জীবনকৃষ্ণ বাবুর পুত্রবধু সরজুবালা বললেন, সবই তো দানে চলে গেছে। সামান্য বসতবাটি দিয়ে কি হবে। বাবার ইচ্ছা পূর্ণ হোক। তাঁকে শান্তি মতো যেতে দিন।
বাড়ির উঠোনে খাটিয়াতে শুয়ে শুয়ে জীবনবাবু তার বসতবাটি মৌখিকভাবে দান করে গেলেন। তিনি নিঃস্ব হয়ে পৃথিবীতে এসেছিলেন, নিঃস্ব হয়েই পৃথিবী থেকে ফেরত গেলেন। এমন অসাধারণ ভাগ্য নিয়ে খুব কম মানুষই পৃথিবীতে আসেন।
জীবনকৃষ্ণু বাবুর চেহারা কেমন ছিল তার একটা নমুনা স্কুলের লাইব্রেরী ঘরে আছে। তিন ফুট বাই চার ফুটের বিশাল এক তৈলচিত্র লাইব্রেরীতে টানানো আছে। যেখানে খালি গায়ে খানিকটা কুঁজো হয়ে এক লোক জলচৌকিতে বসা। ছোট ছোট চোখ। কপালও ছোট। ছোট কপাল ও ছোট ছোট চোখের জন্যে তৈলচিত্রের মানুষটাকে ক্রুর ধরনের একজন বলে মনে হত। ঠোঁটের নিচে বিশাল গোঁফের কারণে সেই ক্রুরতার সঙ্গে মিশেছিল নিষ্ঠুরতা। ছবি দেখে লাঠিয়াল বাহিনীর নেতা ছাড়া ভাঁকে আর কিছু মনে করার কোন কারণ ছিল না।
একাত্তরে পাকিস্তানী মিলিটারী এসে ক্যাম্প করল জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুলে। বর্তমান মন্ত্রী সিরাজ সাহেবের বাবা মফিজ সাহেব তখন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান এবং স্থানীয় রাজাকার বাহিনীর প্রধান।
মিলিটারী ক্যাপ্টেন এজাজ মফিজ সাহেবকে বিরক্ত হয়ে বলল, আপনার মত মানুষ থাকতে হিন্দুর নামে স্কুল, এ ৰ্মেন কথা?
মফিজ সাহেব হাত কচলে বললেন, স্যার, আপনি একটা নাম দিয়ে যান। সুন্দর একটা ইসলামী নাম।
ক্যাপ্টেন এজাজ বললেন, স্কুল কলেজ এইসবের নাম হবে বিশিষ্ট দেশপ্রেমী মানুষের নামে।
মফিজ সাহেব বললেন, অবশ্যই অবশ্যই।
স্কুলের নাম দিন কায়দে মিল্লাত লিয়াকত আলী খান স্কুল।
আলহামদুলিল্লাহ, বড় সুন্দর নাম। ময়মনসিংহ থেকে সাইন বোর্ড লিখায়ে এনে আপনার হাতে টানায়ে দিব।
নতুন সাইন বোর্ড টানানো হল–ক্যাপ্টেন এজাজ নিজের হাতেই নতুন সাইন বোর্ড টানতে গেলেন। ফজলুল করিম সাহেব তখন বললেন–স্যার, এইটা আপনি করতে পারেন না। জীবনকৃষ্ণ বাৰু এই অঞ্চলের অতি বিশিষ্ট একজন মানুষ। অতি শ্রদ্ধায় তার নাম স্মরণ করা হয়……
এজাজ বিস্মিত হয়ে বললেন, তুমি কে?
আমি এই স্কুলের একজন শিক্ষক।
তুমি বলতে চাও একজন হিন্দু এই অঞ্চলের একজন বিশিষ্ট মানুষ। সে কি কায়দে মিল্লাত লিয়াকত আলী খানের চেয়েও বড়?
স্যার, উনার নিজের জমিতে উনার টাকায় স্কুল হয়েছে।
প্রশ্নের জবাব দাও। উনি কি কায়দে মিল্লাতের চেয়েও বড়?
ফজলুল করিম সাহেব ইতস্তত করতে লাগলেন। ক্যাপ্টেন এজাজ বললেন, কায়দে মিল্লাত শব্দের অর্থ জানেন?
জ্বি স্যার জানি। সমস্যাটা হল–স্কুল বোর্ডের অনুমতি ছাড়া আপনি নাম পাল্টাতে পারেন না।
আচ্ছা, ঠিক আছে, স্কুল বোর্ডের সভা ডাকা হোক।
সেই দিন বিকেলেই স্কুল বোর্ডের সভা হল। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হল–স্কুলের নাম পাল্টানো হবে।
সভা শেষে ক্যাপ্টেন এজাজ হুকুম দিলেন ফজলুল করিম নামের শিক্ষককে নেংটা করে এই স্কুলের চারিদিকে যেন পঞ্চাশবার চক্কর দেয়া হয়।
মফিজ সাহেবের ক্ষীণ আপত্তি সত্ত্বেও মিলিটারী হুকুম যথাযথভাবে পালন করা হয়। ফজলুল করিম সাহেবের স্ত্রী তখন পাঁচ মাসের গর্ভবতী। খবর শুনে মাথা ঘুরে উঠোনে পড়ে যান। তাঁর মৃত্যু হয় পরদিন ভোরবেলা।
স্কুলের ঘণ্টা এরকম করে বাজছে কেন
স্কুলের ঘণ্টা এরকম করে বাজছে কেন? শব্দটা ঠিক মত আসছে না। ঝনঝন শব্দ না চাপা শব্দ। ব্যাপার কি? ফজলুল করিম সাহেবের ভুরু কুঁচকে গেল। হরিপদকে ডাকা দরকার। এই মুহুর্তে ডাকলে সে ঘণ্টা পেটা বন্ধ করে ছুটে আসবে। কাজেই পাঁচটা ঘণ্টা পড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। বয়সের কারণে হরিপদের সমস্যা হচ্ছে। গত সপ্তাহেই ফোর্থ পিরিয়ড শুরু হচ্ছে সে পাঁচটা ঘণ্টা বাজিয়ে বসে আছে। এইসব অপরাধ ক্ষমার যোগ্য না। তিনি দুটাকা ফাইন করেছেন। বেতন থেকে কাটা যাবে। যার প্রধান কাজই ঘণ্টা পেটানো। সে যদি তাতেই ভুল করে বসে তাহলে হবে কিভাবে?
দুটাকা ফাইন করে তার নিজেরও মন খারাপ হয়েছে। দুটাকার মূল্য হরিপদের কাছে অনেক। তারপরেও স্কুলের শৃঙ্খলার ব্যাপার আছে। ক্লাসে ক্লাসে ছেলেরা কান খাড়া করে আছে ঘণ্টা শোনার জন্য। চারটার জায়গায় পাঁচটা ঘণ্টা শুনলে ওদের কেমন লাগবে?
ফজলুল করিম সাহেব টিচারদের রোস্টারের দিকে তাকিয়ে আছেন। মমতাজ সাহেব আজও এবসেন্ট। মাহবুব সাহেব এসেছেন ফার্স্ট পিরিয়ডের পর। শিক্ষকদেরও ফাইন করার ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন ছিল। নিয়ম সবার জন্যেই এক হওয়া উচিত। কারো জন্যে কঠিন নিয়ম। কারো জন্যে সহজ, অ হয় না।
হরিপদ।
আজ্ঞে।
ঘণ্টা নিয়ে ভেতরে আস।
হরিপদ স্কুল-ঘণ্টা বগলদাবা করে ভয়ে ভয়ে ঢুকল। বিনয়ে নিচু হয়ে পড়ল। এখন অবশ্যি বিনয় ছাড়াই তার শরীর নুয়ে পড়েছে। কোমর বেঁকে গেছে। বয়স মানুষকে বাকা করে ফেলে।
স্কুলের ঘণ্টার আওয়াজ ঠিকমত শোনা যাচ্ছে না ব্যাপার কি?
হরিপদ আরো নিচু হয়ে গেল। মাথা প্রায় মাটির সঙ্গে যাচ্ছে।
দেখি ঘণ্টা দেখি। ঘণ্টা ঠিক আছে।
হরিপদ ঘণ্টাটা টেবিলের ওপর রাখল। ঘণ্টা ঠিক আছে। ফেটে যায়নি। এই স্কুলের সবচে মূল্যবান সম্পত্তি হল–ঘণ্টাটা। জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুল শুরু হয় এই ঘণ্টা দিয়ে। ফজলুল করিম সাহেব তখন ছিলেন না–কত আগের কথা। তবে তিনি শুনছেন–স্কুল শুরু হবার প্রথম ঘণ্টা জীবনকৃষ্ণ বাবু নিজে বাজিয়েছিলেন। ঘণ্টা বাজিয়ে তিনি কিছুক্ষণ কেঁদেছিলেন। কি জন্যে কেঁদেছিলেন? মনের আনন্দে?