একটাই ছাতা।
মওলানাকে বাজারে পৌঁছে দিয়ে সেই ছাতা দিয়ে হেডমাস্টার সাহেব তার ঘরে ফিরবেন। মওলানা খাকেন মজিদ মিয়ার কাপড়ের দোকান রূপসা ক্লথ হাউসে। এই অঞ্চলের সবচে বড় কাপড়ের দোকান। দোকানের পেছনে বিস্তর জায়গা। কয়েকটা খুপড়ি খুপড়ি ঘর। জায়গীর রাখার মত একটা খুপড়ি মওলানার। মজিদ মিয়া খুব আগ্রহ করে মওলানাকে রেখেছেন। তার বিনিময়ে মজিদ মিয়াকে কোরআন শরীফ পড়া শেখানোর কথা। বছর দুই হয়ে গেল এখনো কোরআন পাঠ শুরু হয়নি। মওলানা মনে করিয়ে দিলেই মজিদ মিয়া বলেন–ভাল দিন দেখে শুরু করতে হয়–দেখি রমজান মাসটা আসুক। রমজানে শুরু করব, রমজানেই কোরআন মজিদ শেষ করব, ইনশাল্লাহ। এই রমজানও পার হয়ে গেল, এখন সামনের রমজানের অপেক্ষা।
হেডমাস্টার সাহেবকে দেখে মজিদ মিয়া আনন্দিত গলায় বললেনস্যার, আসেন আসেন। ভাল দিনে এসেছেন। আজ আপনাকে ছাড়ব না। খানা খেয়ে যাবেন। বিরিয়ানী পাকাতে বলেছি।
বিরিয়ানী তো খাই না মজিদ সাহেব। পেটের অবস্থা ভাল না। তৈলাক্ত খাবার সহ্য হয় না।
একদিন খেলে কিছু হবে না। বসুন বসুন……
জি–না। আজ না আরেকদিন।
আর আরেক দিন। আপনাকে এখন পর্যন্ত চারটা ভালভাত খাওয়াতে পারলাম না–এই এক আফসোস-?
খাব, একদিন এসে খেয়ে যাব।
তাহলে বেলের শরবত খেয়ে যান, বেলের শরবত করতে বলছি।
এই সময় বেল পেলেন কোথায়?
আছে, ব্যবস্থা আছে। আপনাকে খাওয়ায়ে দিচ্ছি। মনে থাকবে–কই রে বেলের শরবত আন। আমার শ্বশুর বাড়ি সান্দিকোনা থেকে আনী। বরমেসে বেল।
অসময়ে বেলের শরবত খাওয়ার কোন ইচ্ছা ফজলুল করিম সাহেবের ছিল না। বাধ্য হয়ে বসলেন। এতে কিছুটা লাভ হল, তিনি তাঁর কাজের মেয়েটার জন্য একটা শাড়ি কিনলেন। মেয়েটাকে একটা শাড়ি দেয়া দরকার–মনে থাকে না। আজ চোখের সামনে শাড়ি বেচা-কেনা হচ্ছে দেখে মনে পড়ল।
মজিদ মিয়া মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, তারপর স্যার, বলেন স্কুলের খবরটা কি?
জ্বি খবর ভাল। সরকারি একটা অনুদান পেয়েছি। সাত লক্ষ টাকা…
তাই নাকি?
