মওলানা ইরতাজউদ্দিন হেডমাস্টার সাহেবের ঘরে উঁকি দিয়ে বললেন, স্যার এখনো যাননি?
একটা চিঠি লিখতে বসেছি। চিঠি শেষ করে উঠব। আপনার নামাজ হয়ে গেল?
জি স্যার।
বসুন তাহলে, চিঠিটা শেষ করি। চিঠির মুসাবিদাটা শুনে যান।
মওলানা বসলেন। হেডমাস্টার সাহেবের আনন্দময় মুখ দেখতে দেখতে তাঁর মন খুব খারাপ হয়ে গেল, কারণ তিনি জানেন জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল হাই স্কুলের শেষ ঘণ্টা বেজে গেছে। এই স্কুলের আয়ু আর অল্প কিছুদিন। স্থানীয় এলাকার মন্ত্রী রমিজ সাহেব এখন স্কুল দিচ্ছেন। পাকা দালান হবে। রাজমিস্ত্রীরা মাপজোখ করে কাজ শুরু করে দিয়েছে। নতুন স্কুলের পাশে জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুল টিকতে পারবে না। সাত লক্ষ টাকার অনুদান কাজে আসবে না। এই অনুদানের চেক স্কুলে এসে পৌছুবে না। আর পৌছুলেও ফেরত যাবে।
চিঠি শেষ হয়েছে। কপি করতে হবে। অফিস কপি রাখতে হবে। কার্বন পেপার নেই। কপির কাজ হাতে করা ছাড়া গতি নেই। বানান ভুল কি আছে? ভাল করে আরেকবার দেখতে হবে। চিঠি ছাত্রের কাছে যাচ্ছে–সে চিঠিতে বানান ভুল থাকলে হবে না। ছাত্ররা সব সহ্য করতে পারে, শিক্ষকদের বানান ভুল সহ্য করতে পারে না।
মওলানা সাহেব।
জ্বি স্যার।
আমার আরো খানিকটা দেরী হবে। আপনি না হয় চলে যান।
আমার তাড়া কিছু নেই–বসি।
আচ্ছা বসুন। একা একা কাজ করতেও ভাল লাগে না। আকাশের অবস্থা কি? বৃষ্টি হবে?
টিপ টিপ করে তো পড়ছে।
এই বছর ভাল বৃষ্টি হল, অতি বৃষ্টি। তবে অতি বৃষ্টি হওয়া ভালআপাতত ক্ষতি হলেও পরবর্তি সময়ে ফল হয় শুভ। মঙ্গল সব সময় অমঙ্গলের পেছনে থাকে।
ফজলুল করিম সাহেবের ভুরু কুঁচকে গেল। গল্প করতে করতে চিঠি কপি করতে যাওয়ার এই সমস্যা। বানান ভুল হয়েছে। হাতের লেখাও ভাল হয়নি, লাইন বাঁকা হয়ে গেছে। তিনি কাগজ ছিঁড়ে ফেলে নতুন করে লিখতে বসলেন।
মওলানা পাঞ্জাবীর পকেট থেকে ছবির ছড়া বের করেছেন। চুপচাপ বসে না থেকে সময়টা কাজে লাগানো যাক। বৃষ্টি পড়ছে। বড় বড় ফোঁটা পড়ছে। টিনের চালে বৃষ্টির ফোঁটায় কি সুন্দর ঝম ঝম শব্দ হচ্ছে। মওলানা বললেন, স্যার, আপনি কাজ করুন আমি বারান্দায় বসি।
আচ্ছা, আচ্ছা। বৃষ্টি মনে হয় জোরেসোরে পড়ছে।
জ্বি স্যার।
পাকা দালানটা হয়ে যাক–তাহলে ঝড় বৃষ্টিতে কিছুই হবে না। অল্প কিছু দিনের ব্যাপার।
জ্বি স্যার। আপনি কাজ শেষ করুন।
ফজলুল করিম সাহেব চিঠি শেষ করলেন। বৃষ্টি আরো বেড়েছে। বৃষ্টির ছাঁট আর ভেজা বাতাস ঘরে ঢুকছে। হারিকেনের শিখা দপ দপ করছে। নিভে যাবে কিনা কে জানে। ড্রয়ারে মোম আছে। ফজলুল করিম সাহেবের আরো কয়েকটা চিঠি লেখার ইচ্ছে আছে। তাঁর দুই মেয়েকে তিনি অনেক দিন চিঠি লেখেন না। ছোট মেয়ে থাকে সিরাজগঞ্জ, ডাক্তার। তার ভাল প্রাকটিস। সেও চিঠি লিখতে পারে না। এই মেয়ের তিনি বিয়ে দিতে পারেননি। মেয়েই রাজি হল না। বিয়ের কথা বার্তা হলেই শুকনো গলায় বলে,–
