিনি পুত্রের জন্মের কারণে হচ্ছে বলে ধরে নেন। এই সময় তিনি তাঁর মৃতা মাকেও স্বপ্নে দেখেন। স্বপ্নে তিনি শিশু ইয়াহিয়াকে কোলে নিয়ে আদর করছেন। হঠাৎ সেখানে মোবারক হোসেনকে দেখে কিছু রাগ কিছু বিরক্তি মেশানো গলায় বললেন, ও মনু (মোবারক হোসেনকে তিনি মনু ডাকতেন), তোর বিপদআপদের দিন শেষ। এই ছেলে তোর জন্য কবজ হিসাবে দুনিয়াতে আসছে। এরে ভালো মতো দেখভাল করবি। বৎসরে একবার এরে আজমিরে নিয়া যাবি। আর মাঝেমধ্যে হরিণের মাংস দিয়া ভাত খাওয়াবি।
পুত্রের দেখভালের জন্যে তিনি পরোয় বৎসর সাফিয়া নামের এক মধ্যবয়স্ক মহিলাকে বিয়ে করেন। এই বিয়ে তাঁর জীবনে আশীর্বাদের মতোই হয়েছিল।
সাফিয়া মোটাসোটা ধরনের মহিলা। তার প্রধান যে তিনটি গুণ মোবারক হোসেনের চোখে পড়ল তা হলো–এই মহিলার রাঁধার হাত খুব ভালো। সে যা-ই রাঁধে অমৃতের মতো লাগে।
মহিলা তার স্বামীকে যমের মতো ভয় পায়। (মোবারক হোসেনের মতে, এই গুণটি স্ত্রীদের মহত্তম গুণের একটি। যে পরিবারে স্ত্রী স্বামীকে ভয় পায় না, মান্য করে না, সেই পরিবারে কখনো সুখ আসে না।)
সাফিয়ার তৃতীয় গুণটি কোনো গুণের মধ্যে পড়ে না। বেকুবির মধ্যে পড়ে। অতি বোকা মহিলাদের মধ্যে এই গুণটি দেখা যায়। তারা স্বামীর সংসারের সবকিছুকেই নিজের মনে করে। স্বামীর আগের পক্ষের সন্তানকে তারই সন্তান বলে ভাবতে থাকে। সাফিয়ার ক্ষেত্রেও এই জিনিস ঘটল। মোবারক হোসেনের তিন মেয়ে অতি দ্রুত হয়ে গেল তার তিন মেয়ে। ছেলেটিকেও যেন সে-ই কিছুদিন আগে প্রসব করেছে।
মোবারক হোসেন একদিন দুপুরে হঠাৎ কী জন্যে যেন বাসায় এসেছেন। তিনি শোবার ঘরে ঢুকে দেখেন, মেঝেতে পাটি বিছিয়ে সাফিয়া পান খাচ্ছে। তার তিন মেয়ের একজন সাফিয়ার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। একজন গায়ে হেলান দিয়ে আছে। আর তৃতীয়জন হাত-পা নেড়ে গল্প করছে। তিন মেয়ের মুখেই পান।
বাবাকে দেখে তিন মেয়ে অতি দ্রুত পালিয়ে গেল। সাফিয়া হঠাৎ এমন ভয় পেলেন যে মুখ থেকে পানের রস বের হয়ে শাড়িতে পড়ে গেল! মোবারক হোসেন অত্যন্ত বিরক্ত হলেন। মার চেয়ে যে মাসির দরদ বেশি, সেই মাসি হলো ডান। মার চেয়ে যদি সৎমায়ের দরদ বেশি হয়, তাহলে সেই সৎমা ডানের চেয়েও খারাপ। মেয়েদের নিয়ে পান খাওয়া-খাওয়ি আবার কী? পানবিড়ি-সিগারেট ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে খাওয়া যায় না।
মোবারক হোসেন ভয়ে অস্থির হয়ে যাওয়া স্ত্রীকে শুধু বললেন, আডিডা গুলবাজি কম করব। এইসব আমার পছন্দ না। সাফিয়া সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়ল। আবার তার মুখে থেকে পানের রস গড়িয়ে পড়ল।
তার ছেলে যে সৌভাগ্যের কবচ হয়ে এসেছে–এই বিষয়ে মোবারক হোসেন নিশ্চিত হলেন ১৯৭০ সনের ১ জানুয়ারিতে। এই দিনই ইয়াহিয়া খান রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করার অনুমতি দিলেন। মোবারক হোসেন খান ঐ দিনই বদলি হলেন খাকি পোশাক থেকে ডিএসবি-তে। খাকি পোশাক বাতিল। এখন সাদা পোশাকের চাকরি, তাও আবার সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের আন্ডারে। দেশে অরাজকতা চলছে, এই সময়ে খাকি পোশাক বিপদজনক পোশাক। দেশের লোকজন ধরেই নিয়েছে, খাকি পোশাক মানেই খারাপ জিনিস। খাকি পোশাক মানেই শক্ৰ।
গোয়েন্দা বিভাগে যোগ দেয়ার দুমাসের মাথায় মার্চ মাসের পঁচিশ তারিখ যেদিন তাঁর ছেলের বয়স এক বছর, তাঁর ডাক পড়ল সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের অফিসে। কর্নেল শাহরুখ খান তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চান। কথা বলবেন সন্ধ্যা সাতটায়, মোহাম্মদপুরের শেরশাহ সুরি রোডের এক বাসায়।
সেদিন বিকাল পাঁচটায় ছেলের জন্মদিন উপলক্ষে তিনি বাড়িতে মিলাদের আয়োজন করেছেন। আত্মীয়স্বজনদের খবর দিয়েছেন। কাচ্চি বিরিয়ানি রাধার জন্যে পুরনো ঢাকা থেকে বাবুর্চি সালু মাতবরকে আনা হয়েছে। মোবারক হোসেন সামান্য দুশ্চিন্তায় পড়লেন। মিটিং কতক্ষণ চলবে কে জানে! ছেলের প্রথম জন্মদিনে মিলাদ হবে। আর তিনি থাকতে পারবেন না–এটা অবশ্যই একটা আফসোসের ব্যাপার। তবে তার ধারণা এই মিটিংয়ে তার জন্যে শুভ কিছু আছে। তা না থাকলে বেছে বেছে ছেলের জন্মদিনেই এই মিটিং পড়বে কেন?
কর্নেল শাহরুখের সঙ্গে দেখা করার জন্যে তিনি সন্ধ্যা ছাঁটার সময়ই উপস্থিত হলেন। যে বাড়িতে মিটিং হচ্ছে সেটা কোনো অফিস না। একজনের বাড়ি। ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকে। তাদের হৈচৈ কান্নাকাটি সারাক্ষণ হচ্ছে। সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের একজন বড় কর্তা তাকে এ ধরনের একটা বাড়িতে ডেকেছেন তা ভাবাই যায় না। মোবারক হোসেনকে বসার ঘরে এক। ঘণ্টা বসে থাকতে হলো। বসার ঘর দেখে মনে হয় না। এখানে কেউ বসে। এক দিকে গাবদা গাবদা কিছু সোফা। অন্য দিকে তিন-চারটা বেতের চেয়ার। সোফার কভার নেই। একটা সোফার গদি ছিঁড়ে ভেতরের কাঠ বের হয়ে গেছে। ঘরের সাজসজ্জা বলতে গোয়ালে কাবা শরীফের ছবি। ছবিটা ঝকঝকে। ঠিক সন্ধ্যা ৭টায় তার ডাক পড়ল।
কর্নেল সাহেবকে দেখে মোবারক হোসেন ধাক্কার মতো খেলেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, একুশ-বাইশ বছরের একজন রূপবান যুবক, চুপ করে বসে আছে। প্ৰেমঘটিত জটিলতায় সে কিছু সমস্যায় আছে। যার জন্যে তার বয়স সামান্য বেশি লাগছে!
যে ঘরে কর্নেল সাহেব বসে আছেন, সেই ঘরটা বেশ বড়। তবে ঘরে আলো কম। এই কম আলোতেও কনেল সাহেবের চোখে কালো চশমা। কালো চশমার কারণে মনে হচ্ছে, কর্নেল সাহেবের চোখ উঠেছে। কর্নেল সাহেব ছাড়াও ঘরে আরেকজন ব্যক্তি উপস্থিত। তিনি সম্ভবত বাঙালি। তবে সাধারণ বাঙালির চেয়ে অনেক লম্বা। তিনি বসেছেন বড় একটা টেবিলের পেছনে। তার সামনে চায়ের কাপ। চায়ের কাপটা এষ্ট্রে হিসেবে কাজ করছে। চায়ের কাপের পাশে ছপ্যাকেট K-2 সিগারেট। ভদ্রলোকের বয়স চল্লিশ বা তারচেয়ে বেশি। চিমশে ধরনের চেহারা। আজ শেভ করেন নি বলে মুখে খোচা খোচা দাড়ি। কোনো কারণ ছাড়াই তিনি মাঝে মাঝে ঠোঁট ফাঁক করছেন। তখন তাঁর দাঁত দেখা যাচ্ছে। অতিরিক্ত সিগারেট খাবার জন্যেই হয়তো তার দাঁতে লাল লাল ছোপ পড়েছে। ভদ্রলোকের সমস্ত মনোযোগ তাঁর সামনে রাখা চায়ের কাপের দিকে। তিনি একবারও মোবারক হোসেনের দিকে তাকান নি। কর্নেল সাহেব তাকিয়েছেন কি-না তাও মোবারক হোসেন ধরতে পারছেন না। কারণ কর্নেল সাহেবের চোখ কালো চশমায় ঢাকা।
ইন্সপেক্টর মোবারক হোসেন, সিট ডাউন প্লিজ।
মোবারক হোসেন কর্নেল সাহেবের সামনে রাখা চেয়ারে বসলেন। তার নিজের উপর খুবই রাগ লাগছে, কারণ ঘরে ঢুকে তিনি সালাম দিতে ভুলে গেছেন। এখন সালাম দেয়াটা কি ঠিক হবে?
হাউ আর ইউ ইন্সপেক্টর?
মোবারক হোসেন বললেন, স্যার, আমি ভালো আছি। বলেই মনে হলো এটা কী করলাম! বাংলা তো উনি বুঝবেন না। আর এমন তো না যে ইংরেজি ভাষাটা তার জানা নেই। তিনি অনায়াসে বলতে পারতেন–স্যার, আই এম ফাইন।
কর্নেল সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আচমকা মোবারক হোসেনকে চমকে দিয়ে সুন্দর বাংলায় স্পষ্ট উচ্চারণে বললেন–ইন্সপেক্টর, তুমি কি কোনো কারণে ভীত?
মোবারক হোসেন বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে নিয়ে বললেন, জি-না স্যার।
সরাসরি কাজের কথায় চলে যাই–তুমি কি শেখ মুজিবর রহমানকে কাছ থেকে দেখেছি?
জি-না স্যার।
কখনো তাকে দেখতে যাও নি? তাকে সালাম করবার জন্যে যাও নি?
জি-না স্যার।
শত শত মানুষ রোজ তাকে দেখতে যায়। তাঁর দোতলা বাড়ির ব্যালকনির নিচে দাঁড়িয়ে থাকে তার কথা শোনার জন্যে। তাকে এক নজর দেখার জন্যে। তুমি যাও নি কেন?
মোবারক হোসেন শান্ত গলায় বললেন, স্যার, আমার শেখ সাহেবের বাড়িতে কোনো দিন ডিউটি পড়ে নাই।
ডিউটি পড়লে যাবে?
অবশ্যই স্যার।
কর্নেল সাহেব এবার মোবারক হোসেনের দিকে সামান্য ঝুঁকে এসে বললেন, তোমার কি ধারণা শেখ মুজিব পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা চায় না-কি অখণ্ড পাকিস্তানের কর্তৃত্ব চায়?
স্যার, আমি জানি না। এইগুলি অনেক বড় ব্যাপার। আমি সামান্য পুলিশ ইন্সপেক্টর। সরকারের নুন খাই।
সরকার যদি শেখ মুজিবের হাতে চলে যায়, তাহলে তো তুমি শেখ মুজিবের নুন খাবে?
জি স্যার।
কর্নেল সাহেব তাঁর শার্টের পকেট থেকে সিগারেট বের করলেন। সাধারণত সিগারেট প্যাকেটে থাকে–ইনার সিগারেট প্যাকেট ছাড়া অবস্থায় পকেটে আছে। ব্যাপারটা মজার তো! কর্নেল সাহেব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, তোমার দেশের কোন জিনিসটা সবচে ভালো?
মোবারক হোসেন বললেন, স্যার, আপনি তোমার দেশ বলছেন কেন? দেশটা তো আপনারও।
কর্নেল সাহেবের ঠোঁটে সামান্য হাসি দেখা গেল। তিনি সেই হাসি তৎক্ষণাৎ মুছে ফেলে গভীর গলায় বললেন–তোমাকে খুশি করার জন্যে বলেছি। এই দেশ যে আমার সেটা আমি জানি। যাই হোক, প্রশ্নের জবাব দাও–তোমার দেশের কোন জিনিসটা তোমার সবচে ভালো লাগে?
মোবারক হোসেন শান্ত গলায় বললেন, মুক্তাগাছার মণ্ডা।
জিনিসটা কী?
এক ধরনের মিষ্টান্ন। ছানা দিয়ে তৈরি হয়। ভাপে পাকানো হয়।
এত জিনিস থাকতে তোমার কাছে তোমার দেশের সবচে পছন্দের জিনিস মুক্তাগাছার মণ্ডা!
জি স্যার।
ভালো কথা, এখন বলো–তোমার কি মনে হয়। এই দেশটা আলাদা হয়ে যাবে? দুই দেশের পতাকা হবে দুই রকম?
স্যার পাকিস্তান ভাঙবে না।
কোন যুক্তিতে বলছি ভাঙবে না?
কোনো যুক্তি না। আমার মন বলছে ভাঙবে না।
কর্নেল সাহেব পকেট থেকে আরেকটি সিগারেট বের করে ঠোঁটে দিতে দিতে বললেন, আমারও তাই ধারণা। যার রাজনৈতিক গুরু সোহরাওয়াদী তিনি পাকিস্তান ভাঙতে চাইবেন না। তিনি চাইবেন অখণ্ড পাকিস্তানের ক্ষমতায় যেতে। তবে জেনারেল ইয়াহিয়াকেও তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। যদিও জেনারেল ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের সব কথাই মেনে নিচ্ছেন। নভেম্বরের জলোচ্ছাসের পর মাওলানা ভাসানী চাইলেন ইলেকশন পিছিয়ে দিতে। মানুষের এত দুর্ভোগ, এর মধ্যে ইলেকশন কী! কিন্তু শেখ মুজিব ইলেকশন পিছিয়ে দিতে রাজি হলেন না। জেনারেল ইয়াহিয়া শেখ মুজিবকে খুশি করার জন্যে ইলেকশন পিছলেন না। আমার ধারণা ইয়াহিয়া শুধু একটা জিনিসই চাচ্ছেন–যা হবার হোক, যার ইচ্ছা ক্ষমতায় যাক, শুধু পাকিস্তান টিকে থাকুক। ইন্সপেক্টর মোবারক!
জি স্যার
তোমার মনের ইচ্ছাটাও তো সে-রকম। তাই না?
জি স্যার।
তোমাকে এখানে ডেকে পাঠিয়েছি, এখন থেকে তোমার ডিউটি শেখ মুজিবর রহমান সাহেবের ধানমণ্ডির বাড়িতে। তুমি সেই বাড়িতে ঢুকবে। নিজের একটা জায়গা করে নিবে। কীভাবে করবে। সেটা তোমার ব্যাপার।
স্যার, আমার কাজটা কী?
ঐ বাড়িতে অবস্থান নেওয়াটাই তোমার কাজ। আর কিছু না।
আর কিছুই না?
না। আর কিছু না। প্রতি সপ্তাতে একবার বুধবার সন্ধ্যায়–জোহর সাহেবের সঙ্গে এই বাড়িতে দেখা করবে। তার সঙ্গে গল্পগুজব করবে। জোহর কে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছি। ঐ যে একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে যাচ্ছে।
মোবারক হোসেন জোহর সাহেবের দিকে তাকাল। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বিনীত ভঙ্গিতে সালাম দিল। জোহর তার জবাব দিলেন না। আগের মতোই চায়ের কাপের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
কর্নেল সাহেব বললেন, জোহর পূর্ণিয়া জেলার লোক। আমার অতি ঘনিষ্ঠ একজন। সে একজন কবি। তার শায়ের শুনলে মুগ্ধ হবে। তার পছন্দের কবির নাম শুনলেও তুমি চমকে উঠবে। তার পছন্দের কবির নাম টেগোর। তোমাদের রবীন্দ্রনাথ।
মোবারক হোসেন চমকালেন না। তবে বিস্মিত হবার ভঙ্গি করলেন। কর্নেল সাহেব বললেন, জোহর একজন চেইন স্ম্যোকার। এখন ইন্সপেক্টর মোবারক বলো তো দেখি–তুমি এই ঘরে ঢোকার পর থেকে জোহর কয়টা সিগারেট খেয়েছে?
নয়টা।
ভালো! তোমার অবজারবেশন ভালো। তুমি যেতে পাের।
স্যার চলে যাব?
হ্যা চলে যাবে।
স্নামালিকুম স্যার।
ওয়ালাইকুম সালাম। ইন্সপেক্টর শোন, তোমার ছেলের জন্মদিন উৎসব থেকে তোমাকে বঞ্চিত করেছি— এতে তুমি কিছু মনে করবে না। দেশের কল্যাণের জন্যে ছোটখাটো স্বাৰ্থ বিসর্জন দিতে হয়।
মোবারক হোসেন চমকালেন না। এরা তার ছেলের জন্মদিন জানে–এতে বিস্মিত হবার কিছু নাই। গোয়েন্দা বিভাগ তার সম্পর্কে কিছু না জেনেশুনে তাকে ডাকবে না। তার ছেলের নাম যে ইয়াহিয়া–এটাও তারা অবশ্যই জানে।
ইন্সপেক্টর!
ইয়েস স্যার।
তুমি কিছু বলবে?
জি-না স্যার।
তোমাকে সামান্য টিপস্ দিয়ে দেই। শেখ মুজিবের আস্থাভাজন হওয়া খুবই সহজ কাজ। এই মুহূর্তে প্রতিটি বাঙালির প্রতি তাঁর অগাধ বিশ্বাস। তিনি সমস্ত বাঙালিকে বিশ্বাস করেন। আর আমরা প্রতিটি বাঙালিকে অবিশ্বাস করি। তিনিও ভুল করছেন। আমরাও ভুল করছি। ভুলের মাশুল তিনি যেমন দেবেন। আমরাও দেব। কে কতটুকু দেবে কে জানে! ঠিক আছে, তুমি যাও। Happy birthday to your son.
ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর বাড়িটাকে কি বাড়ি বলা যাবে? বাড়ি মানেই অলস দুপুর। বাড়ি মানেই ভদ্র মাসের গরমে আচমকা উড়ে আসা হিমেল হাওয়া। বাড়ি মানে বারান্দার রেলিং-এ শুকাতে দেয়া রঙিন শাড়ি।
এখানে সেরকম কিছু নেই–বাজারের মতো ভিড়। এই একদল আসছে। এই যাচ্ছে। যারা আসছে প্রথম কিছুক্ষণ খুবই উত্তেজিত অবস্থায় থাকছে। কয়েকবার স্লোগান দেয়ার পর তাদের উত্তেজনা বাপ করে অনেকখানি কমে যাচ্ছে। তখন তাদের খানিকটা দিশাহরাও মনে হচ্ছে। স্লোগান পর্ব শেষ। এখন কী করা উচিত তা বুঝতে না পেরে দিশাহারা। দল নিয়ে এসে হুট করে চলে যাওয়া যায় না। কিছুক্ষণ থাকতে হয়। দল পরিচালনা করে যারা এসেছেন, শেখ সাহেবের সঙ্গে দেখা না করে চলে গেলে তাদের মান থাকে না।
গ্রহকে ঘিরে উপগ্রহ ঘুরপাক খায়। শেখ সাহেব বিশাল গ্রহ। তাকে ঘিরে ঘুরপাক খাওয়া উপগ্রহের সংখ্যাও সেই কারণে অনেক। তাদের ডিঙিয়ে শেখ সাহেবের দেখা পাওয়া মুশকিল। তবু চেষ্টা চালাতে হয়।
মোবারক হোসেন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এখানে থাকেন। কাণ্ডকারখানা দেখেন। তাঁর ভালোই লাগে। দুপুরে কখনো কখনো বড় বড় হাঁড়ি ভর্তি খাবার আসে। কোনোদিন তেহারি, কোনোদিন খিচুড়ি মাংস। তখন চারদিকে আলাদা উত্তেজনা তৈরি হয়। এই উত্তেজনা দেখতেও খারাপ লাগে না। সবচে ভালো লাগে পাতি নেতাদের জ্ঞানী জ্ঞানী আলোচনা। পাতি নেতাদের সঙ্গেও পাতি উপগ্ৰহ থাকে। পাতি নেতাদের আলোচনা চলে পাতি উপগ্রহদের সঙ্গে।
মাওলানা কী চাচ্ছে বুঝলাম না। তার দলের স্লোগান ভোটের আগে ভাত চাই। ভাতের অধিকার নিশ্চিত করার জন্যেই তো ভোট দরকার। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হওয়া অস্বাভাবিক না যে, ইয়াহিয়ার সাথে তার একটা অশুভ আঁতাত হয়েছে। এদিকে আবার কমুনিস্ট পার্টির হাবভাব ভালো লাগছে না। কমু্যনিস্টরা কী করবে না করবে সেটা বোঝা অবশ্যি খুবই মুশকিল। বিষয়টা নিয়ে শেখ সাহেবের সঙ্গে বসতে হবে।
যিনি বিষয়টা নিয়ে শেখ সাহেবের সঙ্গে বসতে চাচ্ছেন–তাঁর ভঙ্গি এরকম যেন তিনি শেখ সাহেবের প্রধান উপদেষ্টাদের অন্যতম। এই শ্রেণীর নেতারা দলীয় কমীদের উৎসাহ বৃদ্ধির জন্যে কিছুক্ষণ পর পর স্লোগানের আয়োজন করে। সবার চেষ্টা থাকে যেন তাদের স্লোগানটা অন্যদের চেয়ে আলাদা হয়।
ইয়াহিয়ার বুকে লাথি মারো
সোনার বাংলা স্বাধীন করো।
একটা দুটা মিলিটারি ধরো
সকাল বিকাল নাশতা করো।
ছাত্রনেতাদের ভাবভঙ্গি সবার চেয়ে আলাদা। যেন বিরাট আন্দোলন, তারাই চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। শেখ মুজিবর রহমান সঙ্গে আছেন ভালো কথা। সঙ্গে না থাকলেও খুব অসুবিধা হবে না, আমরা চালিয়ে নিয়ে যাব। দেশ স্বাধীন করা আমাদের কাছে কোনো ব্যাপার না। শেখ মুজিবর রহমান এদের প্রশ্ৰয়ও দিচ্ছেন। প্রশ্রয় না দিয়ে তার হয়তো উপায়ও নেই।
মোবারক হোসেনের এই বাড়িতে তৃতীয় দিনের ঘটনা। সকাল হচ্ছে। শেখ মুজিব ফজরের নামাজ শেষ করে দোতলা থেকে একতলায় নামলেন। সরাসরি এগিয়ে গেলেন মোবারক হোসেনের দিকে। ভরাট গলায় বললেন, তুই কে?
মোবারক হোসেন প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পা ছুঁয়ে সালাম করল।
তোকে প্রায়ই দেখি। তুই কে?
স্যার, আমি আইবির লোক।
তোকে কি আমার বাড়িতে ডিউটি দিয়েছে?
জি স্যার।
তোর সঙ্গে পিস্তল আছে?
আছে।
তোর ডিউটি কী?
কে আসে কে যায় এইটা খেয়াল করা।
শেখ সাহেব হেসে ফেলে বললেন, তুই তো তোর গোপন কথা সবই বলে ফেললি। তুই আইবির লোক, তুই তোর পরিচয় গোপন রাখবি না?
আমি সরকারের হুকুমে আসলেও আমি ডিউটি করি আপনার। আমি খেয়াল রাখি যেন কেউ আপনার কোনো ক্ষতি করতে না পারে।
আমার ডিউটি করিস কী জন্যে?
কারণ আপনিই সরকার।
শেখ মুজিব এই কথায় খুবই তৃপ্তি পেলেন। মোবারক হোসেনের কাধে হাত রেখে বললেন, তুই আমার জন্যে কী করতে পারবি?
আপনি যা করতে বলবেন, করতে পারব। যদি বলেন ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়। আমি পড়ব।
তোর নাম কী?
মোবারক হোসেন। পুলিশ ইন্সপেক্টর।
দেশের বাড়ি কোথায়?
কিশোরগঞ্জ।
ভালো জায়গায় জন্ম। বীর সখিনার দেশ। ছেলেমেয়ে কী?
তিন মেয়ে এক ছেলে। তিন মেয়ের নাম–মরিয়ম, মাসুমা, মাফরুহ। আর ছেলের নাম ইয়াহিয়া।
কী বলিস তুই, ছেলের নাম ইয়াহিয়া?
আমার দাদিজান রেখেছেন। নবির নামে নাম।
আয় আমার সঙ্গে।
স্যার, কোথায় যাব?
তোকে নিয়ে বাড়ির ছাদে উঠব। তারপর তোকে হুকুম দিব ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়তে। দেখি হুকুম তালিম করতে পারিস কি-না।
মোবারক হোসেন শান্ত গলায় বললেন, স্যার চলেন।
শেখ মুজিব মোবারক হোসেনকে নিয়ে দোতলায় এলেন। তিনি তাঁর স্ত্রীকে বললেন, এই আমাদের দুজনকে নাশতা দাও। এ হলো আমার এক ছেলে।
শেখ মুজিবের চোখে-মুখে তৃপ্তি ও আনন্দ ঝলমল করতে লাগল।
নীলগঞ্জ হাইস্কুলের বারান্দা
ইরতাজউদ্দিন কাশেমপুরীর মনটা আজ খারাপ। তিনি নীলগঞ্জ হাইস্কুলের বারান্দায় কিছুক্ষণ হাঁটাহাটি করে এখন টিচার্স কমনরুমে বসে আছেন। তাঁর হাতে দুদিন আগের বাসি। খবরের কাগজ। দুদিন আগে ঢাকা শহরে কী ঘটেছে কাগজে মোটামুটি তাই লেখা। নীলগঞ্জ ঢাকা থেকে দুদিন পিছিয়ে আছে। ইরতাজউদ্দিন খবরের কাগজটা পড়ার চেষ্টা করছেন। তাঁর মন বসছে না! মেজাজ বিগড়ে গেলে কোনো কিছুতেই মন বসে না। হেডমাস্টার মনসুর সাহেব আজ সকালে তাকে কিছু কথা বলেছেন, যা শোনার জন্য তিনি প্ৰস্তুত ছিলেন না। মনসুর সাহেব বয়সে তার ছোট। বয়োকনিষ্ঠ একজন মানুষের কাছ থেকে কঠিন কথা শুনলে মন খারাপ হয়ে যায়। তবে বয়স কোনো ব্যাপার না। ধানী মরিচ সাইজে ছোট হলেও তার ঝাঝি বেশি। সেভাবে চিন্তা করলে হেডমাস্টার সাহেবের কঠিন কথাগুলো হজম করে নেওয়া যায়। ইরতাজউদ্দিন হজম করতে পারছেন না। কারণ হেডমাস্টার সাহেবের কথাগুলো তার কাছে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হচ্ছে না।
ব্যাপারটা সামান্য। ঢাকা থেকে ফেরার সময় তিনি স্কুলের জন্যে একটা বড় পতাকা কিনে এনেছেন। ১২ টাকা নিয়েছে দাম। দাম বেশি নিলেও জিনিসটা সিল্কের তৈরি, সাইজেও আগেরটার তিনগুণ। সবুজ রঙটা গাঢ়। আগেরটার রঙ জ্বলে গিয়েছিল। পতাকাটা আজ তিনি নিজের হাতে টানিয়েছেন। ঝকঝকে নতুন পতাকা বাতাস পেয়ে ডানা মেলে উড়ছে। দেখলেই মন ভরে যায়। বাঁশটা যদি আরো লম্বা হতো আর পতাকাটা আবো বড় হতো, তাহলে অনেক দূর থেকে চোখে পড়ত। মানুষজন অহঙ্কার নিয়ে বলত, ঐ যে দেখা যায় পতাকাআমাদের নীলগঞ্জ হাইস্কুলের পতাকা। গ্রামের মানুষ ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে অহঙ্কার করতে ভালোবাসে।
ইরতাজউদ্দিন মুগ্ধ চোখে পতাকার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তার কাছে মনে হলো, নীল আকাশে সবুজ রঙের একটা টিয়া পাখি উড়ছে। গভীর আনন্দে ইরতাজউদ্দিন সাহেবের চোখে যখন প্রায় পানি এসে গেছে—তখন স্কুলের দপ্তরি। মধু এসে বলল, আপনেরে হেডস্যার ডাকে। তিনি আনন্দ নিয়েই হেডমাস্টার সাহেবের ঘরে ঢুকলেন। হেডমাস্টার সাহেব তার খুব পছন্দের মানুষ। ইরতাজউদ্দিন মনে মনে ঠিক করে ফেললেন, পতপত করে নতুন পতাকা উড়ছে–এই সুন্দর দৃশ্যটা হেডমাস্টার সাহেবকে দেখাবেন।
নীলগঞ্জ হাইস্কুলের হেডমাস্টার মনসুর সাহেব তাকে দেখে শুকনো গলায় বললেন, বসুন মাওলানা সাহেব। বলেই তিনি কী একটা লেখায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তার সামনে যে কেউ বসেছে, এটা যেন তার আর মনেই রইল না।
মনসুর সাহেব (এমএ, বিটি. গোন্ড মেডেল) মানুষটা ছোটখাটো। গায়ের রঙ ভয়াবহ ধরনের কালো। ছাত্ররা আড়ালে তাকে ডাকে অমাবস্যা স্যার। স্বভাবে-চরিত্রে অসম্ভব কঠিন। গত নবছর ধরে তিনি এই স্কুলের হেডমাস্টার। এ নবছরে শুধু একদিনই নাকি তাকে হাসতে দেখা গেছে। ১৯৬৩ সালের মে মাসের ৮ তারিখে। সেদিন মেট্রিক পরীক্ষার রেজাল্ট হয়েছিল এবং নেপালচন্দ্ৰ হাওলাদার নামের এই স্কুলের একজন ছাত্র ফোর্থ স্ট্যান্ড করেছিল। আবারো কোনো একদিন এই স্কুল থেকে কেউ স্ট্যান্ড করলে মনসুর সাহেব হয়তো হাসবেন। সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ। গ্রামের স্কুলে ভালো ছাত্র আসছে না।
ইরতাজউদ্দিন বসেই আছেন। হেডমাস্টার সাহেবের লেখালেখির কাজ শেষ হচ্ছে না। ইরতাজউদিনের মনে হলো–হেডমাস্টার সাহেব আজ যেন অন্যদিনের চেয়েও গম্ভীর। মনে হয় তার শরীরটা ভালো না। কিংবা দেশ থেকে খারাপ কোনো চিঠি পেয়েছেন। প্রায়ই হেডমাস্টার সাহেব দেশ থেকে খারাপ চিঠি পান। মনসুর সাহেবের স্ত্রীর মাথা পুরোপুরি খারাপ। ভদ্রমহিলা থাকেন তার বাবার কাছে। সেখানে তার উপর নানান ধরনের চিকিৎসা চলে। চিকিৎসার কারণে কিংবা প্রাকৃতিক কারণে ভদ্রমহিলার মাথা মাঝে-মাঝে ঠিক হয়, তখন হেডমাস্টার সাহেব তাকে নীলগঞ্জ নিয়ে আসেন। সেই সময় হেডমাষ্টার সাহেবের মুখ ঝলমল করতে থাকে। তাকে দেখে মনে হয় সুখী একজন মানুষ। গায়ের কালো রঙ তখন তেমন কালো লাগে না। সেই সময় প্রায় প্রতিদিনই তিনি স্ত্রীকে নিয়ে সোহাগী নদীর পাড় ধরে হাঁটেন। তাদের বাড়ির কাছেই একটা বটগাছ–যার কয়েকটা ঝুরি নেমে গেছে সোহাগী নদীর পানিতে। সেই বটগাছের গুড়িতেও প্রায়ই হেডমাস্টার সাহেবের স্ত্রীকে বসে থাকতে দেখা যায়। ঘোমটাটানা লাজুক ধরনের একটি মেয়ে। যার ভাব-ভঙ্গি এমন যেন নতুন বিয়ে হওয়া বউ, স্বামীর সঙ্গে যার এখনো তেমন করে পরিচয় হয় নি। মহিলা বসে থাকেন, তার আশপাশে হাঁটাহাঁটি করেন হেডমাস্টার সাহেব। বড়ই মধুর দৃশ্য। কিছুদিন পর ভদ্রমহিলার মাথা আবার যথানিয়মে খারাপ হয়। হেডমাস্টার সাহেব বিষণ্ণ মুখে তাকে শ্বশুরবাড়ি রেখে আসেন। স্কুলে ফিরে কিছুদিন তার খুব মেজাজ খারাপ থাকে। অকারণে সবাইকে বকাঝকা করেন। তারপর আবার স্বাভাবিক হয়ে যান। সোহাগী নদীর পাড়ে একা একা হাঁটেন। বটগাছের কুরিতে একা বসে থাকেন।
হেডমাস্টার সাহেব লেখা বন্ধ করে চোখ তুলে তাকালেন। প্রায় বিড়বিড় করে বললেন, আমার বড় শ্যালককে একটা পত্র লিখলাম। আমার স্ত্রীর অবস্থা ভালো না। তারা তাকে পাবনার মেন্টাল হাসপাতালে ভর্তি করতে চায়।
কী হয়েছে?
নতুন করে কিছু হয় নাই। পুরনো ব্যাধি। তবে এবার নাকি বাড়াবাড়ি। আমার বড় শ্যালকের স্ত্রীকে মাছ কাটা বটি দিয়ে কাটতে গিয়েছিল। সবাই এখন ভয় পাচ্ছে। ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক। এখন তাকে ঘরে তালাবন্ধ করে রেখেছে। খুব চিৎকার চেচামেচিও না-কি করে।
ইরতাজউদ্দিন কিছু বললেন না। চুপ করে রইলেন। তার মনটা খারাপ হলো। আর তখনি ভুরু কুঁচকে হেডমাস্টার সাহেব কথা বলা শুরু করলেন।
ইরতাজউদ্দিন সাহেব।
জি।
দেখলাম স্কুলে একটা পতাকা টানিয়েছেন।
জি, ঢাকা থেকে নিয়ে এসেছি। বারো টাকা দাম নিয়েছে। কাপড়টা সিস্কের। জাতীয় পতাকা আজকাল পাওয়াই মুশকিল। কেউ বিক্রি করতে চায় না।
নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় কাজে খরচ করেছেন। অপ্রয়োজনীয় খরচ করার মতো অবস্থা স্কুলের নেই। যেখানে মাস্টারদের বেতন দিতে পারি না…
ইরতাজউদ্দিন নিচু গলায় বললেন, জাতীয় পতাকা অপ্রয়োজনীয় কোনো ব্যাপার না।
পতাকা তো একটা আমাদের ছিল।
সেটার রঙ জ্বলে গেছে। মনসুর সাহেব গম্ভীর মুখে বললেন, এই দেশের জন্যে রঙ জ্বলে যাওয়া পতাকাই ঠিক আছে, রঙ তো বাস্তবেও জ্বলে গেছে।
ইরতাজউদ্দিন বললেন, আপনার কথা বুঝলাম না। হেডমাস্টার সাহেব বিরস গলায় বললেন, এক সময় এই পতাকাটাকে নিজের মনে হতো, এখন হয় না। সারা দেশে কী হচ্ছে খবর নিশ্চয়ই রাখেন, না রাখেন না?
জি, খবর রাখি।
লক্ষণ খুব খারাপ। পতাকা বদলে যেতে পারে। কাজেই আমার ধারণা, আপনি অকারণে দরিদ্র একটা স্কুলের বারোটা টাকা খরচ করিয়ে দিয়েছেন।
ইরতাজউদ্দিন বিস্মিত গলায় বললেন, পতাকা বদল হয়ে যাবে?
হ্যাঁ, যাবে। চট করে বদল হবে না। তবে হবে। লক্ষণ সে-রকমই। মাওলানা ভাসানী পল্টনের মাঠে কী বক্তৃতা দিয়েছেন জানেন?
জি-না।
না জানারই কথা, কোনো কাগজে আসে নাই। সব খবর তো কাগজে আসে না। কোনটা আসবে কোনটা আসবে না তা তারা ঠিক করে দেন।
মাওলানা ভাসানী কী বলেছেন?
তিনি বলেছেন–নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবার। স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান জিন্দাবাদ।
কী বলেন এসব?
পতাকা বদল হয়ে যাবে। চানতারা পতাকা থাকবে না। মাওলানা সাহেব সুফি মানুষ। উনার জীন সাধনা আছে। জীনদের মারফতে তিনি আগে আগে খবর পান। চানতারা পতাকা থাকবে না।
ইরতাজউদ্দিন চিন্তিত মুখে বললেন, যদি হয়ও সেটা ভালো হবে না।
ভালো হবে না কেন?
হিন্দুর গোলামি করতে হবে। মুসলমান হিন্দুর গোলামি করবে সেটা কি হয়?
হেডমাস্টার সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, কপালে গোলামি লেখা থাকলে গোলামি করতে হবে, উপায় কী? তবে দেশ স্বাধীন হলেই হিন্দুর গোলামি করতে হবে–এ কী ধরনের চিন্তা? আপনি আধুনিক মানুষ। আপনি উন্নত চিন্তা করবেন, সেটা তো স্বাভাবিক। এখন তো আমরা গোলামিই করছি। অন্য কিছু তো করছি না। সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের সার্ভিসে বাঙালির সংখ্যা কত জানেন? শতকরা দশেরও কম। সেনাবাহিনীতে বাঙালির সংখ্যা জানেন? না জানাই ভালো। পশ্চিমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বাইরে যাবার আমাদের উপায় আছে? কোনো উপায় নেই। শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব ইলেকশানে জিতে কি পেরেছেন এসেম্বলিতে বসতে? পারেন নি। কারণ তাকে বসতে দেওয়া হবে। না। কোনোদিনও না। এখন যা হচ্ছে তার নাম ধানাই। আর পানাই। কাজেই আমাদের সময় হয়ে আসছে। পতাকা খুলে ফেলে দেওয়ার।
পতাকা নামিয়ে ফেলব?
হ্যাঁ। আপাতত পুরনো পতাকাই উড়ুক। নতুনটা না।
জি আচ্ছা।
আর পতাকার দাম বাবদ বারো টাকা আপনাকে স্কুল ফান্ড থেকে দেওয়া হবে না। পারচেজ কমিটির অনুমোদন ছাড়া আপনি পতাকা কিনেছেন। এটা আপনি পারেন না। সবকিছু নিয়মের ভিতর দিয়ে হতে হবে। নিয়মের বাইরে যাওয়া যাবে না।
জি আচ্ছা।
আর শুনুন, আমার স্ত্রীর জন্য একটু দোয়া করবেন।
জি, অবশ্যই করব। জোহরের নামাজের পরেই দোয়া করব ইনশাআল্লাহ।
ইরতাজউদ্দিন মন খারাপ করে হেডমাস্টার সাহেবেব ঘর থেকে বের হলেন।
স্বাধীন পূর্ববাংলা এই জাতীয় কথাবার্তা ইদানীং খুব শোনা যাচ্ছে, কিন্তু এগুলি কোনো কাজের কথা না। আকাজের কথা। অখণ্ড হিন্দুস্তানে মুসলমানরা অনেক কষ্ট করেছে। জিন্নাহ সাহেব মহাপুরুষ মানুষ ছিলেন, তিনি অভাগা মুসলমানদের মুক্তি দিয়েছিলেন। অকৃতজ্ঞেব মতো সেইসব কথা ভুলে গেলে চলবে না। মুসলমানদের ভুলে গেলে চলবে না যে কোনো হিন্দুর বাড়িতে তারা ঢুকতে পারত না! হিন্দু বাড়িতে মুসলমান ঢুকলে সেই বাড়ি অপবিত্র হয়ে যেত। হিন্দু ময়রার মিষ্টির দোকানে বসে তারা মিষ্টি খেতে পারত না। মুসলমানরা নগদ পয়সা দিয়ে ভিখিরির মতো দুহাত বাড়িয়ে দিত। মিষ্টি ছুঁড়ে দেওয়া হতো সেই হাতে; এই অপমানের ভেতর দিয়ে তাকে অসংখ্যবার যেতে হয়েছে। আজ যারা স্বাধীন বাংলা স্বাধীন বাংলা করছে, তারা কি এই অপমানের ভেতর দিয়ে গিয়েছে? মাওলানা ভাসানী তো গিয়েছেন। তাহলে তিনি কেন এই কাণ্ডটা করছেন? তার মতো বুদ্ধিমান লোক হিন্দুদের চাল বুঝতে পারবেন না তা কী করে হয়?
ইন্ডিয়া যে একটা গভীর ষড়যন্ত্র করছে–এ তো বোঝাই যাচ্ছে। পুরো জাতিকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করছে। খুব সূক্ষ্মভাবে করছে। এটা আর কিছুই না, জিন্নাহ সাহেবের সঙ্গে দাবাখেলায় হেরে যাবার শোধ তোলার চেষ্টা। এতদিন পর তাবা! একটা সুযোগ পেয়েছে। এই সুযোগ তারা হাতছাড়া করবে না।
জোহরের নামাজের পর মাওলানা ইরতাজউদ্দিন পাকিস্তানের সংহতি ও মঙ্গলের জন্য দীর্ঘ প্রার্থনা করলেন। হেডমাস্টার সাহেবের স্ত্রীর বিষয়ে দোয়া করার কথা ছিল। করতে ভুলে গেলেন। তার মনটা খারাপ হয়ে গেল। তিনি আবারো নফল নামাজে বসলেন।
সেদিনই দুপুর একটায় রেডিওতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলেন। তারিখটা হলো
রেডিও পাকিস্তান ঢাকা থেকে ইয়াহিয়াকে উদ্ধৃত করে ঘোষণা প্রচার করা হলো–
যথাক্রমে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্বশীল দুটি প্ৰধান দলের মধ্যকার অচলাবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমি বাধ্য হয়েছি ____ সালের ৩ মার্চের জাতীয় পরিষদের বৈঠক মুলতবি করতে। তবে আমি সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই, এ মুলতবি দুই/তিন সপ্তাহের বেশি অতিক্রান্ত হবে না এবং এই স্বল্প পরিসর সময়ে আমি আমাদের দেশের দুই অঞ্চলের নির্বাচিত প্ৰতিনিধিদের মধ্যে সৌহার্দ্য আনয়নে সব ধরনের প্ৰচেষ্টাই করব।
সন্ধ্যা পার হয়েছে। মাগরেবের নামাজ শেষ করে ইরতাজউদ্দিন রান্না বসিয়েছেন। আয়োজন সামান্য। ভাত, ডাল আর আলুভর্তা। বৈয়মে খাঁটি ঘি আছে। আলুভর্তার সঙ্গে দুচামচ ঘি দিয়ে দিবেন। ক্ষুধা পেটে অমৃতের মতো লাগবে। নবিজী দুটা খেজুর খেয়ে অনেক রাত পার করেছেন। সেই তুলনায় রাজ ভোগ।
আলুভর্তা করা গেল না। তিনটা আলু ছিল। তিনটাই পচা। তাছাড়া আলুভতাঁর প্রধান উপকরণ কাঁচামরিচ বা শুকনামরিচ কোনোটাই নেই।
ইরতাজউদ্দিন বললেন, শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। সবসময় সর্ব পরিস্থিতিতে শুকুরগুজার করতে হবে। আল্লাহপাক শুকুরগুজারি বান্দা পছন্দ করেন।
হাঁড়িতে পানি ফুটছে— ইরতাজউদ্দিন ফুটন্ত পানিতে ডাল ছাড়বেন, তার ঠিক আগে আগে মধু এসে বলল, হেড স্যার ডাকে। রাতে তার সাথে আপনেরে খাইতে বলছেন।
ইরতাজউদ্দিন বললেন, রান্না কী?
মধু বলল, মৈরিলা মাছের ঝোল, টাকি ভর্তা, মাষকলাই-এর ডাইল।
রেঁধেছে। কে? তুই?
জে।
ইরতাজউদ্দিন আবারো বললেন, শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। মধু হেডমাস্টার সাহেবের বাড়িতে থাকে। রান্নাবান্না করে। তার রান্নার হাত খুবই ভালো। মাছের কাটাকুটা, সামান্য লাউপাতা কুমড়াপাতা দিয়ে সে এমন জিনিস তৈরি করে যে মোহিত হয়ে খেতে হয়। তার রান্না মিষ্টি কুমড়ার ভর্তা যে খায় নি, সে জানেই না ভতাঁর স্বাদ কী।
মধু!
জি স্যার।
দেশের অবস্থা তো ভালো না রে মধু। কী হয় কে জানে!
মধু দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলল, হউক গা। কপালের লিখন না হবে খণ্ডন।।
মধুকে অতিরিক্ত আনন্দিত মনে হচ্ছে। কারণে অকারণে দাঁত বের করে নিঃশব্দে হাসছে। ইরতাজউদ্দিন ভুরু কুঁচকে বললেন, গাজা খেয়েছিস না-কি?
মধু দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল, খাইতেও পারি, আবার নাও খাইতে পারি।
এই জিনিসটা না খেলে হয় না?
হয়। খাইলেও হয়, না খাইলেও হয়।
ইরতাজউদ্দিন ডাল পানিতে ভিজিয়ে ফেলেছেন। পানি থেকে তুলে কুলায় মেলে দিলেন। শুকিয়ে গেলে আবার ব্যবহার করা যাবে। কোনো কিছুই নষ্ট করা উচিত না। আল্লাহপাক অপচয়কারী পছন্দ করেন না।
স্যার গো, দিনের অবস্থা কিন্তু ভালো না। ঝড় তুফান হইতে পারে।
ইরতাজউদ্দিন সামান্য চিন্তিতঃ বোধ করলেন। তিনি যে চালাঘরে বাস করেন তার অবস্থা শোচনীয়; প্রধান খুঁটির সব কটাতে উইপোকা ধরেছে। ঝড়ের বড় ঝাপ্টা এই ঘর নিতে পারবে না। ঘর নতুন করে বাঁধতে হবে। ঠিক করে রেখেছিলেন, বর্ষার আগে আগে ঘরের কাজটা ধরবেন। মনে হয় না। এইবারও পারবেন। সব নির্ভর করছে আল্লাহপাকের ইচ্ছার উপর। উনি ইচ্ছা! করলে হবে। উনি ইচ্ছা না করলে হবে না। তাঁর অনুমতি ছাড়া কিছুই হবে না। তাহলে মানুষের চেষ্টার মূল্যাটা কী?
মধু খিকখিক করে হাসছে। ইরতাজউদ্দিন বললেন, কী হয়েছে?
মধু বলল, কিছু হয় নাই। একটা শিলুক মনে আসছে। বলব?
বল শুনি।
গাই এ ভাঙ্গে নল খাখরী, বাছুর ভাঙ্গে আইল
ছয় মাস হইল গাই বিয়াইছে বাছুর আইছে কাইল।
কন দেহি জিনিসটা কী?
জানি না।
খুবই সোজা। একটু চিন্তা নিলেই হবে।
চিন্তা নিতে পারছি না।
জিনিসটা হইল গিয়া কচ্ছপের আন্ডা।
ইরতাজউদ্দিন বললেন, কচ্ছপের আন্ডা হলে তো ভালোই।
আরেকটা বলি?
শিলুক শুনব নারে মধু। চল রওনা দেই।
মধু উসখুসি করছে। শিলুক তার খুব পছন্দের একটা বিষয়। এই অঞ্চলে শিলুক-ভাঙ্গানি হিসাবে তার নাম-ডাক আছে; বিয়ে-শাদি হলেই তার ডাক পড়ে। বরযাত্রীদের কঠিন কঠিন শিলুক দিয়ে সে নাকানি-চুবানি খাওয়ায়।
দিনের অবস্থা আসলেই ভালো না; আকাশে ঘন মেঘ। মাঝে-মাঝে বিজলি চমকাচ্ছে। বিজলির চমকে দেখা যাচ্ছে পশ্চিম দিক থেকে মেঘ উড়ে উড়ে আসছে। পশ্চিমি মেঘ ভালো জিনিস না। ঝড়-ঝাপ্টা হবে।
ইরতাজউদ্দিন দ্রুত পা চালাচ্ছেন। বৃষ্টি নামার আগেই হেডমাস্টার সাহেবের বাড়ি পৌছানো দরকার। থানার সামনে দিয়ে গেলে সময় বেশি লাগবে। তবে রাস্তা ভালো। ডিসট্রিক্ট বাের্ডের সড়ক। জেলেপাড়ার ভেতর দিয়ে গেলে অতি দ্রুত পৌছানো যাবে। সমস্যা একটাই–জঙ্গলের ভেতর দিয়ে রাস্তা। মাঝেমধ্যে খুব সাপের উপদ্রব হয়। ইরতাজউদ্দিন সাপ ভয় পান।
বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে। ঠাণ্ডা বাতাসও ছেড়েছে। শরীর জুড়িয়ে যাওয়া ঠাণ্ডা। চারদিকে ঘুরাঘুট্টি অন্ধকার। ডিসট্রিক্ট বোর্ডের সড়ক এই অন্ধকারেও চিকচিক করছে। ইরতাজউদিনের মনে হচ্ছে তিনি সড়ক না, নদীর উপর দিয়ে হাঁটছেন। থানার সামনে দিয়ে যাবার সময় তার মুখে পাঁচ ব্যাটারি টর্চের আলো পড়ল। মুখে টর্চের আলো ফেলা বিরাট অভদ্রতা। এই অভদ্রতাটা থানাওয়ালারা সবসময় করে। তাদের দোষও দেয়া যায় না। তাদের মানুষ চিনতে হবে। কে চোর কে সাধু জানতে হবে।
মাওলানা সাহেব, স্নামালিকুম।
ওয়ালাইকুম সালাম।
আমাকে চিনেছেন? আমি ওসি ছদারুল আমিন।
গলা শুনে চিনতে পারি নাই। পরিচয়ে চিনেছি।
মুখের উপর টর্চের আলো ফেলেছি, বেয়াদবি মাফ করে দিবেন। আপনি যান কই?
হেডমাস্টার সাহেবের বাড়িতে যাচ্ছি। উনি খবর পাঠিয়েছেন।
উনাকে আমার সালাম দিবেন। বিশিষ্ট লোক।
অবশ্যই দিব।
দেশের খবর তো মাওলানা সাহেব শুনেছেন–ইয়াহিয়া অধিবেশন স্থগিত করেছে। এখন লাগবে ক্যাচাল। ঢাকায় পোস্টিং থাকলে অবস্থা কেরোসিন হয়ে যেত। পাবলিকের সঙ্গে কাটাকাটি মারামারি। পুলিশ দেখলেই পাবলিক ক্ষেপে যায়। ক্ষেপিস কেন রে বাবা? পুলিশ কি তোরই বাপ-ভাই না? তুই ভাত-মাছ খাস, পুলিশও খায়। তোর ণ্ড-এ যেমন দুৰ্গন্ধ, পুলিশের গু-তেও সেইরকম দুৰ্গন্ধ। আচ্ছা ঠিক আছে, মাওলানা সাহেব। আপনি যান। আপনাকে দেরি করায়ে দিয়েছি। গায়ে একটা দুটা বৃষ্টির ফোটাও পড়তেছে। আসসালামু আলায়কুম।
ওয়ালাইকুম সালাম।
ইরতাজউদ্দিন হাঁটতে শুরু করলেন। থানার ওসিকে রাস্তায় দেখে মধু একটু পিছিয়ে পড়েছিল, এখন সে এগিয়ে এলো। গলা নিচু করে বলল, স্যার, আমরার ওসি সাহেবের বেজায় সাহস এইটা জানেন?
না।
আরে ব্যাপারে—সাহস কী! তার সাহসের একটা গাফ করব?
দরকার নাই।
তাইলে একটা শিলুক ভাঙ্গানি দেন! কন দেখি স্যার–চামড়ার বন্দুক বাতাসের গুল্লি এইটা কী?
জানি না। কী?
এইটা হইল গিয়া আপনের–পাদ। পাদে যে শব্দ হয়। সেই শব্দটা হইল গুল্লি। চামড়ার বন্দুক হইল–পুটকি।
ইরতাজউদ্দিন স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। এত বড় বেয়াদব–এ ধরনের অশ্লীল কথাবার্তা তার সঙ্গে বলছে? কানে ধরে একশবার উঠবোস করানো দরকার। যাতে ভবিষ্যতে কোনোদিন এই ধরনেম কথাবার্তা না বলে।
বৃষ্টির ফোটা ঘন হয়ে পড়তে পড়তে হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। মধু বলল, লক্ষণ ভালো না, বিষ্টির ফোঁটা পড়তে পড়তে বন হইলে বেজায় পরমাদ।
ইরতাজউদ্দিন কঠিন গলায় বললেন, চুপ করে থাক। আর একটা কথা বললে এমন চড় খাবি…
কথা বইল্যা দোষ কী করলাম!
অনেক দোষ করেছিস। আর কথা না।
হেডমাস্টার সাহেব বারান্দায় চৌকির উপর বসে আছেন। ঘরের ভেতর হারিকেন জুলছে। হারিকেনের আলোয় তাকে আবছা দেখা যাচ্ছে। বারান্দায় পেতে রাখা চৌকি হেডমাস্টার সাহেবের পছন্দের জায়গা। এখানে বসলে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। সামনে বুড়ো ফসলের মাঠ। দক্ষিণ দিকে নদী। বর্ষা মৌসুমে সামনের মাঠের পুরোটাই ড়ুবে যায়। বাতাস এলে সমুদ্রের মতো ঢেউ ওঠে! ছলাৎ ছিল।াৎ শব্দ হয়। বারান্দা থেকে এই শব্দ শোনা যায়। হেডমাস্টার সাহেবের বড় ভালো লাগে।
ইরতাজউদ্দিন বারান্দায় উঠতে উঠতে বললেন, আসসালামু আলায়কুম। খবর দিয়েছেন?
হেডমাস্টার সাহেব বললেন, খানা খেতে ডেকেছি। দিনের পর দিন একা খেতে ভালো লাগে না। মন যখন অস্থির থাকে, তখন আরো ভালো লাগে না।
মধু বদনায় করে পানি নিয়ে এসেছে। জলচৌকিতে দাঁড়িয়ে ইরতাজুদ্দিন পা ধুলেন। উঠে এলেন চৌকিতে। হেডমাস্টার সাহেব বললেন, আপনার ভাবির কথা মন থেকে দূর করতে পারছি না। শেষে আমার বড় শ্যালককে একটা চিঠি লিখলাম। চিঠিটা আপনাকে পড়ে শোনাতে চাচ্ছি।
ইরতাজউদ্দিন বললেন, পড়ুন শুনি।
হেডমাস্টার সাহেব তৎক্ষণাৎ চোখ বন্ধ করে চিঠি মুখস্থ বলে যেতে থাকলেন। যে-কোনো চিঠি একবার লেখা হয়ে গেলে দাড়ি-কমাসহ তার মনে থাকে। মানুষটার স্মৃতিশক্তি অস্বাভাবিক।
জনাব আব্দুর রহমান।
প্রিয় ভ্ৰাতা,
পরিসমাচার তোমার ভগ্নির বর্তমান অবস্থার কথা পাঠ করিয়া মুহ্যমান হইয়াছি। এ কী কঠিন পরীক্ষায় পতিত হইলাম? এই পরীক্ষার শেষ কোথায়? বেচারি নিজে কষ্ট পাইতেছে, অন্যদেরও কষ্ট দিতেছে। তাহার বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেয়া যায় সে-সম্পর্কে আমার পক্ষে কিছু বলা অসম্ভব। এত দূরে বসিয়া প্রকৃত অবস্থা জানা আমার পক্ষে অসম্ভব। তোমরা যাহা ভালো মনে করো তাঁহাই করা বাঞ্ছনীয়।
তোমার অতি আদরের ভগ্নির জন্যে তোমরা কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিবে না। এই বিষয়ে আমি নিশ্চিত।
পাবনা মানসিক হাসপাতালে তাহাকে ভর্তি করাইবার ব্যাপারে আমার কোনো আপত্তি নাই। আল্লাহপাকের কাছে প্রার্থনা যেন হাসপাতালে তাহার সুচিকিৎসা হয়।
ইতি
চিঠি মুখস্থ বলা শেষ করে হেডমাস্টার সাহেব ইরতাজউদ্দিনের দিকে তাকালেন। ইরতাজউদ্দিন বললেন, পুনশ্চতে কিছু লিখেছেন?
না।
চিঠির বক্তব্যের সঙ্গে আপনি কি একমত?
অবশ্যই।
ইরতাজউদ্দিন ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আপনি একমত না। আপনার মনে সংশয় আছে। সংশয় আছে বলেই আপনি আমাকে চিঠিটা শুনিয়েছেন। আপনার মন চাচ্ছে যেন আমি বলি আপনি যা করেছেন ঠিকই করেছেন। আপনি আমার Support চাচ্ছেন।
হেডমাস্টার সাহেব কিছু বললেন না। এক দৃষ্টিতে ইরতাজউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ইরতাজউদ্দিন বললেন, আপনি একটা কাজ করেন। ভাবিকে আপনার কাছে নিয়ে আসেন। আপনার পাশে থাকলে ভাবি সাহেবার মনে একটা পরিবর্তন আসতে পারে। তারপরেও যদি কিছু না হয়, আমরা দুজন উনাকে হাসপাতালে দিয়ে আসব। ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে কথাবার্তা বলে আসব।
আমাকে নিয়ে আসতে বলছেন?
জি।
তাহলে বরং এটাই করি?
হেডমাস্টার সাহেবকে দেখে মনে হলো–তার বুক থেকে পাষাণ ভার নেমে গেছে। তিনি সহজে নিঃশ্বাস নিতে পারছেন।
ইরতাজউদ্দিন বললেন, ক্ষুধা হয়েছে। খানা দিতে বলেন। আকাশের অবস্থা ভালো না। সকাল সকাল বাড়ি ফিরব। পশ্চিম আকাশ কেমন লাল হয়ে আছে। ঝড়-তুফানের লক্ষণ।
মধু এসে বিড়বিড় করে বলল, খানা দেওন যাইব না। দিরং হইব।
হেডমাস্টার সাহেব বললেন, দেরি হবে কেন? রান্না তো আগেই করা।
মধু সেই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে উদাস চোখে মাথা চুলকাতে লাগল। জানা গেল, কুকুর খাবারে মুখ দিয়েছে বলেই নতুন করে রান্না বসাতে হবে। সেটাই এই মুহূর্তে সম্ভব হচ্ছে না; চাল বাড়ন্ত। চাল কিনে আনতে হবে।
হেডমাস্টার সাহেব অবাক হয়ে বললেন, বলিস কী?
মধু বলল, হারামি কুত্তা একটা আছে, বড় ত্যক্ত করতাছে। বিষ খাওয়াইয়া এরে মারণ ছাড়া গতি নাই।
হেডমাস্টার সাহেব বললেন, আমার শরীরটা ভালো না। আমি আগেই ঠিক করেছিলাম রাতে কিছু খাব না। এক গ্লাস তোকমার শরবত খেয়ে শুয়ে পড়ব। মাওলানা সাহেবের খাবার ব্যবস্থা করা দরকার। উনি ক্ষুধার্তা! ঘরে চিড়া মুড়ি আছে না?
ইরতাজউদ্দিন বললেন, আমার ভাতের ক্ষিধা হয়েছে। এই ক্ষিধা চিড়া মুড়ি খেলে যাবে না। আমি ঘরে গিয়ে ভাত চড়াব।
হেডমাস্টার সাহেব বললেন, মধুকে সঙ্গে নিয়ে যান, রোধে দিয়ে আসবে। ও নিজেও চারটা খাবে।
ইরতাজউদ্দিন মধুকে নিয়ে পথে নামলেন। ডিসট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তায় উঠার পর পর প্রচণ্ড শব্দে কয়েকবার বিদ্যুৎ চমকাল।
জঙ্গলের দিক থেকে শো শো শব্দ আসছে। মধু ভীত গলায় বলল— ঝড় আসন্তাছে গো। আইজ খবর আছে।
দেখতে দেখতে ঝড় এসে গেল। ঝড়ের প্রথম ধাক্কায় মধু ছিটকে রাস্তা থেকে খালে পড়ে গেল।
ইরতাজউদ্দিনকে দৌড়ে এসে আশ্ৰয় নিতে হলো থানায়; ঝড়ের তাণ্ডব চলল অনেক রাত পর্যন্ত। রাতে তাকে খেতে হলো ওসি সাহেবের বাসায়। ওসি সাহেবের স্ত্রী লম্বা ঘোমটা টেনে অতি যত্নে ইরতাজউদ্দিনকে খাওয়ালেন। মহিলা সন্তান-সম্ভবা। শরীর ঢেকে ঢুকে রাখার চেষ্টায় ব্যস্ত।
ওসি সাহেব থানায় নেই। ঝড় আসছে দেখে তিনি তিনজন কনষ্টেবল নিয়ে বের হয়ে পড়েছেন। তার উদ্দেশ্য ডাকাত হাসান মাঝিকে ধরা। ঝড়-বৃষ্টির রাতে সে নিশ্চয়ই তার তৃতীয়পক্ষের স্ত্রীর কাছে রাত কাটাতে আসবে। হাসান মাঝির তৃতীয়পক্ষের স্ত্রীর নাম রঙিলা। সে আগে গৌরীপুরের নটিবাড়িতে নটির কাজ (দেহব্যবসা) করত। হাসান মাঝি তাকে বিয়ে করে মিন্দাপুর গ্রামে ঘর তুলে দিয়েছে। মিন্দাপুর নীলগঞ্জ থেকে দুই-আড়াই মাইল দূরে। সে যে মাঝে-মাঝে এখানে রাত কাটায়, সে-খবর ওসি সাহেব জানেন। তার ভাগ্য ভালো হলে দেখা যাবে ব্যাটা আজই এসেছে।
রান্নার আয়োজন ভালো। গরুর মাংস, পাবদা মাছের ঝোল, করলা ভাজি, বেগুন ভর্তা।
ইরতাজউদ্দিন বললেন, মাগো, বড়ই তৃপ্তি করে খেয়েছি। আল্লাহপাক কার রুজি কোথায় রাখেন বলা মুশকিল। খাওয়া শেষ করে তিনি হাত তুলে মোনাজাত করলেন, হে আল্লাহপাক, হে গাফুরুর রহিম, যে খানা আজ আমি এত তৃপ্তি করে খেয়েছি তার জন্যে তোমার দরবারে শুকরিয়া। যে বিপুল আয়োজন করে আমাকে খাইয়েছে, তার ঘরে যেন এরচেয়েও দশগুণ ভালো খানা সবসময় থাকে–তোমার পাক দরবারে এই আমার প্রার্থনা। আমিন।
দোয়া শেষ করে ইরােতাজউদ্দিন তাকিয়ে দেখেন, ওসি সাহেবের স্ত্রী চোখের পানি মুছছে। ইরতাজউদ্দিন বিস্মিত হয়ে বললেন, কাঁদছেন কেন গো মা?