ফজলুল করিম সাহেব বেলের শরবত খেতে খেতে সরকারি অনুদানের ইতিহাসটা পুরোটা বর্ণনা করলেন। গল্প শুরু হলো ছাত্রের সঙ্গে দেখা হওয়া থেকে। মজিদ মিয়া এই গল্পে তেমন আগ্রহ বোধ করছিল না। তবু সে বেশ মন দিয়েই শুনল।
গল্পের শেষে হেডমাস্টার সাহেব তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, স্কুলটা এবার দাঁড়িয়ে গেল।
তাইতো দেখতাছি।
পাকা দালান হবে। হোয়াইট ওয়াশ করে দেব। দূর থেকে চোখে পড়বে….মওলানা বললেন, ইনশাআল্লাহ্ বলেন স্যার। প্রতিটি সৃৎ নিয়তের শেষে ইনশাআল্লাহ্ বলতে হয়। নবী-এ-করিম একবার ইনশাআল্লাহ্ না বলায় আল্লাহ পাক নারাজ হয়েছিলেন–কোরআন শরীফে এই বিষয়ে আয়াত নাজেল হয়েছে।
ফজলুল করিম পর পর দুবার বললেন,–ইনশাআল্লাহ্, ইনশাআল্লাহ।
বৃষ্টি আরো বেড়েছে। হেডমাস্টার সাহেবকে পৌঁছে দেবার জন্যে মজিদ মিয়ার নিজস্ব রিকশা চলে এসেছে। রাস্তা ঘোর অন্ধকার। মওলানা সাহেব তার টর্চ লাইট দিয়ে দিয়েছেন। ব্যাটারী ডাউন হয়ে আছে। টর্চ জ্বালালে চারদিকের অন্ধকার আরো গাঢ় মনে হয়। তাঁকে কাঠেরপুল পার হয়ে মগরা নদীর ঐ পারে যেতে হবে।
রিকশা নিয়ে এই অন্ধকারে কাঠের পুলে ওঠা দুরুহ ব্যাপার, পিছল কাঁচা রাস্তা থেকে খাড়াখাড়ি টেনে অনেকদূর উঠতে হয়। পুলের উপর দিয়ে যখন রিকশা যায় মচমচ শব্দ হয়। মনে হয় এই বুঝি কাঠের কোন একটা টুকরা ভেঙে পড়ে গেল।
দেশের কত পরিবর্তন হল–নীলগঞ্জে কিছু হচ্ছে না। নীলগঞ্জ থেমে আছে।
কাঠেরপুলের কাছাকাছি এসে ফজলুল করিম সাহেব বললেন,বাবা আমি রিকশা থেকে নেমে যাই–তুই টেনে তোল।
স্যার, আফনে টাইট হইয়া বইয়া থাকেন, আল্লাহ মালিক।
রিকশাওয়ালা ঝড়ের গতিতে রিকশা টেনে পুলের উপর তুলে হাঁপাতে লাগল। ফজলুল করিম সাহেব ঠিক করে ফেললেন এইবার শহরে বাসা নেবেন। আর পুল পাড়ি দেয়া না। যদিও তিনি জানেন শেষ পর্যন্ত কোনটাই করা হবে না। শহরের বাইরে মগরা নদীর পশ্চিম পাড়ের এই বাসাবাড়ি ছেড়ে দেয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব না। গাছ গাছালিতে ছাওয়া ছোট্ট ছিমছাম বাড়ি, যার কাছাকাছি এলেই মন ভাল হয়ে যায়। টমাস হার্ডির উপন্যাসটার কথা। মনে পড়ে–Far from the mading crowd.
রিকশাওয়ালা এখনো ধাতস্থ হয়নি–লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস নিচ্ছে। ফজলুল করিম সাহেবের খুব মায়া লাগছে। তিনি রিকশা থেকে নেমে কাঠের পুলের রেলিং ধরে দাঁড়ালেন। মাথায় ছাতা ধরা নেই–পা ভিজে যাচ্ছে, ভিজতে ভাল লাগছে। রিকশাওয়ালা বলল, এই বচ্ছর বিষ্টি বাদলা হয় নাই, কিন্তু পানির কি টান দেখছেন স্যার? পুল কাঁপতাছে।
পাহাড়ি পানি। পাহাড় থেকে নামে–বৃষ্টির সঙ্গে এর সম্পর্ক নাই।
টান যেবায় বাড়ছে পুল ভাঙ্গল বইল্যা।
ফজলুল করিম কিছু বললেন না। পানির টান অনুভব করার চেষ্টা করলেন। কাঠের এই পুলটিও জীবনকৃষ্ণ বাবু বানিয়েছেন। পুল ভেঙে গেলে জীবনকৃষ্ণ বাবুর একটি স্মৃতি নষ্ট হবে। সব চলে গেলেও স্কুল থাকবে। স্কুলের সঙ্গে তিনিও থাকবেন। মহাপুরুষেরা কোন না কোনভাবে থেকেই যান। তবে জীবনকৃষ্ণ বাবুকে মহাপুরুষ বলাটা বোধ হয় ঠিক হচ্ছে না।
স্যার, উঠেন।
নামার সময় সাবধানে নামবে।
ঝড়ের গতিতে রিকশা নামছে। উঁচু নিচু রাস্তা। প্রবল ঝাঁকুনি হচ্ছে। একবার মনে হল তিনি বোধহয় ছিটকে পড়েই যাবেন।