ইউনিয়ন বোর্ডের রাস্তা ছেড়ে রিকশা এবার কাঁচা রাস্তায় নেমেছে। চাকা থেকে ছপছপ শব্দ হচ্ছে। রাস্তায় পানি জমে গেছে।
স্যার, মনে লইতাছে, এই বছর বান হইব।
হতে পারে। প্রতি দুবছর পর পর বন্যা হয়। গত দুবছর বন্যা হয় নি।
ফজলুল করিম সাহেবের বাড়ি দেখা যাচ্ছে। বাইরের উঠোনে রেশমী হারিকেন জ্বালিয়ে রেখেছে। হারিকেনে এত আলো হয়? চারিদিকের সুপারি গাছ পর্যন্ত চোখে পড়ছে।
ফজলুল করিম সাহেবের মন ভাল হয়ে গেল। তিনি জানেন–রেশমী ঘর বাড়ি ঝকঝক করে রেখেছে। উঠোনে জ্বলন্ত হারিকেনের পাশে জলচৌকি। জলচৌকির পাশে বালতি ভর্তি পানি আর একটা মগ। তার পাশেই সাবানদানীতে সাবান। হাত পা ধুতে ধুতেই শুকনা একটা গামছা নিয়ে রেশমী দাঁড়াবে। এই মেয়েটা বোধহয় মনের কথা বুঝতে পারে। সে তাকে তখনই খেতে ডাকবে যখন তিনি ক্ষুধার্ত। খেতে বসে দেখবেন–যে সব খাবার তিনি খেতে চেয়েছেন সেগুলিই রান্না করা হয়েছে। মাঝে মাঝে রাতে তাঁর চা খেতে ইচ্ছা করে। রেশমী সেই সব রাতেই চা বানায়। তার চা খেতে ইচ্ছা করছে না অথচ রেশমী চা বানিয়ে এনেছে এরকম কখনো হয়নি।
রেশমী উদ্বিগ্ন মুখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। ফজলুল করিম সাহেবকে দেখে তার উদ্বেগ কিছুটা কমল। সে ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল।
রেশমীর বয়স তেইশ চব্বিশ। হালকা পাতলা গড়নের জন্যে তাকে আরো কম দেখায়। গায়ের রঙ শ্যামলা। তার চেহারা খুবই সাধারণ, কিন্তু চোখে অসহায় ভাব আছে বলে ফজলুল করিম সাহেব যতবারই তার দিকে তাকনি ততবারই তার খুব মায়া লাগে।
রেশমী বলল, কাঠের পুলটা না-কি ভাইঙ্গা গেছে?
না-তো।
আমি খুব চিন্তার মইধ্যে ছিলাম।
না, পুল ভাঙ্গে নাই। পুলের উপর দিয়েই তো আসলাম।
এই দিকে রটনা পুল ভাঙ্গছে। একটা গরুর গাড়ি পুল ভাইঙ্গা নিচে পরছে।
তিনি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। মানুষ গল্প তৈরী করতে পছন্দ করে। পুল ভাঙ্গেনি অথচ পুল ভাঙ্গার গল্প তৈরী হয়ে গেছে। কেউ এসে চাক্ষুষ দেখে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করছে না।
ফজলুল করিম সাহেব জলচৌকির উপর উঠে দাঁড়ালেন। হাত পা ধুবেন। জলচৌকির পাশেই কাঠের বৌলাওয়ালা খড়ম সাজানো। রেশমীর কাজে কোন রকম খুঁত নেই। তিনি বালতি থেকে মগ ভর্তি পানি নিলেন। পায়ে পানি ঢালতে যাবেন। রেশমী এসে হাত থেকে মগ নিয়ে নিল।
আপত্তি করা অর্থহীন, রেশমী পায়ে পানি ঢালতে দেবে না। কখনো দেয়। পায়ে পানি ঢালার কাজটা সে খুব আগ্রহের সঙ্গে করে।
ফজলুল করিম সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। রেশমী এক হাতে পায়ে পানি ঢালছে। অন্য হাতে কাদা মুছে দিচ্ছে। রেশমীর পিঠ দেখা যাচ্ছে। তার মুখটা শ্যামলা হলেও পিঠতো বেশ ফর্সা দেখাচ্ছে। তার মাথার চুল বাঁধা। এই মেয়েটির চুল খুব লম্বা। ফজলুল করিম সাহেবের শরীর কেমন ঝিম ঝিম করতে লাগল। তিনি চেষ্টা করেও রেশমীর ফর্সা পিঠ থেকে চোখ সরাতে পারছেন না। তিনি বুঝতে পারছেন কাজটা ঠিক হচ্ছে না। ভুল হচ্ছে। অন্যায় হচ্ছে।
রেশমী।
জি।
সাত লাখ টাকা স্কুলের জন্যে পাওয়া গেছে। সরকারি অনুদান। আমার এক ছাত্রের কথা তোমাকে বলেছিলাম না? জয়েন্ট সেক্রেটারী, ও-ই ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
ভাল তো।
হ্যাঁ, ভাল। অনেক দিনের ইচ্ছা স্কুলটা পাকা করা। স্কুল ঘর পাকা হবে। ছাত্রদের হোস্টেল থাকবে। টিউব ওয়েল বসানো হবে…….