মহিলা শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বললেন, আপনি এত সুন্দর করে দোয়া পড়লেন! শুনে চোখে পানি এসে গেছে।
ঝড় থামার পর ইরতাজউদ্দিন বাড়ি ফিরলেন। বাড়ির সামনে এসে তিনি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। বাড়ির কোনো চিহ্নই নেই। ঝড় উড়িয়ে নিয়ে চলে গেছে। তিনি কিছুই বললেন না। মধু শুধু বলল, স্যার, আফনেরে তো শুয়াইয়া দিছে।
ইরতাজউদ্দিন জবাব দিলেন না; মধু বলল, মন খারাপ কইরেন না। একটা শিলুক দেই, ভাঙেন–
যায় না চোখেতে দেখা কৰ্ণে শোনা যায়
উড়াল দিয়া আসে হে উড়াল দিয়া যায়।
স্যার পারছেন? খুব সোজা।
ইরতাজউদ্দিন জবাব দিলেন না। মধু আনন্দিত গলায় বলল, এইটা হইল ঝড়; ঝড় উড়াল দিয়া আসে উড়াল দিয়া যায়। এরে চউক্ষে দেখা যায় না।
কলিমউল্লাহ নামটা
কলিমউল্লাহ নামটা কোনো আধুনিক কবির জন্যে তেমন মানানসই না। কবিতা মানেই তো শব্দের খেলা। কলিমউল্লাহ নামের মধ্যে কোনো খেলা নেই। এই নাম উচ্চারণের সময় মুখ বড় হয়ে যায়। জিব দেখা যায়। কিন্তু কলিমউল্লাহ একজন কবি। এই মুহুর্তে সে দৈনিক পাকিস্তান অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার বয়স পঁচিশ। সে জগন্নাথ কলেজে বি.কম পড়ে। বি.কম পরীক্ষা সে আগে দুবার দিয়েছে। পাশ করতে পারে নি। তৃতীয়বারের জন্যে জোরেসোরে পরিশ্রম করে যাচ্ছে। কলিমউল্লাহর বাবা দ্বিতীয়বার পরীক্ষা ফেলের কথা শুনে টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছেন। তাতে তার তেমন অসুবিধা হচ্ছে না। সে দুটা টিউশনি করে। কাটাবনের কাছে একটা হোটেলের সঙ্গে মাসকাবারি ব্যবস্থা করা আছে, সেখানে খায়। রাতে ঘুমাতে যায় ইকবাল হলে। গ্রাম-সম্পর্কের এক বড় ভাই, ইতিহাসের থার্ড ইয়ার অনার্সের ছাত্র রকিব আলি ইকবাল হলে থাকেন। তার ঘরের মেঝেতে বিছানা পেতে শুয়ে থাকা। হলে এই বিষয়টা চালু আছে। রকিব ভাইয়ের বিছানাটা আলাদা রেখে মেঝেতে যে কজন ইচ্ছা শুয়ে থাকতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া বড় ভাইরা আশ্রয়হীন ছোট ভাইদের না দেখলে কে দেখবে? রুমের দরজা সবসময় খোলা থাকে। রাত একটা দেড়টায় হলে এসে উপস্থিত হলেও তেমন কোনো অসুবিধা হয় না।
অসুবিধা একটাই–নিরিবিলি কবিতা লেখাটা হয় না। এই কাজটা তাকে করতে হয় টিউশনির সময়। ছাত্রকে এক ঘণ্টা পড়বার জায়গায় দুঘণ্টা পড়ালে সবাই খুশি হয়। বাড়তি সময়টা সে কাজে লাগায়। ছাত্রকে রচনা লিখতে দিয়ে সে কবিতা লেখে। কলিমউল্লাহ ঠিক করে রেখেছে কবিতা, লিখে খ্যাতিমান হলে সে একটা কবিতার বই বের করবে। বইটার নাম দিবে টিউশন কাব্য। যে বইটির প্রতিটি কবিতা ছাত্রকে পড়াতে গিয়ে লেখা। রবীন্দ্রনাথের মতো প্রতিটি কবিতার শেষে রচনার তারিখ ও স্থান দেয়া থাকবে। যেমন মেঘবালিকাদের দুপুর কবিতার নিচে লেখা থাকবে–মটুদের ঝিকাতলার বাসা।
কবিতার বইটা বের হবে ছদ্মনামে। অনেকগুলি ছদ্মনাম নিয়ে সে চিন্তা করছে। কোনোটিই তেমন মনে ধরছে না। একটা নাম মোটামুটি পছন্দ হয়েছে, সেটা হলো শাহ কলিম। এই ছদ্মনামটা মূলের কাছাকাছি। নামের আগে শাহ যুক্ত করায় মরমী আধ্যাত্মবাদী কবি ভাব চলে আসে। তারপরেও এই নাম আধুনিক না। গ্রাম্য কবিয়ালটাইপ নাম। যারা মুখে মুখে গান রচনা করে এবং একটা পর্যায়ে গানে নিজের নাম ঢুকিয়ে দেয়; যেমন
শাহ কলিমে কয়
রোজ-হাসরের দিনে তোমার পরাজয়।।
পিতা নয় মাতা নয়
ব্রাদার ভগ্নি কেহই নয়
হৃদয়ে জাগিবে ভয়,
জানিবা নিশ্চয়।
রোজ-হাসরের দিনে তোমার পরাজয়।
শাহ কলিম-এর পাশাপাশি আরেকটা নাম তার পছন্দের তালিকায় আছে–ধূর্জটি দাশ। কঠিন নাম, তবে বেশ আধুনিক। শাহ কলিম নামটা মনে এলে একটা বোকা-সোকা বাবরি চুলের লোকের চেহারা মনে আসে। ধূর্জটি দাশ-এ মনে হয় গম্ভীর চোখে চশমা পরা বুদ্ধিমান একজন মানুষ। নামটা হিন্দু, এটা একটা সমস্যা। সে যদি কোনো একদিন খুব বিখ্যাত হয়ে যায়, তাহলে সমালোচকরা তাকে ধরবে। আপনি কেন হিন্দু ছদ্মনাম গ্ৰহণ করেছেন? এটা কি হীনমন্যতার কারণে? মুসলমান নাম কবির নাম হিসেবে চলে না। এই বোধ থেকে? এ দেশের অনেক কবিই তো ছদ্মনাম গ্ৰহণ করেছেন। এমনকি আমাদের প্রধান কবি শামসুর রাহমানও এক সময় ছদ্মনামে লিখতেন। হিন্দু ছদ্মনাম লেখার কথা তো তার মনে হয় নি। আপনার মনে হলো কেন?
রোদ মাথার উপর চিড়বিড় করছে। কলিমউল্লাহ মনস্থির করতে পারছে না। দৈনিক পাকিস্তান অফিসে ঢুকবে কি ঢুকবে না। তার ইচ্ছা কবি শামসুর রাহমানেব। হাতে একটা কবিতা দিয়ে আসা। ডাকে কবিতা পাঠিয়ে লাভ নেই। পত্রিকা অফিসের লোকজন খাম খুলে কিছু পড়ে না। এত সময় তাদের নেই। টেবিলের পাশে রাখা ঝুড়িতে সরাসরি ফেলে দেয়।
কবি শামসুর রাহমানের সঙ্গে সে কীভাবে কথা বলবে তা নিয়ে অনেক ভেবেছে। মনে মনে রিহার্সেল ও দিয়েছে। যদিও সে জানে কোনো রিহার্সেলই কাজে লাগবে না। কবি কোন প্রসঙ্গে কথা বলবেন তা তো জানা নেই। ঘরে ঢোকা মাত্র কবি হয়তো বলবেন, এখন যান। পরে আসবেন। এখন ব্যস্ত আছি। তবে কবি যদি টুকটাক কথা বলেন এবং যদি বলেন, তুমি কি আমার কোনো কবিতা পড়েছ?—তাহলে কেল্লা ফতে। কলিমুল্লাহ কবির একটা কবিতা–আসাদের শার্ট ঝাড়া মুখস্থ করে এসেছে। গড়গড় করে বলে কবিকে মুগ্ধ করা যাবে। কবি-সাহিত্যিকরা অল্পতেই মুগ্ধ হয়।
তিনবার ইয়া মুকাদ্দিমু পড়ে ডান পা আগে ফেলে কলিমউল্লাহ। দৈনিক পাকিস্তান অফিসে ঢুকে গেল। ইয়া মুকাদিমুর অর্থ হে অগ্রসরকারী। আল্লাহর পবিত্র নিরানব্বই নামের এক নাম। এই নাম তিনবার পড়ে ডান পা ফেলে যেকোনো কাজে অগ্রসর হওয়ার অর্থ সাফল্য। বি.কম পরীক্ষা দেবার জন্যে হলে ঢোকার আগে আগে এই নাম সে পড়তে পারে নাই। কিছুতেই নামটা মনে পড়ে না। মনে পড়লে অবশ্যই ঘটনা ভিন্ন হতো।
কবি শামসুর রাহমান বিশাল এক সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপাশে বসে আছেন। তার ডান পাশে জমিদারদের নায়েব টাইপ চেহারার ফর্সা এবং লম্বা এক লোক, ক্রমাগত কথা বলে যাচ্ছে। মাথা দোলাচ্ছে, হাত নাড়ছে। কবি তার দিকে তাকিয়ে আছেন। কিন্তু সব কথা মনে হয় শুনছেন না। কবিরা ভ্যাড়াভ্যাড়ানি শুনতে ভালোবাসে না।
কলিমউল্লাহর মনে হলো, কবি সাহেব তাকে দেখে খুশি হয়েছেন। অন্তত কিছু সময়ের জন্যে হলেও নায়েব সাহেবের ভ্যাড়াভ্যাড়ানি শুনতে হবে না।
শামসুর রাহমান টেবিলে হাত রেখে গালে হাত দিয়ে সুকান্ত-টাইপ। ভঙ্গিতে বসেছেন। তিনি কলিমুল্লাহর দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার কাছে কী?
কলিমউল্লাহ বলল, স্যার, আমি একটা কবিতা নিয়ে এসেছি। কবিতাটা আমি ডাকে পাঠাতে পারতাম। কিন্তু আমার অনেক দিনের শখ কবিতাটা আমি আপনার হাতে দেই।
কবি কিছু বলার আগেই পাশে বসা নায়েবটা বলল, টেবিলে রেখে চলে যান।
কলিমউল্লাহ নায়েবের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, ঐ গাধা, তুই কথা বলছিস কেন? আমি তো তোর সঙ্গে কথা বলছি না। তোর ভ্যাড়ভাড়ানি শোনার আমার কোনো প্রয়োজন নাই। মনে মনে এই কথা বললেও সে মুখে বলল, আমি কবিতাটা কবির হাতে দিব এই জন্যে এসেছি। টেবিলে রেখে দেবার জন্যে আসি নি।
নায়েব বলল, জিনিস একই। কবি টেবিল থেকে কবিতাটা হাতে নেবেন।
কলিমউল্লাহ বলল, জিনিস এক না। আমরা যদি কাউকে ফুল দিতে চাই আমরা তার হাতে দেই। টেবিলের এক কোনায় রেখে দেই না। আমি যে কবিতাটা লিখেছি সেটা হয়তো খুবই তুচ্ছ, তবে আমার কাছে তা ফুলের মতোই। আমি কবির হাতেই সেই ফুল দিতে চাই।
কলিমউল্লাহ নিজের কথা বলার ক্ষমতায় নিজেই মুগ্ধ হলো। অবশ্যি এই অংশটি সে আগেই রিহার্সেল দিয়ে ঠিক করে রেখেছে। জায়গামতো লাগানো গেছে। এতেই সে খুশি।
শামসুর রাহমান হাত বাড়িয়ে কবিতা নিতে নিতে বললেন, আপনি কী করেন? ছাত্ৰ?
জি ছাত্র। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যায় এমএসসি করছি (এই মিথ্যা কথাটা যে সে বলবে তাও আগেই ঠিক করা। বিজ্ঞানের জটিল বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করে কবিতা লেখার মধ্যে অন্য ব্যাপার আছে। কবি নিশ্চয়ই ঢাকা ইউনিভাসিটিতে গিয়ে খোঁজ নেবেন না।)
আপনার নাম কী?
স্যার আমার নাম শাহ কলিম।
ছদ্মনাম?
জি-না, আসল নাম। আমরা শাহ বংশ।
ও আচ্ছা।
কলিমউল্লাহ ফাঁক খুঁজছে আসাদের শার্ট কবিতাটা মুখস্থ শুনিয়ে দেয়ার জন্যে। ফাঁক পাওয়া যাচ্ছে না। সে তো নিজ থেকে হড়বড় করে কবিতা আবৃত্তি শুরু করতে পারে না। নায়েব চেহারার লোকটাই সুযোগ তৈরি করে দিল। সে কলিমউল্লাহর দিবে, তাকিযে হাসি হাসি মুখে বলল, কবিতা যে লিখছেন ছন্দ জানেন? চাক্কা ছাড়া যেমন গাড়ি হয় না, ছন্দ ছাড়া কবিতা হয় না। কবিতাকে চলতে হয়। চাক্কবিহীন গাড়ি হলো গদ্য। চাক্কাওয়ালা চলমান গাড়ি হলো কবিতা। বুঝেছেন?
কলিমউল্লাহ মুখে বলল (অতি বিনয়ের সঙ্গে), স্যার, বোঝার চেষ্টা করছি। মনে মনে বলল, চুপ থাক ছাগলা। তোকে উপদেশ দিতে হবে না।
নায়েব বলল, (তার উপদেশ দেয়া শেষ হয় নি) কবিতা লেখা শুরুর আগে প্রচুর কবিতা পড়তে হবে। অন্য কবির কী লিখছেন, তারা শব্দ নিয়ে, ছন্দ নিয়ে কী experiment করছেন তা জানতে হবে। আপনি যে কবি শামসুর রাহমানের কাছে এসেছেন, তাঁর কোনো কবিতা কি আপনি পড়েছেন?
কলিমউল্লাহ মনে মনে বলল, এই প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করার জন্যে তোর অতীতের সব অপরাধ এবং ভবিষ্যতের দুটা অপরাধ ক্ষমা করে দিলাম। মনে মনে কথা বলা শেষ হওয়া মাত্র সে গড়গড় করে কবির আসাদের শার্ট কবিতাটা মুখস্থ বলে যেতে লাগল। তার উচ্চারণ ভালো, সে আবৃত্তিও ভালো করছে। কবিকে দেখে মনে হচ্ছে না। তিনি অভিভূত হয়েছেন। মনে হয় তার আগে আরো অনেকেই এসে কবিকে কবিতা মুখস্থ করে শুনিয়েছে। তাঁর জন্যে এটা নতুন কিছু না।
গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের
জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট
উড়ছে হাওয়ায়, নীলিমায়।
বোন ভাই-এর অম্লান শাটে দিয়েছে লাগিয়ে
নক্ষত্রের মতো কিছু বোতাম কখনো
হৃদয়ের সোনালি তন্তুর সূক্ষ্মতায়;
বর্ষিয়সী জননী সে শার্ট উঠোনের রৌদ্রে দিয়েছেন মেলে।
ডালিম গাছের মৃদু ছায়া আর রোদ্দুর শোভিত
মায়ের উঠোন ছেড়ে এখন সে শার্ট
শহরের প্রধান সড়কে
গমগমে এভিন্নুর আনাচে-কানাচে
উড়ছে, উড়ছে অবিরাম।
কবি পুরো কবিতা শেষ করতে দিলেন না, তার আগেই বললেন, আপনি বসুন। চা খাবেন?
কলিমউল্লাহ বলল, স্যার, চা খাব না। তবে আপনি বসতে বলেছেন, আমি কিছুক্ষণ বসব। আপনার সামনে কিছুক্ষণ বসে থাকা আমার জন্যে পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার।
কলিমউল্লাহ বসল। তাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে নায়েব ব্যাটা কবির দিকে ফিরে হাত-মাথা নেড়ে গল্প শুরু করল, যেন এই ঘরে তারা দুজনই আছে আর কেউ নেই।
তারপর শুনুন কবি, কী ঘটনা–আমি নেতার সঙ্গে বরিশাল থেকে স্টিমারে করে ফিরছি। সারাদিন খুব পরিশ্রম গিয়েছে। এখানে মিটিং ওখানে মিটিং। ভেবেছিলাম রাতে স্টিমারে ভালো ঘুম হবে। সেটা হলো না। চাঁদপুরের কাছাকাছি এসে ঘুম ভেঙে গেল। স্টিমারের রেলিং ধরে দাড়িয়ে আছি, দূরে দেখা যাচ্ছে চাঁদপুর শহর। শহরের বাতি পানিতে পড়েছে। এদিকে আবার ভোর হচ্ছে। ভোরের আলো। মায়াবী একটা পরিবেশ।
কলিমউল্লাহ মনে মনে বলল, চুপ থাক ব্যাটা। মায়াবী পরিবেশ! তুই তো মায়াবী বানানই জানস না।
আমি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ চমকে উঠলাম। কে যেন আমার কাধে হাত রেখেছেন। তাকিয়ে দেখি নেতা, তার হাতে পাইপ। নেতা আমার নাম ধরে বললেন, কী দেখিস, বাংলার শোভা?
কলিমউল্লাহ মনে মনে বলল, নেতা তোর কাধে হাত রেখে কথা বলেছে? তুই কি নেতার ইয়ারবন্ধু? বাকোয়াজ বন্ধ করবি?
আমি নেতাকে বললাম, আপনি এত ভোরে উঠেন তা জানতাম না। নেতা বললেন, বাংলার শোভা আমাকে বাদ দিয়ে তোরা দেখে ফেলবি তা তো হতে দেব না। আয় আমার ঘরে আয়। চা খেয়ে যা। আমি নেতার কেবিনে গেলাম। উনি নিজেই চা বানিয়ে আমার হাতে দিলেন।
কলিমউল্লাহ মনে মনে বলল, শুধু চা বানিয়ে তোর হাতে দিলেন? তোর গা হাত পা ম্যাসেজ করে দেন নাই?
নেতার সঙ্গে তখন আমার একটা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হলো। আমি নেতাকে বললাম, আপনি কিছু একটা করেন। মাওলানা ভাসানীকে সামলান। তার সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে ফেলুন। নেতা বললেন, মাওলানাকে নিয়ে তোদের চিন্তা করতে হবে না। আমি মাওলানাকে চিনি। মাওলানা আমাকে চেনে।
কলিমউল্লাহ মনে মনে বলল, তুই তো দেখি আমার চেয়েও বড় মিথ্যাবাদী! তুই হয়ে গেলি শেখ মুজিবের উপদেষ্টা?
কলিমউল্লাহ উঠে পড়ল। ই বকবকানি আর শোনা যায় না। সে ঘর থেকে বের হবার আগে কবি এবং নায়েব সাহেব দুজনকেই পা ছুঁয়ে সালাম করল। কবি খুবই বিব্রত হলেন, তবে নায়েব সাবে এমন ভাব করলেন যেন প্রতিদিন পঞ্চাশজনের মতো তরুণ উঠতি কবি তাকে কদমবুসি করে।
পরের সপ্তাহে শাহ কলিমের কবিতা মেঘবালিকাদের দুপুর দৈনিক পাকিস্তানের সাহিত্যপাতায় প্রকাশিত হয়। তার পরের সপ্তাহে দৈনিক পূর্বদেশে প্রকাশিত হয় একটি কাব্য নাটিকা। এর দুটি চরিত্র; একটির নাম পরাধীনতা। সে অন্ধ তরুণী। আরেকটা চরিত্রের নাম স্বাধীনতা। সে অসম্ভব রূপবান একজন যুবা পুরুষ।
শাহ কলিম এর পরপরই বাবরি চুল রেখে ফেলল। দাড়ি কাটা বন্ধ করে দিল। আপাতত তার প্রসঙ্গ এইখানেই শেষ, তাকে যথাসময়ে আবার আনা হবে।
মোবারক হোসেনের ছুটির দিন
আজ বুধবার।
মোবারক হোসেনের ছুটির দিন। ছুটির দিনেও তিনি কিছু সময় অফিস করেন। সকাল দশটা সাড়ে দশটা পর্যন্ত শেখ সাহেবের বাড়িতে থাকেন। সেখান থেকে সরাসরি চলে যান। আমিনবাজার। সপ্তাহের বাজার আমিনবাজার থেকে করে চলে আসেন মৌলবীবাজার। সেখানে কুদ্দুস নামের একজন কসাই তাকে গরুর মাংস দেয়। বাজারের সেরা মাংস । তিনি বাসায় ফিরেন দুপুর বারোটার মধ্যে। তখন ইয়াহিয়াকে গোসল দেয়া হয়। গোসলের আগে তার গায়ে খাঁটি সরিষার তেল মাখানো হয়। তেল মাখানোর সময় সে খুব হাত-পা ছুঁড়ে হাসে। আবার যখন তাকে গামলার পানিতে নামানো হয়, তখন সে হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদে। শিশুপুত্রের হাসি এবং কান্না দুটাই তিনি দেখতে ভালোবাসেন।
মোবারক হোসেন সপ্তাহে একদিন দুপুরে ঘুমান। ঘুম ভাঙার পর মোহাম্মদপুর যাবার ব্যাপারে প্রস্তুতি নিতে থাকেন। প্রস্তুতি মানে মানসিক প্ৰস্তুতি। মোহাম্মদপুরের শের শাহ সুরী রোডে যেতে হবে মনে হলেই তিনি এক ধরনের অস্বস্তি অনুভব করেন। বুধবার দুপুরের ঘুমও তাঁর ভালো হয় না। ঘুমের মধ্যে বিকট এবং অর্থহীন স্বপ্ন দেখেন। একবার স্বপ্নে দেখলেন, কর্নেল শাহরুখ খানের কোলে তিনি বসে আছেন। স্বপ্নের মধ্যে ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল। যেন কর্নেল সাহেবের কোলে বসে থাকাটাই যুক্তিযুক্ত এবং শোভন।। আরেকবার স্বপ্নে দেখলেন–তিনি, কর্নেল সাহেব এবং জোহর সাহেব খেতে বসেছেন। টেবিলে আস্ত খাসির একটা রোষ্ট সাজানো। সবাই সেই রোষ্ট থেকে মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে নিচ্ছে। সমস্যা হচ্ছে খাসিটা জীবিত। যখনই তার গা থেকে মাংস ছেড়া হচ্ছে তখনই সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাচ্ছে এবং বিড়বিড় কবে বলছেআস্তে, আস্তে।
এরকম কুৎসিত এবং অর্থহীন স্বপ্ন দেখার কোনো মানে হয় না। জোহর সাহেব তার সঙ্গে খুবই সহজ-স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বলেন। মাঝে-মাঝে হাসি তামাশাও করেন। সন্ধ্যাবেলা চায়ের সঙ্গে কাবাব খেতে দেন। মাঝেমাঝে থাকে গরুর পায়া। গরম গরম রুমালি রুটি দিয়ে পায়া খেতে অতি সুস্বাদু।
জোহর সাহেব বেশিরভাগ কথাবার্তাই বলেন খাবারদাবার নিয়ে। তিনি কোথায় কখন কোন ভালো খাবারটা খেয়েছেন সেই গল্প। মিঠা কাবাব নামের একটা কাবাবের কথা তার কাছে প্রায়ই শোনা যায়। গাজরের রসে মাংস। জ্বাল দেয়া হয়। তারপর সেই মাংস টুকরা টুকরা করে আগুনে ঝলসে খাওয়া। জোহর সাহেবের ধারণা, বেহেশতেও এই খানা পাওয়া যাবে কি-না সেই বিষয়ে সন্দেহ আছে।
খাওয়া-দাওয়ার ফাকে ফাঁকে রাজনীতি নিয়েও কথা হয়। রাজনৈতিক আলাপের সময় এই মানুষটা কোনোরকম সংশয় ছাড়া কথা বলেন। তখন তার চোখ বন্ধ থাকে। তাকে দেখে মনে হয়, তিনি যা বলছেন তা যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন।
বুঝলেন ইন্সপেক্টর সাহেব, একটা দেশ স্বাধীন হবে কি হবে না তা সেই দেশের মানুষ কিংবা সেই দেশের কোনো বিপ্লবী নেতার উপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে আন্তর্জাতিক রাজনীতির খেলার উপর। ভারত চাচ্ছে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হোক, এতে তার সুবিধা। তার চিরশত্রু পাকিস্তানের একটা শিক্ষা হয়। পাকিস্তানের কোমর ভেঙে যায়। আরেক দিকে আছে চীন। ভারতের আরেক শত্ৰু। কাজেই পাকিস্তানের বন্ধু। বিরাট এক শক্তি। ১৯৬২ সনে ভারতের উপর এমন চড়াও হয়েছিল যে ভারতের বুকোব রক্ত জমে পানি হয়ে গিয়েছিল। চীন কিছুতেই চাইবে না পাকিস্তান ভেঙে যাক। যেহেতু চীন চাচ্ছে না, আমেরিকাও চাইবে না। ভারতের পাশে থাকবে সোভিয়েত ইউনিয়ন। এইসব হিসাবনিকাশে যে পাল্লা ভারী হবে সেই পাল্লাই… বুঝতে পারছেন?
জি পারছি।
শেখ মুজিব। যদি বোকামি করেন, কোনোরকম প্রস্তুতি ছাড়াই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দেন, তাহলে কী হবে দেখা যাক। সাতদিনের মাথায় মিলিটারি বিদ্রোহ দমন করবে। ভারত যদি যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়ে, তাহলে পনেরো দিনের মাথায় সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। অনেক বড় বড় বিপ্লবী নেতাকে তখন দেখা যাবে–পাক সার যামিন শাদ বাদ গান করছেন। মানুষ সবসময় শক্তের পূজারী। দুর্বলকে মানুষ কখনো পছন্দ করে না। কেন বলুন তো?
জানি না।
কারণ বেশিরভাগ মানুষই দুর্বল। সে তার নিজের দুর্বলতা জানে। এই দুর্বলতা সে ঘৃণা করে। কাজেই অন্যের দুর্বলতাকেও সে ঘৃণা করে। Mankind abhors timidity because he is timid. এখন ইন্সপেক্টর সাহেব বলুন দেখি, শেখ মুজিব কি ভুল করবেন? স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন? ঢাল-তলোয়ার ছাড়া নিধিরাম সর্দার হতে চাইবেন।
জি করবেন। এটা ছাড়া তাঁর অন্য কোনো বিকল্প নাই। মানুষ তাঁকে নেতা বানিয়েছে, মানুষের ইচ্ছাকে তাঁর দাম দিতে হবে।
স্বাধীনতার ঘোষণা যদি সত্যি সত্যি দেয়া হয়, তাহলে কী পরিমাণ মানুষ এই দেশে মারা যাবে সেই সম্পর্কে তাঁর কি কোনো ধারণা আছে? শুধুমাত্র ঢাকা শহরের রাস্তাতেই এক হাঁটু রক্ত হবার কথা। বাদ দেন এসব, যা হবার হবে। এখন বলেন আছেন কেমন?
জি ভালো।
ছেলে-মেয়ে-স্ত্রী সবাই ভালো?
জি। এদের ঢাকায় রেখে লাভ নাই। এদের কোনো নিরাপদ জায়গায় পাঠিয়ে দেন।
নিরাপদ জায়গা কোনটা?
সেটাই একটা কথা, নিরাপদ জায়গাটা কী? এই বিষয়ে একটা শের আছে। পুরোপুরি মনে নাই, ভুলে গেছি। ভাবাৰ্থ হলো–
আমাকে একটা নিরাপদ জায়গার সন্ধান
হে পারোয়ার দেগার তুমি দাও
যে নিরাপদ স্থানে প্ৰেম আমাকে স্পর্শ করবে না।
দুপুর বারোটা থেকে সাড়ে বারোটা পর্যন্ত মোবারক হোসেন পুত্রের হাসি এবং কান্না দেখলেন। তিনি বড়ই মজা পেলেন। এই সময়টাতে তার একবারও শের শাহ সুরী রোডের কথা মনে পড়ল না। আজই যে সেখানে যেতে হবে এবং আজই কর্নেল সাহেব উপস্থিত থাকবেন— এটাও মনে থাকল না। অথচ তিনি খবর দিয়ে রেখেছেন। মুক্তাগাছার মণ্ডা নিয়ে আসরের নামাজের আগেই একজনের আসার কথা। কর্নেল সাহেবকে মণ্ডা খাওয়াতে হবে।
বুধবারে তাঁকে বাসায় পাওয়া যায়–এই খবরটা হয়তো প্রচার হয়ে গেছে। অনেকেই এই দিনে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসে। বেশিরভাগই আসে দুপুরে খাওয়ার সময়। আজ এসেছেন মুসলেম উদ্দিন সরকার। মোবারক হোসেনের ছোট মামা। তিনি টুকটাক ব্যবসা করেন। কোনো ব্যবসাই গোছাতে পারেন। না। টাকা-পয়সার টানাটানি হলেই ভাগ্লের কাছে টাকা ধার করতে আসেন। মোবারক হোসেন প্রতিবারই বিরক্ত হন, তবে প্রতিবারই কিছু না কিছু সাহায্য করেন।
দুপুরে মোবারক হোসেন একা খেতে পছন্দ করেন। খাবার সময় কেউ সামনে থাকবে না। সবগুলি পদ হাতের কাছে সাজানো থাকবে, তিনি নিজের মতো ধীরে-সুস্থে খাওয়াদাওয়া সারবেন। তার হাত ধোয়ার শব্দ শুনে একজন কেউ পিরিচে দুটা জর্দা দেয়া পান নিয়ে আসবে।
আজ তাকে বাধ্য হয়ে ছোট মামাকে সঙ্গে নিয়ে খেতে বসতে হলো। ছোটমামা মুসলেম উদ্দিন সরকার ভাগ্নের দিকে তাকিয়ে আনন্দিত গলায় বললেন, তুই এমন বিরক্ত মুখ করে আমার দিকে তাকাচ্ছিস কী জন্যে? আজি টাকা ধার করতে আসি নাই। গগুগোলের বাজারে আমার ব্যবসা ভালো যাচ্ছে। ভালো পয়সা কামাচ্ছি।
এখন আপনার কিসের ব্যবসা?
লবণের ব্যবসা আর মোমবাতির ব্যবসা। কেরোসিনের ব্যবসাতেও নামব। কেরোসিনের ব্যবসাতেও রমরমা ভাব। শুধু আল্লা আল্লা করতেছি। গণ্ডগোল আরো কিছুদিন চলুক। দুই মাস চললেই আল্লাহর কাছে হাজার শুকুর। তুই রাজি থাকলে কেরোসিনের ব্যবসায় তোকে পার্টনার নিতে পারি। ফিফটি ফিফটি শেয়ার। করবি পার্টনারশিপ ব্যবসা?
না।
আচ্ছা থাক, যে জন্যে এসেছি সেট শোন। তোর বড় মেয়ের বিয়ে দিবি? মেয়ে ইন্টারমিডিয়েট দিবে–এখন বিয়ে দেয়া যায়। হাতে ভালো ছেলে আছে।
মোবারক হোসেন কথা বলছেন না। শুনে যাচ্ছেন। খাওয়ার সময় কথা বলতে তার মোটেই ভালো লাগে না।
ছেলে অত্যন্ত ভালো। এই ছেলে হাতছাড়া করলে আল্লাহ নারাজ হবেন। সুযোগ তো তাঁরই করে দেয়া।
মোবারক হোসেন বললেন, ছেলে কী করে?
ছেলে কিছু করে না, তবে ভবিষ্যতে বড় কিছু করবে ইনশাল্লাহ।
মোবারক হোসেন বিরক্ত চোখে তাকালেন। কী সুন্দর বিয়ের প্রস্তাব—ছেলে কিছু করে না, তবে ভবিষ্যতে বড় কিছু করবে!
মুসলেম উদ্দিন সরকার আগ্রহ নিয়ে বললেন, ছেলের বাবা-মা নাই। মা জন্মের সময় মারা গেছেন। বাবা মারা গেছেন–ছেলের বয়স যখন এগারো। ছেলে নিজের চেষ্টায়, বন্ধুবান্ধবদের চেষ্টায় লেখাপড়া করেছে।
মোবারক হোসেন কিছু বললেন না। কথা বলার কোনো মানে হয় না। পাত্র কিছু করে না, এতিম— এরপর আর কথা কী?
তুই ছেলেটাকে একদিন দেখ।
প্ৰয়োজন দেখি না।
ছেলেটাকে দেখলে, তার সঙ্গে কথা বললে তোর ভালো লাগবে। ছেলে অত্যন্ত রূপবান।
মোবারক হোসেন বললেন, অত্যন্ত রূপবানকে আমার দেখতেও ভালো লাগে না, কথা বলতেও ভালো লাগে না।
আমি তাকে আজ সন্ধ্যায় তোদের বাসায় আসতে বলেছি।
কেন?
তোদের সঙ্গে চা খাবে।
মোবারক হোসেন অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললেন, মামা শুনুন, এটা তো আপনার কেরোসিনের ব্যবসা না যে আপনি হঠাৎ কোনো এক ডিলারের কাছ থেকে একশ টিন কেরোসিন কিনে ফেললেন। আপনি কী মনে করে কারো সঙ্গে আলোচনা না করে ছেলেকে রাতে চা খেতে বলেছেন?
মুসলেম উদ্দিন সরকার বললেন, কারো সঙ্গে আলোচনা করি নাই— এটা তো ঠিক না। তোর স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করেছি। বৌমা খুব আনন্দের সঙ্গে রাজি হয়েছে।
মোবারক হোসেন ঠাণ্ডা গলায় বললেন, আপনি অবশ্যই ছেলেকে না করে আসবেন।
মুসলেম উদ্দিন বললেন, তুই শান্ত হ। এত রাগ করার কিছু নাই। আমি বিকালের মধ্যেই নিজে গিয়ে না করে আসব। ভালো একটা ছেলে হাতছাড়া হয়ে গেল–এটাই একটা আফসোস। বড়শিতে মাছ মারার সময় মাঝে মাঝে খুব বড় মাছ বড়শি গিলে তারপর সুতা ছিঁড়ে চলে যায়। তখন বর্শেলের আফসোসের সীমা থাকে না। আমার সে-রকম আফসোস হচ্ছে। এই মাছটা ছিল বিরাট কালবোস। কালবোস চিনিস?
মোবারক হোসেন জবাব দিলেন না। তার খাওয়া শেষ হয়েছে। তিনি হাতমুখ ধুয়ে পান মুখে দিচ্ছেন।
কালবোস হলো রুই এবং কাতলের শংকর। বাবা হলো রুই মাছ, মা হলো কাতল মাছ। অতি স্বাদু মাছ। একটাই সমস্যা–এরা বংশবিস্তার করতে পারে না। এই জন্যেই কালবোসের সংখ্যা এত কম। হঠাৎ হঠাৎ পাওয়া যায়।
মামা, আমি কিছুক্ষণ রেস্ট নেব। ফ্যান ছেড়ে শুয়ে থাকব।
আমিও চলে যাব। দেখি ছেলেকে পাই কি-না। সে থাকে পুরান ঢাকায়। গলির ভিতর গলি, তার ভিতরে গলি। বাড়ি খুঁজে পাওয়াই সমস্যা। এক কামরার একটা ঘর ভাড়া করে থাকে; ঘরে ঢুকলে মনে হয়, টিনের ট্রাংকের
মোবারক হোসেন শোবার ঘরের দিকে রওনা হলেন।
মুসলেম উদ্দিন বললেন, ছেলের সম্পর্কে আসল কথাটাই তো তোকে বলা হয় নি। গল্প-উপন্যাসে এক ধরনের ছেলের কথা থাকে যারা জীবনে কোনো পরীক্ষায় সেকেন্ড হয় না। সে-রকম ছেলে। ফিজিক্স অনার্সে ফাস্টক্লাস ফাস্ট, এমএসসি-তে ফাস্টক্লাস ফাস্ট, ইন্টারমিডিয়েটে ফাস্ট। শুধু ম্যাট্রিকে সেকেন্ড হয়েছিল; ছেলের কোনো দাবি-দাওয়া নাই, শুধু তাকে ক্যাশ এগারো হাজার টাকা দিতে হবে। তার কিছু ঋণ আছে, সে ঋণ শোধ করবে। ভবিষ্যতে এই ছেলে কী করবে চিন্তা কর। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে লেকচারার হয়ে ঢুকবে। কমনওয়েলথ স্কলারশিপ পেয়ে স্ত্রী নিয়ে চলে যাবে পিএইচডি করতে। ছেলেকে চা খেতে আসতে বলব?
মোবারক হোসেন চুপ করে আছেন।
মুসলেম উদ্দিন বললেন বলধ চা খেতে আসার জন্য? আসুক না। এসে চা খেয়ে যাক। কত লোকই তো তোর এখানে এসে চা-নাস্তিা খেয়ে যায়। তাতে অসুবিধা কী?
সন্ধ্যার সময় আমি থাকব না।
তাহলে একটু রাত করে আসতে বলি। আমাদের সঙ্গে রাতের খানা খাক। বলব? বেচারা দিনের পর দিন হোটেলে খায়, একবার বাড়ির খাওয়া খেয়ে দেখুক খাওয়া কাকে বলে।
মোবারক হোসেন হ্যাঁ না কিছুই বললেন না। ঘুমোতে চলে গেলেন। ঘুমে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। এটা খারাপ লক্ষণ! যখন প্রচণ্ড ঘুম পায় তখন বিছানায় যাওয়া মাত্র ঘুম কেটে যায়।
কর্নেল সাহেবকে আজ আরো সুন্দর লাগছে। তিনি পরেছেন ফুলতোলা হাফ হাওয়াই সার্ট। সাদা রঙের উপর হালকা সবুজ ফুল। মাথায় লাল রঙের কাপড়ের ক্যাপ। চোখ যথারীতি কালো চশমায় ঢাকা। কর্নেল সাহেবকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি একজন টুরিস্ট। সমুদ্রতীরের কোনো এক শহরে বেড়াতে এসেছেন। স্ত্রীকে হোটেলে রেখে জরুরি একটা মিটিং সারাতে এসেছেন। মিটিং শেষ করেই স্ত্রীর কাছে যাবেন। তারা হাত ধরাধরি করে সমুদ্রের কাছে বেড়াতে যাবে। মিটিং-এ মন বসছে না বলেই তিনি বারবার আঙুল দিয়ে টেবিলে ঠকঠক করছেন।
ইন্সপেক্টর, তোমার এই মাটির হাঁড়িতে কী আছে?
মুক্তাগাছার মণ্ডা। আপনার জন্য আনিয়েছি।
তোমার দেশের যে জিনিসটা তোমার সবচে প্ৰিয় সেটা?
ইয়েস স্যার।
থ্যাংকয়্যু। এখন বলো, কেমন আছ?
স্যার, ভালো আছি।
আমি খবর নিয়েছি, তুমি খুব ভালোভাবে তোমার ডিউটি পালন করছ। আমি তোমার উপর খুশি। You are a good Pakistani officer.
থ্যাংকয়্যু স্যার।
তোমার সঙ্গে যে পিস্তলটিা আছে, সেটা আমি রেখে দেব।
মোবারক হোসেন চিন্তিত গলায় বললেন, স্যার, আমাকে অফিসে হিসাব দিতে হবে। আপনার কাছে পিস্তল দিয়ে দিলে আমি বিপদে পড়ব।
তোমাকে বিপদে ফেলতে চাই না। তুমি বরং আগামীকাল তোমার অফিসে পিস্তল জমা দিয়ে দিবে।
জি আচ্ছা, স্যার।
তোমাদের এই পিস্তলগুলি পুরনো। ট্রিগার টিপলে দেখা গেল গুলি হলো না। আমি তোমাকে ভালো একটা পিস্তল দিব।
মোবারক হোসেনের পেটে কেমন যেন শব্দ হচ্ছে। মাথা বিমঝিম করছে। পায়ের নিচটা অবশ হয়ে যাচ্ছে এরকম অনুভূতি। মনে হচ্ছে তিনি চোরাবালিতে দাঁড়িয়ে আছেন। ধীরে ধীরে তার শরীর ডেবে যাচ্ছে। আশেপাশে কেউ নেই যে তাকে টেনে তুলবে। জোহর সাহেব অবশ্যি আছেন। তিনি আগের মতো মাথা নিচু করে সিগারেট টেনে যাচ্ছেন। কটা সিগারেট খাওয়া হয়েছে সেই হিসাব রাখা হয় নি। কর্নেল সাহেব হঠাৎ যদি জিজ্ঞেস করেন, তিনি জবাব দিতে পারবেন না। কর্নেল সাহেব নিশ্চয়ই খুব বিরক্ত হবেন।
ইন্সপেক্টর।
ইয়েস স্যার।
তুমি হঠাৎ খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েছ। কী জন্যে?
স্যার, আমি চিন্তিত না।
অবশ্যই তুমি চিন্তিত। তোমার কপাল ঘামছে। তুমি মনে মনে কী ধারণা করছি সেটা বলব? তোমার ধারণা আমি নতুন পিস্তল দিয়ে তোমাকে নির্দেশ দিব–যাও, শেখ মুজিবকে খুব কাছ থেকে গুলি করো। তোমার প্রতি এটাই হাই কমান্ডের নির্দেশ। তাই ভাবিছ না?
মোবারক হোসেন তাকালেন জোহর সাহেবের দিকে। তার ঠোঁটে চাপা হাসি। এই ভদ্রলোক কটা সিগারেট খেয়েছেন? কর্নেল সাহেব যদি সিগারেটের সংখ্যা জিজ্ঞেস কলেন, তাহলে বিপদে পড়ে যেতে হবে। হে আল্লাহপাক, কর্নেল সাহেব আজ যেন সিগারেটের সংখ্যা না জিজ্ঞেস করেন।
ইন্সপেক্টর।
ইয়েস স্যার।
আমরা এ ধরনের কোনো পরিকল্পনা করলেও করতে পারি। আততায়ীর হাতে শেখ মুজিবের মৃত্যু। দলপতি শেষ মানেই দল শেষ। তবে এ ধরনের পরিকল্পনা করা হলে তার দায়িত্ব আমরা তোমাকে দিব না। তুমি বাঙালি। কোনো বাঙালিকে আমরা বিশ্বাস করি না। তোমার হাতের টিপ কেমন তাও জানি না। ভালো হবার কথা না। আমাদের দরকার সার্প শুটার। বুঝতে পারছি?
জি স্যার।
কর্নেল সাহেব মাথা ঝাকালেন। পকেটে হাত দিয়ে সিগারেট বের করে ঠোঁটে দিলেন। সিগারেট ধরলেন না। তবে তিনি সিগারেটে টান দিচ্ছেন এবং ধোয়া ছাড়ার ভঙ্গি করছেন। এটা যেন এক ধরনের খেলা।
ইন্সপেক্টর।
ইয়েস স্যার।
একটা শক্তিশালী বাঘ চুপচাপ বসে আছে। তোমরা বাঘটাকে খোচাচ্ছি। কাঠি দিয়ে খোচোচ্ছ, গায়ে পানি ঢেলে দিচ্ছ। বাঘটার কানের কাছে ক্ৰমাগত চিৎকার করছ–জয় বাংলা, জয় বাংলা। এই বাঘ তো অবশ্যই ঝাপ দিয়ে পড়বে। আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি যাও। জোহর, তুমি তাকে পিস্তল আর ছয় রাউন্ড গুলি দিয়ে দাও। মিষ্টির জন্যে ধন্যবাদ।
মোবারক হোসেন রাতে বাসায় ফিরলেন জ্বর নিয়ে। জ্বর এবং তীব্র মাথার যন্ত্রণা। মুসলেম উদ্দিন ছেলেটিকে নিয়ে এসেছেন। তার নাম নাইমুল। দেখে মনে হচ্ছে ছায়ার কচুগাছ। প্রাণহীন বিবর্ণ। লম্বাতেও বেশি। স্কুলে এই ছেলেকে নিশ্চয়ই তালগাছ ডাকা হতো। মরিয়ম বেঁটে। এই তালগাছের সঙ্গে মরিয়মকে একেবারেই মানাবে না। ছেলের চোখে-মুখে উদ্ধত ভঙ্গি আছে। চোখে চোখ পড়ার পরেও চোখ নামিয়ে নিচ্ছে না। তাকিয়ে থাকছে।
মোবারক হোসেন তাদের সঙ্গে খেতে বসলেন, কিন্তু কিছু খেতে পারলেন না। তার জ্বর বেড়েছে। পেটে মোচড় দিচ্ছে। তিনি খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়লেন।
মুসলেম উদ্দিন যখন তার ভাগ্নেকে জিজ্ঞেস করলেন, কি-রে ছেলেটাকে পছন্দ হয়েছে? তখন মোবারক হোসেন বললেন, ছেলে পছন্দ হয় নি। কিন্তু বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারেন। ছেলের আত্মীয়স্বজনকে খবর দিন। ওদের সঙ্গে কথা বলেন। তবে আমাকে এইসবের মধ্যে জড়াবেন না। বিয়ের তারিখ ঠিক করে জানাবেন। আমি খরচ দিব। ছেলে ক্যাশ টাকা যেন কত চায়?
এগারো হাজার।
মোবারক হোসেন বললেন, এগারো হাজার টাকা দিয়ে দিব। কোনো সমস্যা নাই।
কবিতা একবার পড়লে
কবিতা একবার পড়লে অনেকক্ষণ মাথায় থাকে। কবিতার শব্দগুলি না থাকলেও ছন্দটা থাকে। ট্রেন চলে যাবার পরেও যেমন ট্রেনের ঝিক ঝিক শব্দ মাথায় বাজতে থাকে সে-রকম। এ ধরনের একটা ব্যাপার শাহেদের হয় তার বড় ভাইয়ের চিঠি পাওয়ার পর। চিঠিটা অনেকক্ষণ মাথায় থাকে।
ইরতাজউদ্দিন চিঠি লেখেন রুলটানা কাগজে। সাদা কাগজে তার লাইন ঠিক থাকে না বলে তিনি সাদা কাগজে লিখতে পারেন না। অক্ষরগুলি বড় বড় এবং স্পষ্ট। অক্ষর যেমন স্পষ্ট চিঠির বক্তব্যও স্পষ্ট। এই মানুষটার ভেতর কোনো অস্পষ্টতা নেই।
শাহেদ তার বড় ভাইয়ের চিঠি গতকাল দুপুরে একবার পড়েছে। রাতে ঘুমুতে যাবার সময় একবার পড়েছে। এখন আরেক দুপুর। শাহেদ ঠিক করেছে, আজ সারাদিনের জন্যেই সে বের হয়ে যাবে। ফিরবে সন্ধ্যার পর। এর মধ্যে একটা ফাক বের করে বড় ভাইজানকে লেখা চিঠিটা পোস্ট করে দেবে।
বড় ভাইজান লিখেছেন–
প্রিয় শাহেদ, আসমানী ও রুনি, (তিনজনের নামে এক চিঠি। এই অদ্ভুত মানুষ শাহেদের বিয়ের পর কখনো শাহেদকে আলাদা চিঠি লিখেন নি। রুনির জন্মের পর সব চিঠিতেই তারা দুইজন ছাড়াও রুনির নাম আছে।)
তোমাদের জন্যে অতীব দুশ্চিন্তায় আছি। সুদূর পল্লীগ্রামে আছি। শহরের অবস্থা বুঝিতে পারিতেছি না। লোকমুখে নানান খবরাদি পাই। কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা তা আলাদা করিতে পারি না। দুশ্চিন্তায় কালক্ষেপণ করি। প্রতি রাতেই আলাদা করিয়া তোমাদের তিনজনের জন্যে আল্লাহপাকের নিকট দেয়া করি। তাহাতেও মন শান্ত হয় না। মন যে শাস্ত হয় না। তাহার প্রমাণ প্ৰায় প্রতি রাতেই তোমাদের নিয়া আজেবাজে স্বপ্ন দেখি। একটি স্বপ্নে দেখিলাম তুমি মা রুনিকে কোলে নিয়া দৌড়াইতেছ। তোমার পাশে রুনির স্নেহময়ী মা আসমানী। তোমাদের পিছনে ভীষণ-দর্শন একজন বলশালী পুরুষ বল্লম হাতে তোমাদের তাড়া করিতেছে। যে-কোনো মুহুর্তে সে বল্লম নিক্ষেপ করিবে এমন অবস্থা।
যদিও জানি স্বপ্ন মানবমনের দুশ্চিন্তার ফসল ছাড়া আর কিছুই না। তারপরেও চিন্তায় অস্থির হইয়াছি। এমন নজির আছে যে মহান আল্লাহপাক স্বপ্নের মাধ্যমে আমাদের সাবধান করিতেছেন।
ঘটনা যাহাই হউক, পত্রপ্রাপ্তির তিনদিনের মাথায় তুমি অতি অবশ্যই সবাইকে নিয়া চলিয়া আসিবা। ইহা তোমার প্ৰতি আমার আদেশ।
আল্লাহপাক তোমাদের সর্ব বিপদ হইতে মুক্ত রাখুন। আমিন।
ইতি ইরতাজউদ্দিন
বড় ভাইয়ের কাছে লেখা শাহেদের চিঠি খুবই সংক্ষিপ্ত। সে শুধু লিখেছে–
ভাইজান, আমরা আসছি। এক সপ্তাহের মধ্যেই আসছি।
আসমানী বলল, এই, কোথায় যাচ্ছ?
শাহেদ জবাব দিল না। এরকম ভাব করল যেন সে আসমানীর কথা শুনতে পায় নি। আসমানী আবারো বলল, ভরদুপুরে তুমি যােচ্ছ কোথায়?
শাহেদ এবারো জবাব দিল না। গত দুদিন ধরে সে আসমানীর সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। শাহেদ নিঃশব্দে ঝগড়া করার চেষ্টা করছে। সমস্যা হচ্ছে, সে কথা না বলে দীর্ঘ সময় থাকতে পারে না। আসমানী পারে। একনাগাড়ে আঠারো দিন কথা না-বলার রেকর্ড আসমানীর আছে। গিনিজ বুক অফ রেকর্ড স্বামী-স্ত্রীর কথা বলা না-বলা জাতীয় বাঙালি ব্যাপার নিমো মাথা ঘামায় না। মাথা ঘামালে স্বামী-স্ত্রীর একনাগাড়ে দীর্ঘ সময় কথা না-বলার রেকর্ড ধরে রাখার ব্যবস্থা করত। এবং শাহেদের ধারণা সেখানে অবশ্যই আসমানী নাম থাকত।
কথা না-বলে দিনের পর দিন পাশাপাশি বাস করা আসমানীর কাছে কিছুই না। কথা বলতে না পারলেই সে যেন ভালো থাকে। সমস্যা হয় শুধু শাহেদের। আসমানীর সঙ্গে কথা বলতে না পারলে তার পেট ফুলতে থাকে। সাত-আট ঘণ্টা পার হওয়ার পর দমবন্ধ দমবন্ধ ভাব হয়, তারপর এক সময় খুব অসহায় লাগতে থাকে। মনে হয় তাঁর ভয়ঙ্কর কোনো অসুখ করেছে। নিঃশ্বাসের কষ্ট হওয়ার অসুখ।
আটচল্লিশ ঘণ্টা হলো শাহেদ কথা না বলে আছে। দমবন্ধ ষ্টেজ পার করে সে এখন আছে অসহায় স্টেজে। তারপরেও ঠিক করেছে, আসমানী ক্ষমা প্রার্থনা না করা পর্যন্ত সে কথা শুরু করবে না। আসমানীর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয়, সে ক্ষমা প্রার্থনা করার জন্য মানসিকভাবে প্ৰস্তৃত। চক্ষুলজ্জার জন্য পারছে না। আসমানী এখন নিজ থেকে আগ বাড়িয়ে অনেক অপ্রয়োজনীয় কথা বলছে। আশেপাশে ঘুরঘুর করছে।
দুদিন আগের ঝগড়ার দায়দায়িত্ব বেশিরভাগই আসমানীর। শাহেদ রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে বলেছে, আসমানী, তুমি এক কাজ করো। নীলগঞ্জে ভাইজানের কাছে চলে যাও।
আসমানী বলল, কেন?
ঢাকার অবস্থা ভালো না। লক্ষণ খুব খারাপ। কখন কী হয়! কী দরকার রিস্ক নিয়ে?
তুমি ঢাকায় থাকবে?
হ্যাঁ।
তুমি ঢাকায় থাকবে। আর আমি চলে যাব? ঢাকার অবস্থা আমার জন্য খারাপ আর তোমার জন্য রসগোল্লা?
এরকম করে কথা বলছি কেন?
কী রকম করে কথা বলছি?
খুবই অশালীন ভঙ্গিত কথা বলছি। যে মেয়ে ইংরেজিতে মাস্টার্স করেছে, তার কথাবার্তা কি আরো শালীন হবে না?
অশালীন, কথা কোনটা বললাম? রসগোল্লা শব্দটা অশালীন? তাহলে শালীন শব্দ কোনটা? পাস্তুয়া? নাকি রসমালাই?
প্লিজ, চুপ করো।
না, আমি চুপ করব না। তুমি আমাকে ব্যাখ্যা করবে। কেন ঢাকা আমার জন্যে খারাপ আর তোমার জন্যে পান্তুয়া।
শাহেদ বিরক্ত হয়ে বলেছে, আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি থাকে। তোমাকে কোথাও যেতে হবে না।
আসমানী গম্ভীর গলায় বলেছে, ঠিক করে বলো তো, কোনো কারণে কি আমাকে তোমার অসহ্য বোধ হচ্ছে? কথায় কথায় নীলগঞ্জ চলে যাও। যেন আমি নীলগঞ্জ চলে গেলে তুমি হাঁপ ছেড়ে বাচ। আমি একা নীলগঞ্জ গিয়ে কী করব? তোমার মাওলানা ভাইয়ের সঙ্গে হাদিস-কোরান নিয়ে গল্প করব?
বললাম তো যেতে হবে না।
আর আমাকে যদি যেতেই হয় আমি নীলগঞ্জ যাব কেন? আমার কি যাওয়ার জায়গার অভাব আছে?
সামান্য ব্যাপার নিয়ে তুমি বাড়াবাড়ি করছি আসমানী।
শুধু আমি সামান্য ব্যাপার নিয়ে বাড়াবাড়ি করি? তুমি করো না? তুমি কি সবসময় অসামান্য ব্যাপার নিয়ে বাড়াবাড়ি করো? ঐ দিন চায়ে চিনি বেশি হয়েছিল বলে তুমি কি কাপসুদ্ধ চা মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দাও নি?
ব্যাপারটা এখানেই শেষ হতে পারত। শেষ হলো না। আসমানী বালিশ নিয়ে উঠে গেল। শাহেদ বলল, কোথায় যােচ্ছ?
আসমানী বলল, তা দিয়ে তোমার দরকার কী? তুমি তোমার ঘুম ঘুমাও। আমি পাশে নেই, কাজেই রাতে ভালো ঘুম হওয়ার কথা। কে জানে হয়তো সুন্দর সুন্দর স্বপ্নও দেখবে।
আসমানী ঘুমুতে গেল বসার ঘরের সোফায়। শাহেদ এই সোফার নাম দিযেছে। রাগ-সোফা। স্বামী-স্ত্রীর ভেতর ঝগড়া হলে একজন কেউ সেই সোফায় গিয়ে শোয়। সেই একজনটা বেশিরভাগ সময়ই আসমানী।
আসমানী সোফায় ঘুমুতে গেছে। শাহেদ আছে বিছানায়। রুনি তার সঙ্গে। আসমানী রাগারগি যাই করুক রুনিকে সঙ্গে নিয়ে মশার কামড় খাওয়ায় না। শাহেদ মশারির ভেতর বসে আছে। তার কাছে মনে হচ্ছে, এমন কিছু ঘটে নি যে রাতে আলাদা ঘুমুতে হবে। ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি তো বটেই। আসমানী বেশ কিছুদিন থেকে বাড়াবাড়ি করছে। দেশের অনিশ্চিত অবস্থা মনের উপর চাপ ফেলে, সবাই কিছুটা হলেও অস্বাভাবিক আচরণ করে। সেই যুক্তিতে আসমানীকে ক্ষমা করা যায়। পরীক্ষণেই মনে হলো, প্রতিবার আগ বাড়িয়ে এত ক্ষমার দরকার কী? সে হবে ক্ষমার সাগর আর আসমানী হবে চৌবাচ্চা। কেন? দেখি না কথা না-বলে কত দিন থাকা যায়।
শাহেদ প্যান্ট পরতে পরতে ভাবল, কথা বলা শুরু করা যাক। এমনিতেও নিজের কোমর সরু হয়ে গেছে কিংবা প্যান্টের কোমর কোনো এক অস্বাভাবিক কারণে বড় হয়ে গেছে। বেল্ট ছাড়া পরা যাবে না। বেল্ট খুঁজে বের করা যাবে না। আসমানীকে বললে সে নিমেষে বের করে দেবে। জিনিস খুঁজে বের করার অলৌকিক ক্ষমতা আসমানীর আছে।
শাহেদ বলল, (আসমানীর দিকে না তাকিয়ে) বেল্টটা কোথায় দেখ তো।
আসমানী বলল, দেখছি, তুমি যােচ্ছ কোথায় বলে।
কাজ আছে, কাজে যাচ্ছি।
কোনো কাজে যাওয়া-যাওয়ি নেই। রুনিকে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। চার দিন ধরে জ্বর চলছে। তুমি তো কপালে হাত দিয়ে মেয়ের জ্বরটা পর্যন্ত দেখ নি।
সন্ধ্যাবেলা নিয়ে যাব।
সন্ধ্যাবেলা না, এখনি নিয়ে যাবে।
এখন ডাক্তার পাব কোথায়?
তাহলে অপেক্ষা করো, যখন ডাক্তার পাবে তখন নিয়ে যাবে। এর আগে
বেরুতে পারবে না।
আসমানী, তোমার কি মনে হয় না। তুমি বাড়াবাড়ি করছি? বাড়াবাড়ি করলে করছি, তুমি বেরুতে পারবে না। আমি তোমাকে যেতে দেব না।
শাহেদ শান্তমুখে জুতাব ফিতা লাগাচ্ছে। জুতার ফিতা লাগানোর সহজ কাজটা সে কখনো ঠিকমতো করতে পারে না। কীভাবে কীভাবে প্যাচ লেগে আন্ধা গিন্টু হয়ে যায়। এবারো বোধহয় হয়ে গেল।
আসমানী শীতল গলায় বলল, তুমি তাহলে বেরুচ্ছ?
হুঁ।
বেশ, যাও, বাসায় ফিরে এসে কিন্তু আমাকে দেখবে না।
তুমি যাবে কোথায়?
যেখানে ইচ্ছা যাব, তা নিয়ে তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না।
বেল্ট খুঁজে দিতে বলছি, খুঁজে দাও।
বেল্টটা খুঁজে বের করতে পারব না। তুমি খুঁজে নাও। তুমি অন্ধ না, তোমার চোখ আছে।
শাহেদ ঘর থেকে বের হলো মন খারাপ করে। আসমানী অবুঝের মতো আচরণ করছে। এরকম সে কখনো ছিল না। তার হয়েছেটা কী? না-কি সমস্যা তার? সে এমন কিছু করছে যে আসমানী রেগে যাচ্ছে? দুজনের কেউ কাউকে বুঝতে পারছে না।
বাসায় ফিরতে ফিরতে শাহেদের সন্ধ্যা হয়ে যাবে এবং সে নিশ্চিত বাসায় ফিরে দেখবে দরজায় তালা ঝুলছে। আসমানী রুনিকে নিয়ে চলে গেছে। তখন আবার বের হতে হবে তাদের খোজে। ঢাকায় মা-বাবা ছাড়াও আসমানীর বেশ কিছু আত্মীয়স্বজন আছে। সে এমন একজনের বাড়িতে উঠবে যার ঠিকানা শাহেদ জানে না। দেশের পরিস্থিতি ভয়াবহ। যে-কোনো সময় শহরে মিলিটারি নেমে যাবে। অতি যে মুর্থ সেও এই সত্যটা খুব ভালো করেই জানে। জানে না শুধু আসমানী। সে ফিট করে রিকশা নিয়ে বের হয়ে পড়বে। এই সময়ে আর যাই করা যাক ছেলেমানুষি করা যায় না। আসমানী বেছে বেছে ছেলেমানুষি করার জন্য এই সময়টাই বেছে নিয়েছে। আশ্চর্য এক মেয়ে!
রাস্তায় পা দিয়েই শাহেদের মন ভালো হয়ে গেল। ব্যাপারটা সে আগেও লক্ষ করেছে–ইদানীং উদ্দেশ্যহীনভাবে রাস্তায় রাস্তায় হাঁটতে তার ভালো লাগে। এর কারণ কী হতে পারে? নগরী কোনো বিশেষ ঘটনার জন্যে প্ৰস্তৃত হচ্ছে। সেই প্ৰস্তুতি কাছ থেকে দেখার আনন্দ? নগরীর উত্তেজনার সাক্ষী হবার আনন্দ? নগরীর মানুষরা অনেক কাছাকাছি চলে এসেছে, সেই কাছাকাছি আসার আনন্দ?
বড় বড় উৎসবের আগে আগে এই ঘটনাগুলি ঘটে। কোরবানির ঈদে গরু কিনে পথে হাঁটার সময় অপরিচিতজনরা আনন্দের সঙ্গে কাছে এসে জিজ্ঞেস করে, কত দিয়ে কিনলেন? দাম শোনার পর খুশি খুশি গলায় বলে, ভাই আপনি জিতেছেন। গরু মাশাল্লাহ ভালো হয়েছে।
ঠিক এইরকম ব্যাপার এখন ঘটছে। যে দোকানে চাল-ডাল কিনতে যাচ্ছে তাকে নিতান্ত অপরিচিত মানুষ অন্যদের সঙ্গে উপদেশ দিচ্ছে— কেরোসিন বেশি করে কিনে রাখেন। কেরোসিনের শটেজ হবে। কেরোসিন, দেয়াশলাই আর মোমবাতি।
চায়ের দোকানে চা খেতে গেলে পাশ থেকে কেউ একজন অবধারিতভাবে জিজ্ঞেস করবে, ভাইসাহেব, দেশের অবস্থা কী বুঝেন? দেশ কি স্বাধীন হবেআপনার কী ধারণা? দেশ স্বাধীন হবে কি হবে না। এই নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে দীর্ঘ আলোচনা চলে। আশপাশের লোকজনও তাতে অংশ নেয়। এক সময় আলোচনা ঐকমত্যে শেষ হয়। দেশ যে স্বাধীন হবে–এই বিষয়ে সবাই একশ ভাগ নিশ্চিত হয়। এই উপলক্ষে আরেক দফা চা খাওয়া হয়।
নগরী স্বাধীনতার জন্যে অপেক্ষা করছে। এই অপেক্ষা খুব কাছ থেকে দেখা এক আনন্দময় অভিজ্ঞতা। শাহেদ মনের আনন্দে দুপুর একটা পর্যন্ত পথে পথে ঘুরল।
রোদ উঠেছে কড়া। ঘামে শরীর ভিজে গেছে। বাসায় গিয়ে সাবান ডলে গোসলটা আরামদায়ক হবে কিন্তু শাহেদের বাসায় যেতে ইচ্ছা করছে না। আসমানীর কাছে রাগ দেখাতে ইচ্ছা করছে। সে যদি রাত বারোটা পর্যন্ত বাইরে থাকে তাহলে রাগ দেখানোটা জামবে।
শাহেদ রিকশা নিয়ে নিল। সে যাবে আগামসি লেনে। সেখানে দুটা রুম ভাড়া করে তার অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু নাইমুল থাকে। তার সঙ্গে অনেক দিন যোগাযোগ নেই। নাইমুলের সমস্যা হলো, সে নিজ থেকে কারোর সঙ্গে যোগাযোগ করবে না। অন্যদের তার কাছে যেতে হবে।
প্ৰচণ্ড বেগে মধ্যবয়স্ক রিকশাওয়ালা ঝড়ের মতো রিকশা টানছে। শাহেদ বলল, কোনো তাড়াহুড়ো নাইরে ভাই, রিকশা আস্তে চালাও। রিকশার গতি তাতে কমল না। রিকশাওয়ালা দাঁত বের করে বলল, টাইট দিয়া বসেন, উড়াল দিয়া নিয়া যাব।
শাহেদ বলল, উড়াল দেয়ার দরকার নাই। এক্সিডেন্ট করবে। জানে মরব। এখন মরে গেলে স্বাধীন দেশ দেখে যেতে পারব না।
স্বাধীন। তাইলে আইতেছে কী কন স্যার?
আসছে তো বটেই।
আইজ শেখ সব স্বাধীন ডিক্লার দিব।
কে বলেছে?
এইটা সবেই জানে।
রিকশাওয়ালা রিকশার গতি কমাল। সম্ভবত স্বাধীনতা নিয়ে যাত্রীর সঙ্গে কথা বলতে তার ভালো লাগছে।
স্বাধীন হইলে আমরার মতো গরিবের দুঃখ-কষ্ট কিছু থাকব না, কী কন স্যার?
থাকার তো কথা না।
খাওয়া-দাওয়া, কাপড়-চোপড় সব দিব ইসটেট। ঠিক না। স্যার? সবই ফিরি।
শাহেদ চুপ করে বাইল। স্বাধীনতার এই চিত্রটা নিয়ে আলোচনায় না। যাওয়াই ভালো।
শেখ সাব একটা বাঘের বাচ্চা। কী কন্ন স্যার?
অবশ্যই বাঘের বাচ্চা।
খাঁটি মায়ের খাঁটি দুধ খাইয়া বড় হইছে। কী কন স্যার?
অবশ্যই।
জীবনে একটা শখ ছিল শেখ সাবরে একদিন আমার রিকশায় তুলব। বিষুদবার হাইকোর্টের মাজারে গিয়া দোয়াও করছি। জানি না দোয়া কবুল হইব কি না।
শাহেদ বলল, সৎ দোয়া সৎ ইচ্ছা সব সময় কবুল হয়।
আগামসি লেনে নেমে শাহেদ ভাড়া দিতে গেল। রিকশাওয়ালা ভাড়া নিবে না। শাহেদ বলল, ভাড়া নিবে না কেন? রিকশাওয়ালা বলল, স্বাধীন হইলে তো সবই ফিরি হইব। ধরেন দেশ স্বাধীন হইছে।
শাহেদ রিকশাওয়ালার দিকে তাকিয়ে আছে। এর চেহারা মনে রাখা দরকার। দেশ যদি সত্যি সত্যি স্বাধীন হয়, তখন একে খুঁজে বের করতে হবে।
ভোঁতা। পাথরের মতো মুখ। মাথার চুল খাবালা-খাব লাভাবে উঠে গেছে। কোনো একজন বিখ্যাত লোকের চেহারার সঙ্গে রিকশাওয়ালার চেহারার মিল আছে। সেই লোকটাকে মনে পড়ছে না। রিকশাওয়ালা হাসিমুখে বলল, এমন নজর কইরা কী দেখোন?
তার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে শাহেদের বিখ্যাত লোকের নামটা মনে পড়ল। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন।
নাইমুলের ঘরের দরজা বন্ধ। কড়ায় ঝাকুনি দিতেই নাইমুল বলল, দরজা খোলা আছে। জোরে ধাক্কা দিলেই খুলবে। ভেতরে চলে আয়।
ঘরে ঢুকতে ঢুকতে শাহেদ বলল, আমি কড়া নাড়ছি বুঝলি কী করে? তুই তুই করছিলি। অন্য কেউ তো হতে পারত।
নাইমুল বলল, অনুমানে বলেছি। সাত-আট দিন পর পর তোর দেখা পাওয়া যায়। আজ নাইনথ ডে।
নাইমুল খালি গায়ে লুঙ্গি পরে বিছানায় শুয়ে আছে। তার মুখের উপর মোটা একটা বই ধরা। সতীনাথ ভাদুড়ির জাগরী। ঘর খুবই ছোট। কোনোমতে একটা খাট এবং একটা চেয়ার-টেবিল এটেছে। ঘরে একটা আলনা আছে, সেই আলনা বসানো আছে খাটের মাথায়। সেই কারণে খাট ছোট হয়ে গেছে। নাইমুলের মতো লম্বা মানুষ পা মেলে ঘুমুতে পারে না, তাকে পা খানিকটা গুটিয়ে রাখতে হয়। তবে ঘরের সিলিং অনেক উচুতে। সেই উচু সিলিং থেকে লম্বা রডের মাথায় ফ্যান ঘুরছে। নাইমুল বই থেকে চোখ না। সরিয়ে বললকোনো কথা না। স্ট্রেইট বাথরুমে চলে যা। বালতিতে পানি তোলা আছে। সাবান আছে, গামছা আছে, একটা লুঙ্গিও আছে। আরাম করে গোসল কর। তারপর কথা হবে।
শাহেদ বলল, বাসায় গিয়ে গোসল করব।
যা বলছি শোন। তোর ঘামে ভেজা শরীর দেখে আমারই অস্বস্তি লাগছে।
শাহেদ বাথরুমে ঢুকে পড়ল। গায়ে পানি ঢালার পর তার মনে হলো, দীর্ঘ একত্ৰিশ বছর জীবনে সে এত আরামের গোসল কোনো দিনও করে নি।
নাইমুল বলল, এই গাধা, গোসল করে আরাম পাচ্ছিস?
শাহেদ বলল, পাচ্ছি।
নাইমুল বলল, দুই বালতি পানি আছে। প্রথম বালতি পানি গায়ে ঢেলে শরীর ঠাণ্ডা কর। শরীর পুরোপুরি ঠাণ্ডা হবার পর গায়ে সাবান মাখবি। তাড়াহুড়ার কিছু নেই, ধীরে সুস্থে সাবান মাখ। তারপর সেকেন্ড বালতি। দুপুরে কি আমার এখানে খাবি?
খেতে পারি।
তাহলে তোকে আজ ইলিশ মাছের ডিম খাওয়াব। এই ডিম খাওয়ার পর পৃথিবীর কোনো খাবার তোর মুখে রুচিবে না।
ডিম কে রাধছে?
গনি মিয়া বাবুর্চি। হোটেলে বলা আছে। খাওয়া যথাসময়ে চলে আসবে। হড়বড় করে পানি ঢালছিস কেন? আস্তে আস্তে ঢাল। শরীর আরাম পাক।
শাহেদ গায়ে পানি ঢালছে। আরামে ঘুম পেয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছা করছে বাথরুমের ঠাণ্ডা মেঝেতে শুয়ে খানিকক্ষণ ঘুমায়। সে ঘুমাবে কেউ একজন গায়ে পানি ঢালবে। নাইমুলের গলা শোনা গোল— শাহেদ, তোকে বলা হয় নি। আমি বিয়ে করছি।
শাহেদ বলল, সে কী!
নাইমুল বলল, চমকে উঠলি কেন? আমি চিরকুমার থাকিব–এরকম তো কখনো বলি নি।
মেয়ে দেখা হয়েছে?
হঁ। চাকমা টাইপ চেহারা।
বলিস কী! মেয়েও ঠিক হয়ে গেছে? আমরা কিছুই জানলাম না।
বিয়ে করব আমি, তোদের জানার দরকার কী?
বিয়ের তারিখ ঠিক হয়েছে?
হ্যাঁ।।
কবে?
আজ।
ঠাট্টা করছিস?
আমি জীবনে কখনো কারো সঙ্গে ঠাট্টা করেছি–এরকম উদাহরণ আছে?
বিয়ে কখন?
রাতে। কাজি ডাকিয়ে বিয়ে। কবুল কবুল কবুল— ঝামেলা শেষ।
শাহেদ গায়ে পানি ঢালা বন্ধ করল। তার অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু নাইমুল। আজ রাতে তার বিয়ে–এই খবরটা জানানোর প্রয়োজনও সে বোধ করে নি। নাইমুল সবসময় এরকম। সে কি আসলেই এরকম, না-কি এটা তার এক ধরনের শো? সবাইকে জানানো— তোমরা আমাকে দেখ, আমি নাইমুল, আমি জীবনে কখনো কোনো পরীক্ষায় সেকেন্ড হই নি। আমি তোমাদের মতো না। আমি আলাদা।
শাহেদ!
বল।
মেয়ের নাম মরিয়ম। আমি ঠিক করেছি। শর্ট করে তাকে ডাকব মরি।
ভালো তো।
আমার শ্বশুরসাহেব পুলিশের লোক। তার নাম মোবারক হোসেন।
তুই কি সত্যিই আজ বিয়ে করছিস?
হ্যাঁ। আজ বিয়ে করাটাই আমার জন্যে সুবিধা। আজ বিশেষ দিন। ৭ই মার্চ। শেখ সাহেব স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন। এক সময় এই দিনটি আমাদের জাতীয় দিবস হয়ে যাবে। সরকারি ছুটি থাকবে। আমি আমার ম্যারেজ ডে কখনো ভুলব না। ভালো কথা, তুই কি শেখ সাহেবের ভাষণ শুনতে যাবি?
হ্যাঁ।
কী দরকার? রেডিওতে প্রচার হবে, রেডিও শোন। ক্রিকেট খেলা এবং ভাষণ–এইসব রেডিওতে শোনা ভালো।
শাহেদ বাথরুম থেকে বের হলো। নাইমুলের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল, গোসল করে আরাম পেয়েছি।
নাইমুল মুখের উপর ধরে রাখা বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বলল, আরাম পাবি জানতাম।
শাহেদ বলল, আমি এখন যাচ্ছি।
নাইমুল বিস্মিত গলায় বলল, যাচ্ছি মানে কী?
যাচ্ছি মানে যাচ্ছি।
ভাত খাবি না?
না।
তুই কি রাগ করে চলে যাচ্ছিস না-কি?
রাগ করব কেন? রাগ করার মতো তুই তো কিছু করিস নি।
এই যে তোকে কোনো খবর না দিয়ে বিয়ে করে ফেলছি। আসলে বিয়ের মতো পার্সেনাল কোনো ব্যাপার নিয়ে আমি ঢাক পিটাতে চাই না। এমন তো না যে তুই আমার স্বভাব জানিস না।
শাহেদ কিছু না বলে দরজার দিকে এগুচ্ছে। নাইমুল বলল, সাতটার আগে চলে আসিস, বরযাত্রী যাবি। ধীরেন স্যারের কাছে যাব। উনাকেও বলব, বরযাত্রী যেতে। আমার ধারণা স্যারকে বললেই তিনি যাবেন। তোর কী ধারণা?
শাহেদ জবাব না দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। সে আহত এবং অপমানিত বোধ করছে। নাইমুল তাকে খবর না দিয়ে বিয়ে করে ফেলছে? শাহেদের গা জ্বালা করছে।
শাহেদ রেসকোর্সের দিকে এগাচ্ছে! শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্সের ময়দানে ভাষণ দেবেন। তিনি কী বলেন তা শোনা অতি জরুরি। ঘরে বসেও শোনা যেত, রেডিওতে ভাষণ প্রচার করা হবে। তবে কিছুই বলা যায় না। হঠাৎ হয়তো ভাষণ বন্ধ করে ইয়াহিয়া খান রাস্তায় মিলিটারি নামিয়ে দেবে। সেই প্রস্তুতি তাদের নেওয়া আছে। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর বদল হয়েছে। ভাইস এডমিরাল এস এম আহসানের বদলে নতুন গভর্নর হয়ে এসেছে লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান। টিক্কা খান, নামটাই তো ভয়াবহ। ইয়াহিয়া তাকে শুধু শুধু নিয়ে আসছে না। তার মাথায় অন্য পরিকল্পনা। যে-কোনো দিন এই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন হবে। কী ভয়ঙ্কর যে হবে সেই দিন কে জানে! ড়ুমস ডে। দেশের বেশিরভাগ মানুষ ড়ুমস ডের ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না। তারা কল্পনা করছে স্বাধীন দেশে বাস করছে। স্বাধীনতা এত সস্তা না।
রেসকোর্সের ময়দানে মানুষের স্রোত নেমেছে। তারা চুপচাপ চলে আসছে তা না। স্লোগান দিতে দিতে এগুচ্ছে–বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো। ভুট্টোর মুখে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো। পরিষদ না রাজপথ-রাজপথ, রাজপথ। তোমার আমার ঠিকানা–পদ্মা-মেঘনা-যমুনা। ঢাকায় যত মানুষ ছিল সবাই বোধহয় চলে এসেছে। লাখ লাখ মানুষ। যেদিকে চোখ যায়। শুধু মানুষের মাথা। অনেকে আবার বাচ্চাকাচ্চা সঙ্গে নিয়ে এসেছে। ঘোমটা দেওয়া বৌরাও আছে। তারা চোখ বড় বড় করে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। বাবার ঘাড়ে বসে একটা বাচ্চা মেয়ে ট্যা ট্যা করে কাঁদছে। মেয়েটার মাথায় চুল বেণি করা। বেণির মাথায় লাল ফিতা বাধা। কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটা মাথা ঝাকাচ্ছে। আর তার বেণি নাড়ছে। সুন্দর লাগছে দেখতে। শাহেদ মুগ্ধ চোখে মেয়েটির বেণি নাড়ানো দেখল। তার মনে হলো রুনিকে নিয়ে এলে হতো। তাকে ঘাড়ে বসিয়ে মানুষের সমুদ্রের এই অসাধারণ দৃশ্য দেখানো যেত। এই দৃশ্য দেখাও এক পরম সৌভাগ্য। পৃথিবীর কোথাও কি এত মানুষ কখনো একত্রিত হয়েছে?
ভাষণ শুরু হওয়ার আগে আগে দুটা হেলিকপ্টার উড়ে গেল। মানুষের সমুদ্রে একটা ঢেউ উঠল। চাপা আতঙ্কের ঢেউ। শাহেদের পাশে বুড়োমতো এক লোক দাঁড়িয়ে আছে, তার হাতে একটা ছাতা। ছাতাটাকে লাঠির মতো বাগিয়ে ধরে আছে সে, যেন এক্ষুণি যুদ্ধ শুরু হবে। সে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে ছাতা হাতে। বুড়ো শাহেদের দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখে বলল, আইজ শেখসাব স্বাধীন ডিক্লার দিব। বলেই সে থু করে পানের পিক ফেলল। সেই পিক পড়ল শাহেদের প্যান্টে। সাদা প্যান্টে লাল পানের পিক, মনে হচ্ছে রক্ত লেগে গেছে। শাহেদ কঠিন কিছু কথা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই ভাষণ শুরু হয়ে গেল। চারদিকে ভয়াবহ নীরবতা, লাখ লাখ মানুষ নিঃশ্বাস বন্ধ করে আছে। তারা তাদের মহান নেতার প্রতিটি শব্দ শুনতে চায়। কোনো কিছুই যেন বাদ না পড়ে। মাঝে মাঝে শেখ মুজিব দম নেবার জন্যে থামছেন আর তখনই আকাশ বাতাস কাপিয়ে ধ্বনি উঠছে–জয় বাংলা! জয। বাংলা!
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভরাট গলা ভেসে আসছে। মাথার উপরে চিলের মতো উড়ছে হেলিকপ্টার। শাহেদ ভাষণ শুনছে আকাশের দিকে তাকিয়ে। আজই ঘটে যাবে না তো? হয়তো আজই ফেলে দিল হেলিকপ্টার থেকে কিছু বোমা।
আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সকলে জানেন এবং বুঝেন আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ অধিকার চায়। কী অন্যায় করেছিলাম? নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে ও আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল এসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈরি করব এবং এ দেশের ইতিহাসকে আমরা গড়ে তুলব।…
হেলিকপ্টার বড় যন্ত্রণা করছে। এরা কী চাচ্ছে? বাচ্চা মেয়েটা কাঁদতে শুরু করেছে। মনে হয় সে ভয় পাচ্ছে।
ভাষণ শেষ হবার পর শাহেদ কি ফিরে যাবে বন্ধুর কাছে? আজ তার বিয়ে। সেই বিয়েতে শাহেদ অবশ্যই অনুপস্থিত থাকতে পারে না। তার উপর রাগ হচ্ছে। রাগ চাপ{ থাক। রাগ দেখানোর সময় আরো পাওয়া যাবে। এ-কী, সে ভাষণ না শুনে মনে মনে কী সব ভাবছে? নেতার প্রতিটি কথা খুব মন দিয়ে শুনতে হবে। এই ভাষণে অনেক সাংকেতিক নির্দেশও থাকতে পারে।
সৈন্যরা তোমরা আমার ভাই। তোমরা ব্যারাকে থাকো, তোমাদের কেউ কিছু বলবে না। কিন্তু আর তোমরা গুলি করার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারব না। আমরা যখন রক্ত দিতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না।
শাহেদ গভীর মনোযোগে বক্তৃতা শোনার চেষ্টা করছে। অতিরিক্ত মনোযোগের কিছু সমস্যা আছে–মাঝে-মাঝে সব আবছা হয়ে যায়। মানুষের মস্তিষ্ক এত মনোযোগ নিতে পারে না! সে কিছু সময়ের জন্যে বিশ্রাম নেয়।
অনেকক্ষণ কড়া নাড়ার পর
অনেকক্ষণ কড়া নাড়ার পর দরজা খুলল। কোমরে ধুতি পেঁচানো খালি গায়ের যে মানুষটি দরজা খুললেন–তাঁর নাম ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়ের প্রফেসর এখন অবসর জীবনযাপন করছেন। সময় কাটছে বই পড়ে। সকালে নাশতা খেয়ে তিনি বই পড়া শুরু করেন। দুপুরের খাবারের পর কিছুক্ষণের জন্যে ঘুমুতে যান। ঘুম ভাঙার পর আবার বই পড়া শুরু হয়। শেষ হয় রাতে ঘুমুতে যাবার সময়। তাঁর অবসর জীবন বড়ই আনন্দে কাটছে।
নাইমুল নিচু হয়ে তার অতি পছন্দের মানুষের পা ছুঁয়ে কদমবুসি করতে করতে বলল, স্যার কি ঘুমাচ্ছিলেন? ঘুম থেকে তুললাম?
ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী আসলেই ঘুমুচ্ছিলেন। এই কথা শুনলে ছাত্র যদি অস্বস্তি বোধ করে সে কারণেই তিনি হাসিমুখে অবলীলায় মিথ্যা বললেন, আরে না। এই সময় কেউ ঘুমায় না-কি?
নাইমুল বলল, স্যার, আমাকে চিনতে পেরেছেন?
আরে চিনব না কেন? অবশ্যই চিনেছি। আসো, ভিতরে আসো। তুমি আছ কেমন, ভালো?
নাইমুল বলল, স্যার আজও যদি আমাকে চিনতে না পারেন, তাহলে ঘরে ঢুকব না। এর আগে যে কয়বার এসেছি, কোনোবারই আপনি আমাকে চিনতে পারেন নি। অথচ ভাব করেছেন যে চিনে ফেলেছেন।
অবশ্যই চিনেছি।
তাহলে আপনি আমার নাম বলুন।
দাঁড়াও, চশমাটা পরে আসি। চশমা ছাড়া দূরের জিনিস কিছুই দেখি না।
নাইমুল হাসিমুখে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইল। ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী শোবার ঘর থেকে চশমা পরে এলেন এবং বেশ কিছুক্ষণ নাইমুলের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার নাম শাহেদ। হয়েছে?
নাইমুল ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ফিফটি পারসেন্ট কারেক্ট হয়েছে স্যার।
তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, ফিফটি পারসেন্ট কীভাবে কারেক্ট হবে?
আমার নাম নাইমুল। আপনি শাহেদের নাম বলেছেন। শাহেদ আমার বন্ধু। তাকে নিয়ে আপনার কাছে তিন-চারবার এসেছি। আপনি শাহেদের নাম মনে রেখেছেন। অথচ সে আপনার ছাত্র না। আমি আপনার ডাইরেক্ট স্টুডেন্ট।
শাহেদ আছে কেমন?
ভালো আছে।
তাকে আনলে না কেন? তোমার এক আসা উচিত হয় নি। তাকে সঙ্গে করে আনা উচিত ছিল।
নাইমুল বলল, তাকে আনা উচিত ছিল কেন স্যার?
ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী তাঁর ছাত্রের দিকে তাকিয়ে বিব্ৰত ভঙ্গিতে হাসলেন। ছাত্ররা মাঝে-মাঝে তাকে খুবই বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে।
নাইমুল, চা খাবে?
খাব।
যাও, রান্নাঘরে চলে যাও। পানি গরমে দাও। চায়ের সঙ্গে আজ তোমাকে অসাধারণ একটা জিনিস খাওয়াব। তিলের নাড়ু। তুমি কতক্ষণ থাকবে এখানে?
ঘণ্টাখানিক। আমি সাতটার সময় চলে যাব।
ঠিক আছে। কোনো অসুবিধা নেই।
আমি আপনার কাছে বিশেষ একটা কাজে এসেছি স্যার।
কী কাজ?
আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি। আমার মুরুবি কেউ ঢাকায় নেই। আপনি আমার সঙ্গে গার্জিয়ান হিসেবে যাবেন।
ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী বললেন, অবশ্যই অবশ্যই।
অবশ্যই অবশ্যই বলা তার মুদ্রাদোষ। কোনো কথা না শুনেই তিনি বলেন অবশ্যই অবশ্যই। ইউনিভার্সিটিতে তার নাম ছিল অবশ্যই স্যার।
নাইমুল বলল, স্যার, আপনি কি আমার কথা মন দিয়ে শুনেছেন?
কোন কথার ব্যাপারে জানতে চাচ্ছ?
এই যে আমি বললাম, আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি, আপনি আমার গার্জিয়ান।
অবশ্যই মন দিয়ে শুনেছি। এবং তোমাকে একটা সত্যি কথা বলি–এখন তোমাকে আমি চিনেছি। তুমি যখন বললে নাম নাইমুল, তখনো চিনতে পারি নি। এখন তোমার কথা বলার ধরন থেকে চিনেছি। তুমি তো কমনওয়েলথ স্কলারশিপ পেয়েছ?
জি স্যার। এবারডিন ইউনিভার্সিটিতে আমার প্লেসমেন্ট হয়েছে শুধুমাত্র আপনার একটা চিঠির কারণে।
ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী বিস্মিত হয়ে বললেন, চিঠি কখন লিখলাম?
চা খেতে খেতে নাইমুল স্যারের সঙ্গে গল্প শুরু করল। গল্প করার সময় সাধারণত মুখোমুখি বসা হয়। ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরীর বিচিত্র স্বভাবের একটি হচ্ছে, তিনি তার ছাত্রদের সঙ্গে গল্প করার সময় তাদের নিজের বা পাশে বসান! এবং বেশিরভাগ সময় তাঁর বাঁ হাত ছাত্রের পিঠের উপর রাখেন। নাইমুলের ধারণা–স্যার মুখ দেখেন না বলেই ছাত্রদের কখনোই চিনতে পারেন না। তবে যে-কোনো ছাত্রের পিঠে হাত দিয়ে তিনি নাম বলতে পারবেন।
স্যার, আমি একটা বিশেষ দিনে বিয়ে করছি। সেটা কি বুঝতে পারছেন?
বিশেষ দিনটা কী?
আজ সাতই মার্চ।
সাতই মার্চ বিশেষ দিন কেন?
স্যার, আপনি নিজে একটু চিন্তা করে বলুন তো সাতই মার্চ কেন বিশেষ দিন।
ধীরেন্দ্রনাথ রায় ভুরু কুঁচকে সামান্য চিন্তার ভেতর দিয়ে গেলেন। নাইমুলের দিকে তাকিয়ে বললেন, সাত হলো একটা প্ৰাইম নাম্বার। মৌলিক সংখ্যা। মার্চ মানে তিন। তিন আরেকটা প্ৰাইম নাম্বার। এই জন্যেই দিনটা বিশেষ দিন। হয়েছে?
হয় নি স্যার। আজ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিবেন। হয়তো ইতিমধ্যে দিয়েও ফেলেছেন।
স্বাধীনতার ঘোষণা? বলো কী? ইন্টারেষ্টিং তো!
যদিও তিনি যথেষ্ট আগ্রহের সঙ্গে বললেন, ইন্টারেস্টিং তো, নাইমুল জানে তিনি মোটেই ইন্টারেস্ট পাচ্ছেন না। এই মানুষটার কাছে পদার্থবিদ্যার যেকোনো সমস্যা জাগতিক সমস্যার চেয়ে অনেক বেশি ইন্টারেটিং।
নাইমুল বলল, দেশ, রাজনীতি–এইসব নিয়ে আপনি কি কখনোই কিছু ভাবেন না?–
কে বলল ভাবি না? ভাবি তো। প্রায়ই ভাবি।
মোটেও ভাবেন না। আপনার সমস্ত ভুবন জুড়ে আছে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। আপনি এর বাইরে কোনো কিছু নিয়েই ভাবেন না।
সেটা কি দোষের?
জি স্যার দোষের। আপনি দেশ বা রাজনীতির বাইরের কেউ না। আপনি সিস্টেমের ভেতর আছেন।
ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী শান্ত গলায় বললেন, নাইমুল, তোমার কথার কাউন্টার লজিক কিন্তু আছে। সবার কাজ কিন্তু ভাগ করা। একদল মানুষ যুদ্ধ করবেন, তারা যোদ্ধা। একদল রাজনীতি করবেন। তারা সেটা বুঝেন। অর্থনীতিবিদেরা দেশের অর্থনীতি নিয়ে ভাববেন। আমি কোয়ান্টাম বলবিদ্যার লোক, আমি সেটা নিয়ে ভাববা। তুমি যে সিস্টেমের কথা বললে–এসো সেই সিস্টেম সম্পর্কে বলি। সিস্টেম কী? সিস্টেম হলো, Observable part of an experiment, একগ্লাস পানিতে আমি এক চামচ সোডিয়াম ক্লোরাইড দিয়ে দিলাম। এখন আমার সিস্টেম হলো, গ্লাসে রাখা লবণের দ্রবণ। তর্কের খাতিরে ধরে নেই এটা একটা closed System.
ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী প্রবল আগ্রহে বক্তৃতা করে যাচ্ছেন। তাঁর বক্তৃতার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, তিনি একগাদা ছাত্ৰ-ছাত্রীর সামনে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অতি জটিল কোনো বিষয় ব্যাখ্যা করছেন। নাইমুল এক ফাঁকে ঘড়ি দেখল। হাতে সময় আছে। স্যারকে মনের আনন্দে আরো কিছুক্ষণ কথা বলার সুযোগ দেয়া যেতে পারে। এই মানুষটার আত্মীয়স্বজন কেউ নেই। সবাই হয ইন্ডিয়া কিংবা আমেরিকায় চলে গেছে। এই মানুষটা, ওয়ারির তিন কামরার ছোট্ট বাড়ি কামড়ে পড়ে আছে। তাঁর একটাই কথা–নিজের বাড়ি-ঘর দেশ ছেড়ে আমি যাব কোথায়? আমি কেন ইন্ডিয়াতে যাব? আমার জন্ম হয়েছে এই দেশে। দেশ ছেড়ে চলে যাব? আমি কি দেশের এত বড় কুসন্তান?
ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী তাঁর বিখ্যাত ভোকসওয়াগন গাড়ি বের করলেন। নাইমুল বলল, রিকশায় করে গেলে কেমন হয় স্যার?
রিকশায় করে যাবে কেন? আজি তোমার বিয়ে।
আপনার সঙ্গে গাড়িতে করে যেতে ভয় লাগে স্যার। আপনি নিজের মনে গাড়ি চালান। রাস্তার দিকে তাকান না।
ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী বিস্মিত হয়ে বললেন, নাইমুল, আমার সম্পর্কে তোমাদের ভুল ধারণা আছে। আমি অত্যন্ত সাবধানী চালক। এখন পর্যন্ত আমি গাড়িতে কোনো একসিডেন্ট করি নি।
গাড়িতে একসিডেন্ট করেন নি, তার কারণ কিন্তু স্যার আপনার ড্রাইভিং না।
তাহলে কী?
আপনি গাড়ি নিয়ে কখনো বের হন না। ঘরেই থাকেন। আমি নিশ্চিত, আপনি গত তিন মাসে আজ প্ৰথম গাড়ি বের করেছেন।
ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী বিরক্ত গলায় বললেন, তুমি তর্ক-প্রিয় হয়ে যাচ্ছ। তর্ক ভালো জিনিস না।
গাড়িতে উঠেই তাঁর বিরক্তি অতি দ্রুত কেটে গেল। তিনি গভীর আগ্রহে Kaluza-klein theory সম্পর্কে বলতে লাগলেন। নাইমুল, মন দিয়ে শোন কী বলি–Kaluza তাঁর পেপার পাঠালেন আইনস্টাইনের কাছে। তারিখটা মনে রাখ–এপ্রিলের একুশ, সনটা খেয়াল করো-উনিশ শ উনিশ। Kaluza সেই পেপারে পাঁচটা ডাইমেনশনের কথা প্ৰথম বললেন। এর আগে আইনষ্টাইন চারটা ডাইমেনশনের কথা বলেছিলেন। Kaluza কী করলেন–ডাইমেনশন একটা বাড়ালেন। আইনস্টাইন বলেছিলেন–না, পেপার গ্রহণযোগ্য না।
নাইমুল বলল, স্যার, আপনি রাস্তার দিকে তাকিয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন না। আমার দিকে তাকিয়ে চালাচ্ছেন।
আমি ঠিকই গাড়ি চালাচ্ছি–তুমি মন দিয়ে শোন কী বলছি। অক্টোবরের ১৪ তারিখ উনিশ শ একুশ সনে ঠিক দুবছর পর আইনস্টাইন তার মত বদলালেন। তিনি Kaluza-র পেপার একসেপ্ট করলেন। অরিজিনাল সেই পেপার আমি জোগাড় করেছি। পেপারটা জার্মান ভাষায়। আমার এখন দরকার ভালো জার্মান জানা লোক। তোমার খোজে কি জার্মান জানা লোক আছে?
নাইমুলের মজা লাগছে। কী অদ্ভুত মানুষ! জগতের কোনো কিছুর সঙ্গেই এই মানুষটির যোগ নেই। রাস্তায় জনস্রোত। অদ্ভুত অদ্ভুত স্লোগান হচ্ছে
ইয়াহিয়া ভুট্টো দুই ভাই
এক দড়িতে ফাঁসি চাই।
ইয়াহিয়ার চামড়া
তুলে নিব আমরা।
বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো
ইয়াহিয়াকে খতম করো।
অথচ ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরীর দৃষ্টি একবারও সেদিকে যাচ্ছে না। তাঁর জগৎ Kaluza-র পঞ্চম ডাইমেনশনে আটকে গেছে।
নাইমুল!
জি স্যার।
তুমি সত্যি সত্যি একা বিয়ে করতে যাচ্ছ–এটা খুবই আশ্চর্যজনক ঘটনা।
একা তো যাচ্ছি না। আপনিও যাচ্ছেন। আমি আমার দুজন আত্মীয়কেও খবর দিয়েছি, তারাও চলে আসবেন। সরাসরি মেয়ের বাড়িতে চলে যাবেন।
তাহলে বরযাত্রীর মোট সংখ্যা দাঁড়াল চার। আরেকজন হলে ভালো হতো।
ভালো হতো কেন স্যার? Kaluza সাহেবের থিওরিতে পাঁচটা ডাইমেনশন, আমার বিয়েতেও বরযাত্রী পাঁচজন এই কারণে?
ঠিক ধরেছ। তোমার বুদ্ধি ভালো। আমি তোমার বুদ্ধি দেখে খুশি হয়েছি।
ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী ছাত্রের বুদ্ধিতে এতই খুশি হলেন যে গাড়ি নিয়ে রাস্তার পাশের নর্দমায় পড়ে গেলেন।
অনেক ঠেলা ঠেলি করেও গাড়ি সেখান থেকে উঠানো গেল না। তিনি হতাশ গলায় ছাত্রকে বললেন, তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। তুমি একটা রিকশা করে চলে যাও। আমাকে ঠিকানা দিয়ে যাও। আমি গাড়ি উঠানোর ব্যবস্থা করে চলে আসব।
নাইমুল বলল, আমি আপনাকে রেখে একা একা চলে যাব?
অবশ্যই যাবে। তুমি হচ্ছি। বর। সবাই তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে। তোমার দেরি হলে সবাই দুশ্চিন্তা করবে। বিশেষ করে মেয়েটি। তুমি যাও তো। এটা তোমার প্রতি আমার আদেশ। ঠিকানাটা বলো, আমি মুখস্থ করে রাখি।
নাইমুল চলে যাবার পরপরই লোজজন মিলে ঠেলে তাঁর গাড়ি তুলে দিল। ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী ছাত্রের দেয়া ঠিকানায় রওনা হলেন। তাকে নাইমুল বলেছে ১৮নং সোবহানব গ। কিন্তু তিনি চলে গেলেন চামেলীবাগে। অনেক রাত পর্যন্ত তিনি চামেলীবাগের আঠারো নম্বর দোতলা বাড়ি খুঁজতে লাগলেন। যে বাড়ির গেট হলুদ রঙের। বাড়ির সামনে দুটা কাঁঠাল গাছ আছে।
মরিয়ম কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না
মরিয়ম কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না–তার বিয়ে হয়ে গেছে। তার যেন কেমন লাগছে। গা হাত পা কাঁপছে। বুকে ধুকধুক শব্দ হচ্ছে। প্রচণ্ড পানির পিপাসা হচ্ছে কিন্তু এক চুমুক পানি খেলেই পিপাসা চলে যাচ্ছে। পানি খেতে আর ভালো লাগছে না। কিছুক্ষণ পর আবার পিপাসা হচ্ছে। সে নিজের কপালে হাত দিল। গায়ে কি জ্বর আছে? জ্বরের সময় এরকম উল্টাপাল্টা লাগে। না জ্বর তো নেই। কপাল ঠাণ্ডা।
কী আশ্চর্য! বসার ঘরে যে লম্বা রোগা ছেলেটি বসে আছে, সে তার স্বামী। যাকে সে আগে কোনোদিন দেখে নি, যার সঙ্গে কোনো কথা হয় নি। মাত্র পনেরো মিনিট আগে থেকে সে তার জীবনের সবচে ঘনিষ্ঠজন। বিয়ে নামক অদ্ভুত একটা ঘটনায় আজ রাত আটটা সাত মিনিট থেকে দুজন শুধু দুজনের।
মরিয়ম তার স্বামীকে এখনো ভালোমতো দেখে নি। দূর থেকে আবছাভাবে দেখেছে। তার খুবই ইচ্ছা করছে কাছ থেকে দেখতে। তার চোখ দুটা কেমন? বিড়াল-চোখা না তো? বিড়াল-চোখা মানুষের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলা যায় না। কথা বললে মনে হয় বিড়ালের সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে। এই বুঝি মানুষটা মিউ করে উঠবে। তার কি জোড়া ভুরু? জোড়া ভুরুর মানুষ মরিয়মের খুব অপছন্দ। যার যা অপছন্দ তাই সে পায়। দেখা যাবে নাইমুল নামের মানুষটার জোড়া ভুরু। আচ্ছা থাকুক জোড়া ভুরু। কপালে যা থাকে তাই তো হবে। বিয়ে হলো কপালের ব্যাপার।
একটু আগে তার সবচে ছোটবোন মাফরুহা এসে বলল, বুকু, তোমার বর খুব সুন্দর। মরিয়মের ইচ্ছে করছিল। জিজ্ঞেস করে–তোর দুলাভাইয়ের জোড়া ভুরু না-কি? চট করে দেখে আয় তো। লজ্জায় প্রশ্নটা সে করতে পারে নি।
মাফরুহা বলল, দুলাভাই কিন্তু রাতে থাকবে না। এখনই চলে যাবে।
মরিয়মের বুক ধক করে উঠল। সে এখনো দেখলই না, তার আগেই চলে যাবে? এমন ঘটনা কি এর আগে কখনো ঘটেছে–বর এসে বিয়ে করেই উধাও হয়ে গেছে? মরিয়মের মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে অবশ্যি অবহেলার ভঙ্গিতে বলল, চলে গেলে চলে যাবে। আমার কী? যাবে কখন?
দুলাভাইয়ের ছোট চাচা তো এক্ষুনি চলে যাবেন বলছেন। উনি নারায়ণগঞ্জ থাকেন। অনেক দূর যেতে হবে। তাঁর সঙ্গে দুলাভাইও চলে যাবেন কি-না বুঝতে পারছি না। দুলাভাই কিছু বলছেন না।
মরিয়ম বলল, দুলাভাই দুলাভাই করছিস কেন? শুনতে বিশ্ৰী লাগছে। চেনা নেই, জানা নেই একটা মানুষ।
কথাটা মরিয়মের মনের কথা না। ছোট বোনের মুখে দুলাভাই ডাকটা শুনতে তার খুবই ভালো লাগছে। কী সুন্দল টেনে টেনে বলছে— দু—লা ভাই।
মাফু, দেখ তো আমাকে কি বিয়ের শাড়িতে মানিয়েছে? (ছোট বোনকে মরিয়ম আদর করে মাফু ডাকে)
মাফরুহা বলল, তোমাকে খুবই সুন্দর লাগছে।
খোঁজ নিয়ে আয় তো ওরা সত্যি সত্যি চলে যাচ্ছে কি-না। ওরা চলে গেলে মা যে এত রান্নাবান্না করেছেন সেগুলি কে খাবে? মাসুমা সন্ধ্যা থেকে চুলার পাড়ে বসে আছে। তার কষ্ট হচ্ছে না?
মাফরুহ খোঁজ নিতে গেল। মরিয়াম দাড়ালো আয়নার সামনে। সে আগেও কয়েকবার দাঁড়িয়েছে। প্ৰতিবারই নিজেকে সুন্দর লেগেছে। এখন মনে হয়। একটু বেশি সুন্দর লাগছে। অথচ খুবই সাধারণ শাড়ি। ওরা নিয়ে এসেছে। সবুজ রঙের শাড়ি। ভাগ্যিস কাঢ়া সবুজ না। গ্রামের মেয়েরাই শুধু কটকট কড়া রঙের সবুজ শাড়ি পরে। শাড়ি যত সাধারণই হোক মরিয়ম ঠিক করে রেখেছে, এই শাড়ি সে খুব যত্ন করে রাখবে। প্রতি বছর ৭ মার্চ বিয়ের দিনে এই শাড়ি সে পরবে। তার মেয়েরা বড় হলে মায়ের বিয়ের শাড়ি দেখতে চাইবে। মেয়েদের কেউ একজন হয়তো বলবে, তোমার বিয়ের শাড়ি এত সস্তা কেন মা? এ তো সত্যি ক্ষেত শাড়ি। পরলে মনে হবে ধানক্ষেত।
তখন মরিয়ম বলবে, আমাদের খুব তাড়াহুড়াল বিয়ে হয়েছিল। দেশজুড়ে তখন অশান্তি। তোর বাবার হাতে বোনো টাকা-পয়সা নেই। সে তার দূরসম্পর্কের এক চাচা এবং এক ফুফাকে নিয়ে এসেছিল। সন্ধ্যাবেল বাসায় এসেছে, তখনো আমি জানি না যে আমার বিয়ে।
মা, তোমার বিয়েতে কোনো উৎসব হয় নি?
না।
গায়েহলুদ-টলুদ কিছুই হয় নি?
না, সে-রকম করে হয় নি। তবে শাড়ি পরার আগে গোসল করলাম, তখন তোর ছোট খালা আমার গালে এক গাদা হলুদ মেখে দিল। মসলা পেষার পাটায় হলুদ পেষা হয়েছিল। শুকনা মরিচের ঝাল চোখে লেগে গেল। কী জুলুনি! চোখ দিয়ে সমানে পানি পড়ছে, আর সবাই ভাবছে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে এই জন্যে কাদছি।
তোমার কান্না পাচ্ছিল না?
না।
বিয়ের দিন সবারই কান্না পায়। তোমার পাচ্ছিল না কেন মা?
জানি না। তখন সময়টা তো অন্যরকম ছিল। প্ৰতিদিন মিটিং মিছিল, পুলিশের গোলাগুলি, কাফু–এই জন্যেই বোধহয়।
বাবাকে প্রথম দেখে কি তোমার ভালো লেগেছিল মা?
না দেখেই ভালো লেগেছিল।
সেটা কেমন কথা! না দেখে ভালো লাগে কীভাবে?
তুই যা তো। তোকে এত কিছু ব্যাখ্যা করতে পারব না।
মরিয়মের ধারণা তার মেয়ে ধমক খেয়েও যেতে চাইবে না। সে চোখ বড় বড় করে তার বাবা-মার বিয়ের গল্প শুনতে চাইবে। সেটাই স্বাভাবিক। মেয়েরা মায়ের বিয়ের গল্প খুব আগ্রহ করে শোনে।
নাইমুলের সঙ্গে বরযাত্রী মাত্র দুজন। তার দূরসম্পর্কের চাচা হাফিজুদিন এবং তার ফুপা হামিদুল ইসলাম। এরা দুজনই থাকেন নারায়ণগঞ্জে। কাজি সাহেব বিয়ে পড়ানো শেষ করতেই দুজনই অতি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন চলে যাবার জন্যে। লক্ষণ খারাপ। শেখ সাহেবের ভাষণ রেডিওতে প্রচার করে নাই। ভাষণের বদলে অন্য কোনো অনুষ্ঠানও নাই। রেডিও নীরব। মিলিটারিরা হয়তো রেডিও স্টেশনের দখল নিয়ে নিয়েছে। এখন হয়তো রাস্তাঘাটের দখল নিবে। যত তাড়াতাড়ি বাড়িতে পৌছানো যায় ততই ভালো।
মুসলেম উদ্দিনও চলে যেতে চাচ্ছেন। ঝামেলার সম্ভাবনা যেহেতু আছে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়াই তো ভালো। তিনি যাবেন যাত্রাবাড়ি। নারায়ণগঞ্জ যাবার পথেই যাত্রাবাড়ি পড়বে। এক সঙ্গে চলে যাওয়া যায়। এখন সময় এমন যে চলে যাওয়াই ভালো। মুসলেম উদ্দিন বললেন, ঘণ্টাখানিক অপেক্ষা করলে খানা দিয়ে দেয়া যাবে। মরিয়মের মা একা মানুষ, সব সামাল দিতে পারছে না। আমি খবর নিয়েছি পোলাও চুলায় বসানো হয়েছে। (কথা সত্যি নয়। পোলাওএর চাল আনতে দোকানে লোক গেছে। আগে যে কালিজিরা চাল আনা হয়েছিল, সে চাল থেকে পচা গন্ধ বের হচ্ছে।)
হাফিজুদিন বললেন, সম্পর্ক যখন হয়েছে অনেক খাওয়া ইনশাল্লাহ হবে। আজ বিদায় দিয়ে দেন। মেয়ের বাবাকে ডাকেন, উনার কাছ থেকে বিদায় নিই।
মুসলেম উদ্দিন বললেন, আমার ভাগ্নে তো কিছুক্ষণ আগে চলে গেছে। অফিসের ডাক পড়েছে। বুঝেন না–ডাক পড়লে সঙ্গে সঙ্গে চলে যেতে হয়। বড়ই কঠিন চাকরি।
হামিদুল ইসলাম গম্ভীর গলায় বললেন, বেয়াই সাহেব তো আমাদের কাছ থেকে বিদায়ও নিলেন না। অবশ্য আমরা তুচ্ছ মানুষ। আমরা কোনো কঠিন চাকরি করি না। দুই পয়সার ব্যবসায়ী।
মুসলেম উদ্দিনকে অবস্থা সামলাবার জন্যে হড়বড় করে অনেক কথা বলতে হলো। তাতে তেমন লাভ হলো না। দুজনই এমন ভাব করতে থাকেন যেন তাদের বিরাট অপমান করা হয়েছে। অপমান যেহেতু করা হয়েছে সেহেতু না খেয়ে উঠে যাওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।
মোবারক হোসেন ঘরেই আছেন। তিনি কিছুক্ষণ আগে মুসলেম উদ্দিনকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলেছেন–বিয়ে তো হয়েছে, এখন আর ঘাটর ঘটর আমার ভালো লাগছে না। এদের বিদায় করেন। ছেলেকেও চলে যেতে বলেন। পরে একটা তারিখ করে তারা বউ উঠিয়ে নিবে।
মুসলেম উদ্দিন বললেন, না খাইয়ে তো বিদায় করতে পারি না।
খাওয়ান। আমাকে আর এর মধ্যে ডাকবেন না। আমি আর আসব না। আমার নিজের শরীর ভালো না। ইয়াহিয়ারও এসেছে জ্বর। অসুখ-বিসুখের মধ্যে বিয়ের যন্ত্রণা অসহ্য লাগছে।
বরযাত্রী দুজনই চলে গেছেন, মুসলেম উদ্দিনও তাদের সঙ্গে গেছেন। কাজি সাহেব আগেই গেছেন। তাঁর না-কি আজ আরেকটা বিয়ে পড়াতে হবে। নাইমুল বসার ঘরে একা বসে আছে। কিছুক্ষণ মাফরুহা ছিল। এখন সেও চলে গেছে। তার দায়িত্ব পড়েছে বাবার মাথার চুল টেনে দেবার। কাজটা সে করছে খুব ভয়ে ভয়ে। একটু জোরে টান লাগলে সে ধমক খাবে, আবার আস্তে টানলেও ধমক খাবে।
মেজ বোন মাসুমা রান্নাঘরে। আসকের রান্নাবান্না সে-ই করছে। সাফিয়া ইয়াহিয়াকে কোলে নিয়ে রান্নাঘরের বারান্দায় আছেন। মাঝে-মাঝে রান্নাঘরে ঢুকে মাসুমাকে কী করতে হবে তা বলে দিচ্ছেন। প্রবল জ্বর আসার কারণে ইয়াহিয়া খুবই কান্নাকাটি করছে; মার কোল থেকে একেবারেই নামতে চাচ্ছে না।
মাসুম বলল, মা, তোমার রান্নাঘরে আসার দরকার নাই। আমি পারব। তুমি বাবুর মাথায় পানি ঢালার ব্যবস্থা করো।
পানি ঢালব?
জ্বর এত বেশি, পানি ঢালবে না?
তোর বাবা যদি আবার রাগ করে! আরেকবার জ্বরের সময় পানি দিয়েছিলাম, তোর বাবা খুব রাগ করেছিল। এতে না-কি ঠাণ্ডা লেগে নিউমোনিয়া হয়।
বাবা যাতে জানতে না পারে। সেইভাবে পানি ঢাল।
তুই একটু সরে বোস না মা। কাপড়ে আগুন লেগে যাবে তো।
মাসুমা সরে বসল। তার হঠাৎ মনে হলো, তাদের এই সৎমা আসল মায়ের চেয়েও ভালো হয়েছেন। নিশ্চয়ই তারা তিনবোন খুব বড় ধরনের কোনো পুণ্য করেছে, যে কারণে আল্লাহ তাদের উপহার হিসেবে এমন একজন মা পাঠিয়ে দিয়েছেন।
না।
হুঁ।
দুলাভাই কি একা বসে আছেন?
হুঁ। এতক্ষণ মাফরুহা ছিল। এখন সে একা।
আহা বেচারা, বিয়ে করতে এসে কেউ এতক্ষণ একা একা বসে থাকে না। মা, এক কাজ করো, বুকুকে পাঠিয়ে দাও। বুৰু গল্প করুক।
তোর বাবা যদি রাগ করে?
বুবুর সঙ্গে বেচারার ভাব হবে না?
রান্না হোক, তখন খাবার দিয়ে মরিয়মকে পাঠাব। তাহলে তোর বাবা কিছু বলতে পারবে না।
দুলাভাই দেখতে রাজপুত্রের মতো, তাই না মা?
হুঁ। মরিয়মের খুব পছন্দ হবে।
বুবুর কথা বাদ দাও মা। রাস্তা থেকে কালু গুণ্ডাকে ধরে এনে যদি বুবুর বিয়ে দাও, বুবু তাকেও অন্তর দিয়ে ভালোবাসবে। মুগ্ধ গলায় বলবে, আমি সারা জীবন এরকম একজন গুণ্ডাই চেয়েছিলাম। ঠিক বলেছি না মা?
মনে হয় ঠিকই বলেছিস।
আমি কিন্তু বুবুর মতো না। আমার পছন্দ অনেক কঠিন।
একেক বোন একেক রকম হবি।–এটাই তো স্বাভাবিক।
আর এরকম আধাখেচড়া বিয়েও আমি করব না। আমার বেনারসি শাড়ি লাগবে। গা ভর্তি গয়না লাগবে। হুট হাটের বিয়ের মধ্যে আমি নাই।
চুলার আগুন কমিয়ে দে। আগুন বেশি।
মাসুমা চুলার আগুন কমাতে কমাতে বলল, আচ্ছা মা, বাবা আমাদের তিনবোনকে সহ্যই করতে পারে না। কেন বলে তো?
সহ্য করতে পারবে না কেন! তোদের জন্যে উনার খুব দরদ। মানুষটা অন্যরকম তো, প্ৰকাশ পায় না।
খুব দরদ থাকলে কি আর….
মাসুমা কথা শেষ করতে পারল না। বাবু আবারো হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদতে শুরু করেছে। সাফিয়া তাকে বাথরুমে নিয়ে গেলেন। চুপিচুপি তার মাথায় পানি ঢালবেন।
রাত দশটা বাজে।
নাইমুলকে খেতে দেয়া হয়েছে। খাবার নিয়ে ঢুকেছে। মরিয়ম। তার হাত কাঁপছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি হাত ফসকে কোরমার বাটিটা মেঝেতে পড়ে যাবে।
নাইমুল তার দিকে তাকিয়ে বলল, মরিয়ম, কেমন আছ?
মরিয়মের শরীরে ঝিম ধরে গেল। এত সুন্দর গলার স্বর! আর কী আদর করেই না মানুষটা জিজ্ঞেস করেছে–মরিয়ম কেমন আছ? মরিয়মের খুব ইচ্ছা! করছে বলে, আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছ? প্রথম থেকেই তুমি করে বলা। একবার আপনি শুরু করলে তুমিতে আসতে কষ্ট হয়। তার এক বান্ধবী, নাম জসি, বিয়ের পরে প্রথম প্রথম স্বামীকে আপনি বলতে শুরু করেছিল। এখন আর তুমি বলতে পারছে না। এই ভুল মরিয়ম করতে রাজি না। সে শুরু থেকেই তুমি বলবে।
কিন্তু কথা বলবে কী, মরিয়মের গলা দিয়ে কোনো শব্দই বের হচ্ছে না। গলার কাছে কী যেন দলা পাকিয়ে আছে। নাইমুল বলল, তোমার নামটা এমন যে ছোট করে ডাকব সে উপায় নেই। ছোট করে ডাকলে তোমাকে ডাকতে হয় মারি। সেটা নিশ্চয় তোমার ভালো লাগবে না।
মরিয়ম মনে মনে বলল, যা ইচ্ছা তুমি আমাকে ডাক। তুমি যাই ডাকবে আমার ভালো লাগবে।
নাইমুল বলল, খাবার তুলে দিতে হবে না। আমি নিয়ে নিচ্ছি। তুমি চুপ করে বসো। তোমাকে খুব জরুরি কিছু কথা বলা দরকার। মেঝের দিকে তাকিয়ে আছ কেন? আমার দিকে তাকিয়ে কথা শোনো। জরুরি কথা শুনতে হলে চোখের উপর চোখ রাখতে হয়।
মরিয়ম চোখের উপর চোখ কীভাবে রাখবো? তার কেমন জানি লাগছে। মানুষটার কোনো কথাই এখন তার কানে ঢুকছে না।
মরিয়ম শোনো, তুমি নিশ্চয়ই আমাকে একটা লোভী মানুষ ভাবছ। কারণ তোমার বাবার কাছ থেকে আমি এগারো হাজার টাকা নিয়েছি। আমার কিছু ঋণ আছে যে ঋণ শোধ না করলেই না। তিন হাজার টাকা ঋণ। আর বাকি টাকাটা আমি নিয়েছি আমেরিকার টিকিট কেনার জন্যে। আমি একটা টিচিং এসিস্ট্যান্টশিপ পেয়েছি। স্টেট ইউনিভার্সিটি অব মোরহেড। নর্থ ডেকোটা। ওরা আমাকে মাসে চারশ ডলার করে দেবে। তবে আমেরিকা যাবার টিকিটের টাকা দেবে না। টাকাটা এইভাবেই আমার জোগাড় করতে হয়েছে।
কবে যাবেন?
কথাটা বলেই মরিয়মের ইচ্ছা করল নিজের গালে সে একটা চড় মারে। সে তো জসির মতোই আপনি শুরু করেছে।
নাইমুল বলল, আমার স্টুডেন্ট ভিসা হয়ে গেছে। এখন আমি যে-কোনো দিন যেতে পারি। আমি ব্যাপারটা কাউকে বলি নি, কারণ আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে আমার ভালো লাগে না। মরিয়ম শোনো, আমি অবশ্যই আমেরিকায় পৌঁছেই তোমার বাবার টাকাটা ফেরত পাঠাব। তোমাকে কথাটা বললাম যাতে তোমার মন থেকে মুছে যায় যে আমি একটা খারাপ মানুষ।
মানুষটা কথা বলা বন্ধ করে এখন তার দিকে তাকিয়ে আছে। অন্য সময় যে-কোনো পুরুষমানুষ তার দিকে তাকালে গা ঘিনঘিন করত। এখন এত ভালো লাগছে! ইশ, তার গায়ের রঙটা যদি আরেকটু ফরসা হতো!
মরিয়ম!
জি।
রান্না খুব ভালো হয়েছে, আমি খুব আরাম করে খেয়েছি। কে রেঁধেছেন, তোমার মা?
জি।
আমি এখন চলে যাব। রাত অনেক হয়ে গেছে।
মরিয়ম নাইমুলকে চমকে দিয়ে হঠাৎ ঘর থেকে বের হয়ে গেল। যেন ভয়ঙ্কর জরুরি কোনো কাজ তাকে এই মুহুর্তেই করতে হবে।
সাফিয়া বারান্দায় বসে ছিলেন। বাবুকে মাসুমার কোলে দিয়ে এসেছেন। সারাদিনে খুব ধকল গেছে। তার নিজের শরীর এখন প্রায় নেতিয়ে পড়েছে। সাফিয়াকে চমকে দিয়ে মরিয়ম ঝড়ের মতো বারান্দায় এসে উপস্থিত হয়ে চাপা গলায় বলল, মা, আমি উনাকে এত রাতে এক ছেড়ে দেব না। কোনো মতেই r
মরিয়ম এসেছে যেমন ঝড়ের মতো কথাবার্তাও বলছে ঝড়ের মতো। সাফিয়া বুঝতেই পারছেন না প্ৰসঙ্গটা কী? মরিয়ম বলল, মা, বাবাকে বলে ব্যবস্থা করো যেন উনি এখানে থাকতে পারেন। আমি অবশ্যই উনাকে একা ছাড়ব না। উনি যদি চলে যান, আমিও উনার সঙ্গে যাব।
এতক্ষণে সাফিয়া বুঝলেন এবং হেসে ফেললেন।
মরিয়ম কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, তুমি হাসছ কেন মা? আমি হাসির কোনো কথা বলি নি। তুমি ব্যবস্থা করো। কীভাবে ব্যবস্থা করবে। আমি জানি না।
সাফিয়া কোনো ব্যবস্থা করতে পারলেন না। মোবারক হোসেন মেয়েজামাইকে বিদেয় দিয়ে বারান্দায় এসে দেখলেন, বড় মেযে ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। তিনি অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললেন, কী হয়েছে? কাদছিস কেন? জামাই পছন্দ হয় নাই? আমি যা পেরেছি। ব্যবস্থা করেছি। চোখ মুছ।
মরিয়ম চোখ মুছল। যা ঘুমাতে যা। খবরদার চোখে যেন আর পানি না দেখি।
মরিয়ম চোখ মুছে তার ঘরের দিকে রওনা হলো।
মোবারক হোসেন
মোবারক হোসেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। জোহর সাহেব এখানে কেন? শেখ সাহেবের বাড়িতে এই সকালে তিনি কেন? এখনো ভালোমতো সকাল হয়। নি। ঘড়িতে বাজছে ছটা পাঁচ। ফজরের নামাজ যারা পড়ে, তারা ছাড়া এত ভোরে কেউ উঠে না। না-কি তিনি ভুল দেখছেন? এই ব্যক্তি জোহর না। এ অন্য কেউ। চেহারায় মিল আছে। সমিল চেহারার মানুষ প্রায়ই পাওয়া যায়। মোবারক হোসেন যতবার জোহর সাহেবকে দেখেছেন ততবার তাঁর মুখে খোঁচাখোচা দাড়ি দেখেছেন। এই লোকের মুখ ক্লিন শেভড। তাছাড়া জোহর সাহেবের হাতে অবশ্যই জুলন্ত সিগারেট থাকত। এই লোকের হাতে সিগারেট নেই। পাতলা ঘিয়া রঙের চাদরে তার শরীর ঢাকা। তার দুটা হাতই চাদরের নিচে। উনি নিশ্চয়ই চাদরের নিচে সিগারেট ধরান নি। ঘটনা। কী? এই গরমে চাদর গায়ে উনি কেন এসেছেন?
এই ভোরবেলাতে শেখ সাহেবের বাড়িতে অনেক লোকজন। টঙ্গি থেকে শ্রমিকদের একটা দল এসেছে মাথায় লাল ফেট্টি বেঁধে। তারা ফজরের ওয়াক্তের আগে এসে জয় বাংলা জয় বাংলা বলে প্ৰচণ্ড স্লোগান শুরু করেছিল। মনে হয় তারা তাদের গলার সমস্ত জোর সঞ্চয় করে রেখেছে শেখ সাহেবের বাড়িতে একটা হুলুস্কুল করার জন্যে। স্লোগান শুনে ভয় পেয়ে কাকের দল উড়াউড়ি শুরু করল। মোবারক হোসেন তাদের দলপতির কাছে গিয়ে বললেন, শেখ সাহেব নামাজ পড়ছেন। এখন কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন।
দলপতি (তার অত্যন্ত বলশালী চেহারা। মুখভর্তি পান। গলায় সোনার চেইন) রাগী গলায় বললেন, আপনি কে?
মোবারক হোসেন বললেন, আমি কেউ না।
আমি কেউ না বলাতে একটা রহস্য আছে। বলার ভঙ্গি সামান্য পরিবর্তন করে আমি কেউ না বলেও বুঝিয়ে দেয়া যায়–আমি অনেক কিছু। মোবারক হোসেন সেটা বুঝিয়ে দিলেন।
দলপতি পানের পিক ফেলতে ফেলতে বললেন, আমি টঙ্গি শ্রমিক লীগের সভাপতি। আমার নাম ইসমাইল মিয়া। শেখ সাহেব আমারে চিনেন। আমার বাড়িতে একবার খানা খেয়েছেন।
মোবারক হোসেন বললেন, শুনে খুশি হলাম।
আছে? আমরা কেউ নাশতা করি নাই।
টিফিনের কোনো ব্যবস্থা নাই।
শেখ সাব নিচে নামবেন কখন?
সেটা তো ভাই উনি জানেন।
আপনি এখানকার কে? কোন দায়িত্বে আছেন?
আমি কোনো দায়িত্বে নাই। আমি তো আপনাকে আগেই বলেছি–আমি কেউ না।
জোহরকে দেখা যাচ্ছে এই দলটির আশেপাশে ঘুরঘুর করতে। সে দুবার তাকাল মোবারক হোসেনের দিকে। কিন্তু তাকে দেখে মনে হচ্ছে না। সে মোবারক হোসেনকে চিনতে পারছে। তাহলে এমন কি হতে পারে যে, এই লোক জোহর না? তার মতো চেহারার অন্য কেউ?
মোবারক হোসেন এগিয়ে গেলেন। যা সন্দেহ করা হয়েছিল। তাই। এই লোক জোহরা। মোবারক হোসেনকে দেখে হাসল। পরিচিতের হাসি এবং আনন্দের হাসি। যেন হঠাৎ দেখা হওয়ায় খুশি হয়েছে।
মোবারক হোসেন বললেন, কেমন আছেন?
জোহর বলল, ভালো।
এখানে কী জন্যে এসেছেন?
দেখতে আসছি। কোনো বিহারি শেখ সাহেবকে দেখতে আসতে পারবে না, এমন আইন কি শেখ সাহেব পাশ করেছেন?
এতক্ষণ হয়ে গেছে আপনাকে তো সিগারেট ধরাতে দেখলাম না।
শেখ সাহেবের বাড়িতে সিগারেট খাব! এত বড় বেয়াদবি তো করতে পারি না। আমি আর যাই হই বেয়াদব না।
গরমের সময় চাদর গায়ে দিয়ে এসেছেন কেন?
জোহর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, যখন বের হয়েছিলাম তখন ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব ছিল। তবে আপনি যা ভাবছেন তা-না। চাদরের নিচে কিছু নাই। চাদর খুলে দেখাতে হবে?
দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে! কেউ চোখ নামিয়ে নিচ্ছে না। মোবারক হোসেন বললেন, গরম বেশি, চাদর খুলে ফেললে ভালো হয়।
জোহরের ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ হাসির রেখা দেখা গেল। হাসি ফুটল না। তার আগেই নিভে গেল। তাকে দেখে মনে হলো, সে মোবারক হোসেনের কথায় খুব মজা পাচ্ছে।
যদি চাদর না খুলি তাহলে কি আমাকে চলে যেতে হবে?
জি।
তাহলে চলেই যাই। চা খেতে ইচ্ছা করছে। আশেপাশে চায়ের দোকান আছে?
আছে।
আমাকে নিয়ে চলেন, দুজনে মিলে চা খাই। কোনো নেশাই একা একা করা যায় না। চা তো একরকম নেশাই, তাই না?
চলেন যাই।
বত্ৰিশ নম্বর থেকে বের হয়ে দুজন মিরপুর রোড পার হলো। ওপাশেই একটা নাপিতের দোকান। দোকানটা সবার চোখে পড়ে, কারণ সেখানে মজার একটা সাইনবোর্ড ঝুলছে–
মুজিবের বাড়ি যেই পথে
আমার দোকান সেই পথে।
নাপিতের দোকানটা এখনো খোলে নি। তবে চায়ের দোকান খুলেছে। দশবারো বছরের একটা ছেলে পরোটা বেলছে। দুখু মিয়া টাইপ চেহারা। বড় বড় চোখ।
জোহর চায়ের দোকানে ঢুকেই গায়ের চাদর খুলে ফেলল, ভাজ করে কাধে রেখে মোবারক হোসেনের দিকে তাকিয়ে হাসল। শান্ত গলায় বলল, চাদরের নিচে যে কিছু নাই কথাটা কি বিশ্বাস হয়েছে?
মোবারক হোসেন হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন।
জোহর বলল, তার পরেও যদি বিশ্বাস না হয়। গায়ে হাত দিয়ে দেখতে °८।।
দেখতে হবে না।
আসুন চা নিয়ে রাস্তার পাশে বসে খাই। আপত্তি আছে?
না, আপত্তি নাই।
রাস্তার পাশে দুজন দাঁড়িয়ে আছে। জোহর সিগারেট ধরিয়েছে। সিগারেট ধরানোর কারণেই হয়তো তার চেহারায় উৎফুল্ল ভাব।
ইন্সপেক্টর সাহেব।
জি।
আপনাকে আগে একবার যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছিলাম যে, পূর্ব পাকিস্তান কখনো স্বাধীন হবে না। মনে আছে?
মনে আছে।
আমার যুক্তি কি আপনার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছিল?
জি, মনে হয়েছে।
এখন আমি বুঝতে পারছি আমার যুক্তি ঠিক না। শেখ মুজিব। যদি চান দেশ স্বাধীন হবে। কীভাবে বুঝলাম জানেন?
না,
আপনাকে দেখে বুঝলাম। কোনো বাঙালির পক্ষে শেখ মুজিবের কোনো অনিষ্ট করা সম্ভব না। অনিষ্ট অনেক দূরের ব্যাপার, তার কোনো ক্ষতির চিন্তা করার ক্ষমতাও বাঙালির নেই। এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে স্বাধীনতা ছাড়া উপায় কী? একজন মানুষ কত দ্রুত এই অবস্থায় চলে গেছেন ভাবতেই বিস্মিত হতে হয়।
মোবারক হোসেন কিছু বললেন না। তার চায়ের নেশা নেই, কিন্তু সকালের এই চা-টা তার খেতে ভালো লাগছে।
ইন্সপেক্টর সাহেব!
জি।
আমি এখনো পাকিস্তানি শাসকদের চিন্তিত হবার মতো কিছু ঘটেছে বলে। মনে করি না। শেখ মুজিব মধ্যবিত্তের নেতা, বুর্জেীয়া নেতা। এ ধরনের নেতারা সরাসরি যুদ্ধের কথা ভাবেন না। এরা ঝামেলামুক্ত সমাধান চান। যেমন ধরেন ভারতের জওহরলাল নেহরু কিংবা মহাত্মা গান্ধী। এরা দেশ স্বাধীন করেছেন জেল খেটে। অসহযোগ আন্দোলন করে। কারণ এই দুজনও বুর্জেীয়া নেতা! সরাসরি যুদ্ধ এরা সমর্থন করেন নি। আপনাদের শেখ মুজিবও করবেন না। বুঝতে পারছেন কী বলছি?
বোঝার চেষ্টা করছি। আমার বুদ্ধি কম। সহজে কিছু বুঝি না।
আমার ধারণা আপনাদের শেখ মুজিবের মাথায়ও গান্ধী-টাইপ চিন্তা-ভাবনা আছে। অসহযোগ আন্দোলন করে জেল টেল খেটে দেশ স্বাধীন করে ফেলা। পুরোপুরি স্বাধীন করা যদি সম্ভব নাও হয়, তাতেও আপাতত চলবে। কনফেডারেশন, ইউনাইটেড স্টেটস। পাকিস্তানের যে এই অবস্থা হবে, সেটা কিন্তু তখনকার নেতারা ঠিকই বুঝেছিলেন। মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ তো দুই পাকিস্তান হচ্ছে জেনে বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন–পোকায় কাটা পাকিস্তান দিয়ে আমি কী করব?
মোবারক হোসেন বললেন, মানুষ তো বদলায়।
জোহর সঙ্গে সঙ্গে বললেন, অবশ্যই বদলায়। পরিস্থিতি মানুষকে বদলায়। ভয়াবহ ডাকাত হয়ে যায় নিজাম আউলিয়া। বিরাট সাধু সন্ত হয়ে যায় ভয়াবহ খুনি। সমস্যাটা এইখানেই। আপনার চা খাওয়া দেখে মনে হয়েছে আপনি খুবই আরাম করে চা খেয়েছেন। আরেক কাপ খাবেন?
জি খাব ।
বক্তৃতা শুনতে যাবেন না?
কী বক্তৃতা?
পল্টনে আজ মাওলানা ভাসানীর বক্তৃতা আছে। আমার ধারণা এটা হবে
খুবই গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা। শোনা দরকার।
মোবারক হোসেন বললেন, আমি বক্তৃতা শুনি না। বক্তৃতা শুনতে ভালো লাগে না। তাছাড়া আমার ডিউটি শেখ সাহেবের বাড়িতে। ডিউটির জায়গা ছেড়ে যেতে পারব না।
জোহর দ্বিতীয় সিগারেট ফেলে দিয়ে তৃতীয়টি ধরাতে ধরাতে বলল, আপনি আসলে কার ডিউটি করছেন বলুন তো?
মোবারক হোসেন জবাব দিতে পারলেন না।
জোহর হালকা গলায় বলল, আপনি এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারবেন না। কারণ জবাব আপনার নিজেরই জানা নেই। আমার জানা আছে। পুরো বাঙালি জাতি এখন একজনের ডিউটি করছে। সেই একজনের নাম শেখ মুজিব। আমি বিহারি না হয়ে বাঙালি হলে বিষয়টা এনজয় করতাম।
মোবারক হোসেন বত্ৰিশ নম্বর বাড়ির গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। আজ এই বাড়িতে অন্যদিনের চেয়েও অনেক ভিড়। লোক আসছেই। বাড়ির সামনের রাস্তােটা যেন নদী হয়ে গেছে। নদীতে মানুষের স্রোত। নদীতে যেমন ঢেউ উঠে এখানেও উঠছে। কখনো মানুষ বাড়ছে কখনো কমছে। মোবারক হোসেনের মানুষের এই প্রবল বেগবান স্রোত দেখতে ভালো লাগছে। হঠাৎ তাঁর মনে হলো তার তিন মেয়েকে নিয়ে এলে ভালো হতো। এরা হয়তোবা মজা পেত। এরা কখনো ঘর থেকে বের হয় না। এ ধরনের দৃশ্য কখনো দেখে না। এত কাছে বাড়ি। একবার নিয়ে এলে হয়।
এই তুই কী করছিস? আছিস কেমন?
মোবারক হোসেন চমকে উঠলেন। শেখ মুজিব দল বল নিয়ে বের হচ্ছেন।
মোবারক হোসেনকে দেখে থমকে দাঁড়ালেন। তাঁর মুখ হাসি হাসি।
স্যার, ভালো আছি।
তোর মেয়ে তিনটা ভালো আছে? কী যেন তাদের নাম–মরিয়ম, মাসুমা, মাফরুহা? নাম ঠিক হয়েছে?
জি স্যার, ঠিক হয়েছে।
আজ মাওলানা ভাসানী পল্টনে বক্তৃতা করবেন। শুনতে যাবি না? শুধু আমার কথা শুনলে হবে? অন্যদের কথাও শুনতে হবে।
শেখ মুজিব এগিয়ে গেলেন। মোবারক হোসেন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তাঁর তিন মেয়ের নাম এই মানুষটা একবার মাত্র শুনেছেন। এখনো নাম মনে আছে। এই ক্ষমতাকে শুধু বিস্ময়কর বললেও কম বলা হয়।
মাওলানা ভাসানীর বক্তৃতা শোনার কোনো আগ্রহ মোবারক হোসেন বােধ করছেন না। তারপরেও তিনি বক্তৃতা শুনতে গেলেন। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, তিনি তাঁর দুই মেয়েকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন। তিনজনকেই নেবার শখ ছিল। বড়টিকে বাড়িতে পাওয়া গেল, না; সে কাউকে কিছু না বলে কোথায় না-কি গেছে। মোবারক হোসেন ঠিক করে রেখেছেন, এ ধরনের কর্মকাণ্ডের উচিত শাস্তি সে পাবে। যথাসময়ে পাবে। বড় ময়ের বিয়ে হয়ে গেছে, তাতে কী? মেয়ে তো এখনো তার সঙ্গে থাকে। যতদিন মেয়ে তার বাড়িতে থাকবে, ততদিন তাকে বাড়ির নিয়মকানুন মানতে হবে।
মাসুমা এবং মাফরুহা দুজনেই ভয়ে অস্থির। বাবার সঙ্গে বেড়াতে যাওয়ায় কোনো আনন্দ নেই। আমরা কোথাও যাব না বলাও সম্ভব না। দুজনেই খুব মন খারাপ করে বাড়ি থেকে বের হলো। তারা খানিকটা ভয়ও পাচ্ছে। বাবা বলেন নি তাদের কোথায় নেয়া হচ্ছে। বাবাকে জিজ্ঞেস করে জানবে সেই সাহসও তাদের নেই।
মোবারক হোসেন রিকশা নিলেন। ছোট মেয়েটিকে বসালেন নিজের কোলে। মাফরুহাকে দেখে মনে হচ্ছে সে লজ্জায় মরে যাচ্ছে। কেন্দেই ফেলত, অনেক কষ্টে সে চোখের জল আটকে রাখছে।
মোবারক হোসেন বললেন, হাতে এখনো সময় আছে, তোরা আইসক্রিম খাবি?
দুজনই চাপা গলায় বলল, না।
খাবি না কেন? আয় আইসক্রিম কিনে দেই।
মোবারক হোসেন বেবি আইসক্রিমের দোকানে গিয়ে দুমেয়েকে আইসক্রিম কিনে দিলেন। দুজনই খুবই আগ্রহের সঙ্গে আইসক্রিম খাচ্ছে। দেখতে ভালো লাগছে। মোবারক হোসেন সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, শেখ সাহেব তোদের তিন বোনেরই নাম জানেন। আজকেও তোদের কথা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন। তোরা কেমন আছিস জানতে চাইলেন।
মাসুম ভয়ে ভয়ে বলল, আমাদেরকে উনি কীভাবে চেনেন?
মোবারক হোসেন বললেন, সে বিরাট ইতিহাস। জানার দরকার নাই। তাড়াতাড়ি আইসক্রিম শেষ কর। বক্তৃতা শুরু হয়ে গেছে।
মাসুমা অবাক হয়ে বলল, কিসের বক্তৃতা?
মোবারক হোসেন জবাব দিলেন না। মেয়েদের সঙ্গে এত কথা বলতে তার ভালো লাগে না।
পল্টনের মাঠের জনসমুদ্রে মাওলানা বললেন–
তের বছর আগে কাগমারী সম্মেলনে আমি আসসালামু আলাইকুম বলেছিলাম। মরহুম শহীদ সোহরাওয়ার্দী তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি হয়েও সেদিন আমার কথা অনুধাবন করতে পারেন নাই। কারণ আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে দুই অংশ যদি একত্রে থাকে তাহলে কালব্যাধি যক্ষ্মার জীবাণু যেমন দেহের হৃৎপিণ্ডের দুই অংশকে নিঃশেষ করে দেয়, তেমনি পাকিস্তানের দুই অংশই বিনষ্ট হবে। তাই বলছিলাম যে তোমরা তোমাদের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করো এবং আমরা আমাদের জন্য শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করি। লাকুম দীনুকুম ওয়ালিয়া দীন। শেখ মুজিবর রহমান আজ ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছে। আমি সাত কোটি বাঙালিকে আজ মোবারকবাদ জানাই এ জন্যে যে তারা এই বৃদ্ধের তের বছর আগের কথা এতদিন পর অনুধাবন করতে পেরেছে।
মাওলানা ভাসানী যখন বক্তৃতা দিচ্ছেন তখন মরিয়ম পুরনো ঢাকায়। সে আগামসি লেনের একটা ঠিকানা খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিছুতেই পাচ্ছে না। ভয়ে সে অস্থির। একা একা এর আগে সে কখনো কোথাও যায় নি। অচেনা একটা জায়গায় ঠিকানা খুঁজে বেড়ানোর তো প্রশ্নই আসে না। সে খুঁজছে নাইমুলের বাসা। বিয়ের পর এই যে সে চলে গেল আর তার কোনো খোঁজ নেই। বাসার মানুষগুলিও যেন কেমন! তারাও তো খোঁজখবর করবে। এখন সময় ভালো না, চারদিকে আন্দোলন হচ্ছে। তার কিছু হয়েছে কি-না কে জানে।
মরিয়ম ঠিক করে রেখেছে, আজ সে মানুষটাকে সাথে করে নিয়ে যাবে। বাসার মানুষজন যার যা ইচ্ছা বলুক কিছুই যায় আসে না। বাবা যদি পিস্তল বের করে তাকে গুলি করে দেন তাহলে দেবেন, কিন্তু মানুষটাকে সে এখানে ফেলে রেখে যাবে না!
বেচারা একা একা থাকে। হোটেলে খায়। কেন সে হোটেলে খাবে? দিনের পর দিন হোটেলের খাবার খেলে কি শরীর ঠিক থাকবে? শরীর যদি খারাপ হয় তাহলে তো মরিয়মকেই সেটা দেখতে হবে। আর কে দেখবো?
সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে গুণ্ডাটাইপ একটা গোফওয়ালা ছেলে সঙ্গে এসে বাসা দেখিয়ে দিল।। ঢাকাইয়া ভাষায় বলল, নাইমুল ছাব এই চিপায় থাকে। ডাক দেন–আওয়াজ দিব।
মরিয়ম নিশ্চিত যে সে একটা ফাঁদে পড়েছে। এরকম একটা জঘন্য। জায়গায় নাইমুল থাকতেই পারে না। এই গুণ্ডাটা ভুলিয়ে ভালিয়ে এখানে নিয়ে এসেছে। এক্ষুনি সে ধাক্কা। ময়ে মরিয়মকে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দেবে। মরিয়ম কাপতে কাপতে দরজার কড়া নাড়ল। তার এক চোখ গুণ্ডাটার দিকে। গুণ্ডাটা চলে যায় নি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
দুবার কড়া নাড়তেই ভেতর থেকে নাইমুলের গভীর গলা শোনা গেলমরিয়াম চলে এসো, দরজা খোলা।
শুধু কড়া নাড়ার শব্দ শুনে একটা লোক কী করে বুঝল কে এসেছে–এই রহস্য মরিয়ম কখনো ভেদ করতে পারে নি। নাইমুল কখনো বলে নি।
চায়ের কাপ নামিয়ে
চায়ের কাপ নামিয়ে রাখতে রাখতে আসমানী হাসিমুখে বলল, এই শোনো, তোমাকে একটু দোকানে যেতে হবে।
আসমানী তার স্বভাবমতো ভোরবেলা গোসল করেছে। ধোয়া একটা শাড়ি পরেছে। কপালে টিপা। খুব সম্ভব চোখে হালকা করে কাজলও দিয়েছে। সুন্দর লাগছে তাকে। আসমানী বলল, এই, কথা বলছি না কেন?
শাহেদ ভুরু কুঁচকে চায়ের কাপে চুমুক দিল। তার সামনে দুটা পত্রিকা–দৈনিক পাকিস্তান, ইত্তেফাক। দৈনিক পাকিস্তানের ভাজ এখনো খোলা হয় নি। পত্রিকার পাতায় পাতায় আগুনগরম সব খবর। এখন স্ত্রীর কথা শোনা তেমন জরুরি না। দোকানে যাওয়াটাও জরুরি না। কাগজ পড়া শেষ হোক, তারপর দেখা যাবে।
আসমানী শাহেদের পাশে বসতে বসতে বলল, চট করে চা-টা খেয়ে নাও। আসমানীকে আজ অন্য দিনের চেয়ে অনেক বেশি হাসিখুশি লাগছে। তার কারণ স্পষ্ট নয়।
শাহেদ চায়ের কাপে চুমুক দিল। মিষ্টি কম হয়েছে। আরেকটু চিনি দাওএই কথাটা বলতেও আলসেমি লাগছে। মনে হচ্ছে চিনির কথাটা বললেও সময় নষ্ট হবে। দৈনিক পাকিস্তান-এর প্রথম পাতায় সুন্দর একটা ছবি ছাপা হয়েছে। কালো পতাকা উড়িয়ে শেখ মুজিবুর রহমান যাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট ভবনে, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক। বৈঠকে কী হলো না হলো পত্রিকায় নিশ্চয়ই তার বিস্তারিত বিবরণ আছে।
তুমি এখন পত্রিকায় হাত দিও না। পড়তে শুরু করলে তুমি এক ঘণ্টার আগে উঠবে না। চা-টা শেষ করে তোমাকে একটু দোকানে যেতে হবে। শেখ মুজিব এবং ইয়াহিয়ার বৈঠকের চেয়েও এটা অনেক বেশি জরুরি।
তাই না-কি?
হ্যাঁ তাই। শেখ মুজিব ভাববেন তাঁর দেশ নিয়ে, আমি ভাবব আমার সংসারের তেল-চিনি নিয়ে।
দেশটা তোমার না?
আমার কাছে আগে আমার সংসার। তারপর দেশ।
কঠিন কিছু কথা শাহেদের মুখে এসে গিয়েছিল। সে নিজেকে সামলালো। সকালবেলাটা তিক্ততার জন্যে ভালো না। সে পত্রিকায় মন দিল।
আসমানী হাত বাড়িয়ে পত্রিকা দুটা নিয়ে নিল। শাহেদের মাথায় চট করে রক্ত উঠে গেল। সে নিজেকে সামলে সিগারেট ধরাল। এখন সে একটা ঝগড়া শুরু করতে চায় না। ঝগড়া করার সময় অনেক পাওয়া যাবে। আপাতত যা করতে হবে তা হচ্ছে, কায়দা করে পত্রিকা দুটা নিয়ে নিতে হবে। এমনভাবে নিতে হবে যেন আসমানী টের না পায়। এই মুহুর্তে পত্রিকা পড়ার প্রতিই তার আগ্রহটিা অনেক বেশি। স্ত্রীরা স্বামীর যে-কোনো বিষয়ের প্রতি অতিরিক্ত আগ্রহকেই সন্দেহের চোখে দেখে।
আসমানী শাহেদের পিঠে হাত রেখে বলল, দোকানে যাওয়া ছাড়াও তোমাকে কাঁচাবাজারেও যেতে হবে, ঘরে কোনো বাজার নেই। চাল-ডাল সব কিনতে হবে। সবাই খাবার কিনে ঘরে জমা করে রাখছে। শুধু আমাদের ঘরে কিছু নেই।
শাহেদ অনগ্রহের মতো ভঙ্গি করে বলল, দেখি কাগজটা?
আসমানী বলল, এখন কাগজ পাবে না। দোকানো যাবে, কাঁচাবাজারে যাবে; তারপর কাগজ। কাগজ পালিয়ে যাচ্ছে না।
শাহেদ রাগ চাপতে চাপতে বলল, দোকান এবং কাঁচাবাজারও পালিয়ে যাচ্ছে না।
আসমানী বলল, আচ্ছা, তোমার প্রতি সামান্য দয়া করলাম। কাঁচাবাজারে পরে যাবে। দোকান থেকে ঘুরে আসো। রুনির জন্য দুনম্বরি খাতা কিনতে হবে। সে ছবি আঁকবে, তারপর নাশতা খাবে। নাশতা না খেয়ে বসে আছে। তোমার মেয়ে যে কী পরিমাণ মেজাজি হয়েছে! আমার ধারণা, সে মেজাজ পেয়েছে তোমার কাছ থেকে। যা বলবে তাই করবে। তোমার চা খাওয়া শেষ হয়েছে না? এখন ওঠে। মেয়ে ঘুম থেকে উঠেছে সাতটার সময়, এখন বাজছে দশটা । কিছু মুখে দেয় নি।
শাহেদ বামেলা করল না। উঠে দাঁড়াল, শার্ট গায়ে দিল। আসমানী বলল, তোমাকে কাগজ পড়তে না দেওয়ার জন্য আমার নিজেরই খারাপ লাগছে, তবে দোকান থেকে ফিরেই দেখবে গরম চা এবং চায়ের কাপের পাশে ভাজ করা পত্রিকা। ভালো কথা, খাতা যে আনবে খাতার কভারে হাতির ছবি থাকতে হবে। হাতির ছবি ছাড়া খাতা আনলে চলবে না। তোমার মেয়ে কী চিজ হয়েছে, তুমি তো জানো না। হাতির ছবির কথা মনে থাকে যেন।
মনে থাকবে।
মুখটা এমন প্যাচার মুখের মতো করে রেখেছ কেন? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, তুমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া। পাকিস্তানের সমস্যায় হতাশ, বিরক্ত ও ক্লান্ত। আমি লক্ষ করেছি। ভোরবেলাতেই তোমার মেজাজ থাকে বেশি খারাপ। ইয়াহিয়া সাহেব! হিজ এক্সিলেন্সি! আজ কি অফিসে যাবে?
नों! ভালো হয়েছে। আজ তাহলে তুমি রুনির মাথা কমিয়ে দেবে। ছোটবেলায় কয়েকবার মাথা না কামালে চুল ঘন হয় না। একটা রেজার ব্লেড এনো তো। এক বোতল ডেটল। মাথা কেটে গেলে দিতে হবে।
আর কী কী লাগবে একসঙ্গে বলো। আর কিছু লাগবে না। দোকানে ভালোবাসা কিনতে পেলে তোমাকে সের খানেক ভালোবাসা কিনতে বলতাম। ইদানীং তোমার মধ্যে এই জিনিসের সাংঘাতিক অভাব দেখছি। ভালো কথা, চা পাতা নেই, চা পাতা আনতে হবে। প্লাস চিনি। এই দুটা যদি না আন তাহলে চা পাতা এবং চিনি ছাড়া চা খেতে হবে।
কিছু বাকি পড়ল কি-না। আবার মনে করে দেখ। তাতের মাকুর মতো আমি দোকান-বাসা, দোকান-বাসা করতে পারব না।
আর কিছু লাগবে না। ভালো কথা, তুমি যখন খুব রেগে যাও তখন তোমার চেহারা কিন্তু খানিকটা ইয়াহিয়া খানের মতো হয়ে যায়। ঠাট্টা করছি না। অনেষ্ট। যে জায়গায় তোমরা গোফ রাখি, তোমার সেই জায়গাটা ইয়াহিয়া খানের মতোই বড়। আচ্ছা গোফ রাখার জায়গাটার নাম যেন কী?
জানি না।
কী আশ্চৰ্য, যেখানে তোমরা এত কায়দা করে গোফ রাখা তার নামও জানো না।
শাহেদ বিরক্ত গলায় বলল, অকারণে এত কথা বলছি কেন? তুমি তো মাথা ধরিয়ে দিচ্ছি।
খাতা, চা, চিনি, রেজার ব্লেড নিয়ে শাহেদ মিনিট দশেকের মধ্যে ফিরে এলো। আসমানী বলল, তোমাকে না বললাম হাতির ছবি মার্কা খাতা কিনতে। এই খাতা দেখেই তো তোমার মেয়ে কাঁদতে শুরু করবে।
হাতিমার্কা খাতা ছিল না।
থাকবে না কেন? ছিল তো বটেই। তুমি বলতে ভুলে গেছ। যা দিয়েছে তাই নিয়ে চলে এসেছি। প্লিজ, খাতাটা বদলে আন।
শাহেদ সার্ট খুলতে খুলতে বলল, বদলাতে পারব না। যা এনেছি তাই তোমার মেয়েকে দাও। আদর দিয়ে দিয়ে তুমি মেয়েটাকে নষ্ট করছ। জগতের নিয়ম হচ্ছে, কোনো জিনিস চাইলেই পাওয়া যায় না। অথচ তোমার মেয়ের ধারণা হয়েছে, যা চাওয়া যায়। তাই পাওয়া যায়। হাতি মার্কা খাতা চেয়েছে, হাতি মার্কা খাতা দিতে হবে। বাঘ মার্কা চাইলে বাঘ মার্কা। এসব কী?
তুমি এমন চোখ বড় বড় করে আমার সঙ্গে কথা বলছি কেন?
জন্ম থেকেই আমার চোখ বড়। এই জন্য চোখ বড় বড় করে কথা বলছি। তুমিই বা সরু চোখে তাকিয়ে আছ কেন? সরু চোখে তাকিয়ে থাকার মতো অপরাধ কি করেছি?
মেয়ে যখন কেঁদে বাসা মাথায় তুলবে, তখন কী করবে?
ওকে বুঝিয়ে বলো! বুঝিয়ে বললেই কেঁদে বাড়ি মাথায় তুলবে না। শিশুরা লজিক বুঝতে পারে। সমস্যা বড়দের নিয়ে। বড়রা লজিক বুঝতে চায় না।
তাহলে দয়া করে তোমার বিখ্যাত লজিক দিয়ে ওকে বোঝাও।
শাহেদ খবরের কাগজ নিয়ে বসল। আসমানী কিছুক্ষণ স্বামীর দিকে তাকিয়ে রুনির কাছে গেল। এবং তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে রুনীর আকাশ ফাটানো চিৎকার শোনা যেতে লাগল। ভয়াবহ চিৎকার। মনে হচ্ছে বাড়িঘর ভেঙে পড়বে। চিৎকার অগ্রাহ্য করে কাগজে মন দেয়া যাচ্ছে না। শাহেদের মেজাজ দ্রুত খারাপ হচ্ছে। ইচ্ছা করছে উঠে গিয়ে মেয়েটার গালে একটা চড় বসিয়ে দেয়। এটাও করা যাবে না। তাহলে সারাদিন আসমানী মুখ ভোতা করে রাখবে। সন্ধাবেলা দেখা যাবে মেয়েকে নিয়ে মার বাড়ির দিকে রওনা হয়েছে। শাহেদ ডাকল, রুনি মা, শুনে যাও তো। রুনি সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঢুকল।
কেন কাঁদছ গো মা?
বাবা, ছবি আঁকব।
ছবি আঁকবে সেটা তো খুবই ভালো কথা। আঁকো। তোমার জন্য তো খাতা কিনে এনেছি। একটা কেনার কথা ছিল, দুটা কিনেছি।
হাতির ছবির খাতা লাগবে। এই খাতায় আঁকিব না। এই খাতা পচা।
হাতির ছবির খাতা দোকানে ছিল না, তাই আনা হয় নি। আমি আবার যখন বের হবো। তখন নিয়ে আসব।
না, আমার এখনি লাগবে।
চাইলেই সব কিছু পাওয়া যায় না মা।
পাওয়া যায়।
না, পাওয়া যায় না।
পাওয়া যায়।
এরকম করে কথা বলবে না। রুনি। এরকম করে কথা বললে আমার মেজাজ খুব খারাপ হবে। হঠাৎ দেখা যাবে তোমার গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিয়েছি।
না তুমি চড় বসাবে না।
তুমি কিন্তু আমার মেজাজ খুব খারাপ করছ রুনি। এখন লক্ষ্মী মেয়ের মতো যাও, ছবি আঁকো, আমি কাগজ পড়ি।
না, তুমি কাগজ পড়বে না।
রুনি হাত বাড়িয়ে খবরের কাগজ টেনে নিল এবং শাহেদের কিছু বলার আগেই ছিঁড়তে শুরু করল। রুনির মুখ গম্ভীর। তাকে দেখে মনে হচ্ছে কাগজ ছেড়ার এই কাজটি সে অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে করছে। শাহেদের অধিক শোকে পাথর হওয়ার মতো ব্যাপার হলো। সে মেয়ের কাগজ ছেড়া দেখল। শোকের প্ৰবল ধাক্কাটা কমে যাওয়ার পরপরই মেয়ের গালে চড় বসিয়ে দিল, রুনি সারা বাড়ি কাঁপিয়ে চিৎকার করতে লাগল। আসমানী ছুটে এসে মেয়েকে তুলে নিয়ে গেল। শাহেদের মনটা হলো খারাপ। ইচ্ছে করলে ছেড়া কাগজগুলো হাতে নিয়ে পড়া যায়। ইচ্ছা করছে না। মেয়েটার গালে আরেকটা চড় দিতে ইচ্ছা করছে। মনে হচ্ছে আগেরবারেরটা তেমন জোরালো হয় নি।
রুনির কান্না থেমে গেছে। জোরালো চড় হলে এত সহজে কান্না থামত না। বাসা থেকে কিছুক্ষণের জন্য দূরে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছে করছে। কাঁচাবাজারে যাওয়া যেতে পারে। চাল-ডাল-তেল-নুন আসলেই কিনে রাখা দরকার। সবাই কিনেছে। সে কেন। কিনবে না? কয়েক কাৰ্টন সিগারেট। যুদ্ধের সময় সবচে দুষ্প্রাপ্য হয় সিগারেট।
আসমানী রুনিকে কোলে নিয়ে ঘরে ঢুকল। ভীত গলায় বলল, দেখ তো দেখ তো ওর মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে। রুনি, হা করো তো মা। হা করো।
রুনি হা করল। আসলেই মুখভর্তি রক্ত। আসমানী হতভম্ব গলায় বলল, কী করেছ তুমি মেয়ের?
শাহেদ অপ্ৰস্তুত গলায় বলল, গালটাল কোথায়ও কেটে গেছে। এত অস্থির হওয়ার মতো কিছু হয় নি। দেখি, ওকে আমার কোলে দাও।
না, আমি আমার মেয়েকে তোমার কোলে দেব না। তুমি কোন সাহসে আমার মেয়েকে কোলে নিতে চাও?
আসমানী ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। রুনি হাত বাড়িয়ে দিয়েছে বাবার কোলে যাবার জন্য। শিশুরা অতি সহজে অন্যের অপরাধ ক্ষমা করতে পারে।
শাহেদ বলল, কোথায় কেটেছে একটু দেখি। দরকার হলে একজন ডাক্তার দেখিয়ে আনি।
তোমাকে কিছুই করতে হবে না। খবরদার, তুমি আমার মেয়েকে কোলে নেবে না। খবরদার তুমি আমার মেয়েকে ছোবে না।
তুমি এমন ভেউ ভেউ করে কাদছ কেন? তোমার মেয়ে তো কাঁদছে না। এই দেখ, রক্ত পড়াও বন্ধ হয়েছে। আর রক্ত পড়ছে না।
আসমানী কাঁদতে কাঁদতেই মেয়ে কোলে নিয়ে পাশের কামরায় চলে গেল। শাহেদের মন এমনই খারাপ হলো যে তার নিজেরও কান্দতে ইচ্ছা করল। দিনটা সুন্দরভাবে শুরু হয়ে হঠাৎ কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। তার আর ঘরে চুপচাপ বসে থাকার কোনো মানে হয় না। সবচেয়ে ভালো হয় কিছুক্ষণ বাইরে কাটিয়ে এলে। অফিসে যাওয়া যেতে পারে। অফিস থেকে ফেরার পথে বাজার করে আনলে আসমানীর রাগ হয়তো কিছু কমবে। মেয়েটার জন্য গাদাখানিক হাতির ছবি আঁকা খাতা আনতে হবে। আর একটা ঘুড়ি কিনতে হবে। কবে যেন ঘুড়ির কথা বলছিল।
অফিসে শাহেদের সময়টা খুব খারাপ কাটল। খা-খা করছে অফিস। বলতে গেলে কেউ আসে নি।
অফিসের পিওন রুস্তম টুলে বসে ঝিমুচ্ছে। চোখ মেলে একবার সে শাহেদকে দেখল। উঠে দাঁড়াচ্ছে–এমন ভঙ্গি করে আবারো চোখ বন্ধ করে বিমাতে লাগল।
ইউনাইটেড ইনসুরেন্স কোম্পানি। একসময় লোকজন গমগম করত। আজ মাছি উড়ছে। যে-সব কোম্পানির মালিক অবাঙালি তার সবগুলোরই এই অবস্থা। মালিকরা অফিসে আসা বন্ধ করেছেন। অফিসে মাছি উড়া শুরু হয়েছে।
ক্যাশিয়ার নিবারণ বাবু বললেন, আজ অফিসে এসেছেন কেন? আজি জোর গুজব শহরে আর্মি নামবে। শেখ সাহেব। আর ইয়াহিয়ার বৈঠক বানচাল হয়ে গেছে। সবাই এখন ঘর সামলাতে ব্যস্ত, আপনি কেন অফিসে?
শাহেদ বলল, আপনিও তো অফিসে।
আমার ঘরে কিছু করার নেই। ফ্যামিলি দেশে পাঠিয়ে দিয়েছি। কাজেই চলে এসেছি। আপনাদের সঙ্গে গল্পগুজব করব।
বেশ তো করুন গল্পগুজব।
নিবারণ সাহেব অনেক ধরনের মজার মজার গল্প করলেন। এর মধ্যে ভৌতিক গল্পও আছে। তার কাকার শ্রাদ্ধের দিন না-কি সবাই দেখেছে অবিকল তার কাকার মতো দেখতে এক লোক শোবার ঘরের খাটে বসে আছে। লোকটা সম্পূর্ণ নগ্ন। শুধু গলায় পৈতা। শাহেদের কোনো গল্পই তেমন মজা লাগল না। নিবারণ বাবু বুকে এসে বললেন, আপনাকে খুব চিন্তিত লাগছে। ভাবিকে দেশের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। তাহলে দেখবেন আমার মতো হয়ে যাবেন। চিন্তাভাবনাহীন লান্টু মিয়া। যখন ইচ্ছে বনবান করে ঘুরবো।
শাহেদ বলল, উঠি।
আরো কিছুক্ষণ বসুন, গল্প করি। চা খাবেন? চা আনিয়ে দেই।
না, চা খাব না।
কেন খাবেন না! চা খান। বি হ্যাপী।
শাহেদ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আপনি অফিসে কতক্ষণ থাকবেন? নিবারণ বাবু আনন্দিত গলায় বললেন, আমি তো অফিসেই থাকি। বিছানা বালিশ নিয়ে চলে এসেছি। অফিস হলো এখন সবচে নিরাপদ জায়গা।
একটিার দিকে শাহেদ অফিস থেকে বের হলো।
মনে হচ্ছে শহর কোনো উৎসবের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড দেওয়া হচ্ছে। শাহেদের সামনেই হাজার হাজার মানুষ মহা-উৎসাহে পুরনো একটা বাস ঠেলতে ঠেলতে এনে রাস্তায় শুইয়ে দিল। এরা কার বাস নিয়ে এসেছে কে জানে! শেখ সাহেব কি রাস্তা ব্যারিকেড দেওয়ার কোনো নির্দেশ দিয়েছেন? তাঁর নির্দেশ ছাড়া তো এখন কিছুই হয় না। অফিস চলছে তার নির্দেশে। ব্যাংক চলছে তার নির্দেশে।
২৩ মার্চ, পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসে কোথাও পাকিস্তানি পতাকা উড়ে নি। শুধু তিনটা জায়গায় পতাকা উড়েছে–প্রেসিডেন্ট ভবনে যেখানে ইয়াহিয়া থাকেন, গভর্নর ভবনে এবং এয়ারপোর্টে। ব্রিটিশ ডেপুটি হাই কমিশন এবং সোভিয়েত কনসুলেটে উড়েছে বাংলাদেশী পতাকা। চীন, ইরান, ইন্দোনেশিয়া এবং নেপাল পাকিস্তানি পতাকা তুললেও জনতার চাপে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছে। আমেরিকান দূতাবাস অবশ্যি কোনো ঝামেলায় যায় নি। তারা কোনো পতাকাই উড়ায় নি। ভয়াবহ কাণ্ডটা করেছে। ইপিআর। তারা যশোহর সদর দপ্তরে উড়িয়েছে বাংলাদুেশী পতাকা।
সে-রাতে টিভি অনুষ্ঠান শেষ হবার পর পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত পাক সার যামিন শাদ বাদ ঠিকই বাজানো হয়েছে, কিন্তু পাকিস্তানি পতাকা দেখানো হয় নি।
লক্ষণ ভালো না। লক্ষণ খুবই খারাপ। পাকিস্তানের সৈন্যবাহিনী এত কিছু দেখার পরেও চুপ করে থাকবে, কিছু বলবে না–তা হতেই পারে না। ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে যাচ্ছে তো বটেই। সেটা কবে ঘটবে?
বাসায় ফিরতে ইচ্ছা করছে না। কী করা যায়? কী করা যায়? নাইমুলের কাছে গেলে কিছুটা সময় কাটে। সে বিয়ে করেছে— এই খবরটা পেয়েছে। বিয়ের পর তার সাথে দেখা হয় নি। নাইমুলকে যে মেয়ে বিয়ে করেছে, সে খুবই ভাগ্যবতী। এই খবরটা মেয়েকে দিতে ইচ্ছা করছে। শাহেদ ঠিক করল, নাইমুলকে পেলে তাকে নিয়ে সে তার শ্বশুরবাড়ি যাবে। নাইমুলের স্ত্রীকে বলবে, ভাবি, কী অসাধারণ একটি ছেলেকে আপনি স্বামী হিসেবে পেয়েছেন জানেন না। আমি জানি। নাইমুল অনেক তুচ্ছ জিনিস নিয়ে আপনার সঙ্গে রাগারগি করবে। আপনাকে বিরক্ত করবে। সব আপনি সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমা করে দেবেন। কারণ এই ছেলে খাঁটি হীরা। তার মধ্যে কোনো ভেজাল নেই। আপনি যদি চান, আপনাকে লিখিতভাবে দিতে পারি।
নাইমুলকে পাওয়া গেল না। ঘর তালাবন্ধ। তবে তালার সঙ্গে সেঁটে দেয়া একটা ছোট্ট চিরকুটে লেখা
যার জন্যে প্ৰযোজ্য
কিছুদিন ঘরজামাই জীবনযাপন করছি। আমার নতুন ঠিকানা–১৮নং সোবাহানবাগ (দোতলা), মিরপুর রোড। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ যেন আমার কাছে না। আসে।
শাহেদ নোট পড়ে হাসল। মনে মনে ঠিক করল, আসমানীর রাগ ভাঙিয়ে তাকে সঙ্গে নিয়ে সন্ধ্যার পর উপস্থিত হবে নাইমুলের শ্বশুরবাড়িতে।
শাহেদ বাসায় ফিরল দুটার দিকে। কাঁচাবাজার ছাড়াই ফিরল। কী কী লাগবে তার লিষ্ট আসমানীর কাছ থেকে নেয়া হয় নি। তবে সে ছটা হাতিমার্ক খাতা কিনল। একবাক্স রঙ-পেনসিল কিনল। আসমানীর রাগ ভাঙানোর জন্যে সে কিনল একটা রাগভাঙনি-শাড়ি। শাড়ির রঙ অবশ্যই আসমানী। রাজশাহী সিল্কের শাড়ি। শাড়ি হাতে নিলেই আসমানীর রাগ অনেকখানি কমবে। শাড়ির সঙ্গে লেখা নোটটা পড়লে এতটুকু রাগও থাকবে না। নোটে লেখা— জান গো! কেন এমন করো?
বাসায় তালা দেওয়া। শাহেদ এতে তেমন বিস্মিত হলো না। তার মনে ক্ষীণ আশঙ্কা ছিল, বাসায় ফিরে এরকম কিছু সে দেখবে। ঘরে তালা দিয়ে আসমানী রাগ করে চলে যাবে কলাবাগানে তার মার কাছে।
আসমানী কলাবাগানে ছিল না। শাহেদের শাশুড়ি বিরক্ত গলায় বললেন, শহরের অবস্থা এত খারাপ, এর মধ্যে আসমানী বের হলো কেন? রোজ রোজ কী নিয়ে তোমাদের এত ঝগড়া? আমি আমার মেয়ের উপর যেমন রাগ করছি, তোমার উপরও রাগ করছি। এখন যাও তাড়াতাড়ি খুঁজে বের করো ও কোথায়। তুমি তো বাবা আমাকে মহা-দুশ্চিন্তায় ফেললে। শহরের অবস্থা এত খারাপ, এর মধ্যে এই খবর…
শাহেদ নানান জায়গায় ওদের খুঁজল। কোনোরকম সন্ধান পাওয়া গেল না। শাড়িটা সে রেখে এসেছে তার শাশুড়ির কাছে। এটা নিয়েও সে দুশ্চিন্তা করছে। শাশুড়ি যদি নোটটা পড়ে ফেলেন, তাহলে খুব লজ্জার ব্যাপার হবে। রাত অনেক হয়েছে। ঘড়ি নেই বলে কত রাত তা বোঝা যাচ্ছে না। রাস্তাঘাটে লোক-চলাচল একেবারেই বন্ধ। রিকশাও চলছে না। কিছুদূর পরপরই রাস্তায় এমন ব্যারিকেড দেওয়া, রিকশা চলার প্রশ্নও আসে না।
শাহেদ হেঁটে হেঁটে ফিরছে, এই সময় শহরে মিলিটারি নামল। রাতটা হলো_
আকাশে ট্রেসার উড়ছে
আকাশে ট্রেসার উড়ছে। আকাশ আলো হয়ে উঠছে। তৈরি হচ্ছে আলোর নকশা। যেন বারবার কালো আকাশে ঝলমলিয়ে উঠছে উৎসবের হাউই বাতি। তারাবাতির মতো আগুনের ফুলকি বেরুচ্ছে মেশিনগানের মুখ থেকে। বাজির শব্দের মতো গুলি। উৎসব। অন্য ধরনের উৎসব। হত্যা ও ধ্বংসের উৎসব। এই উৎসবের জন্যে কেউ কি তৈরি ছিল? ঢাকার ঘুমন্ত মানুষ ভয়াবহ আতঙ্ক নিয়ে জেগে উঠল। কী হচ্ছে? কী হচ্ছে?
সবাই জানে কী হচ্ছে। তারপরেও যেন কেউ কিছু জানে না। ভারী মিলিটারি ট্রাক, মিলিটারি জিপ অবলীলায় রাস্তায় চলাচল করছে। সবকটি রাস্তায় না বেরিকেড ছিল? এরা এত দ্রুত বেরিকেড সরালো কীভাবে? অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে রাস্তায়। ট্যাংক নেমেছে নাকি? ট্যাংক চললে রাস্তায় এমন অদ্ভুত শব্দ হয়? একটানা যে ট্যা ট্যা শব্দ হচ্ছে সেই শব্দ কিসের? তার চেয়েও বিচিত্র আরেক ধরনের শব্দ হচ্ছে–শো শো হুস হুইইই।
ভয় এবং কৌতূহল বোধহয় পাশাপাশি চলে। প্রচণ্ড ভীত মানুষের কৌতূহলও হয় প্রচণ্ড। এরা জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়েছে। দেখতে চেষ্টা করছে কী হচ্ছে বাইরে। কেউ কেউ চলে এসেছে বারান্দায়। চোখের সামনে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ দেখার আলাদা মাদকতা আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই এক ধরনের ঘোর তৈরি হয়। মাথার ভেতরে জগাখিচুড়ির মতো কিছু হয়। তখন মানুষ যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। এমনসব কাণ্ড করে।
এই জাতীয় কাণ্ড কিছু শুরু হলো। কিছু কিছু নিতান্তই নিরীহ ছাপোষা ধরনের মানুষ জয় বাংলা, জয় বাংলা বলে গলা ফাটিয়ে চোঁচাল। দীর্ঘ আন্দোলনে এদের কেউ হয়তো কোনোদিন রাজপথে নামে নি। কোনো মোগান দেয় নি। অফিসে গিয়েছে, অফিস থেকে ফেরার পথে বাজার করে নিয়ে এসেছে। চটের ব্যাগের ভেতর থেকে উঁকি দিয়েছে একটা লাউ, ইলিশ মাছের লেজ। আজ হঠাৎ তাদের কী হয়ে গেল?
ভীত মানুষের কান্না ও চিৎকার শোনা যেতে শুরু করল তারও কিছু পরে। আকাশে তখন ট্রেসারের সংখ্যা কমে এসেছে। কারণ তার প্রয়োজন নেই। সারা ঢাকা শহর আলোকিত। অসংখ্য জায়গায় আগুন জুলছে, কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে কালো ধোয়া। আগে সারা শহরে একসঙ্গে গুলি হচ্ছিল, এখন তা হচ্ছে না। গুলি হচ্ছে অঞ্চল বিশেষে। টেলিফোন কাজ করছে না। রাস্তা শুধু যে জনশূন্য তাই নয়, প্রথমবারের মতো কুকুরশুন্য। কোথায় কী হচ্ছে কেউ জানতে পারছে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কী হলো? তাঁর আঙুলের ইশারায় দেশ চলছিল। এখন তিনি কিছু বলছেন না কেন? ইয়াহিয়ার সঙ্গে শেষ বৈঠকের আগে, সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ভালো কিছু আশা করছি। খারাপ কিছুর জন্যেও প্রস্তুত আছি। কোথায় তাঁর প্রস্তুতি? নাকি যুদ্ধ শুরু হয়েছে, কেউ কিছু জানে না।
একদল মিলিটারি ঢুকে পড়ল বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। তাদের হাতে শিক্ষকদের তালিকা। তারা মানুষ না, তারা সাক্ষাৎ আজরাইল। মানুষের বেশে জানি কবজ করতে এসেছে।
এটা কার বাড়ি? জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট? হিন্দু মালাউন? বদমাশটার নাম কী? জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা?
মিলিটারি লেফটেনেন্ট বাড়িতে ঢুকে পড়ল। জোয়ানরা বাড়ি ঘিরে আছে। হতভম্ব জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন।
আপ প্রফেসর সাব হ্যায়?
Yes.
আপকো লে যায়গা।
Why?
হোয়াই প্রশ্নের জবাব দেবার সময় নেই। তাকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তাঁর স্ত্রী বাসন্তী গুহঠাকুরতা, তার অতি আদরের কন্যা দোলা তখনো বুঝতে পারছে না। কী হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্যে নিয়ে যাচ্ছে। এর বেশি কী হবে? খালি পায়ে স্বামীকে নিয়ে যাবে? বাসন্তী গুহঠাকুরতা দৌড়ে ঘরে ঢুকলেন স্যান্ডেল আনতে। এর মধ্যেই জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে বাইরে নিয়ে গুলি করা হয়েছে।
তাদের বসার ঘরের সঙ্গেই চিৎ হয়ে পড়ে আছে ড. মনিরুজ্জামানের মৃতদেহ। একটু দূরে আরো তিনজন। একজন ক্ষীণস্বরে বলছে, পানি পানি।
মারা গেলেন দার্শনিক আত্মভোলা অধ্যাপক ড. জি. সি. দেব। জি. সি. দেব। মৃত্যুর আগে প্রায় হাসিমুখে বললেন, আমি হিন্দু। আমার বাড়িতে যারা আছে সবাই হিন্দু।
তিনি হয়তো ভাবলেন, সংখ্যালঘু হিন্দুদের প্রতি কোনো অত্যাচার করা হবে না। কিংবা অন্য কিছু তখন তার মাথায় খেলা করছিল।
মারা গেলেন মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ফজলুর রহমান, ফলিত পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচাৰ্য, পরিসংখ্যান বিভাগের প্রধান ড. মনিরুজ্জামান, ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মুহম্মদ আব্দুল মুকতাদির, অংক বিভাগের অধ্যাপক শরাফত আলী, পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এম. আর. খান খাদিম, শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সিটিউটের শিক্ষক মুহম্মদ সাদিক ও ড. মুহম্মদ সাদত আলী।
মিলিটারিরা ঢুকে পড়ল ইকবাল হল এবং জগন্নাথ হলে। তাদের পরিকল্পনা একটি ছাত্রও যেন জীবিত বের হয়ে সেতে না পারে। তোমাদের জয় বাংলা অনেক সহ্য করেছি। আর না।
রোকেয়া হল এবং শামসুন্নাহার হল। মেয়েদের দুটি হল। হলের মেয়েরা আতঙ্কে অস্থির হয়ে দেখল, গেট ভেঙে মিলিটারিরা ঢুকছে। আমাদের বাঁচাও বলে চিৎকার করার মতো মানসিক শক্তিও তাদের রইল না। তারা দেখল, পাকিস্তানি জোয়ানরা মার্চ করে হলের দিকে এগুচ্ছে।
সেনাবাহিনী আগুন জুলিয়ে দেয়। ইত্তেফাক অফিসে। দাউদাউ করে আগুন জুলতে থাকে দি পিপলস, গণবাংলা এবং সংবাদ অফিসে। আত্মনিমগ্ন কবি শহীদ সাবের সংবাদ অফিসেই ঘুমাতেন। সংবাদ অফিসই ছিল তাঁর ঘর-বাড়ি। তিনি জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা গেলেন সংবাদ অফিসেই।
পাকিস্তান মিলিটারি রাত একটায় যে অপারেশন শুরু করে তার নাম অপারেশন সার্চ লাইট।* ব্রিগেডিয়ার আরবাবের ৫৭ ব্রিগেড ছিল ঢাকা অপারেশনের দায়িত্বে। অধিনায়ক মেজর জেনারেল ফরমান আলি। তিনি শায়েস্তা করবেন। ঢাকা নগরী। মেজর জেনারেল খাদেমের উপর দায়িত্ব পড়ল ঢাকা ছাড়া বাকি দেশ শায়েস্তা করার।
ব্রিগেডিয়ার আরবাব ১৮ পাঞ্জাব, ২২ বেলুচ এবং ৩২ পাঞ্জাবের যৌথ দলকে লেলিয়ে দিল বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়।
৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্টকে পাঠাল রাজারবাগের এক হাজার পুলিশকে জন্মের শিক্ষা দেবার জন্যে।
পুরনো ঢাকার গাদারদের শায়েস্তা করবে ১৮ পাঞ্জাব।
২২ বালুচের দায়িত্ব পড়ল পিলখানা ইপিআরদের ঠাণ্ডা করা।
১৩ ফ্রিন্টিয়ার ফোর্সকে কোনো কাজে লাগানো হলো না। রিজার্ভ বাহিনী হিসেবে তাদের ক্যান্টনমেন্ট এলাকাতে রেখে দেয়া হলো।
৪৩ হালকা বিমান বিধ্বংসী রেজিমেন্টকে পাঠানো হলো তেজগাও বিমানবন্দরের দায়িত্ব দিয়ে।
এক প্লাটুন কমান্ডো পাঠানো হলো ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর থেকে শেখ মুজিবকে ধরে আনতে।
রাত একটায় ওয়্যারলেসে ৫৭ ব্রিগেডের ব্রিগেড কমান্ডার মেজর জাফরের উৎফুল্ল কণ্ঠ ভেসে এলো–Big Bird in the cage… others not in the nests…over.
সামরিক বাহিনীর জিপে করে তাকে নিয়ে আসা হলো ক্যান্টনমেন্টে। মেজর জাফর জানতে চাইল জেনারেল টিক্কা কি তাকে চোখের দেখা দেখতে চান? টিক্কা উত্তর দিল–I dont want to see his face.
জেনারেল টিক্কা ২৫ মার্চ রাত নটায় ঢাকা অঞ্চল কমান্ডার মেজর জেনারেল ফরমান আলীর স্টাফ অফিসে ঢাকা অপারেশনের দায়িত্বে নিযুক্ত অফিসারদের হাসতে হাসতে বলেছিলেন–ঢাকা শহরে এমন তাণ্ডব তৈরি করতে হবে যেন আতঙ্কে দুগ্ধবতী মাতার বুকের দুধ জমে দই হয়ে যায়। বাংলাদেশ ছোট্ট একটি দুষ্ট প্রাণী। ঢাকা হলো সেই প্রাণীর মাথা। আমরা শুধু মাথাটা ভেঙে গুড়ো করে দেব। আমাদের আর কিছু করতে হবে না। ২৭ মার্চ ভোরবেলা আমি কারফিউ তুলে দেব। দেখা যাবে ২৭ মার্চেই ইনশাল্লাহ দেশ ঠিক হয়ে গেছে।
জেনারেল টিক্কা পরম সৌজন্যে টিপট থেকে নিজেই সবার জন্য চা ঢেলে দিলেন। হাসিমুখে বললেন, শেকসপিয়র তার হ্যামলেটে বলেছিলেন, I have to be cruel only to be kind. VONTAİK FC3orf5 TRICK qKF KKG3 TS21*fr। বাঙালিদের প্রতি দয়া। গ্যাংগ্রীনে আক্রান্ত অংশ শল্যচিকিৎসক কেটে বাদ দেন। তিনি তা করেন রোগীর মঙ্গলের জন্য, রোগী তা বুঝতে পারে না। রোগগ্ৰস্ত বাঙালিকে আমরা বাঁচাব না তো কে বাচাবে? মিটিং-এর শেষ পর্যায়ে তিনি পাঞ্জাবি সৈন্যদের বুদ্ধি-সুদ্ধি নিয়ে একটা রসিকতা করলেন। সেই রসিকতায় এক একজন হেসে প্রায় গড়িয়ে পড়ল। একজন জেনারেলের সামনে এভাবে হাসা বড় ধরনের বেয়াদবি, কিন্তু না হেসে পারা যাচ্ছিল না। রসিকতাটা ছিল বড়ই মজার।
জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে ভুট্টোর সাক্ষাৎ হলো গভর্নর হাউসে। ততক্ষণে অপারেশন সার্চ লাইট শুরু হয়ে গেছে। ভুট্টো খানিকটা উত্তেজিত। অস্থির। তার জানার আগ্রহ, কী হচ্ছে? অপারেশন কোন পর্যায়ে? জেনারেল টিক্কা খান তাকে তেমন পাত্তা দিচ্ছে না। মিলিটারি অপারেশন কী হচ্ছে কীভাবে হচ্ছে তা সিভিলিয়ানদের জানানোর কিছু নেই। উত্তেজিত ভুট্টো রাতেই মিলিটারি কনভয়ের সঙ্গে বের হয়ে শহরের অবস্থা দেখতে আগ্রহী। জেনারেল টিক্কা হাসি হাসি মুখে বলল, No. ভুট্টো মেঝেতে জুতা ঠিকে বলল, why no? জেনারেল টিক্কা বলল, Because said no.
ভুট্টো বলল, আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে কথা বলতে চাই।
টিক্কা বলল, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করেছেন। তিনি এখন পাকিস্তানের পথে।
ভুট্টো আবারো মেঝেতে জুতা ঠিকে বলল, এই তথ্যটা আমি কেন জানলাম না? আমিও তো তার সঙ্গে চলে যেতে পারতাম।
আপনাকে রেখে যাওয়া হয়েছে বিদ্রোহী পূর্ব পাকিস্তানের শান্ত রূপ দেখে যাবার জন্যে। অখণ্ড পাকিস্তানের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী, কফি খাবেন?
সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী সম্বোধনে ভুট্টোকে খানিকটা তুষ্ট মনে হলো।
লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফের রিপোর্টার সিমন ড্রিং-এর পাঠানো প্ৰত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য ঢাকা থেকে পাঠানো প্রথম বিদেশী প্রতিবেদন। তিনি তার দীর্ঘ প্রতিবেদনের এক অংশে লিখলেন–
City lies silent
Shortly before dawn most firing had stopped, and as the sun cane up an eerie silence settled over the city, deserted and completely dead except for the noise of the crows and occasional convoy of troops or two or three tanks rumbling by mopping Up.
At noon again without warning, columns of troops poured into the old section of the city where more than one million fived in a sprawling maze of narrow, winding streets. For the next 11 hours they devasted the old town as it is called.
The lead unit was followed by soldiers carrying cans of gasoline. Those who tried to escape was shot. Those who stayed were burnt alive.
নগরী নীরব
সকাল হবার কিছুক্ষণ আগে গোলাবর্ষণ থেমে গেল, সূর্য উঠল, এক ভৌতিক নীরবতা নগরীকে গ্রাস করল, পরিত্যক্ত ও মৃত এই নগরীতে শুধু শোনা যাচ্ছে কাকের ডাক, মিলিটারি কনভয় ও চলমান ট্যাংকের ঘর্ঘর শব্দ।
দুপুরে আচমকা সৈন্যদলের গাড়ি পুরনো ঢাকায় ঢুকে পড়ল, যার গোলকধাঁধার মতো গলিঘুজিতে দশ লাখ মানুষ বাস করেন। পরের এগারোটা ঘণ্টা ধরে চলল ধবংসযজ্ঞ।
অগ্রবর্তী দলের পেছনে পেছনে সৈন্যরা পেট্রোলের টিন হাতে করে যাচ্ছিল। যারা পালাতে চেষ্টা করছিল তাদের গুলি করা হলো। যারা পালালো না তাদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হলো।
শাহেদ নিতান্ত অজানা অচেনা এক বাড়িতে আটকা পড়ে আছে। ২৫ মার্চের মধ্যরাতে সে উপায় না দেখে বিজয়নগরের এই গলিতে ঢুকে পড়েছিল। একতলা একটা বাড়ির বন্ধ গেট টপকে সে প্রাণপণ শক্তিতে বাড়ির দরজায় ধাক্কা দিল। জানালার পর্দা সরিয়ে বাচ্চা একটা মেয়ে উঁকি দিল। ভীত গলায় বলল, কে, কে?
শাহেদ বলল, খুকি, তুমি আমাকে চিনবে না। দরজা খোলো।
দরজা খুলছে না। রাস্তায় গাড়ির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। শাহেদ বলল, খুকি। দরজা খোলো।
খুকির মা দরজা খুললেন। তিনি তার মেয়ের মতোই ভয় পেয়েছেন। তার চোখ-মুখ সাদা। তিনি ভয়ে কাঁপিছিলেন। খুঁকির মা বললেন, বাইরে কী হচ্ছে? শাহেদ বলল, শহরে মিলিটারি নেমে গেছে। সব জানালা বন্ধ করে বাতি নিভিয়ে দিন। বাতি জ্বেলে রেখেছেন কেন? বাড়ির ভেতর থেকে এক বৃদ্ধর শ্লেষ্মাজড়ানো গলা ভেসে এলো, বউমা, দরজা কেন খুললা? তুমি কার সাথে কথা বলো?
শাহেদ বৃদ্ধের কথার জবাব দিতে পারে নি। তার আগেই খুব কাছে কোথাও মটারের গোলা পড়ল। প্রথম গোলার পর দ্বিতীয় গোলা পড়ল। এবারেরটা যেন আরো কাছে। পুরো বাড়ি কেঁপে উঠল। বসার ঘরের দেয়ালে ঝুলানো বঁধানো সবকটা ছবি খুলে পড়ে গেল। ঝন ঝন শব্দ হতেই থাকল। কারেন্ট চলে গিয়ে বাড়ি অন্ধকার হয়ে গেল। বৃদ্ধ ভয় পেয়ে শিশুর মতো চোঁচাতে লাগলেন, ও বউমা। বউমা।। ও বউমা। তুমি কার সঙ্গে কথা বলো?
বাচ্চা মেয়েটা চিৎকার করে কাদছে। গুলির চেয়েও সে অন্ধকারকে ভয় পাচ্ছে। শাহেদ বলল, খুকি, তুমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছ সেখানেই দাঁড়িয়ে থাক। নড়বে না। ঘর ভর্তি কাচের টুকরা।
দুঃসময় মানুষকে অতিদ্রুত দলবদ্ধ করে। অরণ্যচারী মানুষ হিংস্ৰ শ্বাপদের ইশারা পেলেই যুথবদ্ধ হতো। সভ্য মানুষের ভেতরেও হয়তো সেই স্মৃতি রয়ে গেছে। আজ এই ভয়াবহ সময়ে তারা চলে এসেছে কাছাকাছি।
মাত্র তিন ঘণ্টা পার হয়েছে–শাহেদ এই পরিবারটির সঙ্গে আছে। এই তিন ঘণ্টায় নিজেকে সে এই পরিবারের একজন সদস্য বলেই মনে করছে। ঢাকা কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক সানাউল্লাহ সাহেবের স্ত্রীকে তার নিজের ছোটবোনের মতোই মনে হচ্ছে। সানাউল্লাহ সাহেবের বাবাকে সে ডাকছে। চাচাজান। সানাউল্লাহ সাহেবের মেয়েটি সারাক্ষণ তার আঙুল ধরে আছে। মেয়েটির নাম কংকন। সে কংকন বলতে পারে না, নাম জিজ্ঞেস করলে বলে ককন! মেয়েটির বয়স পাচের কাছাকাছি। এই বয়সে অনুস্বারের উচ্চারণ আয়ত্তে এসে যাওয়া উচিত। মেযেটি মনে হয় কথা বলায় পিছিয়ে আছে। শাহেদ নিতান্তই অপরিচিত একজন তারপরেও সে সানাউল্লাহ সাহেবের শোবার ঘরের খাটে অন্য সবার সঙ্গে বসে আছে।
কংকনের মায়ের নাম এখনো জানা যায় নি। তার শ্বশুর তাকে মানু ডাকছেন। মানু নিশ্চয়ই তার নাম না। বড় নাম ভেঙে আদর করে তিনি হয়তো পুত্রবধূকে ছোট নামে ডাকেন। বৃদ্ধ যে তার পুত্রবধূকে অত্যন্ত পছন্দ করেন তা তার কথাবার্তায় বোঝা যাচ্ছে। তবে তিনি কথার ফাঁকে ফাকে ধমক দিচ্ছেন। কংকনের মা তাতে বিচলিত হচ্ছেন না। কথায় কথায় শ্বশুরের ধমক খেয়ে তার হয়তো অভ্যাস আছে।
ঘরে হারিকেন জ্বালানো হয়েছে। কংকন ঘুমিয়ে পড়েছে। বাকি তিনজন তাকিমে আছে হারিকেনের দিকে। অন্ধকারে মানুষ সবসময় আলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে পছন্দ করে। শুধু ইলেকট্রিক বাতির দিকে তাকায় না। ইলেকট্রিকের আলো চোখে লাগে।
কংকনের মা শাহেদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ভাই, আপনি কি রাতে খেয়েছেন?
শাহেদ বলল, জি না। তবে আমি কিছু খাব না। এই সময় খাওয়ার প্রশ্নই আসে না!
ঘরে খাবার কিছু নেই। গরম ভাত দেই। আর একটা ডিম ভেজে দেই? আমার ক্ষিধে নেই।
বৃদ্ধ খুবই বিরক্ত গলায় বললেন, বৌমা, আমি তোমার কথাবার্তা, কাৰ্যকলাপে যারপরনাই বিরক্ত। ভাত দেই, ডিম ভেজে দেই,–এইসব কী ধরনের কথা? শুনেছ একটা লোক খায় নাই। তুমি ভাত রোধে, ডিম ভেজে তাকে খেতে ডাকবে। বাড়ির বৌ যদি সভ্যতা-ভব্যতা না জানে কে জানবে? বস্তির মাতারি জানবে?
শাহেদ লজ্জিত গলায় বলল, চাচাজান, আমার একেবারেই ক্ষিধে নেই।
তুমি চুপ কর। গোলাগুলির মধ্যে ক্ষিধা আছে কি নাই বোঝা যায় না। হঠাৎ দেখবে ক্ষিধায় নাড়িতুড়ি জুলছে। বৌমা, তুমি হারিকেন নিয়ে যাও, ভাত চড়াও। একমুঠ চাল বেশি দিও, আমিও চারটা খাব।
কংকনের মা হারিকেন হাতে রান্নাঘরে চলে গেল। শাহেদ বলল, কংকনের বাবা কোথায়?
বৃদ্ধ বিরক্ত গলায় বলল, ঐ গাধাটার কথা আমাকে জিজ্ঞেস করবে না। গাধাটার কথা জিজ্ঞেস করলেই চড়াৎ করে রক্ত মাথায় উঠে যাবে। গাধা গেছে বরিশাল। আমি তাকে বললাম, দেশের অবস্থা ভালো না। এই সময় কোথাও যাবার দরকার নেই। তবু সে গেল।
কোনো জরুরি কাজে গেছেন?
অত্যন্ত জরুরি কাজে গেছে। বন্ধুর বিয়েতে গেছে। আরো গাধা, তোর নিজের পরিবারের নিরাপত্তার চেয়ে বন্ধুর বিয়ে বড় হয়ে গেল? তোর বউ, মেয়ে, বৃদ্ধ বাবা এইগুলা কিছু না? বউমা বলতে গেলে বাচ্চা একটা মেয়ে। আমি প্রায় পঙ্গু। তুই বসে বসে কোর্মা-কালিয়া খাচ্ছিস আর আমরা খাচ্ছি গুলি। কাণ্ডজ্ঞানহীন শাখামৃগ। তাকে বললাম ট্রানজিস্টারের ব্যাটারি শেষ। ব্যাটারি কিনে দিয়ে যা। সে বলল, জি আচ্ছা বাবা। কিনে দিয়ে গেছে ব্যাটারি? না। উনি ভুলে গেছেন। উনি সবকিছু ভুলে যান, শুধু বন্ধুর বিয়ে মনে থাকে। খা ব্যাটা বিয়ে খা।
বৃদ্ধ হঠাৎ চুপ করে গেলেন। খুব কাছেই গুলির শব্দ হচ্ছে। মানুষের চিৎকার হৈচৈও শোনা যাচ্ছে। বৃদ্ধ আতঙ্কিত গলায় বললেন, বৌমা, হারিকেন নিভিয়ে দাও। হারিকেন নিভিয়ে দাও।
কংকনের ঘুম ভেঙে গেছে। সে ভয় পেয়ে কাঁদতে শুরু করেছে। বৃদ্ধ বললেন, শাহেদ, মেয়েটার কান্না থামাও। কান্নার শব্দ শুনে মিলিটারি এদিকে চলে আসতে পারে। ওর মুখটা চেপে ধরে।
রাত বাজছে তিনটা পঁচিশ।
কিছুক্ষণের জন্যে গোলাগুলি বন্ধ ছিল। আবারো শুরু হয়েছে। প্রবলভাবেই শুরু হয়েছে। মরিয়মের ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ। টেবিলে মোমবাতি জ্বলছে। মোমবাতির আলোয় খেতে বসেছে নাইমুল। সে খুব আগ্রহ করে খাচ্ছে। তারচে অনেক আগ্রহ করে তার খাওয়া দেখছে মরিয়ম। তার শুধু একটাই কষ্ট, নাইমুল খেতে বসে কাঁচামরিচ চেয়েছিল। মরিয়ম কাঁচামরিচ দিতে পারে নি। ঘরে ছিল না। সে ঠিক করে রেখেছে। এরপর থেকে সে নিজের দায়িত্বে কাঁচামরিচ কিনে রাখবে। নাইমুল খেতে বসে কাঁচামরিচ চায়।
মরিয়ম বলল, খেতে ভালো হয়েছে?
নাইমুল জবাব দিল না। হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। এই মাথা নাড়া দেখতে মরিয়মের ভালো লাগে। সবাই মাথা নাড়ে দুবার। মরিয়মের সম্পূর্ণ নিজের এই মানুষটা তিনবার নাড়ে; মরিয়ম ঠিক করেছে এখন থেকে সে নিজেও মাথা নাড়লে তিনবার নাড়বে। তার সব কিছুই হবে তার নিজের মানুষটার মতো। নাইমুল হঠাৎ খাওয়া বন্ধ করে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, মরি, বলো তো ঢাকায় সবচে ভালো মোরগপোলাও কোথায় পাওয়া যায়?
মরিয়ম বলল, জানি না।
নাইম বলল, পুরনো ঢাকায় সাইনি পালোয়ানের মোরগপোলাও। তোমাকে একদিন খাওয়াব।
মরিয়ম আদুরে গলায় বলল, কবে?
নাইমুল স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হাসল। সেই হাসি এত সুন্দর! হাসার সময় তার নিজের মানুষটার ঠোঁট কী সুন্দর বাঁকে। তখন ইচ্ছা করে ঠোঁটে হাত দিয়ে ছয়ে দেখতে। এই কাজটা মরিয়ম কোনোদিন করে নি। তবে কোনো একদিন করবে। যদি সে দেখে এতে নাইমুল রাগ করছে না, তা হলে সব সময় করবে। নাইমুল হাসলেই সে ঠোঁট ছুঁয়ে দেবে।
বাইরে গুলির শব্দ হচ্ছে। মরিয়মদের বাড়ি বড় রাস্তার পাশে। রাস্তায় ঘড়ঘড় শব্দে ট্যাংক চলছে। আর তারা কী সুন্দর টুকটাক গল্প করছে! হাসছে। যেন এই পৃথিবীতে তারা দুইজন এবং দুজনের সামনে জ্বলন্ত মোমবাতি ছাড়া আর কিছু নেই।
মরি!
উঁ।
মোরগপোলাওটা যে খাচ্ছি। এটা কে বেঁধেছে?
মা
খুব ভালো হয়েছে। তুমি মোরগপোলাও রাধা শিখে নিও।
আমি কালই শিখব।
নাইমুলের খাওয়া শেষ হয়েছে। সে প্লেটের উপর হাত ধুচ্ছে। মরিয়মের ইচ্ছা করছে হাত ধুইয়ে দিতে। তার লজ্জা এখনো কাটে নি বলে যা যা করতে ইচ্ছা করে তার কোনোটাই করতে পারে না। লজ্জাটা কাটা উচিত।
মরি!
উঁ।
তোমাদের এখানে একটা পাগলা কোকিল আছে। দিনে রাতে সবসময় ডাকে। এখনো ডাকছে।
মনে হয় ভয় পেয়ে ডাকছে, বাইরে গুলি হচ্ছে তো।
ভয় পেয়ে ডাকলে তো কাকদেরও ডাকার কথা। কোনো কাক কিন্তু ডাকছে না।
তাই তো!
পাখিদের মধ্যে সবচে সুন্দর কোন পাখি ডাকে বলো তো?
জানি না। কোন পাখি?
চোখ গেল পাখি। তুমি চোখ গেল পাখির ডাক শুনেছ?
শুনেছি।
চোখ গেল পাখির হিন্দি নাম কী বলো তো?
জানি না।
পিঁউ কাহা।
পিঁউ কাহা তো শুনেছি। এটা যে চোখ গেল পাখি তা জানতাম না।
ইংরেজিতে এই পাখিকে কী বলে জানো?
না।
ইংরেজিতে বলে ব্রেইন ফিভার।
এত কুৎসিত নাম?
কুৎসিত তো বটেই। মরি, তোমার গরম লাগছে না?
লাগছে। একটা কাজ করলে কিন্তু গরমটা কম লাগবে। কী কাজ?
শাড়ি খুলে ফেলো।
মরিয়ম লজ্জায় বেগুনি হয়ে গেল। নাইমুল বলল, আমার সামনে লজ্জা কিসের?
মরিয়ম অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, আগে মোমবাতি নেভাও।
নাইমুল বলল, তা হবে না। মোমবাতি জ্বালানো থাকবে। একেক আলোয় মানুষের শরীর একেক রকম দেখায়। ইলেকট্রিকের আলোয় এক রকম, মোমবাতির আলোয় আরেক রকম, আবার মশালের আলোয় সম্পূর্ণ অন্যরকম। আমি দেখতে চাচ্ছি। মোমবাতির আলোয় নগ্ন মরিয়মকে কেমন দেখায়।
আমি পারব না। আগে মোমবাতি নেভাও।
নাইমুল মোমবাতি নেভাল না। মরিয়মের শরীর ঝনঝন করছে। শরীরের প্রতিটি কোষে সাড়া পড়ে গেছে। তারা জেনে গেছে কিছুক্ষণের মধ্যেই ভয়ঙ্কর আনন্দের ঘটনা ঘটবে। মরিয়ম কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, বাতি নেভাও, তোমার দোহাই লাগে। নাইমুল বলল, না। বলেই হাসল। মরিয়মের মনে হলো বাতি না নিভিয়ে ভালোই হয়েছে। বাতি নিভিয়ে ফেললে এত সুন্দর হাসি দেখা যেত না। মরিয়ম হাত বাড়িয়ে নাইমুলের ঠোঁট স্পর্শ করল।
২৬ মার্চ ভোর আটটায়
২৬ মার্চ ভোর আটটায় আগুপিছু জিপ ও ট্রাকে মোতায়েন সশস্ত্র প্রহরায় একটি ১৯৬১ মডেলের শেভ্রলেট গাড়ি হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালের সামনে এসে থামে। এই গাড়িবহর জুলফিকার আলি ভুট্টো এবং তার সঙ্গীদের এয়ারপোর্টে নিয়ে যাবে।
তাকে ভীত-সন্ত্রস্ত দেখাচ্ছিল। সাংবাদিকদের সব প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, আমার মন্তব্য করার কিছু নেই।
পশ্চিম পাকিস্তানে পা দিয়ে তিনি আনন্দিত গলায় বললেন, আল্লাহর রহমতে পাকিস্তান রক্ষা পেয়েছে।*
————-
*রিপোর্ট : শিডনি শনিবাৰ্গ।
রোনোন্ড জোফে পরিচালিত দা কিলিং ফিন্ডস ছবিটি অস্কার বিজয় করে। এই সত্য কাহিনীর নায়ক যে সাংবাদিক তিনিই শিডনি শনিবাৰ্ণ।–লেখক
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্ৰ
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্ৰ : অষ্টম খণ্ড গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, তথ্যমন্ত্রণালয় পৃষ্ঠা : ৫০
পরদেশী
পিতা : ছোটন ডোম
সুইপার, সরকারী পশু হাসপাতাল
ঢাকা।
২৭শে মার্চ সকালে রাজপানী ঢাকায় পাকসেনাদের বীভৎস হত্যাকাণ্ডের পর ঢাকা পৌরসভার তৎকালীন চেয়ারম্যান মেজর সালামত আলি খান শূরের প্রশাসনিক অফিসার মি. ইদ্রিস পৌরসভার আরও কয়েকজন অফিসার সঙ্গে নিয়ে একটি মিউনিসিপ্যাল ট্রাকে পশু হাসপাতালের গেটে এসে বাঘের মতো পরদেশী পরদেশী বলে গর্জন করতে থাকলে আমি ভীতসন্ত্রস্ত্ৰভাবে আমার কোয়াটার থেকে বের হয়ে আসি। ইদ্রিস। সাহেব অত্যন্ত ক্রুদ্ধভাবে কর্কশ স্বরে বলতে থাকেন, তোমরা সব সুইপার ডোম বের হও, যদি বাঁচতে চাও অবিলম্বে সবাই মিলে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় স্তুপীকৃত লাশ উঠিয়ে ধলপুর ময়লা ডিপোতে ফেলে দাও। নইলে কাউকে বাঁচানো হবে না, কেউ বাঁচতে পারবে না। পৌরসভার সেই ট্রাকে নিম্নবর্ণিত সুইপাররা বসা ছিল–১. ভারত, ২০ লাড়ু, ৩. কিষন।
আমি তার নির্দেশ অমান্য করার কোনো উপায় না দেখে ট্রাকে উঠে বসলাম। সেই ট্রাকে করে ঢাকা পৌরসভা অফিসে আমাদের প্রায় আঠারজন সুইপার ও ডোমকে একত্রিত করে প্রতি ছয়জনের সাথে দুইজন করে সুইপার ইন্সপেক্টর আমাদের সুপারভাইজার নিয়োজিত করে তিন ট্রাকে তিনদলকে বাংলাবাজার, মিটফোর্ড ও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রেরণ করা হয়। আমি মিটফোর্ডের ট্রাকে ছিলাম। সকাল নয়টার সময় আমাদের ট্রাক মিটফোর্ড হাসপাতালের লাশঘরের সম্মুখে উপস্থিত হলে আমরা ট্রাক থেকে নেমে লাশঘরের ভিতরে প্রবেশ করে বুকে এবং পিঠে মেশিনগানের গুলিতে ঝাজড়া করা প্ৰায় একশত যুবক বাঙালির বীভৎস লাশ দেখলাম। আমি আমার সুপারভাইজারের নির্দেশে লাশঘরের ভিতরে প্রবেশ করে প্রতিটি লাশের পায়ে ধরে টেনে ধরে বের করে বাইরে দাঁড়ানো অন্যান্য সুইপারের হাতে তুলে দিয়েছি ট্রাকে উঠাবার জন্য। আমি দেখেছি প্রতিটি লাশের বুক ও পিঠ মেশিনগানের গুলিতে ঝাজড়া। সব লাশ তুলে দিয়ে একপাশে একটা লম্বা টেবিলের উপর চাদর দিয়ে ঢেকে দেওয়া একটি লাশের উপর থেকে চাদর টেনে উঠিয়ে দেখলাম একটি রূপসী ষোড়শী যুবতীর উলঙ্গ লাশ–লাশের বক্ষ যোনিপথ ক্ষতবিক্ষত, কোমরের পিছনের মাংস কেটে তুলে নেওয়া হয়েছে, বুকের স্তন থেতলে গেছে, কোমর পর্যন্ত লম্বা কালো চুল, হরিণের মতো মায়াময় চোখ দেখে আমার চোখ বেয়ে পানি পড়তে থাকল, আমি কিছুতেই চোখের পানি রাখতে পারলাম না। আমি আমার সুপারভাইজারের ভয়াল এবং ভয়ঙ্কর কর্কশ গর্জনের মুখে সেই সুন্দরীর পবিত্ৰ দেহ অত্যন্ত যত্ন সন্ত্রমের সাথে ট্রাকে উঠিয়ে দিলাম। মিটফোর্ডের লাশঘরের সকল লাশ ট্রাকে উঠিয়ে আমরা ধলপুরের ময়লা ডিপোতে নিয়ে গিয়ে বিরাট গর্তের মধ্যে ঢেলে দিলাম। দেখলাম বিরাট বিরাট গর্তের মধ্যে সুইপার ও ডোমেরা রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে নিয়ে আসা লাশ ট্রাক থেকে গর্তের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। আমি অধিকাংশ লাশের দেহে কোনো কাপড় দেখি নাই, যে সমস্ত যুবতী মেয়ে ও রমণীদের লাশ গর্তের মধ্যে ফেলে দেওয়া হলো তার কোনো লাশের দেহেই আমি কোনো আবরণ দেখি নাই। তাদের পবিত্ৰ দেহ দেখেছি ক্ষতবিক্ষত, তাদের যোনিপথ পিছন দিকসহ আঘাতে বীভৎস হয়ে আছে। দুপুর প্রায় দুটিার সময় আমরা রমনা কালিবাড়ীতে চলে আসি পৌরসভার ট্রাক নিয়ে। লাশ উঠাবার জন্য ট্রাক রমনা কালিবাড়ীর দরজায় দাঁড় করিয়ে ভিতরে গিয়ে দেখি সবকিছু পুড়ে ভষ্ম হয়ে আছে। কালিবাড়ীর ভিতরে বিভিন্ন জায়গায় ছড়ানো ছিটানো ৪১টি পোড়া লাশ আমি ট্রাকে তুলেছি। কালিবাড়ীর এ সকল লাশ আমরা ধলপুরের ময়লার ডিপোতে গর্তের মধ্যে ফেলেছি। লাশ তুলে তুলে মানুষের পচা চর্বির গন্ধে আমার পাকস্থলি বের হতে চাচ্ছিল। পরের দিন আমি আর লাশ তুলতে চাই নাই, যেতে পারি নাই, সারাদিন ভাত খেতে পারি নাই, ঘৃণায় কোনো কিছু স্পর্শ করতে পারি নাই। পরের দিন। ২৯শে মার্চ সকালে আমি আবার ঢাকা পৌরসভা অফিসে হাজির হলে আমাকে ট্রাক দিয়ে লাশ তোলার জন্য আরও কয়েকজন সুইপারের সাথে ঢাকা শাখারীবাজারে যেতে বলা হয়। জজ কোর্টের সম্মুখে আগুনের লেলিহান শিখা তখনও জুলিছিল, আর পাকসেনারা টহলে মোতায়েন ছিল বলে আমরা ট্রাক নিয়ে সে পথ দিয়ে শাখারীবাজারে প্রবেশ করতে পারি নাই। পাটুয়াটুলি ঘুরে আমরা শাখারীবাজারের পশ্চিম দিকে প্রবেশ করে পাটুয়াটুলি ফাঁড়ি পার হয়ে আমাদের ট্রাক শাখারীবাজারের মধ্যে প্রবেশ করল। ট্রাক থেকে নেমে আমরা শাখারীবাজারের প্রতিটি ঘরে ঘরে প্রবেশ করলাম–দেখলাম। মানুষের লাশ, নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, বালকবালিকা, কিশোর-শিশুর বীভৎস পচা লাশ, চারদিকে ইমরান্তসমূহ ভেঙ্গে পড়ে আছে, মেয়েদের অধিকাংশ লাশ আমি সম্পূর্ণ উলঙ্গ দেখলাম, দেখলাম তাদের বুক থেকে স্তন তুলে নেওয়া হয়েছে! কারও কারও যোনিপথে লাঠি ঢুকানো আছে। বহু পোড়া, ভষ্ম লাশ দেখেছি। পাঞ্জাবী সেনারা পাষণ্ডের মতো লাফাতে লাফাতে গুলি বর্ষণ করছিল, বিহারী জনতা শাখারীবাজারের প্রতিটি ঘরে প্রবেশ করে মূল্যবান আসবাবপত্র, সোনাদানা লুণ্ঠন করে নিয়ে যাচ্ছিল, আমরা অবিরাম গুলিবর্ষণের মুখে প্রাণের ভয়ে দুই ট্রাক লাশ তুলে লাশ তোলার জন্য সেদিন আর শাখারীবাজারে প্রবেশ করার সাহস পাই নাই।। ৩০শে মার্চ সকালে আমার দলকে মিলব্যারাক থেকে লাশ তুলতে বলা হয়। আমি মিলব্যারাক ঘাটে পৌরসভার ট্রাক নিয়ে গিয়ে দেখলাম নদীর ঘাটে অসংখ্য মানুষের লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, বহু লাশ রশি দিয়ে বাধা দেখলাম, প্রতিটি রশির বন্ধন খুলে প্ৰতি দলে দশজন পনের জনের লাশ বের করলাম, সব যুবক ছেলে ও স্বাস্থ্যবান বালকদের লাশ দেখলাম। প্রতিটি লাশের চোখ বাধা, হাত বাধা, শক্ত করে। পিছন দিক থেকে। প্রতিটি লাশের মুখমণ্ডল কালো দেখলাম, এসিডে জ্বলে বিকৃত ও বিকট হয়ে আছে। লাশের সামনে গিয়ে ঔষধের অসহ্য গন্ধ পেলাম। লাশের কোন দলকে দেখলাম মেশিনগানের গুলিতে বুক ও পিঠ বাজাড়া হয়ে আছে, অনেক লাশ দেখলাম বেটন ও বেয়নেটের আঘাতে বীভৎস হয়ে আছে, কারো মাথা চূৰ্ণ-বিচূর্ণ হয়ে মগজ বের হয়ে আছে, কারো কাটা হৃদপিণ্ড বের হয়ে আছে। নদীর পাড়ে ছয়জন রূপসী যুবতীর বীভৎস ক্ষতবিক্ষত, উলঙ্গ লাশ দেখলাম। চোখ বাধা, হাত-পা শক্ত করে বাধা প্রতিটি লাশ গুলির আঘাতে ঝাজড়া, মুখমণ্ডল, বক্ষ ও যোনিপথ রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত ও বীভৎস দেখলাম। দুইবারে দুই ট্রাকে আমি সত্তরটি লাশ উঠিয়ে ধলপুর ময়লা ডিপোতে ফেলেছি। এরপর আমাকে সদরঘাট, শ্যামবাজার, বাদামতলী ঘাট থেকে লাশ তুলতে বলা হয়। আমি উপরোক্ত এলাকার নদীর ঘাট থেকে পচা লাশ তুলে ধলপুর ময়লা ডিপোতে ফেলেছি। আমি যেদিন কালিবাড়ী লাশ তুলেছি সেদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের পিছনে স্টাফ কোয়ার্টার, রোকেয়া হলের পশ্চিম দিকে জনৈক অধ্যাপকের বাসা থেকে আমি লাশ তুলেছি। রোকেয়া হলের পিছনের স্টাফ কোয়ার্টারের ভিতর থেকে আমি যেয়ে পুরুষ ও শিশু সমেত নয়টি লাশ তুলেছি। আর অধ্যাপকের বাসা থেকে সিঁড়ির সামনে লেপের ভিতর পেঁচানো জনৈক অধ্যাপকের লাশ। আমি তুলে নিয়ে গেছি।
স্বাক্ষর
পরদেশী
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ
দলিলপত্ৰ : অষ্টম খণ্ড
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, তথ্যমন্ত্রণালয়
পৃষ্ঠা : ৪৪
চুন্নু ডোম
ঢাকা পৌরসভা
রেলওয়ে সুইপার কলোনী
২২৩ নং ব্লক, ৩ নং রেলগেট
ফুলবাড়িয়া, ঢাকা।
২৮শে মার্চ সকালে আমাদের পৌরসভার সুইপার ইন্সপেক্টর ইদ্রিস সাহেব আমাকে লাশ উঠাবার জন্য ডেকে ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটিতে নিয়ে যান। সেখান থেকে আমাকে, বদলু ডোম, রঞ্জিত লাল বাহাদুর, গণেশ ডোম ও কানাইকে একটি ট্রাকে করে প্রথম শাখারীবাজারের কোর্টের প্রবেশপথের সম্মুখে নামিয়ে দেয়। আমরা উক্ত পাঁচজন দেখলাম ঢাকা জজ কোর্টের দক্ষিণ দিকের প্রবেশপথের যে রাজপথ শাখারীবাজারের দিকে চলে গেছে সেই রাস্তার দুধারে ড্রেনের পাশে যুবক-যুবতীর, নারী-পুরুষের, কিশোর-শিশুর বহু পচা লাশ। দেখতে পেলাম, বহু লাশ পাচে ফুলে বীভৎস হয়ে আছে, দেখলাম শাখারীবাজারের দুদিকের ঘরবাড়িতে আগুন জ্বলছে, অনেক লোকের অৰ্দ্ধপোড়া লাশ পড়ে থাকতে দেখলাম, দুই পার্শ্বে অদূরে সশস্ত্ৰ পাঞ্জাবী সৈন্যদের প্রহরায় মোতায়েন দেখলাম। প্রতিটি ঘরে দেখলাম মানুষ, আসবাবপত্র জুলছে। একটি ঘরে প্রবেশ করে একজন মেয়ে, একজন শিশুসহ বারজন যুবকের দগ্ধ লাশ উঠিয়েছি। শাখারীবাজারের প্রতিটি ঘর থেকে যুবক-যুবতী, বালক-বালিকা, কিশোর-শিশু ও বৃদ্ধের লাশ তুলেছি। পাঞ্জাবীরা প্রহরায় থাকাকালে সেই মানুষের অসংখ্য লাশের উপর বিহারীদের উশৃংখল উল্লাসে ফেটে পড়ে লুট করতে দেখলাম। প্রতিটি ঘর থেকে বিহারী জনতাকে মূল্যবান সামগ্ৰী, দরজা, জানালা, সোনাদানা সবকিছু লুটে নিয়ে যেতে দেখলাম। লাশ উঠাতে উঠাতে এক ঘরে প্রবেশ করে এক অসহায়া বৃদ্ধাকে দেখলামবৃদ্ধা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পানি পানি বলে চীৎকার করছিল, তাকে আমি পানি দিতে পারি নাই ভয়ে, বৃদ্ধাকে দেখে আমি আরও ভীত হয়ে পালিয়ে এসেছি। আমি পানি দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের পিছনে সশস্ত্ৰ পাঞ্জাবী সেনা প্রহরায় থাকায় আমি সেই বৃদ্ধাকে পানি দিয়ে সাহায্য করতে পারি নাই। আমরা ১৯৭১ সনের ২৮শে মার্চ শাখারীবাজার থেকে প্রতিবারে একশত লাশ উঠিয়ে তৃতীয়বার ট্রাক বোঝাই করে তিনশত লাশ ধলপুর ময়লা ডিপোতে ফেলেছি। ১৯৭১ সনের ২৯শে মার্চ সকাল থেকে আমরা মিটফোর্ড হাসপাতালের লাশঘর ও প্রবেশপথের দুপার্শ্ব থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিববাড়ী, রমনা কালিবাড়ী, রোকেয়া হল, মুসলিম হল, ঢাকা হল থেকে লাশ উঠিয়েছি। ২৯শে মার্চ আমাদের ট্রাক প্ৰথম ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালের প্রবেশপথে যায়। আমরা উক্ত পাঁচজন ডোম হাসপাতালের প্রবেশপথে নেমে একটি বাঙ্গালী যুবকের পচা, ফুলা, বিকৃত লাশ দেখতে পেলাম। লাশ গলে যাওয়ায় লোহার কাটার সাথে গোথে লাশ ট্রাকে তুলেছি। আমাদের ইন্সপেক্টর পঞ্চম আমাদের সাথে ছিলেন। এরপর আমরা লাশঘরে প্রবেশ করে বহু যুবক-যুবতী, বৃদ্ধকিশোর ও শিশুর স্তুপীকৃত লাশ দেখলাম। আমি এবং বদলু ডোম লাশঘব থেকে লাশের পা ধরে টেনে ট্রাকের সামনে জমা করেছি, আর গণেশ, রঞ্জিত (লাল বাহাদুর) এবং কানাই লোহার কাটা দিয়ে বিধিয়ে বিধিয়ে পচা, গলিত লাশ ট্রাকে তুলেছে। প্রতিটি লাশ গুলিতে বাজাড়া দেখেছি, মেয়েদের লাশের কারো স্তন পাই নাই যোনিপথ ক্ষত-বিক্ষত এবং পিছনের মাংস কাটা দেখেছি। মেয়েদের লাশ দেখে মনে হয়েছে, তাদের হত্যা করার পূর্বে তাদের স্তন সজোরে টেনে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে, যোনিপথে লোহার রড কিংবা বন্দুকের নল ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। যুবতী মেয়েদের যোনিপথের এবং পিছনের মাংস যেন ধারাল চাকু দিয়ে কেটে এসিড দিয়ে জুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি যুবতী মেয়ের মাথায় খোপা খোপা চুল দেখলাম। মিটফোর্ড থেকে আমরা প্রতিবারে একশত লাশ নিয়ে ধলপুর ময়লা ডিপোতে ফেলেছি।
৩০শে মার্চ। আমাদের উক্ত পাঁচজনের সাথে দক্ষিণা ডোমকে সাহায্য করতে দেওয়া হয়। আমাদের ট্রাক সেদিন সাত মসজিদে যায়। আমি সাত মসজিদের সম্মুখ থেকে যখন বাঙ্গালী লাশ উঠাচ্ছিলাম তখন অসংখ্য বিহারী জনতা আমাদের চারদিকে দাড়িয়ে হাসছিল, বাঙ্গালীদের পরিণতি দেখে উপহাস করছিল। আমরা সাত মসজিদের সম্মুখ থেকে আটটি বাঙ্গালী যুবকের লাশ তুলেছি, কতিপয় লাশ দেখলাম উপুড় হয়ে আছে, সবার পিঠ গুলির অসংখ্য আঘাতে কাজড়া হয়ে আছে। পচা, ফুলা লােশ তুলতে যেয়ে দেখলাম। কারও লুঙ্গি পরা, কারও পাজামা পরা। আবার কারও দেহে হাওয়াই শার্ট এবং টেট্রনের দামি প্যান্ট। পানি থেকে বারটি লাশ তুলেছি; প্রতিটি লাশের চোখ এবং হাত পিছন দিকে বাধা ছিল। নদীর পাড় থেকে বারটি লাশ গুলির আঘাতে বাজাড়া দেখেছি। লাশ দেখে মনে হলো, ভদ্রঘরের অভিজাত বাঙ্গালী যুবকদের লাশ। সাত মসজিদের সকল লাশ তুলে আমরা ধলপুরের ময়লা ডিপোতে ফেলেছি। ফিরে এসে ট্রাক নিয়ে আমরা মিন্টু রোডে লাশ তুলতে গিয়েছি। মিন্টু রোডের রাস্তার পাশ থেকে প্যান্ট পরা দুটি পচা ফুলা লাশ তুলেছি। ধলপুর যাওয়ার পথে ঢাকা স্টেডিয়ামের মসজিদের সম্মুখ থেকে এক বৃদ্ধ ফকিরের সদ্য গুলিবিদ্ধ লাশ তুলেছি, দেখলাম। লাশের পাশেই ভিক্ষার ঝুলি, টিনের ডিবা ও লাঠি পড়ে আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিববাড়ীর সম্মুখ থেকে দুজন রূপসী যুবতী মেয়ে এবং তিনজন যুবকের ক্ষত-বিক্ষত লাশ তুলেছি। রোকেয়া হলে একটি অৰ্দ্ধ দগ্ধ যুবতীর লাশ তুলেছি, মুসলিম হলে প্ৰবেশ করে একটি পচা লাশ পেয়েছি, ঢাকা হলের ভিতর থেকে চারজন ছাত্রের লাশ তুলেছি। পরের দিন ৩১শে মার্চ বাসাবো খাল থেকে তিনটি পচা লাশ তুলেছি। সেদিন অসুস্থ থাকায় আমি আর লাশ তুলতে যেতে পারি নাই।
টিপসহি
চুন্নু ডোম
ভয়ঙ্কর রাতের পরের যে ভোর
ভয়ঙ্কর রাতের পরের যে ভোর, সেখানে কিছু আশা থাকে, কিছু আনন্দ থাকে। দিনের আলো মানুষকে আর কিছু দিক না-দিক ভরসা দেয়। মঙ্গল-সঙ্গীতের মতো পাখি ডাকতে শুরু করে। এমনকি ভোরবেলার কাকের কা-কা ধ্বনিকেও শুভ মনে হয়। তারাও আলোর বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে।
পঁচিশে মার্চের ভয়ঙ্কর রাত কেটে গেছে। ভোর হয়েছে। পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে, অথচ কোনোরকম ভরসা পাওয়া যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে একটা দীর্ঘ রজনী পার করার পর শুরু হয়েছে আরেকটি দীর্ঘ রজনী। রাতের পর দিন আসে নি। রাতের পর এসেছে রাত।
শাহেদ বসে আছে সম্পূর্ণ অপরিচিত এই পরিবারের প্রধান বৃদ্ধ সোবাহান সাহেবের শোবার ঘরের একটা চেয়ারে। সারারাত এক পলকের জন্যেও সে চোখ বন্ধ করে নি। এখন তার চোখ জ্বালা করছে। মাঝে মাঝে চোখকে আরাম দেয়ার জন্যে সে কিছুক্ষণের জন্যে চোখ বন্ধ করছে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই চোখ খুলে ফেলছে। মনে হচ্ছে এখন চোখ বন্ধ করে থাকার সময় না।
সোবাহান সাহেব তাঁর বিছানায় জায়নামাজ পেতে নামাজে বসেছেন। তিনি শেষরাতে কিছু সময়ের জন্যে ঘুমিয়েছিলেন। ঘুমের মধ্যে ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখেছেন। স্বপ্নটা এরকম–তার ছেলে বরিশাল থেকে লঞ্চে করে ফিরছে। ছেলের বন্ধু সঙ্গে আছে। বন্ধুর নব-পরিণীতা স্ত্রী আছে। তাদের আত্মীয়স্বজনও আছে। তারা লঞ্চের একটা কেবিনের দরজা-জানালা বন্ধ করে গানবাজনা করছে। জমিয়ে গল্প করছে। এই সময় লঞ্চের তলা খুলে গেল। লঞ্চে হুড়মুড় করে পানি ঢুকতে লাগল। লঞ্চ ধীরে ধীরে পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। অন্য যাত্রীরা প্ৰাণে বাঁচার জন্যে ছোটাছুটি করছে। কেউ কেউ নদীতে ঝাপ দিয়ে পড়ে সীতারাবার চেষ্টা করছে। দূরে উদ্ধারকারী কিছু পাল তোলা নৌকাও দেখা যাচ্ছে। অথচ সোবাহান সাহেবের ছেলে সালুর (সালাউদ্দিন) এই দিকে কোনো নজরই নেই। সে এখন তাস খেলছে। নববধূও তাস নিয়ে বসেছে। সবাই খুব মজা পাচ্ছে। লঞ্চ যে তলিয়ে যাচ্ছে সেদিকে কারো ইশ নেই। সবাই এত মত্ত। সোবাহান সাহেব ঘুমের মধ্যেই চিৎকার করতে লাগলেন, এই গাধা, এই বেকুব, তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দেখা কী হচ্ছে। গাধারবাচ্চা গাধা, তাস পরে খেলবি দরজা খোল। দরজা খোল। দরজা খোল।
চিৎকারের এই পর্যায়ে শাহেদ তার গায়ে ধাক্কা দিয়ে ঘুম ভাঙায়। ঘুম ভাঙার পর ঘোরলাগা গলায় তিনি শাহেদকে যে প্রশ্নটা করেন তা হলো–দরজা খুলেছে? খুলেছে। দরজা?
দুঃস্বপ্ন দেখার পর থেকে সোবাহান সাহেব ছেলের জন্যে অস্থির হয়ে পড়েছেন। একটা মুরগি সদগা মানত করেছেন। সেই সঙ্গে একশ রাকাত নফল নামাজ। ফজরের নামাজের পর থেকে তার নফল নামাজ চলছে। আটটা বাজে। মাত্ৰ চল্লিশ রাকাত পড়া হয়েছে। শুরুর দিকে দাঁড়িয়েই পড়ছিলেন। হাঁটুতে আর্থরাইটিসে তীব্র ব্যথা শুরু হওয়ায় এখন আর দাঁড়িয়ে পড়তে পারছেন না। মাথাও বেশি নিচু করতে পারছেন না, কোমরে ব্যথা করছে। জায়নামাজের সামনে দুটা বালিশ রেখে সেজদার সময় কোনোমতে বালিশে মাথা ছোয়াচ্ছেন। কংকন দাদুভাইয়ের এই অদ্ভুত ভঙ্গির নামাজ পড়া দেখে খুব মজা পাচ্ছে। সোবাহান সাহেব যতবার বালিশে মাথা ছোয়াচ্ছেন ততবারই সে ফিক করে হেসে ফেলছে। আঙুল উচিয়ে শাহেদকেও এই মজার দৃশ্য দেখাচ্ছে। শাহেদের সঙ্গে এক রাতেই তার খুব ভাব হয়েছে। শাহেদকে সে ডাকছে বাবু। কেন বাবু ডাকছে সে-ই জানে। শিশুদের সব কর্মকাণ্ড ব্যাখ্যা করা কঠিন।
রাতে গোলাগুলির ভয়ে ঠাণ্ডা মেঝেতে শুয়ে থাকার জন্যে কংকনের গলা ব্যথা করছে। টনসিল ফুলে গেছে। তার মা মনোয়ারা গরম পানি দিয়ে মেয়েকে গাৰ্গল করানোর চেষ্টা করেছেন। সে গার্গল করতে পারছে না। মুখে পানি দিতেই সে পানি গিলে ফেলছে।
শাহেদ এক জায়গায় বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারছে না। তার সময় কাটছে হাঁটাহাঁটি করে। হাঁটাহাঁটি করার মতো বেশি জায়গা এ বাড়িতে নেই। সোবাহান সাহেবের ঘর থেকে বসার ঘর, সেখান থেকে বারান্দা। বারান্দা থেকে বসার ঘর, বসার ঘর থেকে আবার সোবাহান সাহেবের ঘর। তাঁতের মাকু চলছেই। বারান্দায় যেতে ভয় ভয় লাগে, কারণ বারান্দা থেকে রাস্তা দেখা যায়। রাস্তা দিয়ে কোনো মিলিটারি। যদি যায়। তারা বারান্দায় একজন কেউ হাঁটছে দেখতে পাবে। কিছুই বলা যায় না–গুলিও করে বসতে পারে।
কংকন বলল, তুমি শুধু হাঁট কেন?
শাহেদ জবাব দিল না। কী জবাব দেবে? সে কেন হাঁটছে সে নিজেই জানে না।
কংকন বলল, বাবু তোমার হাঁটতে ভালো লাগে, এই জন্যে তুমি হাঁট?
হ্যাঁ।
হাঁটতে ভালো লাগে কেন?
জানি না।
কেন জানো না?
মনোয়ারা রান্নাঘর থেকে বললেন, কংকন, বিরক্ত করবে না।
কংকন বলল, কেন বিরক্ত করব না?
তার প্রশ্ন করা খেলা শুরু হয়েছে। অবিকল রুনির স্বভাব। একবার প্রশ্ন করা শুরু করলে করতেই থাকবে। বিরক্ত করে মারবে। একবার তো চড় দিয়ে প্রশ্ন প্রশ্ন খেলা বন্ধ করতে হলো। টনসিালে গলাব্যথা রোগও রুনির আছে। একটু ঠাণ্ডা লাগল। তো গলায় ব্যথা। কিছুই গিলতে পারবে না। কাঁদো কাঁদো। গলায় মাকে বলবে, ব্যথা কমিয়ে দাও।
শাহেদ রুনির কথা বা রুনির মার কথা ভাবতে চাচ্ছে না। কিন্তু বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে। এই দুঃসময়ে তারা কোথায় আছে? কীভাবে আছে? আসমানী সারাৱাত জেগেছিল তা অনুমান করা যায়। রুনি কি ঘুমিয়েছিল? গোলাগুলির শব্দে নিশ্চয়ই খুব ভয় পেয়েছে। ভয় পেলে রুনির জ্বর এসে যায়। জ্বর হলে সমস্যা–সে বাবার কোল ছাড়া কারো কোলেই যাবে না। মেয়ে জ্বরে পড়লে আসমানী খুবই বিপদে পড়বে।
শাহেদ হাঁটাহাঁটি বন্ধ করে এখন বসার ঘরের বেতের চেয়ারে বসে আছে। ব্যাটারি না থাকার কারণে ট্রানজিস্ট্রর চলছে না। বাইরে কী হচ্ছে না হচ্ছে কিছুই বোঝার উপায় নেই। একতলা এই বাড়িটা অন্য বাড়ি থেকে আলাদা। প্রতিবেশীর কাছ থেকে খবর নেবার উপায় নেই। এই বাড়িটার উত্তর দিকে আরেকটা একতলা বাড়ি আছে। যেটা কাছাকাছি। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ডাক দিলে। ঐ বাড়ির লোকজন শুনতে পাবে। কিন্তু ঐ বাড়িতে কেউ নেই। তালা বন্ধ। শাহেদের আবারো চোখ জ্বালা করছে। বা চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। সে চোখ বন্ধ করল। মনোয়ারা এসে পাশে দাঁড়াল। তার হাতে চায়ের কাপ।
ভাই, একটু চা খান।
শাহেদ হাত বাড়িয়ে চা নিল। মনোয়ারা বলল, খিচুড়ি বসিয়েছি। আজকের নাশতা খিচুড়ি। ঘরে আটা-ময়দা কিছুই নাই।
শাহেদ বলল, বাজার আছে? চাল, ডাল, কেরোসিন?
মনোয়ারা বলল, এক দুই দিন চলবে। ও এসে বাজার করে দিবে বলেছিল। এখন তো তারই খোঁজ নেই।
শাহেদ বলল, কারফিউ তুললেই আমি বাজার করে দিয়ে যাব। নিশ্চয়ই কিছুক্ষণের জন্যে হলেও কারফিউ তুলবে। সমস্যা হচ্ছে, কারফিউ কখন তুলবে কতক্ষণের জন্যে তুলবে। এটা বুঝব কী করে? একটা রেডিওর খুব দরকার ছিল।
মনোয়ারা বলল, ভাই, আপনার কি সিগারেট খাবার অভ্যাস আছে? কংকনের বাবা তার সিগারেটের প্যাকেট ফেলে গেছে। সিগারেট খাবার অভ্যাস থাকলে প্যাকেটটা আপনাকে দিতে পারি।
দিন সিগারেট।
মনোয়ারা আঁচলের ভেতর থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। সে সিগারেট-দেয়াশলাই সঙ্গে নিয়েই এসেছিল। শাহেদ বলল, ভাবি, থ্যাংক য়ু। সিগারেটের প্যাকেটটা হাতে পেয়ে কী যে ভালো লাগছে, আপনি বুঝতেও পারবেন না।
মনোয়ারা বলল, আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না। আপনার মেয়ে আপনার স্ত্রী ভালো আছে। কারফিউ তুলে নিলেই ওদের সঙ্গে আপনার দেখা হবে।
শাহেদ বলল, কীভাবে জানেন? আমার মন বলছে। কাল রাতে তাহাৰ্জ্জুদের নামাজ পড়ে কংকনের বাবার জন্যে যেমন দোয়া করেছি, আপনার স্ত্রী এবং মেয়ের জন্যেও দোয়া করেছি। দোয়া শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে একটা শান্তি শান্তি ভাব হলো। তখনই বুঝলাম, আল্লাহপাক আমার দোয়া কবুল করেছেন। আমার কোনো দোয়া যখন কবুল হয়। আমি বুঝতে পারি।
শাহেদের চোখে সঙ্গে সঙ্গে পানি এসে গেল। নিতান্তই অপরিচিত এই মেয়েটির সামনে চোখ মুছতে তার মোটেও লজ্জা লাগল না।
রুনি সকালবেলা হড়হড় করে বমি করল। রাতে গুলির শব্দে ভয় পেয়ে দুবার বমি করেছে। এখন বেলা প্রায় এগারটা। সকালে কিছু খায় নি। বমি হওয়ার জন্যে পেটে তো কিছু থাকতে হবে। বমি হচ্ছে কেন? আসমানী দুহাতে মেয়ের মাথা ধরে আছে। ভয়ে তার হাত-পা কাঁপছে। মেয়ের গা অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা। এর মানে কী? জ্বর এসে গা গরম হতে পারে, ঠাণ্ডা হয়ে যাবে কেন? ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে যাচ্ছে না তো! বাচ্চাদের ভয়ঙ্কর কোনো অসুখ করলে আগেভাগে কিছু বোঝা যায় না। এরা হোসে-খেলে বেড়ায়, তারপর হঠাৎ এক সময় নেতিয়ে পড়ে। ডাক্তারের কাছে নেওয়ার সময়ও পাওয়া যায় না। এরকম কিছু হচ্ছে না তো? এরকম কিছু যদি হয়, সে ডাক্তারের কাছে কীভাবে নেবে?
বাইরে কারফিউ। কখন কারফিউ তুলবে কিছুই বলছে না। রেডিওতে সারাক্ষণ হামদ আর নাত হচ্ছে। ফাকে ফাঁকে জরুরি নির্দেশ। ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলছে–রাস্তায় কাউকে দেখা মাত্র গুলি করা হইবে।
আসমানী বলল, কেমন লাগছে রে মা?
রুনি বলল, ভালো।
আর বমি হবে?
না।
তাহলে আয়, মুখ ধুইয়ে দি।
না।
মুখ ধুবি না? মুখ ধুয়ে কুলি কর।
কুলি করব না।
মুখে না বললেও রুনি কুলি করল। আসমানী মেয়ের মুখ ধুইয়ে দিল।
শরীরটা এখন ভালো লাগছে মা?
লাগছে। বাবা কোথায় মা?
তোর বাবা আছে, ভালোই আছে।
কোথায় আছে?
বাসায় আছে। আর কোথায় থাকবে?
রুনি চোখ-মুখ শক্ত করে বলল, আমি বাবার কাছে যাব।
যাবে বললেই তো যে, ঐ পারবে না। বাইরে কারফিউ, মিলিটারি রাস্তায় কাউকে দেখলে গুলি করে দেবে।
আমি বাবার কাছে যাব।
কারফিউ তুললেই আমরা তোমার বাবার কাছে যাব।
আমি এখন যাব।
মা গো, অবুঝ হাইও না। এখন অবুঝ হবার সময় না।
আমি বাবার কাছে যাব। অবশ্যই যাব। যাবই যাব।
আসমানী মেয়ের গায়ে চড় বসিয়ে দিল। রুনি কাঁদল না। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। যতই দিন যাচ্ছে মেয়েটা ততই অবাধ্য হচ্ছে। এতটুকু একটা মেয়ের গায়ে হাত তুলতে হচ্ছে। অসুস্থ মেয়ে, শরীরে কিছু নেই–হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আছে। আসমানীর মন খুব খারাপ হয়ে গেল। কী করবে। সে? মেয়েকে কোলে নিয়ে আদর করবে? এখন তাও করা যাবে না। রুনি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। অনেক সময় লাগবে তার রাগ কমতে। আসমানী বলল, রুনি, মা, কথা শোন…।
রুনি বলল, আমি কথা শুনব না। আমি বাবার কাছে যাব। যাবই যাব।
আসমানী মেয়েকে বাথরুমে রেখেই বসার ঘরে চলে এলো। দুঃখ-কষ্টে তার প্রায় কান্না এসে যাচ্ছে। কী ভয়াবহ সমস্যায় যে পড়েছে! রাগ করে চলে এসেছিল কুমকুমাদের বাড়িতে। তার স্কুল এবং কলেজ জীবনের সবচে প্রিয় বান্ধবী কুমকুমা। রাগ করে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছে করলে সে এ-বাড়িতে এসে উঠে। কুমকুমের মা তাকে নিজের মেয়ের মতোই দেখেন। গত দুদিন ধরে সে এ-বাড়িতে আছে। তার আদর-যত্নের কোনো অভাব হচ্ছে না। মেয়েকে নিয়ে থাকার জন্য তাকে আলাদা একটা ঘর দেওয়া হয়েছে। কুমকুমের মা তাকে দিনের মধ্যে প্রায় একশবার বলছেন, মা, তুমি কোনোরকম ভয় করবে না। শুধু আল্লাহ আল্লাহ করো। কারফিউ তোলা মাত্র শাহেদকে খুঁজে এনে সবাই একসঙ্গে গ্রামে চলে যাব।
কুমকুমাদের বাড়ির সবাই সুটকেশ টু্যটকেস গুছিয়ে অপেক্ষা করছে। কারফিউ শেষ হবার জন্যে অপেক্ষা করছে। আসমানীর খুব অস্বস্তি লাগছে। তাছাড়া বড় কথা, কুমকুম। এ-বাড়িতে নেই। সে কুমিল্লায় তার শ্বশুরবাড়িতে। আসমানী যে কারো সঙ্গে গল্প করবে, কথা বলবে, সে উপায় নেই। কুমকুমের বাবা মোতালেব সাহেব আছেন। তিনি অবশ্যি সারাক্ষণই কথা বলেন। সেইসব কথা শুনতে আসমানীর ভালো লাগে না। কথা বলার সময় ভদ্রলোকের মুখ দিয়ে থুথু ছিটে বের হয়। দেখতে এত খারাপ লাগে–গা ঘিনঘিন করে।
বসার ঘরে মোতালেব সাহেব বসেছিলেন। তাঁর মুখ হাসি হাসি। দেখে মনে হয় তিনি বেশ আনন্দে আছেন। কিছু কিছু মানুষ দুঃসময়ে ভালো থাকে। দুঃসময়ের গল্পে আনন্দ পায়। ইনি বোধহয় সে-রকম একজন। আসমানীকে দেখে মোতালেব সাহেব আনন্দিত গলায় বললেন, লেটেস্ট খবর কি জানো নাকি মা?
আসমানী শুকনো গলায় বলল, জানি ন চাচা।
বাঙালি জাতির হাগা বের করে দিয়েছে। এখন তো যাকে বলে বেড়াছেড়া অবস্থা।
আসমানী বলল, জি।
এখন ধরে নিতে পার বাঙালি জাতি খতম। আর পাঁচ বছর পরে দেখবে সবাই উর্দুতে বাতচিৎ করছে। চারদিকে হাম করেঙ্গা, তুম করেঙ্গা।
আসমানী আবারও বলল, জি। তার এখন কোনো কিছুতেই কিছু যায় আসে না। শেখ সাহেব ধরা পড়লে ধরা পড়ুক, বাঙালি জাতি উর্দুতে কথা বললে বলুকি–তার এখন দরকার তার স্বামীকে। আর কিছু দরকার নেই। সে প্রতিজ্ঞা করল, বাকি জীবনে সে আর কখনোই রাগ করে শাহেদকে ছেড়ে কোথাও যাবে। না। ভয়ঙ্কর রাগারগি হোক, শাহেদ তার গায়ে থুথু দিক–তারপরেও না।
আসমানী!
জি।
একটা স্ট্রং রিউমার হচ্ছে, মিলিটারি সেকেন্ড অফেনসিভে যাবে। আরো ম্যাসিভ স্কেলে। গতরাতে যেটা হয়েছে সেটা হলো তবলার ঠিকঠাক। আসল পাজনা এখনো শুরু হয় নাই। তবে ওদের মূল টার্গেট শহর। আপাতত গ্রামে তারা হাত দেবে না। শহর পুরোপুরি শেষ করার পর ধরবে গ্রাম। কাজেই আমাদের গ্রামে চলে যেতে হবে।
আসমানী আবারও কিছু না বুঝেই বলল, জি। সে কিছুতেই বুঝতে পারছে। না ভয়ঙ্কর কথাগুলি বলে এই বুড়ো মানুষটা অত আনন্দিত হচ্ছে কেন?
শাহেদের আমরা যদি ট্রেস করতে না পারি, তাহলে ওকে ছাড়াই যেতে হবে। এখন অবস্থাটা হচ্ছে ইয়া নফসি অবস্থা। বুঝতে পারছি? শুধু নিজে বেঁচে থাক।
জি
কাজেই তৈরি হয়ে নাও। বুড়িগঙ্গা দিয়ে নৌকা করে যাব। নদীপথ এখনো সেফ। ওরা পানি ভয় পায়।
বাথরুম থেকে হাড়হড় শ, আসছে। রুনি আবারও বমি করছে। আসমানী ছুটে গেল বাথরুমের দিকে। তার মনেই ছিল না মেয়েকে সে রাগ করে বাথরুমে রেখে এসেছে।
কারফিউ উঠল। পরদিন ২৭ মার্চ শনিবার ভোর নটায়। তিন ঘণ্টার জন্য কারফিউ তোলা হয়েছে।
রাস্তায় প্রচুর লোকজন। ভূমিকম্প হলে বাড়িঘরের ভেতর থেকে সব মানুষ বের হয়ে আসে। কিন্তু তাদের মনটা থাকে বাড়ির ভেতরে। শহরের মানুষের অবস্থাটা সে-রকম। তারা রাস্তায় এসেছে ঠিকই কিন্তু মনেপ্ৰাণে চাইছে আবার ঘরে ঢুকে যেতে। সবার চোখেমুখে অনিদ্রাজনিত গভীর ক্লান্তি। এরা কেউ গত দুরাত ঘুমোয় নি। মানুষের তৈরি দুর্যোগে একটা শহরের সব মানুষ দুরাত জেগে কাটিয়েছে এমন নজির বোধহয় নেই।
শাহেদ রিকশা নিল। মাত্র তিনঘণ্টার জন্যে কারফিউ তোলা হয়েছে, তার হাতে একেবারেই সময় নেই। কংকনদের বাসা থেকে বের হতে অনেক সময় লেগেছে। সোবাহান সাহেব কিছুতেই তাকে যেতে দেবেন না। কংকনও তার হাত ধরে রেখেছে। সেও তাকে যেতে দেবে না। কাঁদো কাঁদো গলায় বলছে, বাবু তুমি থাক। বাবু তুমি থাক।
রিকশাওয়ালা বুড়ে ধরনের। সে রিকশা টানতে পারছে না। বুড়োদের কৌতূহল থাকে কম। তার কৌতূহলও বেশি। জায়গায় জায়গায় থামছে। অবাক হয়ে দেখছে–যেখানে বস্তি ছিল এখন নেই, কিছু কালো অঙ্গার পড়ে আছে। শাহেদের ইচ্ছা করছে রিকশাওয়ালাকে বলে, অবাক হয়ে দেখার সময় এটা না। এখন মাথা নিচু করে প্ৰিয়জনদের সন্ধানে যাবার সময়। সে কিছু বলল না। রিকশাওয়ালা নিজের মনে বলল, ইকবাল হলের বেবাক ছাত্র মাইরা ফেলছে।
বিশ্বাসযোগ্য কথা না। তবে সময়টা এমন যে কোনটা বিশ্বাসযোগ্য। আর কোনটা না বোঝা যায় না। মেরে ফেলতেও পারে। ঢাকা শহরের সব মানুষ মেরে ফেললেও বা কী আর করা যাবে!
শাহেদ বলল, ইকবাল হলের সব ছাত্র মেরে ফেলেছে?
হ।
তুমি দেখেছ?
হ। দেখছি।
আর কী দেখেছি?
গজব দেখছি। গজব। রোজ-হাসরের কিয়ামত দেখছি।
গজব তো বটেই। এই গজবের শেষ কোথায় কে বলবে। ঢাকা কলেজের সামনে একটা মিলিটারি জিপ থেমে আছে। একজন অফিসার এবং দুজন জোয়ান জিপের কাছেই দাঁড়িয়ে। অফিসারটি হাসিমুখে গল্প করছে। জোয়ান দুজন এটেনশান ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকলেও আগ্রহ নিয়ে গল্প শুনছে। শাহেদ মাথা নিচু করে ফেলল যেন এদের সঙ্গে চোখাচোখি না হয়। শাহেদের হাতে সিগারেট, তার জন্যই কেমন ভয় ভয় লাগছে। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট দেখলে এরা রাগ করবে না তো? সিগারেটটা কি ফেলে দেওয়া উচিত? মুখে কী কারণে যেন থুথু জমছে। থুথু ফেলা নিশ্চয়ই ঠিক হবে না। এরা অন্য কিছু ভেবে বসতে পারে। এরা গল্প করুক এদের মতো। আমরা তাদের সামনে দিয়ে মাথা নিচু করে চলে যাব।
শাহেদ আসমানীর খোজে। প্রথম গেল তার শ্বশুরবাড়িতে। সেই বাড়ি তালাবদ্ধ। পাশের বাড়ির ভদ্রলোক বললেন, আধঘণ্টা আগে একটা গাড়িতে করে সবাই চলে গেছে। গাড়িতে কে কে ছিল তা তিনি বলতে পারলেন না। বাড়ি ছেড়ে কেন গেল তাও তিনি জানেন না। শাহেদের সঙ্গে কথা বলতে তার বোধহয় বিরক্তি লাগছিল। তিনি একটু পরপর ভুরু কোঁচকাচ্ছিলেন। এই ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলে সময় নষ্ট করা অর্থহীন, তবু শাহেদের নড়তে ইচ্ছা করছে না! মনে হচ্ছে তার হাত-পা শক্ত হয়ে গেছে। আবার যে হেঁটে গিয়ে রিকশায় উঠবে। সেই শক্তি নেই। এখন সে যাবে কোথায়? তার নিজের বাসায়? আগে সেখানেই যাওয়া উচিত ছিল। আসমানী নিশ্চয়ই সেই বাসাতেই তার খোজে লোক পাঠিয়েছে। শাশুড়িও গাড়ি নিয়ে নিশ্চয়ই সেখানে গেছেন। শাহেদ ঘড়ি দেখল। তিন ঘণ্টার জন্য কারফিউ তোলা হয়েছে–এক ঘণ্টা পার হয়ে গেছে, আর মাত্র দুই ঘণ্টা বাকি। এর মধ্যেই নিজের আস্তানায় ফিরে যেতে হবে, দেরি করা যাবে। না। সময় এত দ্রুত যাচ্ছে কেন?
দোকানপাট কিছু কিছু খুলছে। লোকজন ব্যস্ত হয়ে কেনাকাটা করছে। কাঁচাবাজারে খুব ভিড়। চাল, ডাল কিনে জমিয়ে রাখতে হবে। আবার কতদিনের জন্য কারফিউ দিয়ে দেয় কে জানে লোকজনের কেনাকাটা, ব্যস্ততা দেখে মনে হয় শহরের অবস্থা স্বাভাবিক।
রিকশাওয়ালা আবারো নিজের মনে বলল, শেখ সাবরে মাইরা ফেলছে। শাহেদ হতভম্ব হয়ে বলল, বিলো কী? সত্যি? হ। সত্যি। শেখ সাব নাই বইল্যা আইজ এই অবস্থা। থাকলে ঘটনা হইত उिला।
শাহেদ সিগারেট ধরালো। প্যাকেটের শেষ সিগারেট। সিগারেট কিনতে হবে। রিকশা থামিয়ে রাস্তার কোনো দোকান থেকে কয়েক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে নেবে। খুব কড়া রোদ উঠেছে, চিড়চিড় করে মাথা ঘুরছে। রিকশার হুড কি সে তুলে দেবে? না থাক, হুড তুলে দেওয়া মানে কিছু গোপন করার চেষ্টা। শাহেদ আকাশের দিকে তাকাল। আকাশ ঘন নীল। এমন নীল আকাশ বোধহয় অনেক দিন দেখা যায় নি। আকাশের দিকে তাকিয়ে শাহেদের মনে হলো, আসমানী ফিবে এসেছে। ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষা করছে। রুনি মনের আনন্দে খেলছে। বাবাকে দেখে সে দৌড়ে এসে কোলে ঝাঁপিয়ে পড়বে। গালের সঙ্গে মাথা ঘষবে। একেকটা শিশু একেকরকম বিচিত্র অভ্যাস নিয়ে পৃথিবীতে জন্মায়। রুনি পেয়েছে গালে মাথা ঘষার অভ্যাস। কী জন্য এই জাতীয় অভ্যাস তৈরি হয়েছে কে জানে। সাইকিয়াট্রিক্টরা নিশ্চয়ই জানেন।
রিকশায় এক ভদ্রলোক যাচ্ছেন। পাশে খুব সম্ভব তার স্ত্রী। তিনি স্ত্রীকে জড়িয়ে আছেন। ভদ্রমহিলা শব্দ করে কাঁদছেন। ভদ্রলোক তাতে খুব বিরক্ত বোধ করছেন। তিনি হতাশ বোধে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। সে সময়মতো ফিরতে না পারলে আসমানীও নিশ্চয়ই এভাবে কাঁদবে।
শাহেদের বাড়ির দরজা তালাবদ্ধ। আসমানী ফেরে নি।
সে এখন কী করবে? এখানেই থাকবে না-কি ফিরে যাবে কংকনদের বাড়িতে? সে কথা দিয়ে এসেছিল ফিরে যাবে। তার যাওয়া উচিত। ওদের বাড়িতে চাল-ডাল নেই। চাল-ডাল কিনে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। বাচ্চাটার জন্যে এন্টিবায়োটিক কিনতে হবে। তার গলা ফুলে গেছে। অবিকল রুনির মতো অবস্থা। গাৰ্গল ফাৰ্গলে কোনো কাজ করে না। এন্টিবায়োটিক নিতে হয়। এন্টিবায়োটিকের নামটা মনে আছে— ওরাসিন কে। কোনো ফার্মেসি কি খুলেছে?
শাহেদ রাস্তায় নামল। হাতে সময় কতটা আছে সে বুঝতে পারছে না। ঘড়ি দেখলেই মনে হবে হাতে সময় নেই। লোকজন যেহেতু চলছে–কারফিউ শুরু হয় নি। একটা খোলা ফার্মেসি দেখা যাচ্ছে। সেখানেও ভিড়। শাহেদ ওরাসিন কে সিরাপ কিনল। দোকানদার এমনভাবে ওষুধ দিচ্ছে টাকা নিচ্ছে যেন সব আগের মতোই চলছে। সব ঠিক আছে।
কোনো রিকশা চোখে পড়ছে না। সে রিকশার খোজে হেঁটে হেঁটে রেলগেট পর্যন্ত আসার পর চোখে পড়ল তিনজন মিলিটারির একটা দল। এদের মধ্যে একজনের পোশাক আবার অন্যরকম। কালো পোশাক। কালো পোশাকের মিলিটারি সে আগে দেখে নি। তাদের একজন হাত ইশারায় তাকে ডাকছে। কেন তাকে ডাকছে? সে চোখে ভুল দেখছে না তো?
না, তাকে ডাকছে না। তার কী করা উচিত? সে কি মিলিটারিটার দিকে তাকিয়ে ভদ্রতার হাসি হাসবে? সেটাও মনে হয় ঠিক হবে না। হাসির অন্য অর্থ করে ফেলতে পারে। তার উচিত এই জায়গা থেকে অতি দ্রুত সরে পড়া। অতি দ্রুত সরাটাও ঠিক হবে না। মিলিটারিরা ভাবতে পারে লোকটা এত দ্রুত যাচ্ছে কেন? নিশ্চয়ই খারাপ লোক।
সোবাহান সাহেব শাহেদকে দেখে আনন্দে প্ৰায় চিৎকার করে উঠলেন। রান্নাঘরের দিকে মুখ করে পুত্রবধূকে ডাকলেন। বৌমা, তাড়াতাড়ি আসো। শাহেদ চলে এসেছে।
কংকন মার ঘরে শুয়েছিল। সোবাহান সাহেব তার কাছেও গেলেন, হড়বড় করে বললেন, শুয়ে আছিস কেন? উঠে আয়, শাহেদ এসেছে। তোর বাবু এসেছে।
সোবাহান সাহেবকে দেখে মনে হচ্ছে, এখন আর তাঁর মনে কোনো ভয়ভীতি নেই। তিনি নিশ্চিন্ত একজন কেউ এসেছে। মহাসঙ্কটের দীর্ঘ দিবস। দীর্ঘ রজনীর দায়-দায়িত্ব এখন তার।
শাহেদের আনা জিনিসপত্র দেখে মনোয়ারা বিস্মিত হলো। সবই এনেছে। চাল-ডাল-তেল, কেরোসিন, ময়দা, ব্যাটারি। সবচে আশ্চর্যের ব্যাপার, কংকনের জন্যে ওষুধও এসেছে। মনোয়ারা বললেন, ভাই, আপনি খুব গোছানো মানুষ।
শাহেদ বলল, বিপদের সময় সব মানুষ বদলায়। আমি কোনোকালেই গোছানো ছিলাম না।
মনোয়ারা বললেন, পৃথিবীর সবচে অগোছালো মানুষ কংকনের বাবা। একবার কী হলো শুনুন। আমার প্রচণ্ড মাথা ধরা। মাথা ছিঁড়ে পড়ে যাচ্ছে এরকম অবস্থা। কংকনের বাবাকে ফার্মেসিতে পাঠালাম মাথা ধরার ট্যাবলেট আনতে। সে দুঘণ্টা পরে ফিরল। রাজ্যের বাজার করে এনেছে। কাঁচাবাজার থেকে মাছমাংস কিনেছে, শাক-সবজি কিনেছে, পেয়ারা কিনেছে, কলা কিনেছেমাথাব্যথার ট্যাবলেট শুধু কিনে নি। ভুলে গেছে। ভুলো মন মানুষের সঙ্গে সংসার করা খুবই কষ্ট।
শাহেদ বলল, ভুলো মন মানুষের সঙ্গে সংসার করার অন্য ধরনের আনন্দও আছে।
মনোয়ারা বললেন, ঠিক বলেছেন। আনন্দও আছে। একবার কী হয়েছে শুনুন। কংকনের তখানা জন্ম হয় নি–রাতে আমাদের এক বিয়ের দাওয়াতে যাবার কথা। ও করল কী…।
মনোয়ারা হঠাৎ গল্পটা থামিয়ে দিল। তার সামনে যে মানুষটা বসে আছে সে অপবিচিত একজন মানুষ। এই মানুষটির সঙ্গে নিতান্তই ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কথা বলা যায় না।
শাহেদ বলল, ভাবি, গল্পটা শেষ করবেন না?
মনোয়ারা বললেন, আরেকদিন শেষ করব। আপনাকে আসল কথাই জিজ্ঞেস করা হয় নি। আপনার স্ত্রীর খোঁজ পেয়েছেন?
শাহেদ বলল, না। ওর মার বাসায় গিয়েছিলাম। বাসা তালাবন্ধ। আশেপাশে কেউ কিছু জানে না।
মনোয়ারা বললেন, ভাই, আপনি নিশ্চিন্ত থাকেন। তারা নিরাপদে আছে এবং ভালো আছে।
কীভাবে বলছেন?
আমার মন বলছে। আমার মন যা বলে তা ঠিক হয়।
সোবাহান সাহেব ব্যাটারি লাগিয়ে ট্রানজিস্টার চালু করেছেন। নিচু ভলিউমে ক্ৰমাগত রেডিও শুনে যাচ্ছেন। সামরিক নির্দেশাবলি প্রচারিত হচ্ছে। তিনি প্রতিটি নির্দেশ মন দিয়ে শুনছেন। অবাঙালি একজন কেউ বাংলায় বলছে। অদ্ভুত বাংলা–সময়কে বলছে সুময়। গুজবকে বলছে গজব। গজবে কান ডিবেন না। সোবাহান সাহেবের মনে হলো–এরা কি রেডিওর সব বাঙালিদের মেরে ফেলেছে? নির্দেশগুলি পড়ার মতো বাঙালি নেই।
সামরিক নির্দেশাবলির পর প্রচারিত হলো যন্ত্রসঙ্গীত। যন্ত্রসঙ্গীতের পর স্বাস্থ্যবিষয়ক কথিকা। বিষয় জলবসন্ত। সোবাহান সাহেব জলবসন্ত বিষয়ক কথিকাও অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে শুনলেন। জলবসন্তে এন্টিবায়োটিক কোনো কাজে আসে না–এই তথ্য তাঁর কাছে হঠাৎ করেই খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো। এখন তাঁকে দেখে গত রাতের সোবাহান সাহেব বলে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে মোটামুটিভাবে আনন্দে আছেন এমন একজন মানুষ। যে মানুষটি। কানের কাছে ট্রানজিস্টার রেডিও ধরে রাখার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ পেয়েছেন। রেডিওতে পাওয়া খবর অন্যদের জানানোর বিষয়েও তাকে উৎসাহী মনে হচ্ছে। শাহেদকে বললেন, ভালো খবর আছে, আগামীকালও দুঘণ্টার জন্যে কার্ফ তোলা হবে। এমনিতে দুঘণ্টা কম সময় মনে হয়, আসলে কিন্তু অনেক সময়। দুই ঘণ্টায় দুনিয়ার কাজ করে ফেলা যায়। কাল মনে করে আরো ব্যাটারি কিনবে।
মনোয়ারাকে রাতে কী রান্না হবে সেই বিষয়ে বললেন, বৌমা খিচুড়ি রান্না করো। বর্ষা বাদলায় আনন্দের দিনে খিচুড়ি খেতে হয়, আবার বিপদে-আপদেও খিচুড়ি খেতে হয়। পাতলা খিচুড়ি সঙ্গে ডিমভুনা।
খিচুড়ি ডিমভুনা খেতে খেতে রাত দশটা বেজে গেল। তার পরপরই উত্তর দিক থেকে প্রবল গোলাগুলির শব্দ আসতে লাগল। গতকালের মতোই অবস্থা। রাস্তায় ভারী মিলিটারি গাড়ির চলার শব্দ কিছুক্ষণ পরপরই শোনা যাচ্ছে। গোলাগুলির সঙ্গে বুম বুম শব্দের বিকট আওয়াজও কানে আসছে। এই শব্দ কিসের তা সোবাহান সাহেব বুঝতে পারছেন না। তিনি চিন্তিত গলায় শাহেদকে বললেন, বুম বুম শব্দটা কিসের? শাহেদ বলল, জানি না। চাচা। কামান দাগছে না-কি? কামান দাগছে কী জন্যে?
রাত বারটার দিকে শব্দ আসতে শুরু করল পশ্চিম দিক থেকে। এই শব্দ অনেক কাছ থেকে আসছে। গুলি মনে হচ্ছে শী শী শব্দ করে এই বাড়ির ছাদের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। সোবাহান সাহেব ভীত গলায় বললেন, সবাই মেঝেতে শুয়ে থাকে। সবাই একঘরে শোও। মহাআজাবের সময় আত্মীয়-অনাত্মীয় নারীপুরুষে কোনো ভেদাভেদ নাই। শাহেদ, তুমিও আমাদের সঙ্গে শুয়ে থাকে।
বসার ঘরের মেঝেতে সবাই শুয়ে আছে। কংকন শুয়েছে শাহেদের পাশে। সে একটা পা শাহেদের গায়ে তুলে দিয়েছে। রুনি এইভাবে ঘুমায় না। সে হাতপা গুটিয়ে পুটলির মতো শুয়ে থাকে। একটা আঙুল থাকে তার মুখে। ঘুমের মধ্যে সে আঙুল চুষতে থাকে। খুবই খারাপ অভ্যাস।
সোবাহান সাহেব অত্যন্ত ভয় পেয়েছেন। ভয়ের কারণে হঠাৎ তার কথা জড়িয়ে যেতে শুরু করেছে। তিনি বললেন, সবাই একমনে আল্লাহপাকের নাম নাও–আমাদের বড়পীর সাহেব আবদুল কাদের জিলানি সব সময় যে জপ। করতেন। ঐটা করো। এক মনে বলো–লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।
কংকন বলল, বাতি জ্বালাও, আমার ভয় লাগে। সোবাহান সাহেব বললেন, বাতি জ্বালানো যাবে না।
গুলির শব্দ আরো কাছে এগিয়ে এসেছে। মানুষজনের চিৎকার শোনা যাচ্ছে। সোবাহান সাহেব শব্দ করেই জিগির করছেন–লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।
মাত্র দুঘণ্টার জন্যে কারফিউ-বিরতি
মাত্র দুঘণ্টার জন্যে কারফিউ-বিরতি।
এই দুঘণ্টায় শাহেদকে অনেক কাজ করতে হবে। যেভাবেই হোক আসমানীর খোঁজ বের করতে হবে। সে নিশ্চিত আজি খোঁজ পাওয়া যাবে। সে যেমন আসমানীর খোঁজ বের করার চেষ্টা করছে, আসমানীও নিশ্চয়ই করছে। প্ৰথমবার কারফিউ তোলা ছিল আকস্মিক । হঠাৎ করে আসমানীরা খবর পেয়েছে দুঘণ্টার জন্যে কারফিউ নেই। তৎক্ষণাৎ কোনো ব্যবস্থা করতে পারে নি। আজকেরটা আগেভাগেই জানা। কাজেই আসমানী নিশ্চয়ই প্ল্যান করে রেখেছে। শাহেদ ঠিক করেছে সে প্রথমে যাবে শ্বশুরবাড়িতে। সেখানে কোনো খোঁজ না বের করতে পারলে নিজের বাসায় এসে বসে থাকবে। তবে আজ খবর পাওয়া যাবেই। গতরাতে সে একটা ভালো স্বপ্ন দেখেছে। সেই স্বপ্নের একটাই অর্থ। আসমানীর সঙ্গে দেখা হবে। স্বপ্নে সে নিজের ঘরের বারান্দায় বসে হাউমাউ করে কাঁদছে, এমন সময় তার বড় ভাই ইরতাজউদ্দিন বারান্দায় এসে বিরক্ত গলায় বললেন, কাদছিস কেনরে গাধা? সে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, আসমানীর খোঁজ পাচ্ছি না। ইরতাজউদ্দিন বললেন, ঘরে বসে ভেউ ভেউ করে কাঁদলে খোঁজ পাবি কী করে? আয় আমার সঙ্গে। দুজন রাস্তায় নামল। রাস্তায় প্রচুর লোকজন। তাদের মধ্যেই দেখা গেল, একটা ঠেলাগাড়িতে আসমানী বসে আছে। সে খুব সুন্দর করে সেজেছে। তার গা ভর্তি গয়না। মুখে চন্দনের ফোঁটা দেয়া। পরনের শাড়িটাও মনে হচ্ছে বিয়ের শাড়ি। শাহেদ ঠেলাগাড়ির দিকে অতি দ্রুত যাবার চেষ্টা করছে। এত লোকজন যে যাওয়া যাচ্ছে না। তবে আসমানী তাকে দেখতে পেয়েছে। সে হাসছে।
ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয়। এই স্বপ্ন অবশ্যই সত্যি হবে। শাহেদ অতি দ্রুত হাঁটছে। স্বপ্নে যেমন দেখেছিল রাস্তায় প্রচুর মানুষ, বাস্তবেও তাই দেখা যাচ্ছে। প্রচুর লোক। মনে হয় শহরের সমস্ত লোকজন এক সঙ্গে পথে নেমেছে। রিকশাও নেমেছে, তবে সংখ্যায় কম। খালি রিকশা দেখা মাত্র শাহেদ ছুটে যাচ্ছে। রিকশা কি কলাবাগান যাবে? প্রতিটি রিকশাওয়ালাই এই প্রশ্নের জবাব দিতে অনেক সময় নিচ্ছে। চট করে বলে দিলেই হয় যাবে না। তা না করে একেকজন আকাশ-পাতাল ভাবছে। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। রাস্তায় থুথু ফেলছে। কপালের ঘাম মুছছে। তারপর বিড়বিড় করে বলছে–ঐ দিকে যামু। না। রিকশা ঠিক করতে যাওয়া মানে সময় নষ্ট। এখন প্রতিটি সেকেন্ড মূল্যবান। মূল্যবান সেকেন্ডের একটিও নষ্ট করা ঠিক না।
সায়েন্স ল্যাবরেটরির মোড়ে এসে শাহেদ রিকশা পেল। এই রিকশা পাওয়া না-পাওয়া একই। জোয়ান রিকশাওয়ালা অথচ সে রিকশা টানতেই পারছে না। পায়ে হেঁটে এরচে দ্রুত যাওয়া যায়। শাহেদ বলল, ভাই একটু তাড়াতাড়ি যান। রিকশাওয়ালা ঘাড় ঘুরিয়ে শাহেদের কথা শুনল। তার রিকশার গতি আরো শ্লথ হয়ে গেল। শাহেদের ইচ্ছা করছে, লাফ দিয়ে রিকশা থেকে নেমে হাঁটা শুরু করে।
কলাবাগানের কাছাকাছি এসে সে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখল। রঙিন কাগজ দিয়ে সাজানো একটা ঘোড়ার গাড়ি। গাড়িতে পাকিস্তানি পতাকা উড়ছে। গাড়ির ভেতর বার-তের বছর বয়েসী একটা কিশোরী। তার পরনে ঘাঘড়া। চুল লাল। কিশোরীকে ঘিরে চারজন যুবক। সবাই পান খাচ্ছে। তাদের মুখ আনন্দে উজ্জ্বল। তারা কি কোনো উৎসবে যাচ্ছে? বিয়ের উৎসব নিশ্চয়ই না। অন্য কোনো উৎসব। এরা বিহারি। বিহারিরা উৎসব করতে পছন্দ করে। আজকের এই দুঃসময় তাদের জন্যে না। এরা দুঃসময়ের বাইরে।
শাহেদ শ্বশুরবাড়িতে কাউকে পেল না। বাড়ির সামনের চায়ের দোকানটা খুলেছে। দোকানদার কিছু বলতে পারল না। আশেপাশে চার-পাঁচটা বাড়িতে সে গেল। তারাও কিছু জানে না। একজন শুধু বলল, কালো রঙের একটা প্ৰাইভেট গাড়িতে করে সবাই চলে গেছে। কখন গেছে, কবে গেছে সেটা আবাব বলতে পারছে না।
শাহেদ নিজের বাড়িতে ফিরল কারফিউর মেয়াদ শেষ হবার আধঘণ্টা আগে। গেট খুলে ভেতরে ঢোকার সময় হঠাৎ মনে হলো, তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে–এক্ষুনি বোধহয় সে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। বাসার সদর দরজায় তালা নেই। বাড়িতে লোক আছে। অবশ্যই আসমানী ফিরেছে। চাবি দিয়ে সদর দরজা খুলেছে। বাড়ির অন্য দরজা-জানোলা সবই বন্ধ। এটাই স্বাভাবিক। এই সময়ে কেউ দরজা-জানালা খোলে না। শাহেদ দ্রুত চিন্তা করছে–চাল-ডাল কি আছে? আসমানী খুব গোছানো মেয়ে। সবকিছুই থাকার কথা। কেরোসিন আছে কি-না কে জানে। যদি না থাকে এক্ষুণি নিয়ে আসতে হবে। আধঘণ্টা সময় এখনো হাতে আছে। সে দেখে এসেছে রাস্তার মোড়ের বড় দোকানটা খোলা। কেরোসিন চা-পাতা চিনি। আসমানী একটু পর পর চা খায়। কড়া মিষ্টির ঘন চা। শাহেদ ঠিক করতে পারছে না–সে কি বাসায় না। ঢুকে আগে বাজারটা করে নিয়ে আসবে? না-কি আগে আসমানীর সঙ্গে দেখা করে বলবেভয় নাই আমি আছি। তাকে না দেখে আসমানী নিশ্চয়ই ভয়ে অস্থির হয়ে আছে। তবে আসমানীর সঙ্গে দেখা হলে একটা বিপদ হবে। রুনি তাকে দেখা মাত্ৰ বাপ দিয়ে কোলে উঠে পড়বে। তাকে তখন কোল থেকে নামানো যাবে না। দোকানে যেতে হলে তাকে কোলে নিয়েই যেতে হবে।
সদর দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। শাহেদ অনেকক্ষণ দরজা ধাক্কাবার পর ভেতর থেকে ভীত পুরুষগলা শোনা গেল— কে?
শাহেদ বলল, আমি শাহেদ। দরজা খুলেন।
দরজা খুলল। শাহেদ অবাক হয়ে দেখে, দরজার ওপাশে গৌরাঙ্গ দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখভর্তি খোচা খোচা দাড়ি। চোখ হলুদ। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, সে বিরাট কোনো অসুখ থেকে উঠেছে।
শাহেদ বলল, তুমি কোত্থেকে?
গৌরাঙ্গ জবাব দিল না। শাহেদ আবার বলল, তুমি কোথেকে? গৌরাঙ্গ এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন সে শাহেদের কথা বুঝতেই পারছে না। শাহেদ বলল, বাসায় আর কেউ আছে?
গৌরাঙ্গ বলল, না।
শাহেদ বলল, তুমি বাসায় ঢুকলে কীভাবে?
গৌরাঙ্গ বিড়বিড় করে বলল, তালা ভেঙে ঢুকেছি। মিতা, আমার কোনোখানে যাবার জায়গা নাই। তুমি যদি বের করে দাও, মিলিটারিরা আমাকে মেরে ফেলবে।
শাহেদ বলল, আমি বের করে দেব কেন?
গৌরাঙ্গ জবাব দিচ্ছে না। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শাহেদের দিকে। শাহেদ বলল, তোমার বৌ-মেয়ে ওরা কোথায়?
শাহেদ বিড়বিড় করে বলল, ওরা ভালো আছে।
তারা কোথায়?
আমার শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে। আমি তোমার সঙ্গে থাকব।
শাহেদ বলল, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমি আমার সঙ্গে থাকবে কেন?
গৌরাঙ্গ আগের মতোই অস্পষ্ট গলায় বলল, মিতা, আমি তোমার সঙ্গে থাকব। আমার সঙ্গে টাকা আছে। শ্বশুরমশাই যে টাকাটা দিয়েছেন, সবটা আমার সঙ্গে আছে। তুমি টাকাটা নাও। খরচ করো। শুধু আমাকে থাকতে দাও।
শাহেদ হতভম্ব গলায় বলল, ঠিক করে বলো তো–ভাবি, বাচ্চ ওরা কোথায়?
গৌরাঙ্গ বলল, বলেছি তো ওরা ভালো আছে। দুজনই ভালো আছে। মেয়েটার জ্বর এসেছিল, এখন মনে হয় জ্বর কমেছে। আমার নিজের শরীরও ভালো না। আমি তোমার এখানে বিশ্রাম নিতে এসেছি। সারাক্ষণ আমার মাথা ঘোরে। মিতা, আমার ক্ষিধাও লেগেছে। তুমি আমাকে কিছু খাওয়াও। টাকা নিয়ে চিন্তা করবে না। আমার কাছে টাকা আছে। মিতা, আমি এখন শুয়ে থাকব। খাবার জোগাড় হলে আমাকে ডেকে তুলবে।
গৌরাঙ্গ সন্ধ্যা পর্যন্ত মরার মতো ঘুমাল। কয়েকবার চেষ্টা করেও শাহেদ তাকে তুলতে পারল না। সন্ধ্যার পর পর সে নিজেই জেগে উঠল। শাহেদ বলল, এখন শরীর কেমন? মাথা ঘোরা কমেছে?
গৌরাঙ্গ বলল, শরীর ভালো আছে। আমার বাচ্চাটাকে মিলিটারিরা মেরে ফেলেছে—এই জন্যে মনটা সামান্য খারাপ।
ভাবি? ভাবি কোথায়?
ওরা তাকে তুলে নিয়ে গেছে। বঁচিয়ে রেখেছে কি-না। আমি জানি না। মেরে ফেললে তার জন্যেও ভালো, সবার জন্যেই ভালো। আমার শ্বশুরসাহেবও মারা গেছেন। মিতা, তোমাকে স্থা বলেছি। সব গোপন রাখবে। মিলিটারি যদি শুনে তাদের নামে আজেবাজে কথা বলছি, তাহলে তারা রাগ করবে। আমাকেও ধরে নিয়ে যাবে। মিলিটারিদের দোষ কী! ওরা হুকুমের চাকর। ওদের যেভাবে হুকুম দিয়েছে, ওরা সেইভাবে কাজ করেছে। তাই না?
শাহেদ বলল, ভাবিকে যখন ওরা নিয়ে যাচ্ছিল তুমি কোথায় ছিলে? আমি দরজার আড়ালে বসে ছিলাম। ওরা সব ওলট পালট করে দেখেছে, শুধু দরজার আড়ালটা দেখে নাই। সবই ভগবানের লীলা। মিতা, তোমাকে যা বললাম সব গোপন রাখবে। কোনে কিছুই যেন প্ৰকাশ না হয়। মিলিটারির কানো গেলে তোমার বিপদ। আমারও বিপদ।
শাহেদ বলল, ভাত-ডাল রান্না করেছি, খেতে আসো।
গৌরাঙ্গ বলল, ঠিক আছে। খুবই ক্ষুধা লেগেছে। ইলিশ মাছের পাতুরি খেতে ইচ্ছা করছে। গরম ধোঁয়া উঠা ভাত, ইলিশ মাছের পাতুরি।
কথা শেষ করেই গৌরাঙ্গ বিছানায় শুয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গেই ঘুম। শাহেদ তার পাশেই বসে আছে। মানুষটা ঘুমের মধ্যে কাঁদছে। ঘুমের মধ্যে কাদার দৃশ্যটা যে দেখতে এত ভয়ঙ্কর তা শাহেদ আগে কখনো বুঝতে পারে নি।
রাত বাড়ছে। ইলেকট্রসিটি সন্ধ্যা থেকেই নেই। ঘর অন্ধকার না। শাহেদ টেবিলের উপর পাশাপাশি দুটা মোমবাতি জ্বলিয়েছে। মোমবাতি পাওয়া গেছে রান্নাঘরের তাকে। আসমানী রান্নাঘরের দরজায় লিস্ট টানিয়ে রেখেছে। কোন জিনিসটি কোথায় তার তালিকা। প্রায়ই সে বাবার বাড়ি চলে যায়, তালিকাটা সে জন্যেই। আজ এই তালিকা পড়তে গিয়ে শাহেদের চোখে পানি এসে গেছে।
চাল, ডাল, মুড়ি–টিনে ভরা। রুনির ঘরে। চৌকির নিচে।
কাপড় ধোবার সাবান, মোমবাতি, দেয়াশলাই— রান্নাঘরের তাকে। সর্ববামে।
মশলা, লবণ–রান্নাঘরের তাকে। সর্ব ডানে। কৌটার গায়ে কী মসলা নাম লেখা আছে।
চা, চিনি–মিটাসেফের উপরে।
পেয়াজ, রসুন, আদা— মিটসেফের পাশের খলুইয়ে।
সরিষার তেল–চুলার পাশে।
ভালোবাসা–আমার কাছে। আমি যেখানে থাকি সেখানে।
আসমানীর পক্ষেই সম্ভব কাজের কথা লিখতে লিখতে হঠাৎ মজার কিছু লিখে ফেলা। তেল, মসলার কথা লিখতে লিখতে লেখা ভালোবাসা–আমার কাছে। আমি যেখানে থাকি সেখানে।
বিয়ের রাতেও সে এরকম মজা করল। বাসর হচ্ছে আসমানীদের কলাবাগানের বাড়িতে। দোতলার বড় একটা ঘর। ফুল দিয়ে সুন্দর করে সাজানো। ঘরে পা দিয়েই শাহেদের মনে হলো— আসমানী কি এত সুন্দর! সে আগেও তো কয়েকবার দেখেছে। এত সুন্দর তো তাকে কখনো মনে হয় নি? শাহেদ খাটে বসতে বসতে বলল, আজ কী রকম গরম পড়েছে দেখেছ? (সে ঠিক করে রেখেছিল প্রথম যে বাক্যটি বলবে তা হচ্ছে–আসমানী কেমন আছ? বলার সময় সম্পূর্ণ অন্য কথা বের হয়ে এলো। বলার সময় বলে বসল— আজি কী গরম পড়েছে দেখেছি? যেন সে দেশের আবহাওয়া নিয়ে খুবই চিন্তিত।)
শাহেদের কথার উত্তরে আসমানী মুখ তুলে তাকাল। শান্তগলায় স্পষ্টভাবে বলল, গরমের সময় গরম তো পড়বেই। গরমকালে গরম পড়বে, ঠাণ্ডাকালে ঠাণ্ডা। আপনার জন্যে তো আল্লাহ আবহাওয়া বদলে দেবেন না।
শাহেদ হতভম্ব! হড়বড় করে এইসব কী বলছে? বিয়ের টেনশনে, অত্যধিক গরমে কি তার মাথা আউলায়ে যাচ্ছে?
আসমানী বলল, চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন কেন? কোনো পুরুষমানুষ এইভাবে তাকিয়ে থাকলে আমার রাগ লাগে। আমি কিন্তু চোখ গেলে দেব।
আতঙ্কে অস্থির হয়ে শাহেদ খাট ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই আসমানী হোসে ফেলল। হাসতে হাসতেই বলল, সরি। কিছু মনে করো না। আমি তোমার সঙ্গে ঠাট্টা করেছি। আমি আমার দুই খালাতো বোনের সঙ্গে বাজি ধরেছি। বাসর রাতে আমি যদি তোমাকে ভয় দেখাতে পারি, তাহলে তারা আমাকে একশ টাকা দেবে। ওরা দুজনেই জানালার ফাঁক দিয়ে আমাদের দেখছে। তুমি দাড়িয়ে আছ কেন? বসো।
শাহেদ বসল। সে তখনো পুরোপুরি স্বস্তি পাচ্ছে না। তার মনে হচ্ছে অদ্ভুত সুন্দর এই মেয়েটি আবারও উদ্ভট কিছু করবে। আসমানী বলল, তুমি কি রাগ করেছি?
শাঙ্গেদ ভীত গলায় বলল, না।
আসমানী বলল, প্রথম রাতেই তোমাকে ভয় দেখিয়ে দিলাম। কাজটা খুব খারাপ করেছি। এতে কী হবে জানো–সারাজীবন তুমি আমাকে ভয় করে চলবে।
শাহেদ এসে বারান্দায় বসেছে। বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে। গুমোট গরম কমতে শুরু করেছে; ভেতর থেকে মাঝে মাঝে গৌরাঙ্গ গোঙানির মতো শব্দ করছে। যেন কেউ তার গলায় পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে চিৎকার করতে গিয়েও করতে পারছে না। একটা ব্যাপার দেখে শাহেদ খুবই অবাক হচ্ছে–গৌরাঙ্গের ভয়াবহ দুঃসময় তাকে তেমন স্পর্শ করছে না। যেন গৌরাঙ্গের এই সমস্যায়। তার কিছু যায় আসে না। ভয়াবহ দুর্যোগের সময় মানুষ কি বদলে যায়? তখন নিজের সুখ নিজের দুঃখই প্রধান হয়ে দাঁড়ায়? দেশের সব মানুষই কি বদলাতে শুরু করেছে? আসমানী বদলে যাচ্ছে? রুনি বদলে যাচ্ছে?
শাহেদ আসমানীর কথা ভাবতে চাচ্ছে না। আসমানীর কথা মনে করলেই বুকের ভেতর কেমন জানি করছে। কী একটা দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। আসমানী এখন আছে কোথায়? কী করছে? সেও কি তার মতো জেগে আছে। গল্পের বই পড়ছে না-কি? নিশিরাতে গল্পের বই পড়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠা তার পুরনো রোগ। একবার তো আসমানীর কান্নার শব্দে সে ঘুম ভেঙে উঠে বসে
নাই। ঘুমাও। গল্পের বই পড়ে কাদছি।
কী বই?
তারাশংকর লেখা একটা বই, নাম–বিপাশা।
বই পড়ে কাদার কী আছে?
আমার স্বভাবই এরকম। নিজের দুঃখে আমি কাদি না। গল্প-উপন্যাসের চরিত্রদের দুঃখে আমি কাদি।
তোমার মাথা কিন্তু সামান্য খারাপ আছে।
তা তো আছেই। পুরোপুরি সুস্থ মাথার একটা মেয়েকে বিয়ে করো। তোমরা সুখে সংসার করো। আমি দূর থেকে দেখে খুব মজা পাব।
শাহেদ বিরক্ত হয়ে বলল, এইসব কী ধরনের কথা?
আসমানী বলল, খুবই ভালো কথা। আমি নিজে এসে তোমাদের সংসার সাজিয়ে দিয়ে যাব। বিয়ে করবে? প্লিজ প্লিজ।
বাতি নেভাও। বাতি নিভিয়ে ঘুমুতে আসো।
না, ঘুমাব না। বইটা আমি আবার পড়ব।
এখন?
হ্যাঁ এখন। গল্পের শেষ না জেনে পড়ার এক ধরনের আনন্দ। আবার শেষ জেনে পড়ার অন্য ধরনের আনন্দ। বাতি জ্বলিয়ে রাখলে তোমার যদি অসুবিধা হয়, তাহলে আমি বরং অন্য ঘরে যাই।
যা ইচ্ছা করো।
বৃষ্টি বাড়ছে। সঙ্গে সামান্য বাতাসও আছে। বাতাসে ছাতিম গাছের পাতা নড়ছে। বারান্দা থেকে গাছটাকে এখন জানি কেমন ভৌতিক লাগছে। এই গাছ দেখে একবার আসমানী খুব ভয় পেয়েছিল। রাতের বেলা তার ঘুম ভেঙেছে, সে এক গ্রাস পানি হাতে নিয়ে বারান্দায় এসে বসেছে। কিছুক্ষণ পরই বিকট চিৎকার। ঘুম ভেঙে শাহেদ ছুটে এসে দেখে, আসমানী থারথার করে কাঁপছে। তার হাত থেকে পানির গ্রাস পড়ে ভেঙে টুকরা টুকরা হয়েছে। শাহেদ বলল, কী হয়েছে? আসমানী বিড়বিড় করে বলল, গাছটা মানুষের মতো হাত নেড়ে ডেকেছে।
শাহেদ বলল, বাতাসে পাতা নড়েছে, তোমার কাছে মনে হয়েছে। অন্য কিছু।
আসমানী কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি ছোট বাচ্চা না, আমি জানি কী হয়েছে।
ভয়ে সেই রাতেই আসমানীর জ্বর উঠে গেল।
না, সে এখন আসমানীর কথা ভাববে না। সে নিশ্চয়ই ভালো আছে। সে আছে তার বাবা-মার সঙ্গে। একজন সন্তান সবচে নিরাপদে থাকে যখন সে বাবা-মার সঙ্গে থাকে। তার সঙ্গে দেখা হচ্ছে না–কাল অবশ্যই দেখা হবে। আগামীকাল কারফিউ ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে সে যাবে মিরপুর দশ নম্বরে। সেখানে আসমানীর এক খালা থাকেন। তিনি নিশ্চয়ই কোনো খবর দিতে পারবেন। আসমানীর সরাসরি কোনো খবর না পেলেও তার অন্য আত্মীয়দের ঠিকানা তার কাছ থেকে নেবে।
মিরপুর যাবার পথে সোবাহান সাহেবদের খোঁজ নিয়ে যেতে হবে। তারা নিশ্চয়ই আজও অপেক্ষা করে বসেছিলেন। সোবাহান সাহেবদের নিরাপদ কোনো জায়গায় পাঠাবার ব্যবস্থা করতে হবে।
গৌরাঙ্গ! তার ব্যাপারটা কী? গৌরাঙ্গ কি তার কোনো আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে যাবে? না-কি এখানে থাকবে? এখানে থাকতে কোনো সমস্যা নেই। যতদিন ইচ্ছা থাকতে পারবে। আসমানী যদি এর মধ্যে চলে আসে, তাহলে কোনো অসুবিধাই হবে না। আসমানীর মেজাজ যখন ঠিক থাকে, তখন সে অসাধারণ একটি মেয়ে। গৌরাঙ্গের ভয়াবহ কষ্ট অনেকখানি কমিয়ে দেয়া কোনো ব্যাপারই না।
মিতা! মিতা!
ভারী গলায় গৌরাঙ্গ ডাকছে। শাহেদ ভেতরে গেল। গৌরাঙ্গ খাটে বসে। আছে। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছে। তার মুখও হা হয়ে আছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। শাহেদ বলল ভাত-ডাল রান্না করেছি। কিছু খাবে?
গৌরাঙ্গ সঙ্গে সঙ্গে বলল, হুঁ।
নামো বিছানা থেকে। দাড়াও আমি ধরছি।
শাহেদ ধরাধরি করে গৌরাঙ্গকে নামাল। গৌৰাঙ্গ বলল, মিতা, আমার স্নান করতে হবে। আমি তিনদিন স্নান করি নাই।
শাহেদ বলল, বাথরুমে পানি আছে, সাবান আছে। গরম পানি করে দেব?
দাও। মিতা শোন, আমি কিন্তু তোমার এখানে থাকব। আমি অন্য কোনোখানে যাব না।
কোনো অসুবিধা নেই। থাকবে।
আগারগাঁও-এ আমার এক মামা থাকেন। ওয়্যারলেস অফিসার না-কি কী যেন। আমি উনার কাছেও যাব না।
তোমার যত দিন ইচ্ছা তুমি থাকবে।
মিতা আমার বুকে ব্যথা করছে। আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।
গরম পানি দিয়ে গোসল করে। গোসল করলে আরাম পাবে।
গৌরাঙ্গ ক্ষীণ গলায় বলল, আচ্ছা। মিতা আমার হাত-পা কেমন শক্ত হয়ে গেছে। হাত-পা নাড়তে পারছি না। এই দেখ, আঙুল বঁকা করতে পারছি না।
গৌরাঙ্গ হাত উচু করে দেখাল। তার আঙুল ঠিকই বঁকা হচ্ছে।
মিতা দেখেছি আঙুল বাঁকছে না।
শাহেদ বলল, ঠিক হয়ে যাবে।
গৌরাঙ্গ বলল, কখন ঠিক হবে?
শাহেদ বলল, ভোর হোক।
গৌরাঙ্গ বলল, আচ্ছা।
আরেকটি ভোর হয়েছে। আগে একটি ভোরের সঙ্গে আরেকটি ভোর আলাদা করা যেত না। এখন আলাদা করা যায়। এখন মনে হয় প্রতিটি ভোর আলাদা।
কারফিউ উঠেছে। লোকজন রাস্তায় নেমেছে। শাহেদ বের হয়েছে। গৌরাঙ্গকে নিয়ে। গৌরাঙ্গের শরীরের অবস্থা ভালো না। তাঁর গায়ে জ্বর। কিন্তু সে এক কিছুতেই বাসায় থাকবে না। একা বাসায় বসে থাকলে সে না-কি ভয়েই মরে যাবে। রাস্তায় নেমেও আরেক বিপদ, সে একটু পর পর বলছে–মিতা ফিরে চল। মিতা ভয় লাগছে, ফিরে চল। শাহেদের খুবই বিরক্ত লাগছে। ফিরে যাবার প্রশ্নই উঠে না। যে করেই হোক আসমানীদের খোঁজ বের করতে হবে। প্রথমে যেতে হবে মিরপুর দশ নম্বর, তার খালার বাড়িতে। বাড়ির নাম্বার সে জানে না। আগে দুবার এসেছে, কাজেই তার ধারণা সে বাড়ি চিনবে। তবে মিরপুর যাবার আগে তাকে সোবাহান সাহেবের খোজে যেতে হবে। এরা নিশ্চয়ই আতঙ্কগ্ৰস্ত হয়ে অপেক্ষা করছে। গতকাল শাহেদ যায় নি। বৃদ্ধ ভদ্রলোক নিশ্চয়ই তাকে নিয়ে অনেক দুশ্চিন্তা করছেন।
সোবাহান সাহেবদের বাড়ির সদর দরজায় তালা ঝুলছে। বেশ বড় তালা। মনে হচ্ছে তারা গতকাল বাসা ছেড়ে নিরাপদ কোনো জায়গায় চলে গেছে। ঢাকা শহরের মানুষ কোনোখানেই এখন নিশ্চিন্তু বোধ করছে না। তারা শুধুই জায়গা বদল করছে। দরজায় তালাবন্ধ, তারপরেও শাহেদ অনেকক্ষণ কড়া নাড়ল। ঢাকা শহরে আরেকটি নিয়ম এখন চালু হয়েছে। সদর দরজায় তালা লাগিয়ে বাড়ির ভেতরে বসে থাকা। মিলিটারি যদি আসে তাহলে যেন তালা দেখে মনে করে এই বাড়িতে লোকজন নেই।
গৌরাঙ্গ বলল, মিতা চল, বাসায় ফিরে যাই। কেউ তো নাই।
শাহেদ বলল, আমাকে মিরপুর যেতেই হবে।
গৌরাঙ্গ বলল, মিতা, আমার খুব ভয় লাগছে।
ভয় লাগলে তুমি বাসায় চলে যাও। আমাকে যেতেই হবে। যে করেই হোক আমাকে আসমানীর খোঁজ বের করতে হবে।
মিতা, আমি একা বাসায় থাকব না। আমি ভয়েই মরে যাব। আমি খুবই ভীতু।
শাহেদ জবাব দিল না। কথা বলে নষ্ট করার মতো সময় তার হাতে নেই। তাকে এখন কোনো বেবিট্যাক্সি খুঁজে বের করতে হবে। বেবিট্যাক্সি না পাওয়া গেলে শক্ত-সমর্থ শরীরের কোনো রিকশাওয়ালা, যে তাকে অতি দ্রুত মিরপুর পৌঁছে দেবে। হাতে সময় অল্প। বারোটা থেকে আবার কারফিউ শুরু হবে।
মিরপুর দশ নম্বরের মাথায় তারা রিকশা ছেড়ে দিল। বাড়ি খুঁজতে শুরু করতে হবে এখান থেকেই। শাহেদের অস্পষ্টভাবে মনে আছে, বাড়ির সামনের গেটের কাছে একটা জবা গাছ আছে! বাড়ির একটা ইংরেজি নামও আছে। নামটা মনে পড়ছে না। তবে শুরুটা ‘S’ দিয়ে।
গৌরাঙ্গ চাপা গলায় বলল, মিতা মিলিটারি। ডানদিকে চায়ের দোকানের সামনে মিলিটারি। মিতা, আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
শাহেদ থমকে দাঁড়াল। চায়ের দোকানের নাম রহমানিয়া টি স্টল। পাঁচজন মিলিটারির একটা দল দোকানের সামনে। একজন পিরিচে চা ঢেলে খাচ্ছে। বাকিরা শক্ত মুখ করে দাড়িয়ে আছে। এদের আশেপাশে কোনো লোকজন নেই। শুধু শাদা গেঞ্জি পরা চায়ের দোকানদার মাথা নিচু করে বসে আছে। দোকানদারকে দেখে মানুষ বলে মনে হচ্ছে না। দূর থেকে মনে হচ্ছে হার্ডবোর্ডে দোকানদারের ছবি এঁকে বসিয়ে দেয়া হয়েছে।
গৌরাঙ্গ চাপা গলায় বলল, মিতা, আমাদেরকে ডাকে। এখন কী করব?
পিরিচে ঢেলে যে চা খাচ্ছিল সে-ই ডাকছে। তার মুখ হাসি হাসি। গৌরাঙ্গ বিড়বিড় করে বলল, মিতা, এখন কী করব? দৌড় দিব?
শাহেদ বলল, যেভাবে দাড়িয়ে আছ সেইভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। খবরদার দৌড় দেবে না। আমি শুনে আসি।
মিতা, ওদের কাছে যাবার দরকার নাই।
শাহেদ এগুচ্ছে। মিলিটারি দলটির দুজন বন্দুক উচিয়ে ধরল। তার দিকে। কেন ধরল শাহেদ বুঝতে পারছে না। হয়তো এটাই তাদের নিয়ম। কোনো বাঙালি তাদের দিকে আসতে থাকলে বন্দুক উচিয়ে নিশানা করতে হয়। তাকে ডাকছেই বা কেন? যে চা খাচ্ছিল, সে চা খাওয়া বন্ধ করে তাকিয়ে আছে। তার মুখ এখনো হাসি হাসি। এটা একটা ভরসার কথা। কিংবা তার মুখ হয়তো হাসি হাসি না। অনেকে এরকম থাকে। খুব রাগ করে তাকালেও মনে হয়। হাসছে। আচমকা খুব কাছেই কোথাও গুলি হলো। শাহেদ অবাক হয়ে তাকাচ্ছে। গুলি কি তাকে করা হলো? মনে হয় না। তাকে গুলি করা হলে ব্যথা বোধ হতো। রক্তে সার্ট ভিজে যেত। সে-রকম কিছু তো হয় নি।
গৌরাঙ্গ তাকিয়ে আছে। শাহেদের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে সে। মিলিটারিদের দিকে তাকাল। যে মিলিটারি চা খাচ্ছিল, তার চা খাওয়া শেষ হয়েছে। সে হাতের ইশারায় গৌরাঙ্গকে চলে যেতে বলল। গৌরাঙ্গ চলে যাচ্ছে।
শাহেদ মিলিটারিদের দিকে এগুচ্ছে। সে হাঁটতে পারছে, এর অর্থ তাকে গুলি করা হয় নি। শরীরে বুলেট নিয়ে কেউ হাঁটতে পারে না। মিলিটারিদের ছয়-সাত হাত কাছাকাছি গিয়ে শাহেদ থমকে দাঁড়াল।
নাম কেয়া? তেরা নাম কিয়া?
মিলিটারিরা তার নাম জানতে চাচ্ছে। নাম দিয়ে তারা কী করবে। তার নাম শাহেদ হলেও যা ফখরুদিন হলেও তা। শাহেদ নাম বলল। যে মিলিটারি চা খাচ্ছিল, সে চায়ের কাপের কিছু চা মাটিতে ফেলে দিয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বলল। শাহেদ একদৃষ্টিতে মিলিটারিটার দিকে তাকিয়ে আছে।
কান পাকাড়ো।
এর মানে কী? মিলিটারিটা তাকে কানে ধরতে বলছে? অপরাধটা কী? শাহেদ কানো ধরল। মিলিটারি ইশারা করল উঠবোস করতে। শাহেদ উঠবোস। করছে। মিলিটারিরা মনে হয় ব্যাপারটায় মজা পাচ্ছে। সবার মুখ হাসি হাসি।
ভয়ঙ্কর দিন যাচ্ছে
মরিয়ম খুব ভালো করেই জানে ভয়ঙ্কর দিন যাচ্ছে। যে-কোনো সময় যে-কোনো কিছু ঘটে যেতে পারে। তারপরেও তার মনে চাপা আনন্দ। এই আনন্দের জন্যে নিজেকে তার খুবই ছোট লাগছে, মনে হচ্ছে সে বাথরুমের তেলাপোকার চেয়ে জঘন্য কোনো প্ৰাণী। কিন্তু সে কী করবে? জোর করে তার আনন্দ চেপে রেখে দুঃখ দুঃখ মুখ করে ঘুরবে?
তার আনন্দের প্রধান কারণ হলো, কারফিউ ভাঙার পরপর নাইমুল বলেছে, আমি একটু বাইরে যাব, শহরের অবস্থা দেখব। মরিয়ম সঙ্গে সঙ্গে বলেছে, আমি তোমাকে ছাড়ব না। তুমি যেতে পারবে না।
নাইমুল বলল, আচ্ছা। তুমি অনুমতি না দিলে যাব না।
কী সুন্দর কথা! তুমি অনুমতি না দিলে যাব না। চোখে পানি চলে আসার মতো কথা। মরিয়ম বলল, দুপুরে কী খাবে বলো। আজ দুপুরে আমি রান্না করব। মার শরীর খারাপ।
নাইমুল বলল, তুমি যা রানা করবে। আমি তাই খাব। তবে…
তবে কী?
সবচে ভালো হয় রান্নাবান্নার ঝামেলায় না গিয়ে তুমি যদি আমার সামনে বসে থাকে। দুঃসময়ে প্ৰিয়জনদের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। এখন আমাদের দুঃসময়।
নাইমুলের কথা শুনে আনন্দে মরিয়মের চোখে পানি চলে এলো। তার কাছে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের সব মানুষের জন্যে দুঃসময় হলেও আজ তার জন্যে দুঃসময় নয়। কোনো দুঃসময় তাদের দুজনের মাঝখানে ঢুকতে পারবে না।
নাইমুলট্রানজিস্টারের নব ঘোরাচ্ছে। তার মধ্যে কোনো অস্থিরতা নেই। বাইরে এত ঝামেলা অথচ মানুষটা শান্ত-সহজ ভঙ্গিতে ট্রানজিস্টারের নব ঘোরাচ্ছে। মনে হচ্ছে সে কোনো গানের অনুরোধের আসরের অনুষ্ঠান ধরতে চাচ্ছে। মরিয়ম বলল, এই, তোমার কি সত্যি সত্যি বাইরে যেতে ইচ্ছা করছে?
নাইমুল বলল, ইচ্ছা করছে কিন্তু আজ আমি তোমার ইচ্ছাটাকেই গুরুত্ব দেব। তুমি যদি বলো Yes তা হলে Yes, তুমি যদি বলো No তা হলে No।
আচ্ছা যাও, ঘুরে আসো। এক ঘন্টার জন্যে যাবে।
থ্যাংক য়্যু।
তুমি যতক্ষণ বাইরে থাকবে ততক্ষণ আমি জায়নামাজে বসে থাকব।
আমি খুব তাড়াতাড়ি ফিরব।
রাস্তায় যতক্ষণ থাকবে দোয়া ইউনুস পড়বে। দোয়া ইউনুস জানো তো? না জানলে একটা কাগজে লিখে দেই।
লিখে দিতে হবে না। জানি।
তাড়াতাড়ি ফিরবে কিন্তু।
নাইমুল বলল, এখন বাজছে নটা পঁচিশ, আমি অবশ্যই দশটা পঁচিশে ফিরব।
ইনশাল্লাহ বলো। ইনশাল্লাহ ছাড়া কথা বলছি কেন?
ইনশাল্লাহ। তুমি চায়ের পানি গরম রেখ। এসেই লেবু চা খাব।
মরিয়ম জায়নামাজে বসে আছে। যে কটা সূরা সে জানে সে কটা তিনবার তিনবার করে পড়ে নফল নামাজ পড়তে শুরু করবে। নাইমুল ঘর ছেড়ে যাবার পরই মরিয়মের মনে হলো, মস্ত ভুল করা হয়েছে, তাকে যেতে দেয়া ঠিক হয় নি। সে সূরা পড়া বন্ধ রেখে ক্ৰমাগত বলতে লাগিল— আল্লাহ, তুমি তাকে ভালো রাখা। আল্লাহ তুমি তাকে ভালো রাখ। মরিয়মের একবারও তার বাবার কথা মনে পড়ল না, পঁচিশে মার্চের পর থেকে তার কোনো খবর নেই। হয়তো মরিয়মের মনে হয়েছে তাঁকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। পুলিশের চাকরিতে দিনের পর দিন অনুপস্থিত থাকা কোনো ব্যাপার না।
সাফিয়ার মুখ ভয়ে-আতঙ্কে ছোট হয়ে আছে। তাঁর ভীতির কারণ সম্পূর্ণ অন্য। পঁচিশে মার্চ রাতে তিনি একটি ভয়াবহ সত্য আবিষ্কার করেছেন। টুনটুনি (ইয়াহিয়াকে এখন টুনটুনি ডাকা হচ্ছে। একমাত্র মোবারক হোসেনই ছেলেকে ইয়াহিয়া নামে ডাকেন।)। কানে শোনে না। এই যে এত গোলাগুলি, কামানের শব্দ তাতে তার কিছুই হচ্ছে না। সে জেগেই আছে কিন্তু একবারও চমকে উঠছে না। তখন তার সন্দেহ হলো, ছেলে হয়তো চোখেও দেখে না। তিনি তার সামনে রঙিন ফিতা ধরলেন। টুনটুনি হাত বাড়াল না। চোখের সামনে ঝুমঝুমি বাজালেন। সে ঝুমঝুমির দিকে তাকাল না। সম্পূর্ণ অন্যদিকে তাকিয়ে আনন্দে হাসতে লাগল। তিনি বুঝতেই পারছেন না। এই ভয়ঙ্কর খবরটা তিনি মরিয়মের বাবাকে কীভাবে দেবেন। মরিয়মের বাবা কি খবরটা সহ্য করতে পারবেন? তিনি যদি বলেন, এই ব্যাপারটা ধরতে তোমার এত দিন লাগল? তখন তিনি কী জবাব দেবেন? সাফিয়ার একটা ভয়ঙ্কর ইচ্ছা হচ্ছে। ছেলেকে কোলে নিয়ে ছাদে চলে যেতে ইচ্ছা করছে। ছাদ থেকে ছেলে কোলে নিয়ে কাপ দিয়ে নিচে পড়ে যাওয়া। চোখ-কান আছে এমন শিশুই এদেশে টিকে থাকতে পারে না, এ কীভাবে টিকবে? তিনিইবা ছেলের বাবার রাগ কীভাবে সামাল দেবেন?
নাইমুলের দশটা পঁচিশে ফেরার কথা। সে ঠিক দশটা পঁচিশেই ফিরল। মরিয়ম তখনো জায়নামাজ ছেড়ে ওঠে নি। নাইমুল বলল, মরি! আমার লেবু চা কই?
মরিয়ম লজ্জায় মরে যাচ্ছে। নাইমুল তার কথা রেখেছে। সে কাটায় কাটায় দশটা পঁচিশে ফিরেছে। সে তার কথা রাখতে পারে নি। চুলায় চায়ের পানিই দেয়া হয় নি।
নাইমুল বলল, চা লাগবে না, তুমি বসো।
মরিয়ম বলল, কী দেখলে?
নাইমুল বলল, ওরা যা দেখাতে চেয়েছিল তাই দেখলাম।
মরিয়ম বলল, ওরা কী দেখাতে চেয়েছিল?
ওরা ওদের হাতের সূক্ষ্ম কাজ দেখানোর জন্যেই তিন ঘণ্টার জন্যে কারফিউ তুলেছে। যেন ওদের কর্মকাণ্ড দেখে আমরা জেলি ফিসের মতো হয়ে যাই!
কী বলছি বুঝতে পারছি না।
নাইমুল হাসল। তার অদ্ভুত হাসি। সে হাসি দেখলেই মরিয়মের শরীর কেমন করতে থাকে।
মরিয়ম বলল, আমি তোমার জন্যে চা নিয়ে আসি।
নাইমুল বলল, চা আনতে হবে না। চুপ করে বসে থাকো। আমি একটা মজার জিনিসও দেখে এসেছি।
এর মধ্যে মজার জিনিস কী দেখলে?
ওরা শহীদ মিনার ভেঙে গুড়া করে দিয়েছে। সেখানে একটা সাইনবোর্ড টানিয়ে দিয়েছে। সাইনবোর্ডে লেখা–
মসজিদ, নামাজ পড়িবার স্থান।
নাইমুল হাসছে। তবে এই হাসি কেমন যেন অন্যরকম। হাসির শব্দ ভোঁতা। শুনতে ভালো লাগে না।
মরিয়ম এখন তোমাকে খুব জরুরি একটা কথা বলব। মন দিয়ে শোনো। পাকিস্তানি মিলিটারিদের সঙ্গে সত্যিকার যুদ্ধ এখন শুরু হবে। কী ভয়াবহ যুদ্ধ যে হবে ওরা বুঝতেও পারছে না। আমি কিন্তু যুদ্ধে যাব।
মরিয়ম হতভম্ব গলায় বলল, কী বললে?
নাইমুল সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, আমি যুদ্ধ করব। কীভাবে করব, অস্ত্ৰ কোথায় পাব।— কিছুই জানি না। শুধু এইটুকু জানি যে ব্যবস্থা হবে।
যুদ্ধে যাবে? তুমি যুদ্ধ করবে?
হ্যাঁ। তবে তোমার ভয়ের কিছু নাই। আমি মরব না। আমি অত্যন্ত বুদ্ধিমান। আমি খুবই সাবধান থাকব। বুদ্ধিমান মানুষ সবার আগে নিজেকে রক্ষা করে। আমি তাই করব।
নাইমুল সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলল, হ্যাঁ। তোমার সঙ্গে আমার আবার দেখা হবে–স্বাধীন বাংলাদেশে।
মরিয়ম আর্তনাদের মতো করে বলল, তুমি কি এখন চলে যাচ্ছ?
নাইমুল বলল, না। আজ দিনটা আমি তোমার সঙ্গে থাকব। আমি যাব আগামীকাল। কারফিউ লিফট হওয়া মাত্র বিদায়। আজকের দিনটা শুধুই আমাদের দুজনের–
She was a child and was a child,
In this kingdom by the sea,
But we loved with a love that was more than love
I and my Annabel Lee–
মরিয়ম হাউমাউ করে কাঁদছে। নাইমুল হাসিমুখে স্ত্রীর কান্না দেখছে।
২৭ মার্চ শনিবার রাত আটটায় রেডিওর নব ঘুরাতে ঘুরাতে এই দেশের বেশ কিছু মানুষ অদ্ভুত একটা ঘোষণা শুনতে পায়। মেজর জিয়া নামের কেউ একজন নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান ঘোষণা দিয়ে বলেন, আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি। তিনি সর্বাত্মক যুদ্ধের ডাক দেন।
দেশের মানুষদের ভেতর দিয়ে তীব্ৰ ভোল্টেজের বিদ্যুতের শক প্রবাহিত হয়। তাদের নেতিয়ে পড়া মেরুদণ্ড একটি ঘোষণায় ঋজু হয়ে যায়। তাদের চোখ ঝলমল করতে থাকে। একজন অচেনা অজানা লোকের কণ্ঠস্বর এতটা উন্মাদনা সৃষ্টি করতে পারে ভাবাই যায় না।
পিরোজপুর মহকুমার সাব ডিভিশনাল পুলিশ অফিসার এই ঘোষণা শুনে আনন্দে ছেলেমানুষের মতো চিৎকার শুরু করতে থাকেন–যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আমরা যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছি। আর ভয় নাই। তিনি পিরোজপুরের পুলিশদের অস্ত্ৰভাণ্ডার থেকে দুইশ রাইফেল স্থানীয় জনগণকে দিয়ে দেন। যুদ্ধ শুরুর প্রস্তুতি হিসেবে। পাকিস্তান মিলিটারি তাঁকে হত্যা করে ৫ মে। এই ঘটনার বত্ৰিশ বছর পরে তার বড় ছেলে জোছনা ও জননী নামের একটা উপন্যাস লেখায় হাত দেয়।
————-
কালুরঘাট রেডিওস্টেশন থেকে প্রচারিত মেজর জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা নিয়ে পরে নানান বিভ্রান্তি তৈরি হয়। তিনি মোট কবার ঘোষণা পাঠ করেছেন? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে বাংলাদেশের একচ্ছত্র নায়ক এবং তার পক্ষেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হচ্ছে–এই বিবৃতি কত তারিখে পড়া হলো, কবার পড়া হলো? এই নিয়ে বিভ্ৰান্তি। জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা পাঠের আগেই স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর দেয়া স্বাধীনতা ঘোষণা পাঠের প্রসঙ্গ বইপত্রে পাওয়া যাচ্ছে। যেমন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জনাব আব্দুল হান্নান দুপুর দুটায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বাংলা অনুবাদ প্রচার করেন। ২৬ মার্চ সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে স্বাধীনতা ঘোষণার বাংলা অনুবাদ দ্বিতীয়বার পড়া হয়। পাঠ করেন। হাটহাজারী কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল জনাব আবুল কাশেম সন্দীপ।
স্বাধীনতার ঘোষণা প্রসঙ্গে মেজর জিয়া নিজে তার ডায়েরিতে যা লিখেছেন তা হলো—২৭শে মার্চ শহরের চারদিকে তখন বক্ষিপ্ত লড়াই চলছিল। সন্ধ্যা সাড়ে ছটায় রেডিওস্টেশনে এলাম। এক টুকরা কাগজ খুঁজছিলাম। হাতের কাছে একটা এক্সারসাইজ খাতা পাওয়া গেল; তার একটি পৃষ্ঠায় দ্রুত হাতে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম ঘোষণার কথা লিখলাম। স্বাধীন সার্বভীেম বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্র প্রধানের দায়িত্বভার নিয়েছি, সে কথাও লেখা হলো সেই প্রথম ঘোষণায়. কিছুক্ষণের মধ্যে সে ঘোষণা বেতারে প্রচার করলাম।। ২৮ মার্চ সকাল থেকে পনেরো মিনিট পর পর ঘোষণাটি প্রচার করা হলো কালুরঘাট রেডিওস্টেশন থেকে। ৩০ মার্চ দ্বিতীয় ঘোষণাটি প্রচার করা হলো রাজনৈতিক নেতাদেব অনুরোধক্রমে।
স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে কোনোরকম বিভ্রান্তি থাকতে পারে না। এই একটি বিষয়ে দল মতের উর্ধে আমাদেরকে উঠতেই হবে। সত্যে- ধাৰ্যতে পৃথুি, সত্যেন তাপতে রবি, সত্যেন বাতি বায়ুশ্চ, সৰ্ব্বং সত্যে প্রতিষ্ঠিতম। সত্যই পৃথিবীকে ধারণ করে আছে, সত্যের দ্বারাই সূর্য তাপ বিকিরণ কবছে, সত্যের জন্যেই বাতাস বইছে, সত্যেই সবকিছু প্রতিষ্ঠিত।–লেখক
পিরোজপুর মহকুমার পুলিশপ্রধান ফয়জুর রহমান
পিরোজপুর মহকুমার পুলিশপ্রধান ফয়জুর রহমান সাহেবের মন আজ অত্যন্ত ভালো। মন ভালো থাকার অস্বাভাবিক ঘটনার জন্যে তিনি খানিকটা লজ্জিত বোধ করছেন। দেশ ড়ুবে গেছে ভয়াবহ অনিশ্চয়তায়। এখন চরম দুঃসময়। এই অবস্থায় কোনো সুস্থ মানুষের মন ভালো থাকতে পারে না। তাহলে তিনি কি মানসিকভাবে খানিকটা অসুস্থ?
তিনি মানসিকভাবে খানিকটা অসুস্থ–এই ধারণা তাঁকে কিছুক্ষণ পীড়িত করল। সেই কিছুক্ষণ তিনি একমনে সূরা আর-রাহমান পড়লেন। একটু পরপর ফাবিয়ায়্যি আ-লা ই রাব্বিকমা তুকাজজিবান । তোমরা আমার কোন কোন নিয়ামত অস্বীকার করবে? আহারে, কী সুন্দর আয়াত!
তিনি বসে আছেন নামাজের পাটিতে। ফজরের নামাজ পড়া হয়েছে। নামাজের পাটি ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা করছে না। ফজরের নামাজ নিয়মিত পড়া তাঁর কখনো হয় না। অনেক রাতে ঘুমুতে যান বলে সকালে ঘুম ভঙে না। আজ অসম্ভব সুন্দর স্বপ্ন দেখে তার ঘুম ভেঙেছে। স্বপ্নে তিনি বিরাট এক বরযাত্রী দল নিয়ে যাচ্ছেন। দলের সঙ্গে নানান ধরনের বাদ্যবাজনার লোক আছে। তারা বাদ্যবাজনা করছে। বিয়েটা কার তা স্বপ্নে বুঝতে পারছেন না, তবে তার অতি ঘনিষ্ঠ কোনো একজনের, এ বিষয়ে তিনি নিশ্চিত। স্বপ্নের মধ্যে তাঁর মনে হলো, বিয়ে সম্ভবত তাঁর বড় মেয়ে শেফুর। কিন্তু মেয়ের বিয়েতে তো বরযাত্রী যায় না। তাহলে ঘটনাটা কী? ঘটনাটা জানার জন্যে তিনি মনের ভেতর অস্থিরতা বোধ করলেন। এই অস্থিরতাতেই ঘুম ভাঙল। তিনি টেবিলে রাখা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেন, ভোর চারটা পঁচিশ। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফজরের আযান হবে। তিনি নিঃশব্দে বিছানা থেকে নামলেন। অজু করে আযানের অপেক্ষা করতে করতে হঠাৎ অনুভব করলেন–তিনি সুখী একজন মানুষ। স্ত্রী-পুত্ৰ-কন্যা নিয়ে সুখী পরিতৃপ্ত একজন। আল্লাহপাক তাঁর প্রতি অসীম দয়া করেছেন।
তিনি দুরাকাত শোকরানা নামাজ পড়লেন। অতি বিনয়ের সঙ্গে বললেন, পরম করুণাময়, আমাকে তুমি অনেক করুণা করেছ। আমি তার শোকরানা আদায় করি। দেশের আজ চরম দুঃসময়। আমার ছেলেমেয়েরা কেউ আমার পাশে ছিল না। তিনজন ছিল ঢাকায়, একজন কুমিল্লায়। তাদের তুমি নিরাপদে আমার কাছে এনে দিয়েছ। আল্লাহ, আমি তোমার শোকারগুজার করি।
তাঁর আরো কিছুক্ষণ নামাজের পাটিতে বসে থাকার ইচ্ছা ছিল। সেটা সম্ভব। হলো না, তার অতি আদরের পোষা হরিণ ইরা লাফ দিয়ে বারান্দায় উঠে নানানভাবে তাকে যন্ত্রণা করতে লাগল। শিং-এর গুতা, সার্ট কামড়ে ধরে পেছন দিকে টানার মতো কর্মকাণ্ড চলতে লাগল। বাধ্য হয়ে তিনি হরিণের সঙ্গে গল্প শুরু করলেন। যখন আশেপাশে কেউ থাকে না, তখন তিনি গলা নিচু করে হরিণের সঙ্গে গল্প করেন। আড়াল থেকে হরিণের সঙ্গে তার কথোপকথন শুনলে যে কেউ ভাববে, তিনি তার ছয় ছেলেমেয়ের যে-কোনো একজনের সঙ্গে গল্প করছেন।
কিরে তুই চাস কী? সার্ট ছেড়ার মতলব করেছিস? ফোস ফোঁস করছিস কেন? তুই কি সাপ যে ফোস ফোস করবি? শান্ত হয়ে বোস আমার পাশে। গলা লম্বা কর। গলা চুলকে দেব। খবরদার চাটোচাটি করবি না। অজু ভেঙে शाद।
হরিণের সঙ্গে গল্পগুজব শেষ করে তিনি খুরপি হাতে বাগানে কাজ করতে গেলেন। হরিণ ইরা গেল তার সঙ্গে। বাগানে নানান ধরনের শীতের সবজি তিনি লাগিয়েছেন। তাদের পেছনে যত্নও কম করা হয় না। কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। অল্প কিছু টমেটো এবং কিছু টেরস হয়েছে। তিনি কয়েকটা টমেটো ছিঁড়ে হরিণকে খেতে দিলেন। হরিণ খাচ্ছে না। তাকে মনে হয় খেলার নেশায় পেয়েছে। সে নানান ভঙ্গিমায় লাফ বাপ করছে।
ভোর হয়েছে। ঘুম ভেঙে সবাই একে একে উঠতে শুরু করেছে। তিনি লক্ষ করলেন–তাঁর বড় ছেলে বাচু টুথব্রাশ দিয়ে দাঁত ঘষতে ঘষতে বারান্দার এক মাথা থেকে আরেক মাথায় যাচ্ছে, আবার ফিরে আসছে। ছেলেটার এই অদ্ভুত স্বভাব–সবসময় হাঁটাহাঁটি। সে কি কোনো চিন্তার মধ্যে থাকে? তার এই পুত্রের জন্ম এবং ইংল্যান্ডের যুবরাজ প্ৰিন্স চার্লসের জন্ম একই সময়ে একই দিনে। নিশ্চয়ই শুভক্ষণ। প্রিন্স চার্লসের জীবন এবং তার পুত্রের জীবন মিলিয়ে দেখতে হবে।
ছেলেকে এখন আর দেখা যাচ্ছে না। সে বাবাকে দেখে আড়ালে চলে গেছে। তিনি ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন। কোনো এক অজানা কারণে তার সব পুত্রকন্যাই তাকে অসম্ভব ভয় পায়। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তাঁর সহজস্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরি হয় নি। ষোড়শ বর্ষেন্তু পুত্ৰ মিত্র বদাচারেৎ। তাঁর পুত্ৰ মিত্র হয় নি। হলে ভালো হতো। দেশের অবস্থা নিয়ে পিতা-পুত্রের মিটিং হতো। ছেলের কাছে শুনতেন সে ঢাকায় কী দেখে এসেছে। তিনি বলতেন, পিরোজপুরে কী হচ্ছে। এই ছোট্ট মফস্বল শহরে অনেক কিছুই হচ্ছে। ভবিষ্যতে ভয়ঙ্কর সব ঘটনা। এখানেও ঘটতে পারে। ট্রেজারিতে এক কোটি টাকার মতো আছে। পনেরোজন আর্মড পুলিশের একটা দল ট্রেজারি পাহারা দেয়। পুলিশের এই দল আসে বরিশাল থেকে। এক মাস থাকে। অন্য এক দল আসে, পুরনো দল ফিরে যায়। দীর্ঘদিনের ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। আইনশৃঙ্খলা যেদিন ভাঙবে সেদিন সবকিছু ভাঙবে। ট্রেজারি লুট হয়ে যাবে।
পিরোজপুর মহকুমার প্রধান ব্যক্তি সিএসপি মুহিবুল্লাহ। সাব ডিভিশনাল অফিসার। সিন্ধু প্রদেশের মানুষ। তার স্থান হবে কোথায়? যদি শত শত মানুষ এসে এসডিওর বাংলো ঘেরাও করে বলে, এই পশ্চিম পাকিস্তানিটাকে আমাদের হাতে তুলে দাও, তখন তিনি কী করবেন? তাঁর পুলিশ বাহিনী দিয়ে এসডিও মুহিবুল্লাহ সাহেবকে রক্ষা করবেন? না-কি একপাশে দাঁড়িয়ে দেখবেন কী করে অসহায় একজন মানুষকে ধরে নিয়ে যায়? তাঁর ভূমিকা কী হবে? পুলিশ বাহিনী কি তখন তাঁর কথা শুনবে? রাষ্ট্ৰীয় শৃঙ্খলা যখন ভেঙে পড়ে, তখন তার প্রথম ধাক্কা এসে লাগে পুলিশ বাহিনীতে। কর্তৃত্ব ভেঙে পড়ে। তখন আর হুকুম চলে না। হুকুমবিহীন পুলিশ বাহিনী কোনো বাহিনী না।
এই অঞ্চলে অন্য এক ধরনের উপদ্রবও আছে। এই উপদ্রবের নাম নকশাল উপদ্রব। একদল ছেলে নকশাল নাম নিয়ে গ্রামে-গঞ্জে ডাকাতি করে বেড়ায়। এই দলের প্রধান ছেলেটির নাম বজলু। সে তার দলবল নিয়ে গা ঢাকা দিয়েই ছিল। সুযোগ বুঝে সে দর্শন দিয়েছে। বিশেষ ভঙ্গিমায় প্রকাশ্যে হাঁটাহাঁটি করছে। তিনি গোপন খবর পেয়েছেন তার লক্ষ্য ট্রেজারির দিকে।
ফয়জুর রহমান সাহেব ক্ষেতের কাজ বন্ধ করলেন। হঠাৎ তার খানিকটা অস্থির লাগছে। দিনের আলো বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অস্থিরতা বাড়তে শুরু করেছে। গত কয়েকদিন হলো এই সমস্যা তার হয়েছে–বেলা বাড়তে থাকে, তার অস্থিরতা বাড়তে থাকে। অস্থিরতা তীব্ৰ হয় সন্ধ্যাবেলা! সন্ধ্যার পর থেকে অস্থিরতা আবার কমতে থাকে। এটা কি কোনো শারীরিক অসুখ? না-কি মনের সমস্যা? সরকারি হাসপাতালের সিভিল সার্জন সিরাজ সাহেবের সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে আলাপ করলে হয়। তিনি প্রতিদিনই আসেন। যখন আসেন তখন আর অস্থিরতার বিষয়টা নিয়ে আলাপ করার কথা মনে থাকে না।
সিরাজ সাহেব অতি ভদ্রলোক, অতি সরল। তাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করলেই এই ধরনের ভরসা পাওয়া যায়। মনে হয় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবার মতো কিছু ঘটে নি। ভদ্রলোকের শরীর যেমন ভারী গলার স্বরও ভারী। তিনি কথা বলেন গলা নামিয়ে। প্রতিটি শব্দ এমনভাবে উচ্চারণ করেন যে মনে গেথে যায়।
এসডিপিও সাহেব শোনেন, আপনি আমি অর্থাৎ আমরা যারা পিরোজপুরে মোটামুটি আন্দামানটাইপ জায়গায় পড়ে আছি তাদের অবস্থাটা বুঝতে পারছেন? তারা আছে আল্লাহর খাস রহমতের তালিকায়। বুঝিয়ে বলি, পাকিস্তানি মিলিটারি মারামারি কাটাকাটি করতে থাকবে বড় বড় শহরে। তারা বিগ সিটি সামলাতেই এখন ব্যস্ত। তারপর যাবে ডিসট্রিক্ট লেভেলে, তারপর সাবডিভিশন। তার আগেই খেল খতম।
কীভাবে খেল খতম?
যা ঘটার ঘটে যাবে। হয় পাকিস্তান, না হয়। বাংলাদেশ। মাঝামাঝি ধরনের কিছু হবার সম্ভাবনাও আছে। লুজ ফেডারেশন টাইপ। কিংবা ধরেন আমেরিকার মতো United States of Pakistan. সেখানে বাংলাদেশ একটা রাষ্ট্র, পাঞ্জাব একটা, সিন্ধু, বেলুচিস্তান… বুঝেছেন?
বোঝার চেষ্টা করছি।
পাকিস্তানিরা খুব মারামারি কাটাকাটি যে করতে পারবে তাও না। জাতিসংঘ আছে না? বড় বড় রাষ্ট্র আছে। রাশিয়ার পদগোনি যদি এক ধমক দেয়। ইয়াহিয়ার পাতলা পায়খানা শুরু হয়ে যাবে। সেই পায়খানা বন্ধ করা ডাক্তারের সাধ্য না। বোতলের ছিপি ব্যবহার করা ছাড়া উপায় নাই। আচ্ছা, মনে করেন। কেউ কোনো ধমক ধামক দিল না, তারপরেও এক হাজার মাইল দূর থেকে উড়ে এসে যুদ্ধ কলা? যুদ্ধ এত সোজা? যুদ্ধ কি মামার বাড়ির উঠানে ডাংগুলি খেলা?
যত সহজ সমাধানের কথা। আপনি বলছেন, তত সহজ আমার কাছে মনে হচ্ছে না।
আপনার কাছে জটিল মনে হচ্ছে?
জি।
আপনি তো ধর্ম বিশ্বাসী মানুষ। কোরআন শরীফ বিশ্বাস করেন?
কী বলেন, কোরআন শরীফ বিশ্বাস করব না মানে?
পাক কোরআনে সূরা বনি ইসরাইলে আল্লাহপাক বলেছেন, আমি তোমাদের ভাগ্য তোমাদের গলায় হারের মতো ঝুলাইয়া দিয়াছি। কাজেই আমাদের কী হবে না হবে সব আগে থেকেই ঠিক করা। যা আগে থেকে ঠিক করা তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করে লাভ আছে?
না, লাভ নেই। যা হবার তা হবে। তারপরেও আমরা নিশ্চয়ই হাত-পা কোলে নিয়ে বসে থাকব না।
কী করবেন?
বিপদের জন্যে তৈরি হবো।
কীভাবে? মিলিটারি আসবে মেশিনগান, রকেট লাঞ্চার নিয়ে, আর আপনারা যুদ্ধ করবেন। একশ বছরের পুরনো থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে? ওদের আছে যুদ্ধের ট্রেনিং, আর আপনাদের ট্রেনিং হলো চোৱের পিছনে দৌড় দেয়া। মাথা থেকে সব চিন্তা-ভাবনা ঝেড়ে ফেলুন। ভাবিকে ভালো করে চা বানাতে বলুন। চা খেতে খেতে গল্প করব। খামাখা দুশ্চিন্তা করে ব্লাড প্রেসার বাড়াবেন না। Do ফুর্তি।
ফয়জুর রহমান সাহেব বাগানে রাখা বালতিতে হাত ধুলেন। ইরা পেছনে পেছনে আসছে। পানি খেতে চায় হয়তো। তিনি বালতি নিচু করে ধরলেন। বালতিতে মুখ ঢুকিয়ে চুমুক দিয়ে পানি খাচ্ছে ইরা। গরু ভেড়া ছাগল সবাই চুমুক দিয়ে পানি খায়। অথচ কুকুর শ্রেণী পানি খায় জিভ ড়ুবিয়ে। এর মানে কী? বড় ছেলেকে কি ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করবেন? সে দিনরাত বই পড়ে। এই প্রশ্নের জবাব নিশ্চয়ই সে জানে। তাছাড়া এ ধরনের টুকটাক কথাবার্তা দিয়ে সম্পর্ক স্বাভাবিক হবার পথ হয়তো তৈরি হবে। তিনি লক্ষ করলেন, বড় ছেলের হাতে চায়ের কাপ। সে চোখ বন্ধ করে সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে। এই অবস্থাতেই চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। এর মানে কী? তিনি ছেলের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে গলাখ্যাকড়ি দিলেন। ছেলে চমকে তার দিকে তাকাল। ছেলের চোখ দেখেই মনে হচ্ছে সে ভয় পাচ্ছে। জড়সড় হয়ে গেছে। ভয় পাবার কী আছে? তিনি বললেন, কী করছিস?
কিছু না।
চোখ বন্ধ করে সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছিস কেন?
ছেলে জবাব দিল না। বিব্ৰত ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। বাবার সামনে থেকে চলে যেতে পারলে সে বাঁচে। অথচ তার কিছুক্ষণ কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছে। তিনি বললেন, স্বরূপকাঠির একটা লোক আছে, তার না-কি জীন সাধনা। সে ঘরের ভেতর জীন নামাতে পারে। সেই জীন কথা বলে। মাথায় হাত দিয়ে দােয়া করে। ভাবছি লোকটাকে আনাই। দেখি ঘটনা কী। আনাব?
ছেলে আগ্রহের সঙ্গে বলল, জি আনান। কবে আনাবেন?
ইচ্ছা করলে আজকেই আনা যায়। দেখি।
তিনি লক্ষ করলেন, উৎসাহ এবং উত্তেজনায় ছেলের চোখ চকচক করছে। ছেলে খুবই মজা পাচ্ছে। তিনি পুরনো প্রসঙ্গে ফিরে গেলেন। তিনি বললেন, চোখ বন্ধ করে সূর্যের দিকে তাকিয়ে ছিলি কেন?
তাঁর ধারণা এইবার ছেলে প্রশ্নের জবাব দেবে। তাকে কিছুটা হলেও সহজ করা হয়েছে। তার ধারণা ঠিক হলো, ছেলে কথা বলতে শুরু করল। তিনি আগ্ৰহ নিয়ে শুনছেন। ছেলের কথা বলার মধ্যে মাস্টার মাস্টার ভাব আছে। যেন সে ক্লাসে বক্তৃতা দিচ্ছে। তাঁর এই ছেলে কি ভবিষ্যতে মাস্টার হবে?
সূর্যরশ্মি মানুষের শরীরে ভিটামিন ডি তৈরি করে। চোখ বন্ধ করে সূর্যের দিকে মুখ করে থাকলে চোখে ভিটামিন ডি তৈরি হয়। চোখ খোলা রাখা যাবে না, কারণ সূর্যরশ্মিতে আলট্রাভায়োলেট আছে। সেটা চোখের ক্ষতি করে।
আলট্রাভায়োলেট কী?
ছোট তরঙ্গ দৈঘ্যের আলো। হাই এনার্জি।
আমি গ্রামে দেখেছি, হিন্দু ব্ৰাহ্মণরা পুকুরে গোসলের সময় সূর্যের দিকে তাকিয়ে মন্ত্র পড়ে।
তারা সূর্যমন্ত্র পাঠ করে। সূর্যের উপাসনা। আমি মন্ত্রটা জানি।
তিনি বিস্মিত হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই সূর্যমন্ত্র জানিস?
জানি। অং জবাকুসুম শংকাসং কাস্যপেয়ং মহা দুৰ্গতিং। ধ্বন্তারিং সর্ব পাপগনিং প্ৰণত হোসমি দিবাকরম ।
তিনি অবাক হয়ে বললেন, সূর্যমন্ত্র মুখস্থ করে বসে আছিস কেন? তুই মুসলমানের ছেলে?
ছেলে লজা পাচ্ছে। এই লজা দেখতে ভালো লাগছে। আজ একদিনে অনেক কথা হয়ে গেছে। আরেকদিন ওজজ্ঞেস করতে হবে, ছেলে এই মন্ত্র কেন শিখেছে?
ফয়জুর রহমান সাহেব সকালের নাশতা শেষ করে পুলিশের পোশাক পরতে বসলেন। গত দুদিন তিনি পোশাক পরেন নি। আজ পোশাক পরার বিশেষ কারণ আছে। কারণটা গোপন। কাউকেই এই বিষয়ে কিছু বলেন নি।
তাঁর অফিস নিজের বাসাতেই। এসডিপিওর বাংলোর একটা কামরায় অফিস। খুবই পুরনো ব্যবস্থা। সিলিং-এ বিশাল এক টানা পাখা। সরকারি খরচে একজন পাংখাপুলার আছে। তার নাম রশীদ। ফয়জুর রহমান সাহেব চেয়ারে বসা মাত্ৰ পাংখাপুলার রশীদ দড়ি ধরে টানতে শুরু করে। তিনি অবশ্যি বলে দিয়েছেন। পাখা টানতে হবে না। টেবিলফ্যান আছে। তারপরেও রশীদ নিয়মমতো কিছুক্ষণ পাংখা টানে। এই পাংখার বিষয়ে তাঁর ছেলেমেয়েদের খুব আগ্রহ আছে। একদিন দেখেছেন, তার মেজ মেয়ে শিখু পাংখার দড়ি ধরে বুলছে। হাতে টানা পাংখার ব্রিটিশ আমলের নিয়ম এখনো কেন এই জায়গায় চালু আছে ভেবে তিনি বিস্ময় বোধ করেন।
রশীদ!
জি স্যার।
দেশের অবস্থা কেমন?
অবস্থা ভালো স্যার। চারদিকে জয় বাংলা।
জয় বাংলার বাইরে কিছু আছে?
রশীদ। চুপ করে আছে। জয় বাংলার বাইরে কিছু নিশ্চয়ই আছে। সেই কিছুটা সে এখন বলবে না। সময়মতো বলবে। রশীদ মাঝে-মাঝে তাকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু খবর দেয়।
ঘাটে নৌকা আছে রশীদ?
জি স্যার।
নৌকায় সুন্দর করে বিছানা করে রাখবে। কলসিতে পানি ভরে রাখবে। আমার ছেলেমেয়েরা যদি নৌকায় করে কোথাও যেতে চায়, তাদের নিয়ে যাবে।
জি স্যার।
মহকুমার পুলিশ প্রধান একটা সরকারি নৌকা পান। বড় নৌকা। নৌকার মাঝিরাও সরকারি কর্মচারী। ফয়জুর রহমান সাহেবের ছেলেমেয়েদের এই নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর খুব শখ। এই কাজটা তিনি কখনোই করতে দেন। না। আজ নিয়মের ব্যতিক্রম করলেন।
ফয়জুর রহমান সাহেব ঘড়ির দিকে তাকালেন। সকাল দশটা পঁচিশ। তিনি সাড়ে এগারোটা বাজার অপেক্ষা করছেন। সময় কাটছে না। টেবিলে অনেক ফাইল আছে; ফাইল দেখতে ইচ্ছা করছে না। টিএ বিল করা যায়। গত মাসের টিএ বিল করা হয় নি। তবে এখন টিএ বিল করা অর্থহীন। কে দেবে বিল? তিনি ড্রয়ার খুলে দুশ পৃষ্ঠার বাঁধানো খাতা বের করলেন। তিনি বেশ কিছুদিন হলো একটা রেডিও নাটক লেখার চেষ্টার করছেন। নাটকের নাম কত তারা আকাশে। এই নামকরণের একটা ইতিহাস আছে। তাঁর সর্বকনিষ্ঠ সন্তান শাহীন এক রাতে উঠানে বসেছিল। হঠাৎ সে আকাশের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ গলায় বলল, কত তারা আকাশে! তিনি ছেলের মুখে শুদ্ধ বাংলায় এই বাক্য শুনে মোহিত হলেন এবং ততক্ষণাৎ ঠিক করলেন, এই নামে একটা গল্প লিখবেন।
গল্প না লিখে রেডিও নাটক লেখারও ইতিহাস আছে। রেডিও পাকিস্তান ঢাকার সহকারী প্রোগ্রাম প্রডিউসার বাহারুল হক সাহেবের বাড়ি পিরোজপুর। তাঁর সঙ্গে ফয়জুর রহমান সাহেবের পরিচয় হয়েছে। বাহারুল হক সাহেব। আশা দিয়েছেন, নাটক ভালো হলে রেডিওতে প্রচারের চেষ্টা করবেন।
ফয়জুর রহমান সাহেব গভীর মনোযোগে সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত নাটক লিখলেন। কয়েকটা দৃশ্য বাদ দিলেন। নতুন যে দৃশ্যটি লিখলেন সেটি এতই আবেগময় যে লিখে শেষ করে তার চোখে পানি এসে গেল। তিনি চোখের পানি মুছে উঠে দাঁড়ালেন। রশীদ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। নতুন এসডিপিও সাহেবের অনেক ব্যাপারই তার কাছে অদ্ভুত মনে হয়। এই এসডিপিও সাহেব প্রায়ই কী যেন লেখেন, তখন তার চোখ দিয়ে পানি পড়ে। এর মধ্যে নিশ্চয়ই কোনো ঘটনা আছে। এই ঘটনা তার জানতে ইচ্ছা করে। জানতে চাইলেই তো আর জানা যায় না। সে সামান্য পাংখাপুলার। পুলিশের কতাঁর মনের রহস্য জানার তার সুযোগ কোথায়?
