মাহবুব সাহেব বললেন, সরকারী টাকা হাতে না আসা পর্যন্ত বিশ্বাস নাই। আগে হাতে আসুক। পঞ্চাশ বস্তা গম সংস্থান হয়েছিল তিন বছর আগে, সেই গম কোথায়?
মাহবুব সাহেব উঠে দাঁড়ালেন।
ফজলুল করিম সাহেব বললেন, আরে বসুন না। খানিকক্ষণ গল্পগুজব করি–এরকম একটা সুসংবাদ পাওয়া গেল। রোজদিন তো এরকম ঘটে না।
কাজ আছে।
আরেকটা কথা তো আপনাদের বলা হয় নাই-আমাদের নতুন সায়েন্স স্যার চলে আসছেন। চিঠি পেয়েছি। এখানেও ভাগ্যের ব্যাপার আছে চেয়েছিলাম বিএসসি। পেয়ে গেছি এমএসসি। তাও যতি এমএসসি না। ফার্স্টক্লাশ পাওয়া এমএসসি। ভাল ভাল ছেলেপুলে না এলে স্কুলের উন্নতি হবে না।
মাহবুব সাহেব বললেন, এরা স্কুলে থাকবে না। চাকরি-বাকরি না পেয়ে স্কুলে ঢুকছে। নাই কাজ তো খই ভাজ-এর মত অবস্থা। যেই একটা কিছু পাবে স্কুলে পেচ্ছাব করে চলে যাবে।
ফজলুল করিম সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, অশালীন শব্দ ব্যবহার করে কথা বলবেন না। আমরা শিক্ষক মানুষ। কথাবার্তায় আমাদের খুব সাবধান হওয়া দরকার। খুবই সাবধান। শিক্ষকদের প্রতিটি শব্দ চিন্তা-ভাবনা করে বলতে হবে।
বিনয় বাবু বললেন, বৃষ্টি নামবে বলে মনে হয়। উঠে পড়া যাক, স্যার যদি অনুমতি দেন।
অবশ্যই, অবশ্যই। যান, বাড়ি যান।
স্কুল ফাঁকা হয়ে গেল। শুধু মওলানা থেকে গেলেন। মাগরেবের ওয়াক্ত হয়ে গেছে। তিনি মাগরেবের নামাজ শেষ করে তারপর যাবেন। তার অজু আছে। নতুন করে অজু করার প্রয়োজন নেই তবু বারান্দায় অজু করতে গেলেন। হেডমাস্টার সাহেব পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। মুখ হাসি হাসি। একজন আনন্দিত মানুষের মুখের দিকে তাকালেও আনন্দ হয়। মানুষটা আনন্দে ঝলমল করছে। আনন্দ শিশুদের ধর্ম। এই মানুষটার ভেতর শিশুভাব আছে। পর্যাপ্ত পরিমাণেই আছে। মওলানার একমাত্র আফসোস–মানুষটা নামাজের ধার ধারেন না। তিনি অজু করতে করতে একবার ভাবলেন হেডমাস্টার সাহেবকে সুযোগমত একবার নামাজের কথা বলে দেখবেন।
মওলানা সাহেব।
জ্বি স্যার।
শিক্ষক হবার সবচে বড় লাভ কি জানেন?
কি লাভ?
হঠাৎ হঠাৎ ছাত্র পাওয়া যায়। কৃতী ছাত্র। এদের দেখলেও আনন্দ হয়। কৃতী ছাত্র দেখলে এত ভাল লাগে। একটা কথা আছে–জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে জয় আশা করিবে শুধু ছাত্রের এবং পুত্রের নিকট পরাজয়কেই আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করিবে। মনজুরের কথাই ধরুন। জয়েন্ট সেক্রেটারী। সহজ ব্যাপার না।
তা তো স্যার ঠিকই।
আমি চিনতেই পারিনি। বয়স হয়ে গেছে। স্মৃতিশক্তি হয়েছে দুর্বল। মনজুর তার স্ত্রীকে নানান গল্প করছে, আমি শুধু শুনে যাচ্ছি। তার মেট্রিকের রেজাল্ট যখন হল, নাইনথ স্ট্যান্ড করেছে, তখন খবর পেয়ে আমি নাকি তাকে কোলে নিয়ে স্কুলের মাঠে একটা চক্কর দিয়েছি। আমার তো কিছুই মনে নেই…..
আপনার মনে থাকবে কেন? আপনি তো কত ছেলেকেই কোলে নিয়ে চক্কর দিয়েছেন। যাদের মনে রাখার তারা ঠিকই মনে রেখেছে।
শিক্ষকতা করে এই জীবনে বড়ই তৃপ্তি পেয়েছি। শেষ জীবনে স্কুলটাকে ঠিকঠাক করে যেতে পারলে মনে শান্তি পেতাম। এতদিনের পুরানো একটা স্কুল।
মওলানা সাহেবের নামাজের সময় যাচ্ছে। কিন্তু হেডস্যার এত আগ্রহ করে কথা বলছেন, তাকে ফেলে চলে যেতেও মায়া লাগছে।
নামাজের ওয়াক্ত হয়ে গেছে স্যার।
ও আচ্ছা, আচ্ছা। যান, নামাজ পড়ন। নামাজ পড়ন। স্কুলের জন্যেও দোয়া করবেন।
অবশ্যই করব, স্যার।
বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। হেডমাস্টার সাহেব প্রাইমারী সেকশানের দিকে যাচ্ছেন। বছরের প্রথম কালবোশেখির ঝড়ে প্রাইমারী সেকশানের খুব ক্ষতি হল। দুটা টিনের চালা উড়ে গেছে। খুঁজে এনে কোনমতে লাগানো হয়েছে। ফাঁক-ফোকর আছে। বৃষ্টি নামলেই ক্লাশের ভেতর পানি পড়ে। পাকা দালান হলে আর দেখতে হবে না। পাকা দালানে ছাত্ররা ক্লাশ করবে। স্কুলের বিশাল কম্পাউণ্ডের ভেতরে থাকবে ফুলের বাগান। এসেমব্লীতে ছাত্রছাত্রীরা লাইন ধরে দাড়াবে, জাতীয় সংগীত গাইবে–আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি। আহ, কি সুন্দর জাতীয় সংগীত! এত সুন্দর জাতীয় সংগীত কি আর কোন জাতির আছে?
স্কুল লাইব্রেরীটা ঠিকমত করতে হবে। কাচের আলমীরার ভেতর থরে থরে বই সাজানো থাকবে, দেয়ালে থাকবে মহাপুরুষদের ছবি। মহাপুরুষদের ছবির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেও মন পবিত্র হয়। মহাপুরুষদের ছবি জোগাড়ের চেষ্টা চালাতে হবে। রবীন্দ্রনাথ, টলস্টয়, আইনস্টাইন, মহাত্মা গান্ধী, শেখ মুজিব……
হেডমাস্টার সাহেব অফিস ঘরে ফিরে গেলেন। তিনি সন্ধ্যার পরেও খানিকক্ষণ অফিসে থাকেন। হরিপদ হারিকেন জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। হারিকেনের কাচের একটা কণা ভাঙ্গা। ধুঁয়া বেরুচ্ছে। সব কিছুরই ভগ্নদশী, তবে এই ভগ্নদশা থাকবে না। হেডমাস্টার সাহেব ঠিক করলেন, মনজুরকে চিঠি লিখে ধন্যবাদ জানাবেন। চিঠিটা আজই লিখে ফেলা দরকার। এইসব ব্যাপারে দেরি করতে নেই। তিনি গোটা গোটা হরফে ইংরেজিতে একটা চিঠি লিখলেন। তিনি ইংরেজির শিক্ষক। ইংরেজিতেই ভাল লিখতে পারেন। বাংলা তেমন আসে না। তাঁর চিঠির বাংলা তর্জমা অনেকটা এরকম–
আমার পুত্রপ্রতিম ছাত্র মনজুর আহমেদ
জয়েন্ট সেক্রেটারী। শিক্ষা দপ্তর।
তোমার অসীম বদান্যতায় আমি মুগ্ধ, ও অভিভূত। আমার জীবনে আজ একটি বিশেষ দিন–সরকারি অনুদানের চিঠি আজ আমার হস্তগত হয়েছে। পর পর তিনবার এই চিঠি পাঠ করার পর আজ আমি অশ্রুবর্ষণ করিয়াছি। এই অশ্রু সুখের ও আনন্দের মিলিত ফসল। আজ আমার মনে হইতেছে আমার দীর্ঘ দিনের শিক্ষাদান বিফল হয় নাই….। আমি তোমার মত দরদী ছাত্র তৈরি করিতে পারিয়াছি…।