পা ধোয়ানো হয়েছে। জলচৌকি থেকে নামার সময় ফজলুল করিম সাহেব রেশমীর কাঁধে হাত রেখে নামলেন। এমন না যে তিনি ঢলে পড়ে যাচ্ছিলেন। কাঁধে হাত রেখে তিনি নিজেই লজ্জায় এবং সংকোচে এতটুকু হয়ে গেলেন। রেশমীর কোন ভাবান্তর হল না–যেন এটাই স্বাভাবিক।
খেতে বসে ফজলুল করিম সাহেব অনর্গল কথা বলে যেতে লাগলেন। এটা নতুন কিছু না–রেশমীর সঙ্গে তিনি প্রায়ই গল্প করেন। রেশমী চুপচাপ শুনছে। তার সব গল্পই রেশমীর আগের শোন–একবার না, অনেকবার শোনা–কিন্তু রেশমী এমনভাবে তাকিয়ে আছে যে মনে হচ্ছে সে এই প্রথমবার শুনছে।
বুঝলে রেশমী, ১১ই মে নাইননি সেভেন্টি ওয়ান, পাক আর্মি হঠাৎ নীলগঞ্জ এসে উপস্থিত। চারদিকে ছছাটাছুটি হৈ চৈ পড়ে গেল। এখন যে মন্ত্রী আছেন সিরাজ সাহেব তাঁর বাবা মফিজ তালুকদার তখন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান। মিলিটারী গিয়ে উঠল তাঁর বাড়িতে। আমরা সবাই আতংকে অস্থির–কি হয়, কি না হয়। হিন্দু যারা ছিল আগেই চলে গেছে। আমাদের স্কুলের বিনয় বাবু শুধু ছিলেন। তাকে ধরে নিয়ে গেল। তাঁর বাড়িতে মরা কান্না……।
গল্পের মাঝখানে ফজলুল করিম সাহেবের মনে হল–রেশমীর জন্যে তিনি একটা শাড়ি কিনেছিলেন। শাড়িটা রিকশা থেকে রাস্তার কোথাও পড়ে গেছে। নতুন শাড়ি পেলে মেয়েটা খুশি হত। একটা ভুল হয়ে গেল। বিরাট ভুল।
রেশমী।
জ্বি।
বিছানা কর, শুয়ে পড়ব।
গল্পটা শেষ করেন।
আরেক দিন। আজ আর ইচ্ছা করছে না। তুমি বিছানা করে দাও।
খাওয়া দাওয়া করবেন না।
না। শরীরটা ভাল না। উপোস দেব। পঞ্চাশের পর মাঝে মাঝে উপোস দেয়া লাগে।
ফজলুল করিম সাহেব ঘুমুতে গেলেন। রেশমী মশারি খাটিয়ে দিল। বিছানার চারদিকে মশারি খুঁজে দিল। পাতলা একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে দিল। মেয়েটা কত অসংকোচেই না তার গায়ের উপর ঝুঁকে আছে। করিম সাহেবের নাক ঘেঁষে রেশমীর শাড়ির আঁচল, ফজলুল করিম সাহেব চোখ বন্ধ করে ফেললেন–রেশমীর দিকে তাকিয়ে থাকতে তার এখন কেমন জানি ভয় লাগছে। মেয়েটা গায়ে চাদর জড়াতে এত সময় নিচ্ছে কেন?