এসডিও মুহিবুল্লাহ তার বাংলোর বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসেছিলেন। ফয়জুর রহমানকে আসতে দেখে তিনি ভুরু কুঁচকে তাকালেন। মহকুমা পুলিশ প্রধানের তাঁর কাছে আসার একটাই অৰ্থ–আইন-শৃঙ্খলাঘটিত কোনো সমস্যা হয়েছে। সমস্যা হবেই। সমস্যার সমাধান দেয়ার ক্ষমতা এখন তার নেই। এসডিপিওকে ফুল পুলিশ ইউনিফর্মে দেখেও তিনি খানিকটা বিস্মিত।
ফয়জুর রহমান সাহেব স্যালুট করলেন। মহিবুল্লাহ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। শান্ত গলায় বললেন, Is anything wrong?
ফয়জুর রহমান বললেন, স্যার, আপনাকে পিরোজপুর ছেড়ে চলে যেঙ্গে হবে।
মহিবুল্লাহ চুপ করে রইলেন।
স্যার, আমি হুলারহাটে লঞ্চ রেডি করে রেখেছি। লঞ্চ আপনাকে বরিশালে নিয়ে যাবে। বরিশালে আপনি নিরাপদে থাকবেন। চেষ্টা করবেন বরিশাল থেকে ঢাকা চলে যেতে। সেখান থেকে নিজের দেশে।
বরিশাল যাবার পথেও তো আমাকে মেরে ফেলতে পারে।
ট্রেজারির পনেরোজন আর্মড পুলিশ সেই লঞ্চে যাচ্ছে। তাদের আমি আপনার নিরাপত্তার বিষয়টি বলে দিয়েছি।
তারা আপনার কথা শুনবে?
জি স্যার, শুনবে।
কখন যাব?
এখন।
আপনি এই চেয়ারটায় বসুন। আমি তৈরি হয়ে আসছি। আপনাকে ছোট্ট একটা প্রশ্ন করব, জবাব ভেবে চিন্তে দেবেন।
স্যার, প্রশ্ন করুন।
আপনার লয়েলটি কোন দিকে? পাকিস্তানের দিকে, না-কি বিদ্রোহীদের দিকে?
অবশ্যই বিদ্রোহীদের দিকে!
তাহলে আমাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করছেন কেন? আচ্ছা থাক, এই প্রশ্নের জবাব দিতে হবে না।
হুলারহাট লঞ্চ টার্মিনালে ফয়জুর রহমান সাহেব মহকুমা প্রধানকে বিদায় দিলেন। মুহিবুল্লাহ লঞ্চে উঠার আগে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, You are a brother that I never had.
রাত নটা। কিছুক্ষণ আগে ফয়জুর রহমান সাহেব খবর পেয়েছেন মুহিবুল্লাহ ঠিকমতো বরিশাল পৌঁছেছেন। আজ রাতেই রকেট স্টিমারে তার বরিশাল থেকে ঢাকায় রওনা দেবার কথা।
পিরোজপুরের রাস্তায় রাস্তায় জঙ্গি মিছিল। মিছিলের স্লোগান–ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে আমরাও প্রস্তুত। বিরুদ্ধে শব্দটা বরিশালের বিশেষ উচ্চারণে হয়েছে ক্ৰদ্ধে। শুনতে অদ্ভুত লাগছে। মিছিলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ন্যাশনাল আওয়ামী পাটির অল্পবয়েসী নেতা আলি হায়দার খান! ফয়জুর রহমান সাহেবের সঙ্গে এই মানুষটির বিশেষ সখ্য আছে। প্রায় রাতেই মিছিল শুরুর আগে আগে তিনি এসডিপিওর বাংলোয় চা খেতে আসেন। সেখান থেকে যখন মিছিলে যান, তখন তাঁর সঙ্গে এসডিপিও সাহেবের দুই ছেলেও থাকে। তারাও মহাউৎসাহে ইয়াহিয়ার ব্রুদ্ধে আমরাও প্রস্তুত। স্লোগান দেয়। তাদের হাতে থাকে বাবার ব্যক্তিগত পয়েন্ট টু টু বোরের একটা রাইফেল। একটাই রাইফেল দুজন হাত বদল করে। রাইফেল হাতে ছেলেদের দেখে তাঁর মনে একই সঙ্গে আনন্দ হয় এবং শঙ্কাও হয়।
আজ এসডিপিও সাহেবের দুই ছেলে মিছিলে যাচ্ছে না। কারণ আজ তাদের বাসায় জীন নামানো হবে। তাদের উৎসাহের কোনো সীমা নেই।
যে ব্যক্তি জীন আনবেন তার নাম কফিলুদ্দি। মধ্যবয়স্ক বলশালী একজন লোক। মুখভর্তি দাড়িগোফের জঙ্গল। ঘোলাটে চোখ। তার পরনে লুঙ্গি, গায়ে গাঢ় সবুজ রঙের পাঞ্জাবি।
কফিলুদ্দি একটা ঘরে সবাইকে নিয়ে বসাল। সেখানে জায়নামাজ পাতা। সে জায়নামাজে বসে বিভিন্ন সূরা বিশেষ করে সূরায়ে জীন পাঠ করে সশরীরে উপস্থিত করবে। যখন জীন আসবে তখন জীনের সঙ্গে বেয়াদবিমূলক কোনো কথাবার্তা বলা যাবে না। জীনকে প্রশ্ন করলেও করতে হবে অত্যন্ত আদবের সঙ্গে। জীনের উপস্থিতি অনুভব করা যাবে, তবে তাকে দেখা যাবে না। কারণ ঘর থাকবে অন্ধকার। ঘরে কোনো আলো জ্বালা যাবে না।
সবাই অজু করে অপেক্ষা করছে। ঘর অন্ধকার। কেউ তার নিজের হাতই দেখতে পাচ্ছে না। এমন অবস্থা। কফিলুদ্দি একমনে সূরা পড়ে যাচ্ছে। তার গলার স্বর ভারী। সে কেরাত পড়ছে বিশেষ ভঙ্গিমায়। হঠাৎ কী যেন হলো, ঘরের মাঝখানে থপ করে শব্দ। যেন ছাদ থেকে কেউ লাফিয়ে মেঝেতে নামল। মেঝেতে সে ব্যাঙের মতো থপথপ শব্দ করে হাঁটছে। কফিলুদ্দি তখনো কেরাত পড়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় জীন বলল, আসসালামু আলায়কুম। আমি আসছি।
ভয়াবহ অবস্থা। বসার ঘরে বাইরের লোক বলতে কফিলুদ্দি একা। জীন সেজে দ্বিতীয় ব্যক্তির প্রবেশের প্রশ্নই ওঠে না। অথচ কফিলুদ্দিনের কোরআন পাঠ এবং জীনের কথাবার্তা একই সঙ্গে শোনা যাচ্ছে। সে যে থপথপ করে ঘরের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় যাচ্ছে তাও বোঝা যাচ্ছে। মাঝে-মাঝে সাপের শিসের মতো তীব্র শিসের শব্দও পাওয়া যাচ্ছে।
এসডিপিও সাহেবের মেজ ছেলে জাফর ইকবাল ভয়ে ভয়ে বলল, আপনি কোথায় থাকেন?
জীন বলল, আমি থাকি কোহকাফ নগরে।
বাংলাদেশ কি স্বাধীন হবে?
কোনোদিন হবে না।
স্বাধীন কেন হবে না?
আমরা সব জীন একত্র হয়ে পাকিণ্ডানের জন্যে দোয়া করি। পাকিস্তান জিন্দাবাদ।
জীন আরো কিছু প্রশ্নের জবাব দিল। সবার মাথায় হাত রেখে দোয়া করল এবং বলল, সে আর বেশিক্ষণ এখানে থাকতে পারবে না। কারণ তার চলে যাবার সময় এসেছে। পাকিস্তানের তাঁরক্কির জন্যে জীন সমাজে আজ বিশেষ দোয়া হবে। তাকে সেই দোয়ায় সামিল হতে হবে।
ফয়জুর রহমান সাহেব এবং তার স্ত্রী দুজনই জীন যে সত্যি এসেছিলএই বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত হলেন। কফিলুদ্দিকে ভালো বখশিশ দিয়ে বিদায় করা হলো। জীন নামানোর এই অদ্ভুত কর্মকাণ্ড তাঁরা কেউই আগে দেখেন নি। বাংলাদেশ স্বাধীন হবে না–এই ভয়ঙ্কর কথা যদি জীন না বলত, তাহলে জীন অনুভবের আনন্দ ষোল আনা হতো। জাফর ইকবাল বলল, দেশ স্বাধীন অবশ্যই হবে। কারণ জীন আসে নাই। জীনের সব কথাবার্তা আমি টেপ রেকর্ডারে টেপ করেছি। জীন যদি সত্যি আসত, সে দেখত যে আমি এই কাণ্ড করছি। তখনই সে রেগে যেত। সমস্তই কফিলুদ্দির কারসাজি।
ফয়জুর রহমান সাহেব তাঁর মেজ ছেলের সাহস দেখে চমৎকৃত হলেন। সে এক ফাঁকে জীনের কথাবার্তা রেকর্ড করে ফেলেছে। এই চিন্তা তো তার নিজের মাথায় আসে নি। তার জন্যে আরো বড় চমক অপেক্ষা করছিল। তাঁর বড় ছেলে জীনের কথাবাতাঁর রেকর্ড বাজিয়ে পুরোটা শুনে জীন যে আসে নাই সে বিষয়ে কঠিন প্রমাণ উপস্থিত করল। জীন কথাবাতাঁর এক পর্যায়ে পুরোপুরি বরিশালের ভাষায় বলেছে পরথম। তার যুক্তি হচ্ছে, যে জীন থাকে কোহকাফ নগরে সে বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায় প্রথমকে পরথম বলবে না।
দেশ স্বাধীন হবে না। জীনের এই কথায় মন খারাপ করার কোনোই কারণ নেই। কারণ জীন আর কেউ না, কফিলুদ্দি নিজে।
ফয়জুর রহমান সাহেব তাঁর ছেলেদের সাহস এবং বুদ্ধিতে অত্যন্ত প্ৰীত হয়ে সেই রাতে ঘুমুতে গেলেন। তাঁর মনে হলো এরকম ছেলেমেয়ে যার আছে তার চিন্তিত হবার কিছু নেই। যে-কোনো বিপদ এরা সামাল দিতে পারবে। তিনি ঘুমুবার জন্যে বিছানায় শুয়ে পড়েছিলেন। কী মনে করে বিছানা থেকে উঠলেন। অজু করে তাহাৰ্জ্জুতের নামাজ পড়তে গেলেন।
নামাজে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই দরজার কড়া নড়ল। অতি ব্যস্ত ভঙ্গিতে কেউ একজন কড়া নাড়ছে। কড়া নাড়ার ভঙ্গি থেকে বোঝা যাচ্ছে, ভয়ঙ্কর কিছু ঘটেছে। ভয়ঙ্কর কিছু না ঘটলে রজনীর দ্বিতীয় প্রহরে এসডিপিওর বাংলোর কড়া কেউ এইভাবে নাড়বে না।
তিনি এখন কী করবেন? নামাজ শেষ করবেন? না-কি কে কড়া নাড়ছে সেই খোঁজ করবেন? তার উচিত আগে নামাজ শেষ করা। যে কড়া নাড়ছে তার তর সইছে না। সে কড়া নেড়েই যাচ্ছে। কড়া নাড়ার শব্দে ফয়জুর রহমান সাহেবের স্ত্রী আয়েশার ঘুম ভেঙেছে। তাঁর বড় মেয়ে সুফিয়ার ঘুম ভেঙেছে। দুজনই ভীত মুখে বিছানা থেকে নেমেছে।
তিনি নামাজের পাটি থেকে নেমে পড়লেন। অসম্ভব খারাপ সময়ের ভেতর দিয়ে সবাই যাচ্ছে। কখন কী ঘটে যায় কিছুই বলা যায় না। আগে খোেজ নেয়া দরকার।
কড়া নাড়ছেন পিরোজপুর সদর থানার ওসি। তার সঙ্গে আছেন সেকেন্ড অফিসার। ফয়জুর রহমান সাহেব দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে ওসি নিচু গলায় বলল, স্যার, থানায় যেতে হবে।
কী হয়েছে?
ওয়ারলেসে জরুরি ম্যাসেজ দেবে। আপনার সঙ্গে কথা বলবে।
কে দিচ্ছে জরুরি ম্যাসেজ?
সেটা কিছু বলে নাই, তবে মনে হয় মিলিটারি হাইকমান্ড। তবে পুলিশ হেড কোয়াটারও হতে পারে।
ফয়জুর রহমান সাহেব অতি দ্রুত লুঙ্গি বদলে প্যান্ট পরলেন। শার্ট গায়ে দিলেন। তাঁর স্ত্রী ভীত মুখে বললেন, কোথায় যাচ্ছ?
থানায় যাচ্ছি।
কেন?
পরে বলব। পরে।
ছেলেদের কাউকে সাথে নিয়ে যাও। ওদের ডেকে তুলি?
কাউকে ডাকতে হবে না। খামাখা ভয় পেও না। ভয় পাবার মতো কিছু হয় নাই।
ওয়ারলেস ম্যাসেজ এসেছে ঢাকার পুলিশ সদরদপ্তর থেকে। আইজির বক্তব্য প্রচার করা হচ্ছে। ঢাকার অবাঙালি ওয়ারলেস অপারেটর জানাল–দেশের সব জেলা মিলিটারির দখলে আছে। সাবডিভিশন এবং থানা লেভেলেও মিলিটারি অতি দ্রুত অভিযান শুরু করবে। পুলিশ বাহিনীকে জানানো যাচ্ছে, তারা যেন সামরিক বাহিনীকে পূর্ণ সহযোগিতা করে। তারা দেশের আইনশৃঙ্খলা দেখবে এবং দেশের মঙ্গলের জন্যে সামরিক বাহিনীর নির্দেশ পালন করবে।
ফয়জুর রহমান ম্যাসেজ নিলেন। ওসি সাহেব বললেন, স্যার আমরা কী করব? ওসি সাহেবের মুখ দুশ্চিন্তায় ছোট হয়ে গেছে। তিনি রীতিমতো ঘামছেন।
ফয়জুর রহমান বললেন, পুলিশ সবসময় থেকেছে। সাধারণ মানুষদেব সঙ্গে। এখানো আমরা তাই করব। দেশের মানুষের সঙ্গে থাকব।
যারা থাকতে চায় না, তারা কী করবে?
তাদেরটা তারা জানে।
আপনি কোনো নির্দেশ দেবেন না?
না। পুলিশের কমান্ড ভেঙে পড়েছে। এই অবস্থায় নির্দেশ চলে না।
পুলিশ বাহিনীর কেউ যদি দেশে চলে যেতে চায়, তাহলে কি চলে যাবে?
হ্যাঁ যাবে।
ফয়জুর রহমান সাহেব হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরছেন। এই শহরে কোনো স্ট্রীট লাইট নেই। কোনো বাড়িতেও আলো জুলছে না। তবে আকাশে চাঁদ আছে। চাঁদের আলোয় পথ চলতে অসুবিধা হচ্ছে না। হঠাৎ তার কাছে মনে হলো, জোছনার গ্রামের চেয়ে জোছনার শহর অনেক সুন্দর।
তিনি থমকে দাঁড়ালেন। বেশ কিছু সময় জোছনা অনুভব করলেন। আবার যখন হাঁটতে শুরু করলেন, তখন লক্ষ করলেন দূর থেকে কেউ একজন তাকে অনুসরণ করছে। তিনি যখন দাঁড়িয়ে যান, সেও দাঁড়ায়। তিনি হাঁটতে শুরু করলে সেও হাঁটে। ব্যাপারটা কী?
কে ওখানে, কে?
যে অনুসরণ করছিল সে থেমে গেল। ফয়জুর রহমান সাহেব পুলিশি গলায় ডাকলেন, কাছে আসো।
ভীত পায়ে মাথা নিচু করে কেউ একজন আসছে; কাছাকাছি এসে দাড়াবার পর তাকে চেনা গেল। পাংখাপুলার রশিদ।
ফয়জুর রহমান সাহেব হাঁটতে শুরু করলেন। রশিদ পেছনে পেছনে মাথা নিচু করে আসছে। রশিদের এই এক অভ্যাস–তিনি যেখানে যান রশিদ তাকে অনুসরণ করে, যত রােতই হোক। এর কোনো ব্যতিক্রম হয় না।
অদ্ভুত স্বপ্নটার কথা ফয়জুর রহমান সাহেবের হঠাৎ মনে পড়ল। স্বপ্নে তিনি বরযাত্রী যাচ্ছিলেন। সেখানেও তাঁর পেছনে ছিল রশিদ। বাস্তবের অনুসরণকাবী স্বপ্নেও ছিল।
রশিদ!
জি স্যার।
বিয়ে করেছ?
জি-না স্যার।
পরিপূর্ণ জোছনায় দুজন হাঁটছে। ফয়জুর রহমান সাহেবের হঠাৎ মনে হলো— স্বপ্নদৃশ্যেও আকাশে জোছনা ছিল; বরযাত্রী চাঁদের আলো গায়ে মাখতে মাখতে এগুচ্ছিল।
জেনারেল টিক্কা খান
জেনারেল টিক্কা খান আজ চোস্ত পায়জামার সঙ্গে মিলিয়ে হালকা ঘি কালারের পাঞ্জাবি পরেছেন। পায়ে পরেছেন কাবুলি চপ্পল। পাঞ্জাবির উপর নকশাদার কাশ্মিরী কটি পরেছিলেন। কাটির লাল, হলুদ এবং কড়া সবুজ রঙ বেশি কটকট করছিল বলে কটি খুলে ফেলেছেন। কানের লতিতে সামান্য আতর দিয়েছেন। আতরের নাম মেশক-এ আম্বর। তাঁর ফুপাতো ভাই এই আন্তর সৌদি-আরব থেকে পাঠান। আতরের কড়া গন্ধ তাঁর ভালো লাগে না। তবে আজ খারাপ গছে না। মেজাজে সামান্য ফুরফুরে ভাব চলে এসেছে। আগামী দুঘণ্টা তাকে এই ফুরফুরে ভাব ধরে রাখতে হবে।
আজ তার জন্মদিন। জনদিন উপলক্ষে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে দুটি কেক আনা হয়েছে। দুটি কেকের উপর উর্দুতে লেখা জিন্দা পাকিস্তান। অর্ডার দিয়ে বানানো এই দুটা কেক আজ রাতে দুই দফায় কাটা হবে। প্রথম দফায় কাটবেন ঢাকা শহরের কিছু বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে। এদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আছেন, কবি-সাহিত্যিক আছেন, শিল্পী আছেন, ফিল্ম লাইনের কিছু লোকজন আছেন। তাদের সময় দেয়া হয়েছে সন্ধ্যা সাতটা। গাড়ি যাবে, তাদের নিয়ে আসবে। অনুষ্ঠান শেষে গাড়ি তাদের পৌঁছে দেবে।
অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা যখন করা হয়, তখন তার এডিসি ইসমত খান বলেছিল, কেউ আসবে না। টিক্কা খান বলেছেন, যাদের দাওয়াত করা হবে, তারা সবাই আসবে। কেউ বাদ যাবে না।
ইসমত খান তারপরেও বলল, স্যার, মনে হয় না কেউ আসবে।
টিক্কা খান বললেন, বাজি ধরতে চাও? এসে তোমার সঙ্গে ছোট একটা বাজি হয়ে যাক।
এডিসি বলল, বাজি রাখলে আপনি হেরে যাবেন। কারণ আমার বাজির ভাগ্য খুব ভালো। আমি সবসময় বাজিতে জিতি।
চলো দেখা যাক। if you win you get a big fruit basket. কেন তুমি উইন করবে না শুনতে চাও?
If you please.
ইন্টেলেকচুয়ালস আর কাউয়ার্ডস। শেকসপিয়ার বলে গিয়েছেন, cowards die many times before their death. V53TT KŘ মৃত। মৃতদের ইচ্ছাঅনিচ্ছা বলে কিছু নেই। বুঝেছ?
চেষ্টা করছি।
জীবন বঁচিয়ে রাখার জন্যে তারা মাটি চাটবে। দুএকটা ব্যতিক্রম থাকতে পারে। যে-কোনো নিয়মেই কিছু ব্যতিক্রম থাকে। ভালো কথা, আমি গায়ে যে আতর দিয়েছি, তার গন্ধ তোমার কাছে কেমন লাগছে?
কড়া।
ওয়াটার কালারের মতো হালকা টান না। তেলরঙের কঠিন ব্ৰাসের টান। ঠিক বলেছি?
ইয়েস স্যার।
যুদ্ধাবস্থায় ওয়াটার কালার থাকে না। তখন সবই তেলরঙ। সেই অর্থে আন্তরটা মানিয়ে যাচ্ছে।
ইয়েস স্যার।
অতিথিরা সময়মতো এসে পড়লেন। তারা ভীত। তাদের দাড়াবার ভঙ্গি, বসার ভঙ্গি–সব কিছুর মধ্যেই জবুথবু ভাব। তাদের নিঃশ্বাস ফেলার ভঙ্গিও বলে দিচ্ছে তারা ঠিকমতো নিঃশ্বাস ফেলতে ভয় পাচ্ছেন। সবাই মেরুদণ্ড সোজা করে বসেছেন। ভীত মানুষ মেরুদণ্ড সোজা করে বসে। তখন তাদের স্নায়ু টানটান হয়ে থাকে।
জেনারেল টিক্কা বললেন, আপনারা আমার নিমন্ত্রণ রক্ষা করার জন্যে কষ্ট করে এসেছেন, এতে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। আপনাদের কাউকে কাউকে আমি চিনি, সবাইকে চিনি না। আপনারা যদি নিজের পরিচয় দেন, তাহলে আমি অত্যন্ত সম্মানিত বোধ করব। না না, উঠে দাঁড়াতে হবে না। বসে বসে বলুন। Please.
আমি ডঃ …। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক।
Thank you sir, thank you for coming.
আমি ডঃ …। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।
Thank you sir, thank you for coming.
আমি …। আমি একজন কবি।
I am honoured to meet a poet.
পরিচয়পর্ব শেষ হতে সময় লাগল, কারণ জেনারেল টিক্কা সবার সামনেই কিছুক্ষণ দাঁড়াচ্ছেন। ভদ্রতার হাসি হাসছেন। কারো কারো সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন। একজনের সঙ্গে কোলাকুলিও করলেন। পরিচয়পর্ব শেষ হবার পর জেনারেল সুন্দর একটা ভাষণ দিলেন। ভাষণটা পুরোপুরি ইংরেজিতে দেয়া হলো।
আমার মতো সামান্য একজন সৈনিকের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে আপনাদের মতো গুণী-জ্ঞানীরা যে এসেছেন তাতে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি। আমার জন্যে আজকের দিনটি একটি বিশেষ দিন। এই দিনে পাঞ্জাবের এক অখ্যাত দুৰ্গম গ্রামে আমার জন্ম হয়। জন্মদিন পালন করার মতো হাস্যকর ছেলেমানুষি করা কোনো সৈনিকের শোভা পায় না। আমি এই ছেলেমানুষিটা করছি মূলত আপনাদের কাছে পাওয়ার একটি অজুহাত হিসেবে।
আপনারা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, দুষ্কৃতকারীদের সব চক্রান্ত আমরা গুড়িয়ে দিয়েছি। দুষ্কৃতকারীদের পেছনে আছে বেঈমান আওয়ামী লীগ। এক বেঈমানকে সাহায্য করবে: অন্য বেঈমান। আওয়ামী লীগকে সাহায্য করছে বেঈমান হিন্দুস্তান। আমরা এখন প্ৰস্তুত হচ্ছি বেঈমান হিন্দুস্তানকে শায়েস্তা করার জন্যে। আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যেই শায়েস্তা হয়েছে। বড় শয়তান খাঁচায় ঢুকে গেছে। আমরা আমাদের সুবিধামতো সময়ে বড় শয়তানটাকে খাঁচা থেকে বের করব। তাকে নিয়ে আমাদের ইন্টারেস্টিং পরিকল্পনা আছে।
স্বাধীন বাংলা বেতার নামে হিন্দুস্তানের আকাশবাণীর একটি শাখা এতদিন প্রচার করছিল–শেখ মুজিব বিদ্রোহীদের সঙ্গে থেকে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে। আশা করি, আমার ভাষণের পর এই বিষয়ে আপনাদের মনে আর কোনো প্রশ্ন থাকবে না। আগামীকালের সংবাদপত্রে করাচি এয়ারপোর্টে বসে থাকা শেখ মুজিবের একটি ছবি ছাপা হবার কথা।
আমি আমার বক্তৃতার শেষপর্যায়ে চলে এসেছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই কেক কাটা হবে। তারপর আপনারা আমার সঙ্গে এক কাপ চা খাবেন। আপনাদের সবার জন্যে সামান্য কিছু উপহারও আছে। Fruit basket. ইংরেজিতে একটা প্রবচন আছে Say it with flowers. আমি প্রবচনটা সামান্য বদলেছি। আমি বলছি Say it with fruits.
আপনারা সবাই পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করবেন। বেঈমানদের কথায় প্রতারিত হবেন না। দেশে যুদ্ধাবস্থা চলছে। যুদ্ধাবস্থায় আমাদের কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আপনারা এমন কিছু করবেন না যাতে আমাদের কঠিন অবস্থা নিতে বাধ্য করা হয়।
কেক কাটা হলো। কেকের এক কোনায় সবুজ রঙের বড় সাইজের একটা মোমবাতি। জেনারেল টিক্কা বললেন, I am making a wish. বলেই চোখ বন্ধ করলেন। চোখ বন্ধ অবস্থায় ফু দিয়ে মোমবাতি নিভিয়ে বললেন, আমার wish ছিল শান্তি ও ফ্রেন্ডশিপের। আসুন কেক খাওয়া যাক। উনি নিজেই সবার হাতে কেক তুলে দিলেন। উপস্থিত বিশিষ্ট অতিথিরা জেনারেলের ভদ্রতায় মোহিত হলেন।
পরবর্তী আধঘণ্টা জেনারেল নানান গল্পগুজব করলেন। কচ্ছের রান এলাকায় তিনি জেভলিন দিয়ে একটা বন্য শূকরী মেরেছিলেন সেই গল্প। অতিথিদের একজন কচ্ছের রান মরুভূমিতে বন্য শূকর আছে কিনা সেই সন্দেহ প্রকাশ করায় তাৎক্ষণিকভাবে ফটো অ্যালবাম এনে বন্য শূকরীসহ তার ছবি দেখালেন।
যুদ্ধবিদ্যা সম্পর্কে কিছু কথাও হলো। তিনি ইতিহাসের অধ্যাপককে বললেন, পৃথিবীর প্রধান যুদ্ধবিশারদ হলেন আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট। পবিত্র কোরআন শরিফে যে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের নাম আছে, তা কি আপনি জানেন?
ইতিহাসের অধ্যাপক বিস্মিত হয়ে বললেন, জানি না স্যার।
আমাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের নাম আছে। তাকে সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে জুলকারনাইন নামে।
জেনারেলের কথাবার্তায় সবাই চমৎকৃত এবং বিস্মিত। তাঁর জ্ঞানের ব্যাপকতায়ও মুগ্ধ। ইনি যে মোটামুটি ভয়াবহ একজন মানুষ এবং বালুচিস্তানের জল্লাদ নামে খ্যাত–সেটা কারোর মনেই রইল না। জেনারেল সবাইকে নিজে উপস্থিত থেকে গাড়িতে তুলে দিলেন।
তাঁর দ্বিতীয় দফা মিটিং শুরু হলো পুলিশের উপরের দিকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে। আইজি ছিলেন না। তিনজন ডিআইজি এবং দুজন এআইজি। এদের মধ্যে একজন ছাড়া বাকি সবাই বাঙালি। জেনারেল তাদের জন্যে দ্বিতীয় কেকটি কাটলেন। প্ৰথম দফায় তিনি যা যা করেছেন এবং বলেছেন তার সবই আবারো করলেন। কোনো কিছুই বাদ পড়ল না। কচ্ছের রানে বন্য শূকরী শিকারের গল্পটাও করলেন। এইবার অবশ্যি মরুভূমিতে বন্য শূকরী পাওয়া যায় কি যায় না–এই নিয়ে কেউ কোনো সন্দেহ প্ৰকাশ করল না। তারপরেও তিনি মৃত শূকরীর পাশে বর্শা হাতে তার দাঁড়িয়ে থাকার ছবি দেখালেন। বাঙালি পুলিশকর্তাদের সঙ্গে তাঁর বক্তৃতা হলো অল্প।
কাজের কথা আমি সংক্ষেপে বলতে পছন্দ করি। আপনারা মন দিয়ে আমার কথা শুনুন। আমি বাঙালি পুলিশের কাছ থেকে ৯৫ ভাগ লায়েলটি আশা করছি। তারা পাঁচ ভাগ লয়েলটি তাদের বাঙালি ভাইদের জন্যে রাখুক। এই পাঁচ ভাগ নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। আপনাদের কাজে সাহায্য করার জন্যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বেশ কিছু পুলিশ অফিসার আসছেন। প্যারামিলিশিয়া বাহিনীও আপনাদের সঙ্গে থাকবে। আপনাদের কিছু বলার আছে?
স্পেশাল ব্রাঞ্চের এআইজি বললেন, আমাদের কিছু বলার নেই স্যার।
জেনারেল বিরক্ত গলায় বললেন, সবার হয়ে আপনি কথা বলছেন কেন? আপনার কিছু বলার নেই, সেটা আপনি বলবেন। অন্যদেরও যে কিছু বলার নেই তা। আপনি জানেন কীভাবে?
এআইজির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। জেনারেল টিক্কা বললেন, প্রত্যেকেই প্ৰত্যেকের কথা আলাদাভাবে বলবে।
সবাই জানালেন, তাদের বলার কিছু নেই।
জেনারেল বললেন, আপনাদের সঙ্গে আমার কথা শেষ হয়েছে। আপনারা যেতে পারেন। আপনাদের প্রতি আমার নির্দেশ–আগামী চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আপনারা পুলিশের শাসন কাঠামো ঠিকঠাক করবেন। সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগ পুলিশ বাহিনীর কর্মকাণ্ডের প্রতি তীক্ষ্ণ নজর রাখছে–এই তথ্যটা আপনাদের জানিয়ে রাখলাম। আপনাদের প্রত্যেকের জন্যে একটা ফুট বাসকেট রাখা হয়েছে। দয়া করে নিয়ে যাবেন। Good day officers.
জেনারেল ডিনার করতে গেলেন। আমি অফিসার্স মেসে। তিনি সামরিক বাহিনীর উধৰ্ব্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে ডিনার করবেন–এই খবর আগেই দেয়া ছিল। ডিনারের আয়োজন ব্যাপক। নৌ-বাহিনীর বাবুর্চি আব্দুল খালেককে এই উদ্দেশ্যেই আজকের রাতের খাবার তৈরির জন্যে কমিশন করা হয়েছে। জাফরান-মুরগি নামের একটি আইটেম রান্নার ব্যাপারে তার খ্যাতি প্রবাদের মতো। বিশেষ আইটেমটি রান্না হয়েছে। গরুর মাংসের কাবাব রান্নার জন্যে মিরপুর এলাকা থেকে এক বিহারিকে আনা হয়েছে। সে মেসের বাইরে আগুন করে কাবাব তৈরি করছে। যারা কাবাব খেতে ইচ্ছুক, তাদের প্লেট হাতে কাবাবওয়ালার কাছে আসতে হচ্ছে। কাবাবওয়ালা আগুনগরম কাবাব তাদের প্লেটে তুলে দিচ্ছে।
মেসের বাইরে খোলা মাঠেও কিছু চেয়ার-টেবিল রাখা হয়েছে। অনেকে সেখানেও বসেছেন।
উত্তম খাদ্যের সঙ্গে পানের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ান রেড ওয়াইন, রাশিয়ান ভদকা এবং ব্ল্যাক লেভেল হুইস্কি। কয়েক ধরনের বিয়ার আছে, তবে সবচেয়ে বেশি চলছে ভদকা। বিশেষ বিশেষ দিনে বিশেষ কোনো একটা ড্রিংক ক্লিক করে। আজ ক্লিক করেছে ভদকা। সবাই দামি ব্ল্যাক লেভেল বাদ দিয়ে ভদকা টানছেন। শুধু জেনারেল টিক্কার হাতে রেড ওয়াইনের একটা গ্লাস। তিনি প্ৰথম গ্রাস রেডওয়াইন শেষ করেছেন। এখন আছেন। দ্বিতীয় গ্রাসের মাঝামাঝি। আবহাওয়া মনোরম। গুমোট গরমের পর ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে। দূরে কোথাও বৃষ্টি হয়েছে বলে মনে হয়।
বৃষ্টির কথা মনে আসায় জেনারেলের ক্ৰ কুঞ্চিত হলো। বৃষ্টি ভালো জিনিস না। মনসুন এসে পড়ার অর্থ আমি চলাচলের সমস্যা। বিচিত্র এক দেশ–নদী, খাল,বিল, পানি। তিনি শুনেছেন সিলেটের দিকের বিশাল এক অঞ্চল নাকি বৃষ্টি নামলেই অতলে তলিয়ে যায়। যখন বাতাস বয়, তখন নাকি সেখানে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ঢেউ ওঠে। এসব এলাকা কাজ করা সেনাবাহিনীর কর্ম না। নৌবাহিনীর ব্যাপার। জেনারেল এক চুমুকে গ্লাস শেষ করে আবার গ্লাস ভর্তি করলেন। ওয়াইন খাবার নিয়ম এরকম না। ওয়াইন খেতে হয়। হালকা চুমুকে। ঠোট ভিজল কি ভিজল না–এই ভঙ্গিতে। ভদকা-হুইস্কি এসব হলো ঢোল, খোল-করতাল, আর ওয়াইন হলো কোমল বাঁশি।
ব্রিগেডিয়ার শামস হঠাৎ লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে ভদকার গ্লাস উঁচু করে বললেন, জেনারেলের জন্মদিন উপলক্ষে চিয়ার্স। যারা বসেছিল তারা উঠে দাঁড়াল। একের পর এক টেষ্ট হতে থাকল।
টেস্ট ফর পাকিস্তান।
টেস্ট ফর দ্য গ্রেট পিপল অব পাকিস্তান।
টেস্ট ফর দ্য লস্ট সোলজার্স।
আর্মি অফিসারদের পার্টি সাধারণত দ্রুত জমে যায়। এতকিছুর পরেও আজ পার্টি জমছে না। ক্যাটালিস্টের অভাবই কি এর মূল কারণ? আর্মি অফিসারদের রূপবতী বধুরা এইসব পার্টিতে থাকেন। তারাই ক্যাটালিষ্ট। তারা পার্টি জমাবার অনেক কায়দা জানেন। অনেক ঢং করতে পারেন। আজকের পার্টি নারী বিবর্জিত।
কর্নেল জামশেদকে সবাই ধরে বসল ম্যাজিক দেখানোর জন্যে। ম্যাজিকের কিছু কলাকৌশল সবসময় তাঁর পকেটে থাকে। কিছু মুদ্রা, দড়ি কাটার খেলা দেখানোর জন্যে দড়ি এবং কাঁচি, এক প্যাকেট তাস, পিংপং বল। দেখা গেল আজ তিনি কিছুই আনেন নি। একজনের কাছ থেকে এক টাকার একটা মুদ্রা নিয়ে তিনি কয়েন ভ্যানিসিং দেখালেন। হাতের মুঠোয় কয়েন রাখা হচ্ছে। মুঠো খুলতে দেখা যাচ্ছে কয়েন নেই। কয়েন রাখা হলো ডান হাতের মুঠোয়, পাওয়া গেল বাম হাতের মুঠোয়।
কর্নেল জামশেদের হাত সাফাইর খেলাও জমছে না। পার্টি শেষ করা উচিত। যে পার্টি জমে না, তাকে দীর্ঘসময় চলতে দিলে শেষে নানান সমস্যা হয়। জেনারেল টিক্কা পার্টির সমাপ্তি ঘোষণা করলেন। ছোট্ট একটা সমাপনী ভাষণও দিলেন। এই ভাষণটি দিলেন উর্দুতে।
বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সেনাবাহিনীর অন্যতম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। এই বাহিনী দেশরক্ষার যে পবিত্র কর্তব্য নিয়ে নেমেছে, সে-কর্তব্য তারা এমনভাবে পালন করবে। যে জাতির ইতিহাসে তা লেখা থাকবে। মুর্থ পূর্ব পাকিস্তানিদের আমরা বুদ্ধিমান বানিয়ে ছাড়ব। বুদ্ধিমান বানানোর এই প্রক্রিয়া এমনই কঠিন হবে যে কাঠিন্য সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই। আমরা যুদ্ধাবস্থায় আছি। যুদ্ধাবস্থায় দয়া, মায়া, করুণা নামক মানবিক গুণগুলি মাটির নিচে তিন হাত গর্ত কবে পুতে রাখতে হয়। আমরা সাত হাত গর্ত করে পুতে রাখব। মানবিক গুণাবলি মানুষদের জন্যে। পূর্ব পাকিস্তানিদের মতো সুবিধাবাদী, হিন্দুর পাছা চাটা বাহেনচোদদের জন্যে না।
আমি ডেজার্ট ফক্স টেংক সেনাপতি রোমেলের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে এবং আপনাদের সবাইকে আগাম অভিনন্দন জানিয়ে বক্তৃতা শেষ করছি। জেনারেল রোমেল মিশর এক্সপিডিসনের সময় বলেছেন–তুমি যখন শক্রকে দয়া দেখাবে, তখন বুঝবে তুমি সৈনিক নও। তুমি শক্রর বুকের উপর বেয়োনেট উঁচু করে ধরেছ। হঠাৎ শত্রুর করুণ মুখ দেখে তোমার মায়া হলো। তুমি দ্বিধাগ্ৰস্ত হয়ে বেয়োনেট নামিয়ে নিলে। শত্রু তখন তোমার করণীয় কাজটি নিজে সুন্দরভাবে সমাধা করবে। তার বেয়োনেট তোমার হৃৎপিণ্ডে ঢুকিয়ে দেবে।
জেনারেল আর্মি মেস থেকে ফিরেছেন। ড্রাইভারকে সরিয়ে তিনি নিজেই স্টিয়ারিং হুইল ধরলেন। চমৎকার লাগছে গাড়ি চালাতে। ঢাকা শহর স্বাভাবিক হয়ে আসছে। ভালো, খুব ভালো। পত্র-পত্রিকা, রেডিও-টিভিতে এই স্বাভাবিকতার খবর পৌঁছে দিতে হবে। বিদেশী সাংবাদিকদের ডাকা হবে। তারা দেখবে একটি পরিচ্ছন্ন নগরী।
ঢাকার খবরের কাগজগুলি দুপৃষ্ঠা করে বের হচ্ছে। এটা কাজের কথা না। পত্রিকা বের হবে পত্রিকার মতো। মেজর সিদিক সালেককে বলতে হবে। এই দায়িত্ব ইন্টার সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশন্স অফিসারের।
দৈনিক পাকিস্তান-এর সাহিত্যপাতা
দৈনিক পাকিস্তান-এর সাহিত্যপাতায় শাহ কলিম-এর একটি গদ্যরচনা প্রকাশিত হয়েছে। রচনার শিরোনাম— শুদ্ধ প্ৰাণ পাকিস্তান। পঁচিশে মার্চের পর সে নতুন একটা নামে লেখালেখি শুরু করেছে। তার বর্তমান নাম গোলাম কলিন্দর। চেহারাও কিছু পাল্টেছে। দাড়ি, চুল দুটাই বড় হয়েছে। বাবরি চুল মিলিটারিরা সন্দেহের চোখে দেখে বলে রাস্তায় বের হবার সময় সে মাথায় সুচোর কাজ করা একটা রঙিন টুপি পরে। চোখে থাকে সানগ্লাস। সানগ্লাসটা তাকে এক পাকিস্তানি মেজর সাহেব (সিদিক সালেক) উপহার দিয়েছেন। এই মেজর সাহেব প্রেস সেকশনের দায়িত্বে আছেন। তিনি মাঝে-মাঝেই পত্রিকা অফিসে উপস্থিত হন। কলিমউল্লাহর সঙ্গে মেজর সাহেবের ভালো খাতির হয়েছে। তার জিপে কলিমউল্লাহকে মাঝে-মাঝে দেখা যায়। মেজর সাহেব একদিন তাকে আমি মেসে দুপুরের খানা খেতে দাওয়াত করেছিলেন।
দুপুরের খানা খাবার পর কলিমউল্লাহ মেজর সাহেবকে বলেছে, পাকিস্তান রক্ষার জন্যে শরীবের শেষ রক্তের ফোটোটাও সে দেবে। যে রাতে পাকিস্তান রক্ষা পেল, সেই রাতে সে বিশ রাকাত নামাজ পড়ে আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করেছে। কিছু প্রাণহানী হয়েছে। কিছু নিরীহ মানুষও মৃত্যুবরণ করেছে। এটা হবেই। কিছু করার নাই। যে-কোনো মহৎ কাজের ধর্ম হলো, মহৎ কাজের সঙ্গে দুএকটা নোংরা কাজও হয়। আমরা দেখব মহৎ কাজটা।
মেজর সিদিক সালেক কলিমউল্লাহকে একটা পাস দিয়েছেন। পাসটা কলিমউল্লাহর খুব কাজে লাগছে। কারফিউ চলার সময় পাস দেখিয়ে সে রাস্তায় নামতে পারে।
কলিমউল্লাহ মিরপুর এলাকায় তিন রুমের একটি বাসা ভাড়া করেছে। ভাড়া বলা ঠিক হবে না, সে বিনা ভাড়াতেই থাকছে। বাড়িওয়ালা ঘর-বাড়ি ছেড়ে দেশের বাড়িতে চলে গেছেন। কলিমউল্লাহকে বলেছেন, কোনো ভাড়া দিতে হবে না। আপনি বাড়িটা দেখেশুনে রাখবেন। অনেক কষ্টে বাড়ি করেছি, হাতছাড়া যেন না হয়। গরিব মানুষ বড় কষ্টের পয়সায় বাড়ি। শুনেছি বিহারিরা বাড়িঘর নিয়ে নিচ্ছে।
কলিমউল্লাহ বলেছে, আপনি বে ফিকির থাকেন (তার কথাবার্তায় কিছু কিছু উর্দু শব্দ এখন ঢুকে পড়ছে।) এই বাড়ি কেউ নিতে পারবে না। আমি বিহারির বাবা। তাছাড়া বাড়ির গায়ে উর্দুতে লেখা থাকবে–ইহা মুসলমানের বাড়ি। কালো একটা তারা চিহ্নও থাকবে। এই চিহ্নটাই আসল । চিহ্ন দেখলে বিহারি মিলিটারি সবাই বুঝবে–সাচ্চা মুকাম। (আবার উর্দু। শুনতে খারাপ লাগে না।)
মিরপুরের এই বাড়িতে কলিমউল্লাহর দিনকাল খারাপ কাটছে না। বাচ্চু মিয়া নামে সে একজন বাবুর্চি রেখেছে। বাবুর্চির বয়স সর্তে রো-আঠারো। বাড়ি নেত্রকোনার রুয়াইলে। চাকরি নেবার সময় সে বলেছিল সব রান্না জানেদেশী, মোগলাই, ইংলিশ। সে আগে চাইনিজ রেস্টুরেন্টে কিছুদিন কাজ করেছিল বলে টুকটাক চাইনিজও জানে।
কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, সে কোনো রান্নাই জানে না। তার সব তরকারির চেহারা রোগীর পথ্যের মতো। খেতেও রোগীর পথ্যের মতো। তবে তার সবচে বড় গুণ হলো সেই খাবার মুখে দিয়ে সে-ই প্রথম চিৎকার করবে—আস্তাগাফিরুল্লাহ, তরকারির কী অবস্থা! ভাইজান মুখে দেওন যায়? হলুদ খারাপ কিনেছি। হলুদের জন্যে এই অবস্থা। নতুন হলুদ কিনতে হবে।
নতুন হলুদ কেনার পরেও স্বাদ বা বর্ণের কোনো তারতম্য হয় না।
কলিমউল্লাহ আর কাউকে পাচ্ছে না বলে বাচ্চু মিয়াকে হজম করছে। শহরে লোক পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। শহর ফাঁকা। ২৭/২৮ তারিখের দিকে যারা পালিয়েছিল তারা ফেরে নি, বরং দফায় দফায় আরো লোকজন চলে যাচ্ছে। রেডিওতে অবশ্যি বলা হচ্ছে শহরের জীবনযাত্রী স্বাভাবিক। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, শীঘ্রই খুলে দেয়া হবে। ব্যাংকের কাজকর্ম চলছে। সরকারি অফিস-আদালত চলছে।
যারা দুষ্টলোকের কথায় বিভ্রান্ত হয়ে কাজকর্ম ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, তারা কাজে যোগদান করলে তাদের সাময়িক কর্মবিরতি ক্ষমা করা হবে।
লোকজন মনে হয় রেডিওর খবরে বিশ্বাস করছে না। তারা বিশ্বাস করছে। গুজবে। কত ধরনের গুজব যে ছড়াচ্ছে তার কোনো মা-বাপ নেই। বাচ্চু মিয়া গুজব সংগ্রহ করে আনার ব্যাপারে অত্যন্ত দক্ষ। বাতাসে কোনো গুজব ভাসছে, বাচ্চু মিয়া সেই গুজব সংগ্রহ করে আনে নি। এটি কখনো হবে না। একদিন ভোরবেলা সে উধাও হয়ে গেল। সারাদিন তার কোনো খোঁজ নেই। ফিরল রাত আটটায়। তার মুখভর্তি হাসি।
ভাইজান, বলেন দেহি ঘটনা কী হইছে? দুই মিলিট সময়, দুই মিলিটের মধ্যে বলেন।
কলিমউল্লাহ বলল, তোকে আমি আর রাখব না। তুই চলে যা।
বাচ্চু মিয়া বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে বলল, না রাখলে নাই। কপালে যা আছে তাই ঘটব। কিন্তু আপনে কন দেখি আইজের ঘটনা। এক মিলিট সময়। (বাচ্চু মিয়ার ন উচ্চারণে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু মিনিট-কে সে বলবে মিলিট।)
কথা বলিস না, চুপ করে থাক।
ভাইজান, টিক্কা তো শেষ। শে-এ-এ-এ-এ-ষ।
কে শেষ?
টিক্কা। জেনারেল টিক্কা। চাইর গুলি খাইয়া উল্টাইয়া পড়ছে। বুনকা বুনিকা রক্ত। মিলিটারির অবস্থা ছেড়াবেড়া। তারার কমান্ডারই নাই।
তোকে কে বলেছে?
বেবাক শহরের লোক জানে। যদি মিথ্যা বইল্যা থাকি, তাইলে আমি বাপের ঘরের না। আমি জারজ সন্তান। স্বাধীন বাংলা খুইল্যা শুনেন কী ডিক্লার দিছে।
সন্ধ্যার পর স্বাধীনবাংলা বেতার থেকেও এই খবর বলা হলো। জেনারেল টিক্কা নিহত। অসমর্থিত খবরে বলা হয়েছে, পূর্বপাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল টিক্কা মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহত। ঢাকা শহরে তুমুল উত্তেজনা। মিলিটারি সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায়।
বাচ্চু মিয়া বলল, ভাইজান, এখন কী কন? গিরিবের কথা বাসি হইছে বইল্যা ফলছে। আল্লাহ। গরিব নাম দিয়া কী অদ্ভুত জাত বানাইছে। গরিবের টাটকা কথার উপরে বিশ্বাস নাই। বাসি কথার উপরে বিশ্বাস। এখন দেন দুইটা টেকা।
দুটাকা দিয়ে কী করবি?
পোলাও-এর চাল কিনব, ঘি, কিনব। আইজ মোরগপোলাও করব। আমি মোরগপোলাও রান্ধন শিখেছি মনা বাবুর্চির কাছে। একবার খাইয়া দেখেন। উস্তাদ আমায় বিরাট স্নেহ করতেন।
মনা বাবুর্চির মেহের শিষ্যের অতি অখাদ্য মোরগপোলাও খাবার সময়ই রেডিও ও টিভিতে জেনারেল টিক্কার ভাষণ প্রচারিত হলো। জেনারেল টিক্কা সশরীরে উপস্থিত হয়ে নতুন কিছু সামরিক নির্দেশ দিলেন। টিভিতে তাঁর মুখ হাস্যময়। যেন সামরিক নির্দেশ দিতে গিয়ে তিনি বড়ই আনন্দ পাচ্ছেন।
কলিমউল্লাহ বাচ্চু মিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, এটা কী হলো? বাচ্চু মিয়া বলল, ভাইজান এইটা আসল টিক্কা না। এইটা নকল। মিলিটারিরে বুঝ দেওনের জন্যে আনছে। আসলটা শেষ। এইটা মনে হয় তার কোনো ভাই। ভাইয়ে ভাইয়ে চেহারায় মিল থাকে। আমার কথা যদি সত্যি না হয় তাইলে আমি বাপের ঘরের না, আমি জারজ সন্তান। মোরগপোলাও কেমন হয়েছে বলেন।
তুই বল কেমন হয়েছে।
অতি জঘন্য হয়েছে। ঘি ভালো ছিল না। ডালডার ভেজাল। ভেজাল ঘি দিয়া মোরগপোলাও আমার উস্তাদ মনা বাবুর্চিও পাকাবে না। লাখ টেকা দিলেও না।
চুপ থাক।
আচ্ছা যান। চুপ থাকলাম।
তুই তো রান্নার কিছুই জানিস না।
এইটা কী কইলেন ভাইজানি! আমি ছিলাম মনা বাবুর্চির এক নম্বর এসিসটেন। ওস্তাদ আমারে নিজের সন্তানের চেয়ে অধিক স্নেহ করতেন। এখন যুদ্ধের সময় রান্ধনে মন বসে না বইল্যা কিছু হয় না।
যুদ্ধ তুই কই দেখলি?
আরে কী কন? ঢাকার বাইরে ধুরুম ধারুম, গুরুম গারুম সমানে চলতাছে। বেঙ্গল রেজিমেন্ট খাবালা দিয়া ধরছে। মেজর জিয়া পাকিস্তান আমিরে কামড় দিয়া ধরছে। কচ্ছপের কামড়। জীবন যাবে কিন্তু কামড় ছাড়বে না।
চুপ থাক গাধা। কিছুই হচ্ছে না। যুদ্ধ যা হচ্ছে স্বাধীন বাংলা বেতারে হচ্ছে, जबई छूशा यूक।
বাচ্চু মিয়া আহত গলায় বলল, ভুয়া যুদ্ধ!
কলিমউল্লাহ পাইপ ধরাতে ধরাতে বলল (এই পাইপটাও সে মেজর সাহেবের কাছ থেকে সংগ্ৰহ করেছে। অবসর সময়ে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে পাইপ ধরাতে তার ভালো লাগে), শোন মন দিয়ে, যুদ্ধ হচ্ছে বেতারে। এই যুদ্ধে গোলাবারুদ লাগে না, শুধু লাগে গলার জোর। স্বাধীন বাংলা বেতার ভুয়া। তার সব খবর ভুয়া।
এইটা কী কন?
তারা খবর দিল শেখ সাহেব মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে আছেন। আদেশ নির্দেশ দিচ্ছেন। পরে পত্রিকার ছবি দেখলাম। উনি করাচি এয়ারপোর্টে। তারা খবর দিল, সুফিয়া কামাল, ড. নীলিমা ইব্রাহিম মারা গেছেন। আমরা পত্রিকায় উনাদের ছবি দেখলাম। মাশাল্লাহ দুজনেই ভালো আছেন। তারপর শুনলাম টিক্কা খান মারা গেছে। এখন তুই বল মারা গেছে?
অবশ্যই। যে টিক্কারে আপনে দেখছেন বিশ্বাস করেন ভাইজান, আপনের আল্লাহর দোহাই লাগে, এইটা নকল। আসলটা শেষ। আমার কথা যদি মিথ্যা হয়, আমার মাথায় যেন ঠাডা পড়ে।
তুই যা আমার সামনে থেকে।
বর্তমান জীবনটা কলিমউল্লাহর বেশ ভালো লাগছে। থাকার জায়গার কোনো অসুবিধা নেই। এই বাড়ি তো আছেই, এ ছাড়াও থাকার মতো বাড়ি আছে। ঝিকাতলার যে বাড়িতে কলিমুল্লাহ প্রাইভেট টিউশনি করত, সেই ভদ্রলোক দেশে চলে যাচ্ছেন। তিনিও কলিমউল্লাহকে তার বাড়ি দেখাশোনা করতে বলেছেন! একটা চাবিও দিয়ে গেছেন। ঝিকাতলার বাড়িটা বড়। জিনিসপত্রে ঠাসা। কলিমউল্লাহ ঠিক করেছে, কোনো এক সময় ঐ বাড়িতে উঠবে। এক জায়গায় বেশি দিন থাকতে নেই। তাতে শিকড় গজিয়ে যায়। যারা গদ্য লেখে শিকড় গজানো তাদের সমস্যা হয় না। কবিদের জন্যে হয় সমস্যা। কবিদের শিকড় থাকতে হয় না। চলমান ছন্দের মতো কবিদেরও হতে হয় চলমান।
তাছাড়া অবসর সময়ে অন্যের বাড়ির জিনিসপত্র নেড়েচেড়ে দেখতে তার ভালো লাগে। এখন যে বাড়িতে আছে সেই বাড়ির মূল শোবার ঘরের খাটের নিচে রাখা একটা ট্রাঙ্কের তালা খুলে সে খুবই আরাম পেয়েছে। অনেক টুকিটাকি জিনিস, চিঠিপত্র। ছবি। এর মধ্যে নায়লা নামের এক মেয়েকে লেখা কয়েকটা চিঠি আছে চূড়ান্ত অশ্লীল। নায়লার স্বামী নায়লাকে লিখেছে। এত অশ্লীল কোনো লেখা কলিমউল্লাহ আগে পড়ে নি। চিঠিগুলি সে নিজের সংগ্রহে রেখে দিয়েছে। ট্রাঙ্কের ভেতর দুশ একুশ টাকা পাওয়া গেছে (হরলিকসের কৌটাতে মুখবন্ধ করে রাখা)। এরা টাকা ফেলে চলে গেল কেন কে বলবো? হরলিকসের কৌটাসহ টাকাটা কলিমউল্লাহ নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। এখান থেকে সে টুকটাক খরচ করছে। তার তেমন খারাপ লাগছে না।
ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে কলিমউল্লাহ হাঁটছে। হাইকোর্টের সামনের রাস্তা ধরে হাঁটা। সে যাবে দৈনিক পাকিস্তান অফিসে। তার পকেটে নতুন আরেকটি গদ্যরচনা। শিরোনাম–
মহাকবি ইকবাল
একুশে এপ্রিল ইকবাল দিবস। সেই দিবসে রচনাটা প্রকাশিত হবে। বিশেষ বিশেষ দিবসের জন্যে লেখা পাওয়া দুষ্কর । এই লেখাও যাচ্ছে গোলাম কলিন্দর নামে। গোলাম কলন্দির নামটা ভালো পরিচিতি পাচ্ছে। ইংরেজি পত্রিকাগুলিতে কিছু লেখা দিতে পারলে ভালো হতো। কলিমউল্লাহর ইংরেজি একেবারেই আসে না। পেসিভ ভয়েস, একটিভ ভয়েস, টেন্স বড়ই ঝামেলার জিনিস।
হাঁটতে কলিমউল্লাহর ভালো লাগছে। প্রায় ফাঁকা রাস্তা। যারা হাঁটছে রাস্তার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাঁটছে।
আগে রিকশাওয়ালারা রিকশা চালাবার সময় প্রয়োজন না থাকলেও টুং-টাং করত। এখন টুং টাং বন্ধ! বেশিরভাগ রিকশাই খালি। যাত্রী নেই। আগে কাজ না থাকলেও লোকজন রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করত, এখন তা না। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে কেউ পথে নামছে না।
দেয়াল, বাড়িঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। কোথাও চিকা মারা নেই। সামরিক নির্দেশে সব তুলে ফেলা হয়েছে। গভীর রাতে চিকামারা পার্টি এসে চিকা মেরে যাবে সেই উপায় নেই। রাত নটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত কারফিউ। পথে কাউকে দেখা গেলেই গুলি।
কলিমউল্লাহ সিগারেট ধরাল। হাঁটতে হাঁটতে সিগারেট খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্যে হানিকর। এত স্বাস্থ্য স্বাস্থ্য করলে স্বাস্থ্য থাকে না। কোনো কিছু নিয়েই বাড়াবাড়ি করতে হয় না। হাইকোটের বিচারপতি বিএ সিদ্দিকী সাহেবের কথাই ধরা যাক। উনি এমনই কঠিন লোক যে জেনারেল টিক্কাকে গভর্নর হিসাবে শপথ নেওয়াতে রাজি হলেন না। জয় বাংলা, জয় সিদ্দিকী। স্লোগান পর্যন্ত হয়ে গেল। সেই তিনি এখন সোনামুখ করে জেনারেল টিক্কাকে শপথ পাঠ করিয়েছেন। বল হরি হরি বল। আয় বাবা দেখে যা, দুটি সাপ রেখে যা।
ঢাকা এখন ঠিক আছে। ঢাকায় কোনো সমস্যা নেই। কোথাও প্যা পোর ভাব হলেই হেলিকপ্টার বোমা ফেলে আসছে। বোমারু বিমানও আছে। কোদাল খুন্তি নিয়ে যে বাঙালি দেশ স্বাধীন করে ফেলবে বলে ঠিক করেছিল, সেই বাঙালি আসমানী বালা মসিবতের কথা ভাবে নি। তাদের ফ্যাড়াফ্যাড়ানি বন্ধ। এখন বসে বসে আরবি হরফে বাংলা লেখা শিখ। ইয়াহিয়ার বিশেষজ্ঞ কমিটি সুপারিশ দিয়েছে–আরবি হরফে বাংলা লেখার। কী মজা! কী মজা! বে। জবর বা, নুন লাম আলিফ জবর লা। বানলা। মজা হচ্ছে না?
দৈনিক পাকিস্তান-এর সামনে এসে কলিমউল্লাহ শান্তি মিছিলের সামনে পড়ল। শান্তি মিছিল চলে ট্রাকে। তাদের শহরের নানান জায়গায় ঘুরতে হয়। হেঁটে এত জায়গা কাভার করা যাবে না। শান্তির দূতদের দিকে কলিমউল্লাহ আগ্রহ করে তাকাচ্ছে। এদের সঙ্গে পরিচয় থাকা ভালো। বিপদে কাজে আসবে। সবাইকে চেনা যাচ্ছে না। খান-এ-সবুর আছেন, খাজা খয়েরউদ্দিন, গোলাম আযম, বেনজির আহমদ। কলিমউল্লাহর মনে হলো–বাংলাদেশ যদি কোনোদিন (সম্ভাবনা নেই, তবু কথার কথা) স্বাধীন হয়ে যায়, তাহলে এদের কী হবে? শান্তির এই কপোতরা কি তখনো শান্তির বকম বকম করবেন?
কলিমউল্লাহকে দেখে দৈনিক পাকিস্তান অফিসে প্রায় অস্পষ্ট এক ধরনের উত্তেজনা দেখা গেল। দারোয়ান টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিল। অফিসে ঢোকার মুখে ছাপাখানার একজন বললেন, কলিম ভাই, কেমন আছেন? গতকাল আপনাকে দেখি নাই। শরীর খারাপ ছিল? আমাদের এখান থেকে এক কাপ চ খেয়ে যান।
এই খাতিরের কারণ মেজর সাহেবের সঙ্গে ঘোরাঘুরি। সূর্যের কাছাকাছি যারা থাকে তারাও আলো বিচ্ছুরণ করে। কলিমুল্লাহ ইকবাল-বিষয়ক রচনাটা জমা দিয়ে চা নিয়ে বসল। পত্রিকা অফিসের চা সবসময় ভালো হয়। প্রথম কাপ শেষ করার পর দ্বিতীয় কাপ খেতে ইচ্ছা করে।
কলিম ভাই, কেমন আছেন?
ক্যাশিয়ার সাহেব মনে হয় কোনো কাজে ঢুকেছিলেন। কলিমউল্লাহকে দেখে থিতামত খেয়ে গেলেন। তার চোখে স্পষ্ট ভীতি। ভয়ের চোখে তাকে কেউ দেখছে – বাহ, ভালো তো! কলিমউল্লাহর মনটা হঠাৎ ভালো হয়ে গেল। তার জীবনটা মোটামুটি ভয়ের মধ্যেই কেটেছে। আজ পাশার দান পাল্টেছে। তাকেও লোকজন ভয় পাচ্ছে। কলিমউল্লাহ চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, আপনি ভালো আছেন?
জি। আপনার দোয়া।
আমার আবার দোয়ার টাইম কোথায়?
ঠিকই বলেছেন দোয়ার টাইম নাই। ইয়া নফসি, ইয়া নফসি।
ইয়া নফসি ইয়া নফসি হবে কী জন্যে?
কলিমউল্লাহ খুবই আনন্দের সঙ্গে লক্ষ করল ভদ্রলোকের মুখ শুকিয়ে গেছে। বেফাঁস কথাটা বলে তিনি এখন আতঙ্কে অস্থির। কলিমউল্লাহ ঠাণ্ডা গলায় বলল, আপনার সঙ্গে আমার কিছু প্ৰাইভেট কথা আছে।
অবশ্যই অবশ্যই।
আপনি আপনার ঘরে যান। আমি চা-টা শেষ করে আসি।
অবশ্যই অবশ্যই।
ঘরে যেন আর কেউ না থাকে।
জি জি জি।
আপনার নাম হেলাল না?
জি জি জি।
আপনি অপেক্ষা করুন, আমি আসছি।
হেলাল সাহেব জড়ানো পায়ে তার ঘরের দিকে যাচ্ছেন। ভদ্রলোকের কলিজা শুকিয়ে গেছে। এখন চলছে কলিজা শুকাবার কাল। ড্রাই লিভার ওয়েদার।
কলিমউল্লাহ চা শেষ করে আরেক কাপ চা নিল। হেলাল সাহেবের কাছে যত দেরি করে যাওয়া যায় ততই ভালো। টেনশনে ব্যাটার ঘাম বের হয়ে যাক। আমি আমার এক জীবনে অনেক টেনশন নিয়েছি। এখন তোরা খানিকটা নে।
কেমন আছেন হেলাল সাহেব?
জি ভালো আছি। চো
খমুখ শুকনা, ভালো তো মনে হয় না। রাতে ঘুম ভালো হচ্ছে না?
জি ঘুম হচ্ছে। কলিম ভাই, চা খাবেন?
না, চা দুকাপ খেয়েছি।
অন্য কিছু খাবেন? আনায়ে দেই।
না, কিছু খাব না। আচ্ছা শুনেন, কবি শামসুর রাহমান সাহেব অফিসে আসতেছেন না, ব্যাপারটা কী? যুদ্ধে চলে গেছেন না-কি?
জি-না। জি-না।
উনি আছেন কোথায়?
তা তো জানি না। ঢাকা শহরে কি আছেন?
জি-না।
কোথায় আছেন? আমি উনার কোনো খোঁজ জানি না।
ঢাকা শহরে যে উনি নাই সেটা তো আপনি জানেন। তাহলে আপনি কেন বলছেন তার খোঁজ জানেন না? কবির গ্রামের বাড়ি কোথায়? ঠিকানাটা দেন। আমি দেখা করে আসব। ইদানীং কী লেখালেখি করছেন–দেখব।
উনি কোথায় আছেন আমি কিছুই জানি না।
জেনে তারপর আমাকে জানান।
হেলাল সাহেব চুপ করে আছেন। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। কলিমউল্লাহ বলল, একটা জর্দা দিয়ে পান আনার ব্যবস্থা করেন। চা খেয়ে মুখ মিষ্টি হয়ে গেছে।
অবশ্যই অবশ্যই।
আমাকে কাগজ আর কলম দেন। নিরিবিলি একটা ঘর দেন। কেউ যেন আমাকে বিরক্ত না করে। শুধু মেজর সাহেব এলে খবর দিবেন।
অবশ্যই অবশ্যই।
দুপুরে আমার জন্যে কোনো খাবারের ব্যবস্থা করবেন না। মেজর সাহেবের সঙ্গে তাঁর মেসে খাবার কথা। (সম্পূর্ণ মিথ্যা। এই জাতীয় মিথ্যা বলতে কলিমউল্লাহর সবসময় ভালো লাগে।)
কলিমউল্লাহ ইজিচেয়ারে শুয়ে আছে। তার মাথার উপরে ফ্যান ঘুরছে। সে কবিতা লেখার চেষ্টা করছে। প্রথম লাইনটা চট করে মাথায় এসে গেছে। লাইনটা খারাপ না–
একটি ধবল বক এক একা উড়িতেছিল বাংলার করুণ আকাশে।
সে করুণ শব্দটা কাটল। করুণ আকাশ মানেই জীবনানন্দ। কারুণের জায়গায় বসালে মেঘলা। এই শব্দটা ভালো লাগছে না। মেঘলা আকাশ, মেঘলা আকাশ লিখে লিখে মেঘলা শব্দটাকে সবাই পচিয়ে ফেলেছে। মেঘলা কেটে সে লিখলা রূপালি। কবিতার বাকি কয়েক পঙক্তি সে দ্রুত লিখে ফেলল।
একটি ধবল বিক একাকী উড়িতেছিল বাংলার রূপালি আকাশে
সঙ্গিনী তার, মরিয়া গেছে বহুকাল বহুকাল আগে।
সঙ্গিনীর দীর্ঘশ্বাস বার মাস বকের পাখায় লাগে
উড়িতে পারে না সে, সঙ্গিনীর নিঃশ্বাসের ভারে,
সে বড় ক্লান্ত হয়
খুঁজে ফিরে ডানা দুটি মেলিবার নিশ্চিন্ত আশ্রয়।
কবিতা লেখার খুব আবেগ এসে গেছে। বাকি লাইনগুলি কিউ-এর মতো একজনের পিছনে একজন দাঁড়িয়ে আছে। তারা ঠেলা ঠেলিও করছে। এমন সময় হেলাল সাহেব ঘরে ঢুকে বললেন, মেজর সাহেব এসেছেন, আপনাকে ডাকেন।
সঙ্গে সঙ্গে কবিতা লেখা বন্ধ করে উঠে চলে গেলে মনে হবে সেও মিলিটারির ভয়ে আধমরা। এটা করা যাবে না। কলিমউল্লাহ হাতের ইশারা করল। যাতে মনে হয় সে বলছে, এখন লেখালেখি করছি। এই সময় বিরক্ত করা যাবে না। পরে আসুন।
ইশারার পরেও হেলাল সাহেব। আবারো বললেন, স্যার আপনাকে ডাকেন।
কলিমউল্লাহ এমন ভাব করে উঠল যেন সে খুবই বিরক্ত হচ্ছে লেখার মাঝখানে উঠতে হয়েছে বলে।
মেজর সাহেব তাকে দেখেই বললেন, Hello poet!
কলিমউল্লাহ বিনয় এবং লজ্জায় (লজ্জাটা অভিনয়) নিচু হয়ে গেল।
মেজর সাহেব বললেন, কী করছিলে? (কথাবার্তা হচ্ছে উর্দুতে। কাজ চালাবার মতো উর্দু এখন কলিমউল্লাহ বলতে পারে।)
পাকিস্তানকে নিয়ে একটা কবিতা লিখছিলাম স্যার।
ভালো। খুব ভালো। A poet in action.
স্যারের শরীরটা কি খারাপ?
আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে শরীর খারাপ?
ইয়েস স্যার। (মেজর সাহেবের চেহারা দেখে শরীর খারাপ মোটেই মনে হচ্ছে না। তারপরেও কলিমউল্লাহ এই ধরনের কথা বলে, যাতে উনি মনে করেন মানুষটা তাঁর শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তিত।)
আমার শরীর ঠিকই আছে। মন সামান্য অস্থির। যুদ্ধাবস্থায় মন অস্থির থাকবে এটাই স্বাভাবিক।
যুদ্ধ কোথায় দেখলেন স্যার? পাটকাঠি দিয়ে যুদ্ধ হয় না। স্যারকে চা দিতে বলি?
না, চা খাব না। তুমি কি কিছু বাড়তি পয়সা রোজগার করতে চাও? তোমাকে আমি কাজ দিতে পারি।
স্যার, আপনার কোনো কাজের জন্যে অন্যরা পয়সা নিলে নিতে পারে। আমি কীভাবে নিব?
মেজর সাহেব বললেন, কাজ করে পয়সা নিবে। এমন এক কাজ যাতে দেশের সেবা হয়। শক্রর বিরুদ্ধে যুদ্ধ।
কলিমউল্লাহর শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেল। ব্যাটা বলে কী? যুদ্ধে যাব মানে? ছোটবেলায় গুলতি দিয়ে এক ছেলের মাথায় টং করে মার্বেল মেরেছিল। তার যুদ্ধ এই পর্যন্তই। বন্দুক দূর থেকে দেখেছে, হাত দিয়ে এখনো ছুঁয়ে দেখে নি। কলিমউল্লাহ ভােবল বলে–সব পারব স্যার, শুধু যুদ্ধটা পারব না। আমরা শাহ বংশ। শাহ বংশে মানুষ মারা নিষেধ! যা ভেবেছিল শেষ পর্যন্ত তা বলল না। মেজর সাহেব বললেই তো বন্দুক কাধে নিয়ে রওনা হতে হবে না। হাতে সময় আছে। সে বলল, জনাব। আপনি যা করতে বলবেন, আমি তাই করব। যুদ্ধ কী আমি জানি না। বন্দুক হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখি নাই। কিন্তু আপনি বললে বন্দুক নিয়ে শক্রর মোকাবিলা করব। আল্লাহর কীরা, আমাদের নবিজীর কীরা।
মেজর সাহেব বললেন, যুদ্ধ মানেই যে বন্দুক নিয়ে গোলাগুলি তা তো না। যুদ্ধের অনেক ধরন আছে। এই যে আমি পত্রিকা অফিস, রেডিও-টেলিভিশন অফিসে ছোটাছুটি করছি এইটাও যুদ্ধ। তোমাকে আমি একজনের ঠিকানা দেব। তাকে আমি তোমার কথা বলেছি, সে তোমাকে কাজ দিবে।
আলহামদুলিল্লাহ। আপনি ঠিকানা লিখে দেন। আমি আজই উনার কাছে যাব। উনার নাম কী?
তার নাম জোহর। পূর্ণিয়া জেলায় বাড়ি! খুব পড়াশোনা জানা লোক। তুমি যেমন কবিতা লেখ, সেও কবিতা লেখে।
বলেন কী? স্যার, আপনি আমাকে একটা চিঠি লিখে দেন। চিঠি নিয়ে উনার সঙ্গে দেখা করব।
চিঠি ফিটি কিছুই লাগবে না। তুমি তোমার নাম বলবে তাতেই হবে।
আপনার নাম কি স্যার বলব? আপনি পাঠিয়েছেন এটা বলব?
কিছু বলতে হবে না।
মেজর সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। অন্য কোথাও যাবেন। কলিমউল্লাহ বলল, স্যার, এক কাপ চা খেয়ে যান। আপনার সঙ্গে চা খাব বলে আমি এখনো চা খাই নাই।
মেজর সাহেব। আবারো বসলেন। কলিমউল্লাহ ছুটে গেল চা আনতে।
জোহর সাহেবকে দেখে কলিমউল্লাহর আশাভঙ্গ হলো। সে ভেবেছিল জোহর সাহেব খুবই গুরুত্বপূর্ণ একজৎ, ব্যক্তি। তার চালচলন হাবভাব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির মতো হবে। চেহারা ও কাজের গুরুত্বের সঙ্গে মানানসই হবে। কথায় আছে–পহেলা দর্শনধারি।
বাস্তবের জোহর সাহেব আধাবুড়া একজন মানুষ। মাথার চুল কালো ঠিক আছে, মুখভর্তি সাদা খোচা খোচা দাড়ি। চোখের নিচে কালি। চোখ গর্তে ঢুকে আছে। সেই চোখ। আবার গাজাখোরদের চোখের মতো লাল। এই গরমেও তার গায়ে চাদর। চাদরটা আধময়লা। লোকটা চেয়ায়ে পা তুলে বসে আছে। যেকোনো কাবাবের দোকানের এসিসটেন্ট হলে তাকে মানাত। কাবাবের মতোই আগুনে ঝলসানো চেহারা।
কলিমউল্লাহ বলল, মেজর সিদিক সাহেব আপনার কাছে আমাকে পাঠিয়েছেন।
জোহর সাহেব তার দিকে না তাকিয়ে শুদ্ধ বাংলায় বলল, আচ্ছা।
কলিমউল্লাহ বুঝতে পারল না এখন সে কী করবে। জোহর সাহেবের সামনের কাঠের চেয়ারটা টেনে বসবে? না-কি দাঁড়িয়েই থাকবে? জানালা বন্ধ ছোট্ট একটা ঘর। খালি চেয়ার বলতে একটাই, সেটাও অনেকটা দূরে। দুজন লোক বসলে বসবে মুখোমুখি। একজন এক কোনায় অন্য আরেকজন আরেক কোনায় বসবে না-কি! কে জানে হয়তো জোহর সাহেবের সঙ্গে কথা বলার নিয়মই এই। ঘরে সিগারেটের কটু গন্ধ। কলিমউল্লাহ নিজে সিগারেট খায়। তারপরেও সিগারেটের গন্ধে তার বমি এসে যাচ্ছে। ]
কলিমউল্লাহ বলল, মেজর সাহেব বলেছেন, আপনি একজন কবি। আপনাকে দেখার শখ ছিল।
জোহর বলল, আপনার ডানদিকে সুইচ আছে। সুইচটা জেলে দেন। ঘর আলো হোক। তারপর আমাকে ভালোমতো দেখেন।
কলিমউল্লাহ মনে মনে বলল, তুমি তো বাবাজি ত্যান্দির আছ। নিজেরে কি ভাবতেছ, টিক্কা খান?
মনের কথা কেউ শুনতে পায় না–এটা বিরাট সুবিধার একটা বিষয়! কলিমউল্লাহ বাতি জ্বালাতে জ্বালাতে বলল, স্যার, আমি কি চেয়ারটা এনে আপনার সামনে বসব?
জোহর বলল, আচ্ছা বসুন।
স্যার, আমি নিজেও একজন কবি। টুকটাক কবিতা লেখি। ইদানীং গদ্য লেখার চেষ্টা করছি।
ভালো। ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়। যুদ্ধের রাজ্যে পৃথিবী কী?
কলিমউল্লাহর মুখে চট করে কোনো উত্তর এলো না। এই বিহারি কাবাবওয়ালা সুকান্তের কবিতা জানে–খুবই আশ্চর্যের কথা। মেজর সাহেব অবশ্যি বলেছিলেন পড়াশোনা জানা লোক। সে চেয়ার টেনে জোহর সাহেবের সামনে বসতেই জোহর সাহেব বললেন, আপনি আরেকদিন আসুন। আজ আমার শরীরটা ভালো না।
কলিমউল্লাহ। সঙ্গে সঙ্গে বলল, জি আচ্ছা। স্যার, কবে আসব?
যে-কোনো দিন আসতে পারেন। আমি এই ঘরেই বেশিরভাগ থাকি। গর্তজীবী হয়ে গেছি।
স্যার তাহলে যাই। স্নামালিকুম।
ওয়ালাইকুম সালাম। আপনার সঙ্গে কাগজ-কলম আছে?
কলিমউল্লাহ উৎসাহের স্বরে বলল, জি স্যার আছে, আমি সবসময় সঙ্গে কাগজ-কলম রাখি।
একটা ঠিকানা লেখেন।
কলিমউল্লাহ ঠিকানা লিখল। জোহর সাহেব বললেন, ঠিকানাটা একজন পুলিশ ইন্সপেক্টরের বাসার, নাম মোবারক হোসেন।
স্যার, আমি কি উনার সঙ্গে দেখা করব?
উনার সঙ্গে দেখা করা সম্ভব হবে না। উনি পঁচিশে মার্চের রাতে মারা গেছেন। আপনি উনার পরিবারের লোকজনদের সঙ্গে দেখা করবেন। ইন্সপেক্টর সাহেব যে মারা গেছেন–এই সংবাদ সম্ভবত তার পরিবারের লোকজন জানে না।
স্যার, আমি কি সংবাদটা তাদের দিব?
আপনাকে কোনো সংবাদ দিতে হবে না! ইন্সপেক্টর সাহেবের ফ্যামিলি কেমন আছে, তাদের কোনো সমস্যা আছে কি-না–এটা জেনে আসবেন। আমি এই পরিবারের জন্যে কিছু করতে চাই। ইন্সপেক্টর সাহেব একজন খাঁটি মানুষ ছিলেন। ভেজাল মানুষের যুগে খাঁটি মানুষ পাওয়া মুশকিল। দুএকটা খাঁটি মানুষ যখন দেখি, তখন ভালো লাগে।
স্যার, আপনার কথা কি উনাদের বলব?
আমার কথা বলার কোনো দরকার নাই। কলিমউল্লাহ সাহেব?
জি স্যার?
আপনি কেমন মানুষ? খাঁটি মানুষ, না ভেজাল মানুষ?
আমি স্যার ভেজাল।
ঠিক আছে আমাদের ভেজাল মানুষই দরকার। এখন যান।
স্যার স্লামালিকুম।
জোহর সাহেব সালামের জবাব না দিয়ে সিগারেট ধরালেন।
কলিমউল্লাহ মনে মনে বলল, শালা কাবাবওয়ালা!
হ্যালো কবি, মনে মনে কী ভাবছ?
কলিমউল্লাহ চমকে উঠল। এই শালা কি মনের কথা বুঝতে পারে? বিচিত্র কিছু না। পৃথিবীতে নানান কিসিমের মানুষ আছে। কলিমউল্লাহ বিনীত ভঙ্গিতে বলল, স্যার আমি কিছু ভাবছি না। কবিতার একটা লাইন মাথায় এসেছে। ঐটা নিয়ে নাড়াচাডা করছি।
বেশি নাড়াচাড়া করবেন না। ভেঙে যেতে পারে।
জি আচ্ছা স্যার।
বিদায় হন। ক্লিয়ার আউট।
জি আচ্ছা স্যার।
শিউলি গাছে আশ্বিন কার্তিক মাসে ফুল ফুটবে
শিউলি গাছে আশ্বিন কার্তিক মাসে ফুল ফুটবে। এইটাই নিয়ম। কদম গাছে ফুল ফুটবে আষাঢ়ের পূর্ণিমায়, শিমুল ফুটবে চৈত্র দিনের উত্তাপে। অথচ মরিয়মদের বাড়ির সামনের শিউলি গাছে চৈত্র মাসে ফুল ফুটেছে। গাছের একটা ডাল দোতলার বারান্দায় এসেছে। ডাল-ভর্তি ধবধবে সাদা ফুল। গাছটার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? মানুষের মাথা খারাপ হতে পারলে গাছের হবে না কেন? গাছেরাও তো জীবন আছে।
চৈত্র মাসে শিউলি গাছে ফুল–এই খবরটা মাসুমাকে দিতেই সে বলল, ফুটুক। মরিয়ম বলল, আয় দেখে যা। মাসুমা বলল, বুরু, আমার ফুল দেখার শখ নাই।
সাফিয়াকে এই খবরটা দিতেই তিনি অনাগ্রহের সঙ্গে বললেন, আচ্ছা। মরিয়ম বলল, মা, চল তোমাকে দেখাই। সাফিয়া বললেন, পরে দেখব। হাতের কাজটা সারি। অথচ তার হাতে কোনো কাজ নাই। তিনি বাবুর পাশে ঝিম ধরে বসে আছেন। মরিয়ম আরেকবার বারান্দায় গেল ফুল দেখতে। ডালটা উঁচুতে। হাতের কাছে থাকলে কয়েকটা ফুল পাড়ত। শিউলি ফুলের বেঁটা দিয়ে সুন্দর হলুদ রঙ হয়। এই হলুদ রঙ দিয়ে পায়েস রান্না করলে পায়েসে ফুল ফুল গন্ধ চলে আসে।
মরিয়ম মুগ্ধ চোখে আরো কিছুক্ষণ ফুলের দিকে তাকিয়ে নিজের ঘরে ঢুকল। এই খবরটা একজনকে দিতে হবে। সেই একজন কোথায় আছে, সে জানে না। তার কাছে খবর কীভাবে পৌছানো যাবে তাও জানে না। তারপরেও সে প্রায় রোজই একটা করে চিঠি লিখে খাতা ভর্তি করে ফেলছে। কোনো এক সময় চিঠিগুলি নিশ্চয়ই পৌছানো যাবে। মরিয়ম দরজা বন্ধ করে দিল। চিঠি লেখার সময় ইট করে কেউ ঘরে ঢুকলে তার বড় বিরক্তি লাগে। চিঠি লেখার সময়টা সম্পূর্ণ তার একার। তখন আশেপাশে কেউ থাকবে না।
চিঠির সম্বোধন নিয়ে মরিয়মের খুব সমস্যা হয়। কোনো সম্বোধনই তার পছন্দ হয় না। তার খুব ইচ্ছা করে নাইমুলকে সংক্ষেপ করে নাই লিখতে। সে যদি মরিয়মকে সংক্ষেপ করে মরি ডাকতে পারে তাহলে মরিয়ম কেন নাইমুলকে সংক্ষেপ করে নাই ডাকতে পারবে না। সমস্যা অবশ্যি আছেপ্রিয় নাই লিখতে যেন কেমন লাগছে। মনে হয় যাকে লেখা হচ্ছে সে নাই।
মরিয়ম লিখল—
এই যে,
তুমি কেমন আছ? জানো কী হয়েছে? আমাদের বাড়ির সামনের শিউলি গাছে ফুল ফুটেছে। এটা অনেক বড় ঘটনা, কারণ শিউলি গাছে চৈত্র মাসে ফুল ফুটে না। আমার ধারণা গাছটার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। মানুষের যদি মাথা খারাপ হয়, গাছের কেন হবে না? গাছের জীবন আছে–জগদীশ বসু আবিষ্কার করেছেন।
তুমি কি জানো আমারও মাথা খারাপ হয়ে গেছে? রাতে আমি এক ফোটা ঘুমাই না। জেগে বসে থাকি। আমার ঘুম আসে। ফজরের নামাজের পর। আযান শুনে নামাজ পড়বার বদলে ঘুমিয়ে পড়ি। দশটা সাড়ে দশটায় ঘুম ভাঙে। দুপুরবেলা খেয়ে আবার ঘুমুতে যাই। ঘুম থেকে উঠি ঠিক সন্ধ্যায়। উঠি বলা ঠিক হবে না। আমাকে উঠিয়ে দেয়া হয়। কারণ সন্ধ্যাবেলা ঘুমানো খুবই অলক্ষণ। পৃথিবীর কোনো পশুপাখি না-কি সন্ধ্যাবেলা ঘুমায় না। তারা তখন অস্থির হTে ছটফট করতে থাকে! আচ্ছা এটা কি সত্যি?
এখন তোমাকে জরুরি কিছু খবর দেই। এক নম্বর খবর–বাবার কোনো খোঁজ এখনো পাই নাই। উনি কোথায় কেউ বলতে পারছে না। বাবা বাড়িতে না থাকায় সবচে বড় সমস্যা হয়েছে মার। উনি সংসার চালাতে পারছেন না। বাবা তো মার হাতে বাড়তি কোনো টাকা দিতেন না। যা টাকা ছিল সব শেষ। চাল-ডাল-তেল কেনা ছিল বলে কিছুদিন চলেছে। এখন তাও শেষ। মা তার তিন মেয়ের যাকেই দেখেন তাকেই জিজ্ঞেস করেন, এখন কী কবি বল তো?
ব্যাংকে বাবার টাকা আছে। সেই টাকা আমরা তুলতে পারছি না। তবে তুমি এইসব নিয়ে দুশ্চিন্তা করবে না। কারণ ঢাকা শহরে আমাদের আত্মীয়স্বজন আছেন, তারা কেউ-না-কেউ আমাদের খোঁজ করতে আসবে। দেশের বাড়ি থেকে দাদাজানও নিশ্চয় কাউকে-না-কাউকে আমাদের খোজে পাঠাবেন। যাত্ৰাবাড়িতে আমার ছোট নানার (যিনি আমাদের বিয়ে দিয়েছেন)। নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা হয়েছে। উনি যদি একবার আসতেন, তাহলেই আমাদের সব সমস্যার সমাধান হতো।
মার এবং আমাদের তিন বোনেরই কিছু প্ৰণয়না আছে। প্রয়োজনে গয়না বিক্রি করা হবে। তুমি এইসব নিয়ে মোটেই চিস্তা করবে না। আমাদের সামনের বাড়ির বাড়িওয়ালা সবাইকে নিয়ে দেশে চলে গেছেন। বাড়ি পাহারা দেবার জন্যে তার শালাকে রেখে গেছেন। তার নাম রতন। আমরা তাকে ডাকি বগা ভাই (দেখতে বকের মতো, এই জন্যে বগা ভাই)। মা ঠিক করেছে বগা ভাইকে দিয়ে গয়না বিক্রি করাবে। আমরা তিন বোন চাচ্ছি না বগা ভাই আমাদের বাড়িতে আসুক। তার ভাব-ভঙ্গি ভালো না। তার কিছু বিহারি বন্ধু-বান্ধব আছে। তাদের নিয়ে সে প্রায়ই তাদের বাড়িতে আডিডা বাসায়। সে নিজেও বিহারিদের মতো ঘাড়ে রঙিন রুমাল বাধে।
তুমি কি জানো বিহারিদের ভয়ে আমরা সবাই আতঙ্কে থাকি? রাত নটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত কারফিউ থাকে, এই সময় বিহারিরা না-কি মানুষের বাড়িতে ঢোকে। বিশেষ করে সেইসব বাড়িতে যেখানে অল্পবয়েসী মেয়েরা আছে। কী যে ভয়ঙ্কর অবস্থা!
রাতে আমরা সবাই একই ঘরে ঘুমাই। মা হাতের কাছে একটা বটি রাখেন। এখন তুমিই বলো–ওরা যদি দল বেঁধে আসে, মা বটি দিয়ে কী করবে?
যাই হোক, তুমি এইসব নিয়ে চিন্তা করবে না। আমরা ঠিক করে রেখেছি, পরিচিত কাউকে পেলেই আমরা দেশের বাড়িতে চলে যাব; একবার দেশের বাড়িতে পৌঁছতে পারলে আমাদের আর কোনো ভয় নেই।
তুমি ভালো থেকো। শরীরের যত্ব নিও। বেশি সাহস দেখানোর দরকার নেই। অন্যরা সাহস দেখাক, তোমাকে সাহস দেখাতে হবে না।
খুবই অন্যরকম একটা খবর তোমাকে দেই। মার ধারণা আমার সন্তান হবে। আমার চেহারায় না-কি মা মা ভাব চলে এসেছে। ঘটনা তা না। তবে আমি এমন ভাব করছি যে ঘটনা। তাই। দেখেছি আমি কেমন মজা করতে পারি?
আজ এই পর্যন্ত। কাল আবার চিঠি লিখব। আচ্ছা! শোন, রাতে ঘুমুতে যাবার আগে আয়াতুল কুরশি পড়ে তিনবার হাততালি দিয়ে ঘুমুতে যাবে। তালির শব্দ যতদূর যায়, ততদূর পর্যন্ত কোনো বালামুসিবন্ত আসতে পারে না। আমরা সবসময় তাই করি।
ইতি
তোমার মরি
চিঠি শেষ করে মরিয়ম আবার বারান্দায় গেল। অসময়ের ফুল আবার দেখতে ইচ্ছা করছে। ফুল পাড়তে পারলে চিঠিতে ফুলের বোটার হলুদ রঙ লাগিয়ে দেয়া মৃেত। বারান্দা থেকে বগা ভাইকে দেখা যাচ্ছে। বগা ভাই তাকিয়ে আছে তার দিকে। তার সঙ্গে আরো তিনজন আছে। প্রত্যেকেরই পান খাওয়া লাল ঠোট। কাঁধে রুমাল বাধা। তারাও তাকিয়ে আছে বারান্দার দিকে। তাদের একজন হঠাৎ হাততালি দিতে শুরু করল। তার দেখাদেখি অন্য দুজনও হাততালি দিচ্ছে। শুধু বগা ভাই দিচ্ছে না। মরিয়ম ছুটে বারান্দা থেকে ঘরে ঢুকে গেল।
সাফিয়া বললেন, কী হয়েছে?
মরিয়ম বলল, কিছু হয় নাই; কেন জানি ভয় লাগছে।
ভয় লাগছে কেন?
বারান্দা থেকে দেখেছি, বগা ভাই কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব নিয়ে তাকিয়ে আছে। তোকানোটা ভালো না। মা চল আমরা দেশের বাড়িতে চলে যাই।
কীভাবে যাবে? কে নিয়ে যাবে?
বোরকা পরে আমরা আমরা চলে যাব। ট্রেনে উঠব। ট্রেন থেকে নামব।
সাফিয়া কিছু বললেন না। ছেলে কাঁদছে, তিনি ছেলে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মেয়ে তিনটিকে তার খুবই পছন্দ। ভালো মেয়ে, বুদ্ধিমতী, কিন্তু বেশি সরল। মনে কোনো প্যাচ গোছ নাই। তারপরেও তিন মেয়ের একটা ব্যবহারে তিনি মনে খুবই কষ্ট পেয়েছেন। তাদের বাবার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে নাএটা নিয়ে তাদের মনে কোনোরকম দুশ্চিন্তা নেই। যেন তাদের বাবা মফস্বলে ইন্সপেকশনে গিয়েছে, কয়েক দিন পরে ফিরে আসবে। বাবার প্রতি মেয়েদের সামান্য মমতা থাকবে না? এই দুঃসময়ে একটা মানুষ নিখোঁজ হওয়া যে কত ভয়াবহ ব্যাপাব–এটা কি এরা জানে না? ধরে নেয়া গেল মানুষটা খারাপ। খুবই খারাপ। সবার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে। সবসময় ধমকা-ধমকি। সবসময় মেজাজ খারাপ। তারপরেও তো বাবা।
একজনের বিয়ে হয়েছে। স্বামীর চিন্তা তার মাথায়। অন্য কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না। তার কথা বাদ দেয়া গেল। সে থাকুক শিউলি ফুল নিয়ে। অন্য দুজন? তাদের তো বিয়ে হয় নি। তাদের তো সম্পূর্ণ নিজের লোক নেই। তারা কেন বাবাকে নিয়ে সামান্য দুশ্চিন্তাও করবে না? বাবা ঘরে ফিরছে না–এতে তারা যেন খানিকটা নিশ্চিন্ত। প্ৰত্যেকেই স্বাধীনভাবে জীবন-যাপন করতে পারছে। গতকাল রাতে মাসুমা ছুটে এসে বলল, মা, আকাশবাণী থেকে খুব ভালো নাটক হচ্ছে। শুনবে?
সাফিয়া হতভম্ব। এই মেয়ে কী বলে! এখন কি নাটক শোনার সময়? মাসুমা উত্তেজিত গলায় বলল, অচিন্তকুমার সেনগুপ্তর উপন্যাস থেকে নাটক। উপন্যাসের নাম প্রথম কদম ফুল । সাফিয়া বললেন, মা, তোমরা শোন। আমার বাবুকে দেখতে হবে।
মাসুম বলল, মা, বাবু তো ঘুমাচ্ছে।
সাফিয়া বললেন, নাটক শুনতে আমার ভালো লাগে না, তোমরা শোন। তিনি গম্ভীর মুখে বাবুর পাশে বসে রইলেন। বাবুকে এখন আর ইয়াহিয়া ডাকা হয় না। তার বাবু নামই মনে হয় স্থায়ী হয়ে গেছে।
বাবু ঘুমাচ্ছে, তিনি তাকিয়ে আছেন তার দিকে। এক সময় এই ছেলের ঘুম ভাঙবে। ঘুম ভাঙার পরেও তার জগতের অন্ধকার কাটবে না। সে হাত বাডিয়ে প্রিয়জনের স্পর্শ খুঁজবে। তার প্ৰিয়জন কে? সাফিয়া নামের একজন যার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্কই নেই। বাবু যে চোখে দেখে না এবং কানে শোনে নাএই বিষয়ে তিনি এখন পুরোপুরি নিশ্চিত। বোনদের এই ভয়ঙ্কর খবরটা তিনি দেন নি। কেন দেন নি তার কারণ তার কাছেও স্পষ্ট না।
সাফিয়া নিশ্চিত মেয়েরা এখনো বুঝতে পারছে না বাইরের জগতে কী ভয়ানক ওলট-পালট হয়ে গেছে। তারা তাদের নিজেদের জীবন নিয়ে প্রায় চিন্তাহীন সময় কাটাচ্ছে। সব কিছুর মধ্যেই এক ধরনের মজা পাচ্ছে। রাতে একই ঘরে সবাই যখন ঘুমুতে আসছে, তার মধ্যেও যেন মজা আছে। তিন বোন পাশাপাশি শুয়ে থাকে। গুটুর গুটুর করে কথা বলে। হঠাৎ হঠাৎ খিলখিল হাসি। একজন সঙ্গে সঙ্গে বলবে, আস্তে হাসো, আস্তে, মিলিটারি শুনবো। ওমনি আরো জোরালো হাসি। সবচে ছোটটা একরাতে বলল, আপু, মিলিটারিরা মেয়েদের ধরে নিয়ে যায় কী জন্যে?
মাসুমা বলল, আদর করার জন্যে ধরে নিয়ে যায়। তোকে যদি ধরে নিয়ে যায় এমন আদর করবে…
মাসুমা কথা শেষ না করেই শুরু করল হাসি। মাসুমা হাসে, মরিয়ম হাসে। তাদের হাসির মাঝখানে মাফরুহ অবাক হয়ে বলে, তোমরা হাসছ কেন? তিন বোনের হাসি তখন আরো প্ৰবল হয়।
হাসির শব্দে সাফিয়ার বুক ধড়ফড় করে। সুসময়ে হাসি সংসারে আরো সুসময় নিয়ে আসে। দুঃসময়ের হাসি আনে ভয়ঙ্কর কোনো দুঃসময়। মরা বাড়িতে লাশ কবর দেওয়ার আগেই যদি কেউ হাসে, অবশ্যই সে বাড়িতে আরো একজন কেউ মারা যায়। এটা পরীক্ষিত সতী।
মেয়েরা হাসে, সাফিয়ার বুক ধড়ফড় করে। নিঃশ্বাসে কষ্ট হয়। মেয়েরা বুঝতে পারছে না। কিন্তু তিনি বুঝতে পারছেন সামনের দিন ভয়ঙ্কর। ভয়ঙ্কর সেই দিনের কথা ভেবে রাতে তাঁর ঘুম হয় না। অনেক রাত পর্যন্ত এপাশি-ওপাশ করেন। চোখ যখন লাগে বিকট সব স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্নগুলি বিকট শুধু না, নোংরাও। এত নোংরা যে ঘুম ভাঙার পর তার গা ঘিনীঘিন করে। মনে হয়। শরীর অশুচি হয়ে আছে। প্রায়ই স্বপ্লে তিনি তাঁর মৃত বাবাকেও দেখেন। বাবা যেন বাসায় এসেছেন। ছটফট করছেন। যেন খুব ব্যস্ততা। হুড়মুড় করে তিনি শোবার ঘরে ঢুকে বললেন, ও খুকি, তাড়াতাড়ি কর। লঞ্চ ধরতে হবে। (সাফিয়াকে তার বাব, সারাজীবন সাফি ডেকেছেন। কখনো খুকি। ডাকেন নি। অথচ স্বপ্নে কেন খুচুক ডাকেন কে জানে)। স্বপ্লের মধ্যেই সাফিয়া বলে, বাবা এত ব্যস্ত কেন? বললেই তো যাওয়া যায না। আমার ছেলে-মেয়ে আছে, স্বামী আছে, সংসার আছে।
বাবা মাথা ঝাকাতে ঝাকাতে বললেন, আরো রাখা রাখ। কিসের স্বামী কিসের ছেলেমেয়ে, লঞ্চ ছেড়ে দিবে; আয় খুকি–তাড়াতাড়ি আয়। বলেই তিনি সাফিয়ার হাত ধরে টানাটানি শুরু করেন। তখন সাফিয়ার ঘুম ভাঙে।
এই স্বপ্ন সাফিয়া প্রায়ই দেখে, তবে সবসময় লঞ্চ থাকে না। মাঝে-মাঝে থাকে ট্রেন, নৌকা, বাস। স্বপ্নের মূল বিষয়ের কোনো পরিবর্তন হয় না।
স্বপ্নে মৃত ব্যক্তির হাত ধরে টানাটানি খুব খারাপ। এই ধরনের স্বপ্ন দেখলে জানের সদকা দিতে হয়। মাওলানা ডাকিয়ে তওবা করে মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুতিও নিতে হয়। সাফিয়া তার কোনোটিই করেন নি। একটা খতম পড়তে চেষ্টা করছেন–এক লক্ষ চব্বিশ হাজার বার দোয়া ইউনুস।
ইউনুস নবি যখন তিমি মাছের পেটে চলে গেলেন–তখন জীবনের সমস্ত আশা ছেড়ে এক মনে এই দোয়া পড়লেন–লাইলাহা ইল্লা আনতা সোবাহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজাজোয়ালেমিনা। এই দোয়ার কারণে তিমি মাছ ইউনুস নবিকে উগরে ফেলে দিল। তাঁর জীবন রক্ষা হলো। দোয়াটার নাম হয়ে গেল। দোয়া ইউনুস। মাছের পেটে চলে যাবার মতো ভয়ঙ্কর কোনো পরিস্থিতিতে যদি মানুষ পড়ে, তাহলে এই দোয়া পাঠ করলে সে নাজাত পাবে।
সাফিয়ার ধারণা তিনি মাছের পেটেই আছেন। তিনি একা না। পুরো দেশটাই এখন মাছের পেটে। দেশের সব মানুষের উচিত দোয়া ইউনুস পাঠ করা।
শুক্রবারে আসরের নামাজের সময় মরিয়মদের বাড়ির দরজার কড়া কে যেন জোরে জোরে নাড়তে লাগল। মরিয়ম ভয় পেয়ে ছুটে গেল মার কাছে। মাসুমা গল্পের বই পড়ছিল। নাইমুল এই বাড়িতে অনেক গল্পের বই নিয়ে এসেছিল। এখন বইগুলি মাসুমার দখলে। সে একটার পর একটা বই পড়ে যাচ্ছে। দরজার কড়া নাড়ার সময় মাসুমা যে বইটা পড়ছিল তার নাম জঙ্গম। লেখকের নাম বনফুল। কড়া নাড়ার প্রবল শব্দে সে বই ছুঁড়ে ফেলে দৌড়ে এলো মায়ের ঘরে।
সাফিয়া তিন মেয়েকে একটা ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে মাস্টারলিক তালা লাগালেন। বাবুকে কোলে নিয়ে দরজা খুলতে এলেন। যদি মিলিটারি হয়, কোলে শিশুকে দেখে দয়া হতে পারে।
সাফিয়া ভীত গলায় বললেন, কে?
বাইরে থেকে কেউ একজন বলল, ভয়ের কিছু নাই, দরজা খুলেন।
আপনি কে?
নাম বললে আপনি আমাকে চিনবেন না। আমার নাম শাহ কলিম।
সাফিয়া বলল, কী চান?
দরজা খুলেন, তারপর বলি কী চাই। বললাম তো ভয়ের কিছু নাই। আমি বিহারি না। বাঙালি। আমি মিলিটারির কোনো লোক না। বিহারি বা মিলিটারি হলে এতক্ষণে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে যেত।
সাফিয়া দরজা খুললেন। শাহ কলিম নামের লোকটাকে ঘরে ঢুকতে দিলেন। শাহ কলিম বলল, আপনার বাড়ি খুঁজে বের করতে বিরাট পরিশ্রম হয়েছে। ঠিকানা ছিল ভুল। দুপুর একটা থেকে হাঁটাহাঁটি করছি, এখন খুব সম্ভব চারটা বাজে। এক গ্রাস পানি খাওয়াবার ব্যবস্থা করেন। বাড়িতে কি আপনি একা?
হ্যাঁ, আমি একা।
আপনি তো একা না, এই বাচ্চাটা ছাড়াও আপনার তিনটা মেয়ে আছে। আমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলছেন কেন? ভয় পাচ্ছেন? ভয় পাওয়ার কিছু নাই। যান, পানি নিয়ে আসেন।
সাফিয়া পানি আনলেন। লোকটার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলার পর তার মনে হলো, আসলেই ভয় পাওয়ার কিছু নাই। লোকটা বলল, আমি এসেছি আপনাদের খোঁজ-খবর নেবার জন্যে। আপনাদের কোনো সমস্যা আছে কি-না তা জানার জন্য।
সাফিয়া বললেন, আপনি কে?
শাহ কলিম বলল, আমি কে সেটা তো বলেছি। আমার নাম শাহ কলিম। কবিতা লেখি। নানান পত্রপত্রিকায় আমার লেখা ছাপা হয়। আপনাদের কাছে এক ভদ্রলোক আমাকে পাঠয়েছেন। উনি আপনার স্বামীর বন্ধু মানুষ। আপনার স্বামীকে খুব পছন্দ করেন। আপনাদের কোনো সমস্যা আছে কি-না জানার জন্যে পাঠিয়েছেন। এখন বলেন–আছে কোনো সমস্যা?
সাফিয়া আগ্রহ নিয়ে বললেন, মরিয়মের বাবা কোথায় আপনি জানেন?
শাহ কলিম বলল, আমি জানি না।
উনি কি বেঁচে আছেন?
আমি উনার বিষয়ে কিছুই জানি না।
উনার বন্ধু কি জানেন? তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারি?
শাহ কলিম বলল, উনার খন্ধুও কিছু জানেন না। আমাকে পাঠিয়েছেন আপনাদের কাছ থেকে খবর নেবার জন্য। এখন দেখি আপনারাও কিছু জানেন না। যাই হোক, অনেক কথা বলে ফেলেছি। গলা শুকিয়ে গেছে। এক কাপ চ্যা খেতে পারলে ভালো হয়। চা খাওয়াতে পারবেন?
চা খাবার সময় শাহ কলিমের দেখা হলো মরিয়ম এবং মাসুমার সঙ্গে। মাসুমাকে দেখে শাহ কলিমা খুবই বিস্মিত হলো। অতি রূপবতী মেয়ে। নাক সামান্য চাপা। এতেই যেন রূপ ফুটেছে। মেয়েটার কথাবার্তাও চমৎকার। কথা বলার এক পর্যায়ে সে ঘাড় কাত করে। চোখ পিটপিট করতে থাকে। দেখতে ভালো লাগে।
মাসুমা বলল, আপনাকে দেখেই মনে হচ্ছে আপনি সত্যি সত্যি একজন কবি।
শাহ কলিম বলল, আমি তো আসলেই কবি।
মাসুম বলল, যখন চাঁদ উঠে, তখন আপনি কী করেন? হা করে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকেন?
আমি জোছনা দেখি। চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকলে তো জোছনা দেখা যায় না। কোনো কবিই চাঁদ দেখেন না। তারা জোছনা দেখেন।
বলুন দেখি পূর্ণিমা কবে? যদি বলতে পারেন তাহলে বুঝব আপনি আসলেই কবি। জোছনার হিসােব আপনার কাছে আছে। আর যদি বলতে না। পারেন তাহলে আপনি ভু-কবি।
শাহ কলিম অবাক হয়ে বলল, ভু-কবি মানে কী?
মাসুমা বলল, ভু-কবি মানে ভুয়া কবি।
ও আচ্ছা।
আপনি কি রাগ করেছেন?
না।
রাগ করা উচিত ছিল, রাগ করেন নি কেন?
তুমি এমন একটি মেয়ে–যার উপর রাগ করা একজন ভু-কবির পক্ষে খুবই কঠিন।
কবি শাহ কলিম রাত আটটা পর্যন্ত থাকল। তার নিজের লেখা কবিতা মেঘবালিকাদের দুপুর গভীর আবেগের সঙ্গে আবৃত্তি করল। কবিতা আবৃত্তির মাঝখানে অবশ্যি মাসুমা দুইবার খিলখিল করে হেসে উঠল। এতে কবি হিসেবে শাহ কলিমের রাগ করা উচিত ছিল। সে রাগ তো করলেই না, বরং তার কাছে মনে হলো–এত সুন্দর শব্দ ও ঝংকারময় হাসি সে এর আগে কোনোদিন শুনে নি। তার মাথায় এক লাইন কবিতাও চলে এলো–
তার হাসি তরঙ্গ ভঙ্গের মতো শব্দময় ধ্রুপদী নদী
ধ্রুপদী শব্দটা যাচ্ছে কি-না বোঝা যাচ্ছে না, তবে শব্দটা জুৎসই। ধ্রুপদীর শেষ অক্ষর দী, আবার নদীর শেষ অক্ষরও দী। মিলাটা ভালো।
কবি শাহ কলিম ঠিক করল, এই অসহায় পরিবারটিকে সে নিজ দায়িত্বে গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে দেবে। শহর ছেড়ে গ্রামে যাওয়া এখন সমস্যা না। শহরে রিকশা, ঠেলাগাড়ি সবই চলছে। শহর থেকে বের হলেই নৌকা। ট্রাক আছে, বাস আছে। সামান্য চেকিং মাঝেমধ্যে হয়, সেটা তেমন কিছু না।
গৌরাঙ্গ বিরক্ত দাস
আমার নাম গৌরাঙ্গ বিরক্ত দাস। এখন আমি নিজের বাড়িতে আছি। কী মজা কী মজা! নিজ বাড়িতে বাস করি নিজের মনে খাই। তাই তাই তাই।
গৌরাঙ্গের কাছে মনে হলো, সে আনন্দে আছে। বেশ আনন্দে আছে। তার বাড়ি-ঘর ঠিক আছে। জিনিসপত্রও ঠিক আছে। বুক শেলফের পেছনে হাত দিয়ে সে একটা পুরো ওল্ড স্মাগলারের বোতল পেয়ে গেল। মুখ পৰ্যন্ত খোলা হয় নি। আধা বােতল রাম পাওয়া গেল। রাম এমন জিনিস যে নষ্ট হয় না। যত দিন যায় ততই তার স্বাদ বাড়তে থাকে। রামের স্বাদ ঠিক আছে কি-না তা দেখার জন্যে বোতল থেকে সরাসরি কয়েক ঢোক খেল। স্বাদ ভালো আছে। শুধু যে ভালো আছে তা-না, স্বাদ জমেছে। হেভি জমেছে। গৌরাঙ্গের মনে হলো, রাম নামে এমন একটা ভালো জিনিস তৈরি হয়েছে অথচ লক্ষণ নামে কিছু তৈরি হয় নি। লক্ষণ নামে কিছু থাকলে সে দুই ভাইকে পাশে নিয়ে বসতো। এক চুমুক রাম, এক চুমুক লক্ষণ–বাহ কী আনন্দ!
সদর দরজা বন্ধ। বাড়ির জানালাগুলিও বন্ধ।। ঘর দিনের বেলাতেও অন্ধকার হয়ে আছে। এই ভালো। অন্ধকারের আলাদা আনন্দ আছে। মানুষ এমন এক জীব যে আনন্দ পেতে চাইলে আনন্দ পাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারে। এই যে গৌরাঙ্গ আনন্দ পাচ্ছে। সে বসার ঘরে কাপেটে পা ছড়িয়ে বসেছে। তার কাছে এখন মনে হচ্ছে, সংসার আগের মতোই আছে। নীলিমা উপরের তলায় তার বাবার কাছে গেছে। সঙ্গে রুনিকে নিয়ে গেছে। নিশ্চয়ই গৌরাঙ্গের সঙ্গে কোনো ঝগড়া হয়েছে। রাগ করে বাবার কাছে গিয়ে বসে আছে।
মেয়েদের এই স্বভাব–ঝগড়া মাথার ভেতর রেখে দেয়। পুরুষমানুষ এই কাজ কখনো করে না। যখন ঝগড়া হবে পুরোপুরি হবে। পাঁচ-দশ মিনিটে ভুলে যাবে। মেয়েরা ভুলবে না। তারা পাঁচ-দশ বছর ঝগড়া মাথায় রেখে দিবে।
গৌরাঙ্গ রামের বোতলে আরো কয়েক বার চুমুক দিল। প্রায় খালি বোতল রেখে দেবার কোনো মানে হয় না। তাছাড়া আজ দুপুরে খাওয়ার কোনো ব্যবস্থাও নেই। এই জিনিস পেটে থাকলে ক্ষিধে লাগবে না।
ঘরে পিন পিন করছে মশা। তবে মশাগুলি ভালো। তাকে কামড়াচ্ছে না। দিনের মশা কামড়ায় না। রাতের মশা কামড়ায়। ব্যথা লাগে চামড়ায়। বাহ ভালো কবিতা হয়েছে তো! দিনের মশা কামড়ায় না, রাতের মশা কামড়ায়, ব্যথা লাগে চামড়ায়।
কবিতাটা রুনিকে বললে মজা হতো। মেয়েটা কবিতা পছন্দ করে। মেয়েটা এখন আছে তার দাদুভাইয়ের কাছে। দাদুভাইয়ের নাম–হরিভজন সাহা। সমাসের ব্যাসবাক্য নির্ণয় কর হরিভজন। হরিকে যে ভজন করে হরিভজন। যা ব্যাটা হরিকে ভজন করতে থাক, এদিকে সংসার শেষ।
মশারা এখন গৌরাঙ্গকে কামড়াতে শুরু করেছে। ভালো যন্ত্রণা হয়েছে তো! আচ্ছা ঘরে কি ধূপ আছে? ধূপের ধোঁয়ায় মশা থাকে না। আছে তো বটেই। নীলিমা যেমন ধর্ম-কৰ্ম করা মহিলা, প্রতি সন্ধ্যাবেলায় মহাদেবের পটে সে ধূপের ধোঁয়া দেয়। পটে মাথা ঠেকিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। প্রার্থনা করে। কী প্রার্থনা করে? হে দেবাদিদেব মহাদেব। তুমি আমার সংসার সুখে রাখো। মহাদেবকে এত ধোয়া খাইয়েও লাভ হয় নি। সংসার মিলিটারি ছারখার করে দিয়েছে। সব শেষ করে একজনকে বাঁচিয়ে রেখেছে মশার কামড় খাওয়ানোর জনো। গৌরাঙ্গ বোতলে লম্বা চুমুক দিয়ে মনে মনে বলল, খা মশা খা। হিন্দুর রক্ত খা।
গৌরাঙ্গ চিন্তিত বোধ করছে। চিন্তা-ভাবনা অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। মাতাল অবস্থায় কষ্টের কথা ভাবলে কষ্ট দশগুণ বেড়ে যায়। আবার আনন্দের কথা ভাবলে আনন্দ বাড়ে মাত্র দুইগুণ। এই বিচার ঠিক হয় নাই। কষ্ট দশগুণ বাড়লে অনিন্দ ও দাশগুণ বাড়া উচিত; গৌরাঙ্গ আনন্দের ভাবনা ভাবতে শুরু করল। যেন তার পেছনে তার পিঠে হেলান দিয়ে রুনি বসে আছে। (রুনি প্রায়ই এ রকম করে। বাবার পিঠে হেলান দিয়ে নিজের মনে পুতুল নিয়ে খেলে। গুটি গুষ্ট করে কথা বলে। এই সময় সে রুনির মুখ দেখতে পায় না।) এখনো যেন সে রকম হচ্ছে।
ও রুনি, কী করো মা?
গৌরাঙ্গের মনে হলো রুনি ক্ষীণস্বরে জবাব দিয়েছে। জবান্ধটা স্পষ্ট না বলে গৌরাঙ্গ শুনতে পায় নি।
মাগো, গল্প শুনবে?
হুঁ।
কিসের গল্প শুনবে মা?
মশার গল্প।
গৌরাঙ্গ চমকে উঠল। কারণ মশার গল্প এই বাক্যটা সে স্পষ্ট শুনেছে। রুনি যেমন প্রতিটি শব্দ টেনে টেনে বলে, মশা শব্দটাও টেনে টেনে বলেছে–ম… শা…। সে কি পেছন ফিরে দেখবে রুনি সত্যি সত্যি তার পিঠে পিঠ লাগিয়ে বসে আছে কি-না? থাকা দরকার নেই, তারচে বরং মশার গল্প করা যাক।
মাগো শোন, এই পৃথিবীতে আগে মশা ছিল না। কীভাবে মশার জন্ম হলো সেই গল্প শোন। জেলেরা সারারাত মাছ ধরে। কিন্তু রাতে তাদের খুব ঘুম পায়। প্রায়ই দেখা যায় মাছ ধরতে গিয়ে তারা ঘুমিয়ে পড়েছে। একদিন তারা দেবী শীতলাকে বলল, ও দেবী, তুমি একটা ব্যবস্থা করে দাও না যেন আমাদের রাতে ঘুম না পায়। দেবী বললেন, তথাস্তু। বলেই নিজের বাম হাত থেকে কিছু ময়লা জেলেদের হাতে দিয়ে বললেন, এই ময়লা তোরা তোদের বাড়ির কাছের ডোবায় ফেলে দিয়ে আসবি। এতেই কাজ হবে। রাতে আর তোদের ঘুম হবে না। তারা তাই করল। দেবীর হাতের ময়লা নিয়ে ডোবায় ফেলল। ওমি ডোবা থেকে পিন পিন করতে করতে হাজারে বিজারে মশা বের হয়ে এলো। এরপর কী হলো শোন। জেলেরা মাছ ধরতে যায়। মাছ ধরতে গিয়ে ঘুমুতে পারে না। তাদের সারা রাত মশা কামড়ায়।
গৌরাঙ্গ রামের বোতলের পুরোটা গলায় ঢেলে দিল। এখন তার মাথা ঘুরছে। শরীর যেন কেমন করছে। বমি হবে কি? হলে হবে। কী আর করা! দরজায় খট করে শব্দ হলো। গৌরাঙ্গ চমকে তাকাল। কী আশ্চর্য নীলিমা দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে! অবশ্যই চোখের ভুল। রাম বেশি খাওয়া হয়ে গেছে। গৌরাঙ্গ বিড়বিড় করে বলল, নীলিমা কেমন আছ?
নীলিমা জবাব দিল না। দরজায় ওপাশে সামান্য সরে গেল! এখন আর তার মুখ দেখা যাচ্ছে না, তবে শাড়ির আঁচল দেখা যাচ্ছে। বাতাসে যে শাড়ির আঁচল কাঁপছে তাও বোঝা যাচ্ছে। গৌরাঙ্গের হঠাৎ মনে হলো, এখন সে যা দেখছে তাই সত্যি। আগে যা ঘটেছে তা সত্যি না। সে হাড়হড় করে বলল, কয়েকদিন বাসায় ছিলাম না। শাহেদের ওখানে ছিলাম। শাহেদ ভালো আছে।
নীলিমা জবাব দিল না। গৌরাঙ্গ বলল, তুমি কি রাগ করেছে না কি? এখন সময় খারাপ। এখন রাগ করা ঠিক না। তুমি এক কাজ করো, অল্প কিছু জিনিসপত্র ব্যাগে গুছিয়ে নাও। তোমাকে আর রুনিকে নিয়ে বর্ডার পাস করে। আগরতলা চলে যাব। অনেকেই যাচ্ছে। সমস্যা নাই।
এই এই!
কে বলল–এই এই? নীলিমা বলেছে? তাহলে তো ব্যাপারটা স্বপ্ন না। যা ঘটছে, বাস্তবেই ঘটছে। অবশ্যই বাস্তব। নীলিমার চুলের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। সে গন্ধরাজ না কী তেল মাথায় দেয়। অনেক দূর থেকে সেই গন্ধ পাওয়া যায়। গন্ধরাজ নাম সার্থক।
কে কথা বলছে? নীলিমা তুমি?
হুঁ।
দূরে কেন? কাছে এসো?
নীলিমা বলল, তুমি কোথায় বসেছ জানো?
গৌরাঙ্গ অবাক হয়ে বলল, কোথায় বসেছি?
তাকিয়ে দেখো।
গৌরাঙ্গ তাকিয়ে দেখল। সে সোফায় বসে নি। সোফায় হেলান দিয়ে মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসেছে। গৌরাঙ্গ বলল, মেঝেতে বসেছি। সামান্য ধুলা আছে।
ভালো করে দেখো। কালো দাগ দেখতে পাচ্ছ না?
পাচ্ছি। কিসের দাগ?
কিসের দাগ তুমি জানো না?
না।
রক্ত শুকিয়ে গেলে কালো দাগ হয়, তুমি জান না?
গৌরাঙ্গ অবাক হয়ে কালো দাগ দেখছে। তার হাত-পা শিরশির করছে। বুকে চাপা যন্ত্রণা। কেমন যেন লাগছে। গৌরাঙ্গ বিড়বিড় করে বলল, পানি খাব। পানি।
নীলিমা দরজায় আড়াল থেকে সরে গেল। সে কি পানি আনতে গিয়েছে? গৌরাঙ্গ পানির জন্যে অপেক্ষা করতে করতে বমি করল। কালো দাগগুলি এখন বমিতে ঢাকা পড়েছে। ভালো হয়েছে। বেশ ভালো হয়েছে।
ঘর নষ্ট হয়েছে। তাতে অসুবিধা নেই। এই ঘরে সে তো থাকছে না। সে মেয়েকে আর স্ত্রীকে নিয়ে বর্ডার ক্রস করে আগরতলা যাবে। কোলকাতা যেতে পারলে ভালো হতো। আত্মীয়স্বজন আছে। আগরতলায় পরিচিত। কেউ নেই। তাতে অসুবিধা হবে না। অনেকগুলি ক্যাশটাকা তার সঙ্গে আছে। উহু ভুল হয়েছে। তার সঙ্গে নেই। সে টাকা শাহেদের কাছে রেখে এসেছে। শাহেদের কাছে টাকা রাখা আর ব্যাংকে টাকা রাখা সমান। বরং ব্যাংকে রাখার চেয়েও ভালো। ব্যাংক ছুটির দিন বন্ধ থাকে। শাহেদকে সবদিনই পাওয়া যাবে। শুধু একটাই সমস্যা–শাহেদ সারাদিন পথে পথে ঘোরে। কখন গুলি করে মিলিটারি তাকে মেরে ফেলবে কে জানে!
গৌরাঙ্গ চাপা গলায় ডাকল, নীলিমা নীলিমা।
মনে হলো অনেক দূর থেকে নীলিমা বলল, কী?
আচাৰ্য ভবতোষ বাবুর ঠিকানা কি তোমার কাছে আছে?
হুঁ।
উনার ঠিকানা লাগবে। বর্ডারের দিকে রওনা হবার সময় ভবতোষ বাবুর কাছে থেকে তিনটা রক্ষা কবচ নিব। তোমার জন্যে, রুনির জন্যে আর আমার জন্যে। রক্ষা কবচ গলায় থাকলে আর কোনো ভয় নেই।
হুঁ।
তোমার বাবাকে যে মিলিটারিরা মেরে ফেলেছে, এতে এক দিক দিয়ে ভালো হয়েছে। উনি বেঁচে থাকলে উনাকে নিয়ে বর্ডার ক্রস করা মুশকিল হতো। বুড়ো মানুষ হাঁটতে পারত না। তুমি তোমার বাবার মৃত্যু নিয়ে মন খারাপ করবে না। বয়স হয়েছে, মারা গেছেন। অপঘাতে মৃত্যু হয়েছে এইটাই সমস্যা। প্রেতিযোনী প্রাপ্ত হবেন। তাঁর নামে পিণ্ডি দিতে হবে। সব ব্যবস্থা আমি করব। মোটেই চিন্তা করবে না।
আচ্ছা।
পানি আনো। কুলি করব।
গৌরাঙ্গ দেখছে নীলিমা দরজা ধরে দাড়িয়ে আছে। নড়ছে না। তার চেহারাও অস্পষ্ট। তাহলে সে কি মদের ঝোঁকে চোখে ভুল দেখছে? গৌরাঙ্গ এবার হতাশ গলায় মেয়েকে ডাকতে লাগল। রুনি! ও রুনি! রুনি!
নেশা কেটে যাবার পর গৌরাঙ্গ পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে গেল। তৃপ্তি করে গোসল করল। চাল-ডালের খিচুড়ি রাধল। খিচুড়ি রাধার ব্যাপারটা সে শাহেদের কাছে শিখেছে। রান্না এত সহজ তা সে আগে বুঝতে পারে নি। আগে বুঝতে পারলে নীলিমার কাছ থেকে দুএকটা রান্না শিখে রাখত। ইলিশ মাছের পাতুরি শিখে রাখতে পারলে কাজের কাজ হতো।
গৌরাঙ্গ নিজের রান্না খুবই আনন্দ করে খেল। শাহেদের জন্যে তার সামান্য মন খারাপ হলো। শাহেদ এই খিচুড়ি খেলে মজা পেত। সে খিচুড়িতে বুদ্ধি করে তরকারির চামচে এক চামচ ঘি ঢেলে দিয়েছে। শুকনা মরিচের গন্ধের সঙ্গে ঘিয়ের গন্ধ মিলে অসাধারণ গন্ধ বের হচ্ছে। শাহেদ পাশে থাকলে গল্প করতে করতে খাওয়া যেত। সে বলত, মিতা খিচুড়ি কেমন হয়েছে? তোরটার চেয়ে ভালো না?
শাহেদ অবশ্যই বলতো, ভালো।
সে বলতো, বল দেখি ভালো খিচুড়ির পেছনে কার ভূমিকা প্রধান? দশ টাকা বাজি, তুই বলতে পারবি না। তুই হয়তো ভাবছিস, তোর অবদান। আসলে তা না।
তাহলে কার অবদান?
নীলিমার অবদান। সে প্রতিটা জিনিস গুছিয়ে রেখেছে বলে এত মজার খিচুড়ি খাওয়া যাচ্ছে। চাল-ডাল-মসলাপাতি-তেল-ঘি সবই আছে। মিউজিয়ামে জিনিসপত্র যে রকম যত্ন করে সাজিয়ে রাখে, সেইভাবে রাখা আছে।
শাহেদ বলতো, ভাবিকে সবসময় দেখেছি, গোছানো মহিলা।
সে বলতো, গোছানো এক জিনিস, আর নীলিমা অন্য জিনিস। বল দেখি, ঘরে কয় পদের ডাল? বলতে পারলে দশ টাকা বাজি।
বলতে পারব না।
ডাল আছে চার পদের। মসুরি, মাষকলাই, মুগা এবং বুটের ডাল। মধু খেতে চাস? মধু আছে দুই রকমের। সুন্দরবনের মধু, হামদর্দের ওষুধ টাইপ মধু। খাবি একটু মধু? খিচুড়ি শেষ করে এক চামচ খা। ডেজার্ট হিসেবে খা।
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে গৌরাঙ্গ লম্বা একটা ঘুম দিল। ঘুম থেকে উঠল। সন্ধ্যা পার করে। সে কোনো বাতি জ্বালালো না। টিভি চালিয়ে কিছুক্ষণ টিভি দেখল। সামরিক আইন প্রশাসকের নির্দেশ প্রচারিত হচ্ছে। সে খুব চেষ্টা করল নির্দেশগুলি মনে রাখতে। নির্দেশ পুরোপুরি পালন করতে হবে। যে দেশে সে বাস করে, তাকে তো সেই দেশের নিয়মই মানতে হবে।
টিভি দেখার পর সে ট্রানজিস্টার রেডিও নিয়ে বসল। ট্রানজিস্টারের নব ঘুরানোয় মজা আছে। এই শোনা যাচ্ছে রেডিও পিকিং চ্যাও ম্যাও ক্যাও। এই বাংলা সংবাদ। এই আবার চিংমিং পিং। ট্রানজিস্টারের নব ঘুরাতে ঘুরাতেই সে আকাশবাণী শিলিগুড়ি ধরে ফেলল। সেখানে বলা হচ্ছে–স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়েছে। তারিখ দশই এপ্ৰিল।
গৌরাঙ্গের মাথা পুরোপুরি খারাপ হয়ে গেল তার পরদিন। তাকে দেখা গেল রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে। যে কাউকে দেখলেই এগিয়ে যাচ্ছে। গলা নিচু করে। বলছে— বলুন দেখি, বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির নাম কী? এক মিনিট সময়। এক মিনিটের ভিতর বলতে পারলে পুরস্কার আছে। বলতে পারছেন না? সহজ প্রশ্ন করি বলেন দেখি, আমার মেয়ের নাম কী? তিনটা চান্স দেব। তিন চান্সে বলতে পারলে পাশ।
ফাঁকা রাস্তায় ঠেলাগাড়ি
ঢাকা শহরের প্রায় ফাঁকা রাস্তায় ঠেলাগাড়ি নিয়ে বের হয়েছে আসগর আলি এবং তার পুত্র মজনু মিয়া। মজনু মিয়ার বয়স নয়-দশ। তার পরনে কালো রঙের প্যান্ট। গা খালি। তবে মাথায় কিস্তি টুপি আছে। মজনু মুসলমান এই পরিচয়ের জন্যে মাথার টুপি বাঞ্ছনীয়। যে-কোনো কারণেই হোক মজনুর মন বড়ই বিষণ্ণ। সেই তুলনায় আসগর আলিকে মনে হয় আনন্দেই আছে। তার বয়স চল্লিশ। শক্ত-সমর্থ শরীর। বা পায়ে কিছু সমস্যা আছে বলে পা টেনে টেনে হাঁটে। তাতে ঠেলাগাড়ি চালাতে অসুবিধা হয় না। পঁচিশে মার্চের পর সে দাড়ি রেখেছে। লোকমুখে শোনা যাচ্ছে মুখে দাড়ি আছে, কলমা জানে—এরকম সাচ্চা মুসলমানদের মিলিটারিরা কিছু বলে না। চড়-থাপ্পড় দিয়ে ছেড়ে দেয়। এই খবর প্রচারিত হবার ফলে অনেক হিন্দুও দাড়ি রেখেছে। বাইরে বের হবার সময় তারা মাথায় গোলটুপি দেয়। কানের ভাঁজে আতর মাখানো তুলা থাকে। এখন অবশ্যি মিলিটারিবা চালাক হয়ে গেছে। দাড়ি এবং টুপিতে কাজ হচ্ছে না। খৎনা হয়েছে কি-না, লুঙ্গি খুলে দেখাতে হচ্ছে।
আসগর আলি তার ছেলেকে নিয়ে চিন্তিত। তার খৎনা এখনো হয় নাই। মিলিটারির হাতে ধরা পড়লে কোন ঝামেলা হয়–এই চিন্তায় আসগর অস্থির হয়ে থাকে। চার কলমা বাপ-বেটা কারোরই মুখস্থ নাই। আসগর আলি একটা কলমা জানে। কলমা তৈহিদ। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। এক কলমায় কাজ হবে কি-না কে জানে! এই কলমা মজনুকে মুখস্থ করানোর চেষ্টা সে কয়েকদিন ধরেই করছে। মুখস্থ হচ্ছে না। দেখা গেল। কলমা জানার জন্যে এবং খৎনা থাকার কারণে মিলিটারি তাকে ছেড়ে দিল। ধরে নিয়ে গেল। মজনুকে। মিলিটারির সঙ্গে দরবার করে কোনো লাভ হবে না। দরবার করতে গেলে উল্টা গুলি খেতে হবে। চোখের সামনে থেকে ছেলে ধরে নিয়ে যাবে। কিছুই বলা যাবে না। চোখের পানিও ফেলা যাবে না। মিলিটারি চোখের পানি দেখলে রেগে যায়। মুখে হাসি দেখলে তারা রাগে, চোখে পানি দেখলেও রাগে। বড়ই আজিব জাত।
আসগর আলি ছেলের দিকে ফিরে বলল, বাপধন শইলটা কি খারাপ? শইল খারাপ হইলে গাড়ির উপরে উইঠ্যা বস। আমি টান দিয়া নিয়া যাব।
মজনু বলল, শইল ঠিক আছে।
ক্ষিধা লাগছে?
না।
ক্ষিধা লাগলে বলবা। আইজ গোছ-পর্যাটা খাব; অবশ্য রিজিকের মালিক আল্লাপাক। উনার হুকুম হইলে খাব। হুকুম না হইলে কলের পানি।
মজনু কিছুই বলছে না। মাথা নিচু করে হাঁটছে। আসগর বলল, মার জন্যে পেট পুড়ে?
মজনু সঙ্গে সঙ্গে বলল,হুঁ।
এইবার রোগ ধরা পড়েছে। ছেলের মন খারাপ মার জন্যে। অনেকদিন মায়েরে দেখে না। এদিকে আবার শুরু হয়েছে সংগ্ৰাম। খোঁজ-খবর নাই।
বলছি তো যাব। এখন পথেঘাটে চেকিং বেশি। মিলিটারি সমানে ধরতাছে। উনিশ-বিশ দেখলেই ঠুসঠাস। তোরে নিয়াই আমার বেশি বিপদ। খৎনা হয় নাই, এইদিকে আবার কইলমাও মুখস্থ নাই। মুখস্থ হইছে?
না।
ক দেহি, ধরাইয়া দিতেছি। প্রথমে–লা ইলাহা…। তারপর কী?
জানি না।
আসগর তাকিয়ে দেখল, ছেলে চোখ মুছছে। লক্ষণ ভালো না। চোখের পানি মার জন্যে। ছেলের বয়স তো কম হয় নাই। অখনো যদি দুধের পুলার মতো মা মা করে তাইলে চলবে ক্যামনে! এখন রোজগারপতি শিখতে হবে। দুইটা পয়সা কীভাবে আসে সেই ধান্ধায় থাকতে হবে। মা মা করলে মার আদর পাওয়া যায়, ভাত পাওয়া যায় না। জগতের সারকথা কী? জগতের সার কথা মা না, বাপ না। জগতের সারকথা ভাত। হিন্দুরা বলে অন্ন।
বাপরে, ক্ষিধা লাগছে?
না।
খেচুড়ি খাবি, খেচুড়ি? (আসগর কী কারণে জানি খিচুড়িকে বলে খেচুড়ি। এই খাদ্যটা তার বড়ই পছন্দ। এক প্লেট আট আনা নেয়। আট আনায় পেট ভরে না।)
খেচুড়ির কথাতেও ছেলের চেহারায় কোনো পরিবর্তন হলো না। সে এখনো রাস্তার দিকে তাকিয়ে হাঁটছে। চোখ তুলছে না। আসগর বলল, আচ্ছা যা বিষ্যুদবারে নিয়া যাব। বিষ্যুদবার দিন ভালো। রহমতের দিন। বারের সেরা জুম্মাবার কিন্তু বিষ্যুদবারও মারাত্মক। থাকিবি কিছুদিন মার সাথে। আমি চেষ্টা নিব। এর মধ্যে খৎনা করাইতে। হাজম পাইলে হয়। সংগ্রামের সময় কে কই গেছে.
মজনুর মুখে হাসি ফুটল। সে বলল, ভুখ লাগছে।
কী খাবি? খেচুড়ি?
ডিমের সালুন দিয়া ভাত।
আসগর ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। এই ছেলের ভবিষ্যৎ অন্ধ