আমার বিয়ের ব্যবস্থা আমি নিজে করব বাবা। আমার বিয়ে নিয়ে তুমি কিছু ভাববে না।
মেয়েদের উচ্চ শিক্ষা দেবার এই এক সমস্যা। উচ্চ শিক্ষা স্বাধীন মতামত দেয়ার ক্ষমতা তৈরি করে দেয়। তার ফল সব সময় শুভ হয় না। তাঁর মেয়ের বেলায় হয়নি। মেয়ে বিয়ে করেনি। করবে বলেও মনে হচ্ছে না।
তাঁর বড় মেয়েকে তিনি যথাসময়ে বিয়ে দিয়েছিলেন। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর পরই বিয়ে। এর ফলও শুভ হয়নি। মেয়ের আর পড়াশোনা হয়নি। অথচ তার বড় মেয়েটাই ছিল পড়াশোনায় সবচেয়ে ভাল। মুক্তার মত হাতের লেখা। তিনি তার দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে এত সুন্দর হাতের লেখা কোন ছাত্রের দেখেননি। বড় মেয়ে এখন নিউ জার্সিতে থাকে। ঘর সংসার দেখে। তার স্বামী কাজ করে সেখানকার এক ব্যাংকে, ফাস্ট ন্যাশনাল ব্যাংক। স্ত্রী হাউস ওয়াইফ।
বৃষ্টির রাত হচ্ছে চিঠি লেখার জন্যে সবচে ভাল রাত। মেয়ে দুটিকে দুটা চিঠি লিখে ফেললে হয়। এত সকাল সকাল ঘরে গিয়ে করারও কিছু নেই। ফজলুল করিম সাহেব বাঁ পাশের তালাবন্ধ ড্রয়ার খুললেন। ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহারের জন্যে কাগজ, কলম, খাম ডাকটিকিট এই ড্রয়ারে থাকে। ব্যক্তিগত কাজে তো আর স্কুলের জিনিস ব্যবহার করা যায় না। শুধু স্কুলের জিনিস না, স্কুলের সময়ও ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করা যায় না।……
ফজলুল করিম সাহেব ড্রয়ার খুলে কাগজ কলম খাম বের করলেন। সাত লক্ষ টাকা অনুদানের ব্যাপারটা মেয়েদের জানানো উচিত। ওরা খুশি হবে……।
তিনি চিঠি লিখছেন। তার জন্যে একজন বারান্দায় অপেক্ষা করছে এটা তার আর মনে নেই। দুই মেয়েকেই তিনি দীর্ঘ চিঠি লিখলেন। দুটি চিঠিই ইংরেজিতে।
লিখতে সময় লাগল কারণ পছন্দের কোটেশন পাচ্ছিলেন না। তার দীর্ঘদিনের অভ্যাস মেয়েদের চিঠিতে মহাপুরুষদের বাণীর উদ্ধৃতি দেয়া। ছাত্র জীবনে একটি বই কিনেছিলেন Great Sayings.-বইটি এখনো আছে। চিঠি লেখার সময় খুব কাজে আসে। তেমন পছন্দের কোন কোটেশন খুঁজে পেলেন না। সেক্সপিয়ারের একটা পেলেন সেটা তেমন পছন্দ হল না। তবুও চিঠির শেষে পুনশ্চ দিয়ে লিখে দিলেন–
One Fire burns out anothers burning;
One pain is lessend by anothers anguish.
–Shakespeare (Remed and Juliet)
চিঠি শেষ করতে করতে এশার আজান হয়ে গেল। তিনি বারান্দায় এসে দেখেন–বারান্দায় জায়নামাজ পেতে মওলানা নামাজে দাঁড়িয়েছেন। অন্ধকার বারান্দায়, বাইরে ঝমঝম বৃষ্টি। এর মধ্যে সাদা পাঞ্জাবী পড়া লম্বা একজন নামাজ পড়ছে–দেখতে ভাল লাগে। নামাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ফজলুল করিম বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলেন।