মওলানা বললেন, মন শান্ত করুন। যা হয় সব আল্লাহপাকের হুকুমেই হয়। ফজলুল করিম সাহেব বললেন, এই স্কুলের চারপাশে মিলিটারী আমাকে নেংটো করে ঘুরিয়েছে। সেও কি আল্লাহর হুকুমে?
অবশ্যই। পরম মঙ্গলময় কিভাবে কি করেন তা বোঝার সাধ্য আমাদের নেই। স্যার আপনি শান্ত হোন। চলুন আপনাকে বাসায় দিয়ে আসি। চলুন।
ফজলুল করিম সাহেব প্রবল জ্বর নিয়ে বাসায় ফিরলেন। সেদিন সন্ধ্যাতেই রেডিও বাংলাদেশের স্থানীয় সংবাদে ঢাকা বোর্ডের রেজাল্ট প্রকাশের খবর ঘোষণা করা হল। বলা হল জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুলের মোঃ বদরুল আলম সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে। এই অসম্ভব গুরুত্বপুর্ণ খবরটি এলাকায় কেউ শুনল না। শুনলেও হয়তো বুঝতে পারলো না যে তাদের স্কুলের কথাই রেডিওতে বলা হচ্ছে।
রাত আটটার খবরের পর নীলগঞ্জ হাই স্কুলের নতুন এসিসটেন্ট হেডমাষ্টার মাহবুব সাহেব ছুটতে ছুটতে এলেন। তিনি সম্ভবত মনের ভুলে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছেন–আমাদের স্কুল সেকেন্ড স্ট্যান্ড করেছে। আমাদের জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুল।
তার পেছনে পেছনে এলেন নীলগঞ্জ স্কুলের অন্য শিক্ষকরা। রাত দশটায় জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুল লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল। এমন আনন্দময় ঘটনা এই অঞ্চলের ইতিহাসে অনেকদিন ঘটেনি।
ফজলুল করিম সাহেব চলে এসেছেন। তাঁর শরীর কাঁপছে জ্বরের ঘোরে আনন্দে তা তিনি বুঝতে পারছেন না। বদরুল আলম এসেছে সে স্যারকে সালাম করবার জন্যে নিচু হতেই ফজলুল করিম সাহেব তাকে জাপটে ধরে ফেললেন। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন–আয় তো দেখি তোকে কোলে নিয়ে স্কুলের চারদিকে একটা চক্কর দিতে পারি কি না। আয়।…..
সত্যি সত্যি বদরুলকে কোলে নিয়ে ফজলুল করিম সাহেব দৌড়ানোর চেষ্টা করছেন। বদরুল স্যারের গলা জড়িয়ে ধরে আছে। সে খুব কাঁদছে। ফজলুল করিম সাহেবের সঙ্গে অনেকেই দৌড়াচ্ছে। শুধু তার অতি প্রিয়জন মওলানা ইরতাজউদ্দিন নেই।
স্কুলে হৈ চৈ হচ্ছে
স্কুলে হৈ চৈ হচ্ছে। মওলানা ইরতাজউদ্দিন হৈ চৈ অগ্রাহ্য করে ফজলুল করিম সাহেবের বাসায় এসেছেন। রেশমীর সঙ্গে জরুরী কথা বলা দরকার। এখনই বলা দরকার।
মওলানাকে দেখেই রেশমী বের হয়ে গেল। সেও আনন্দে ঝলমল করছে।
মওলানা বললেন, খবর জান তো রেশমী?
জি জানি। খালুজান কই?
উনি বদরুলকে কোলে নিয়ে চক্কর দেয়ার চেষ্টা করছেন।
রেশমী শাড়ির আঁচল মুখে দিয়ে হাসি চাপার চেষ্টা করছে। মওলানা বললেন, রেশমী শোন–আমাদের স্কুল আবার শুরু হবে। নতুন করে শুরু হবে। খুব ভালোমত শুরু হবে।
জ্বি আমি জানি।
এখন তোমার কাছে একটা অনুরোধ। তুমি উনাকে ছেড়ে চলে যাবে।
আমি কি করেছি?
তুমি খুব ভাল করে জান আমি কেন এইসব বলছি। তুমি বুদ্ধিমতি মেয়ে, তোমার বুদ্ধির অভাব নেই। তুমি উনার মনের ভাব জান। ওনারটাও জান।
রেশমী মাথা নিচু করে রইল। মওলানা বললেন, হেড স্যারকে নিয়ে কোন রটনা হতে দেয়া যাবে না। তুমি যদি থাক ঘটনা অনেক দূর গড়াবে। লোকজন হেড স্যারকে ছিঃ ছিঃ করবে। তুমি কি সেটা জান না?
জানি।
তুমি চাও না আমরা স্কুলটাকে নিয়ে অনেক দুর যাই?
চাই। আমি চলে যাব।
কখন যাবে?
আপনি যদি বলেন এখন, তা হইলে এখনই যাব।
হ্যাঁ, এখনই চলে যাও।
উনার পা ধোয়ার পানির ব্যবস্থা করে তারপরে যাই?
আচ্ছা।
রেশমী জলচৌকির পাশে পানির বালতি টেনে আনছে। খড়ম জোড়া এনে রাখল। রেশমী কাদছে। টপ টপ করে তার চোখ থেকে দু ফোটা পানি জলচৌকিতে পড়ল।
মওলানা দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি মনে মনে মেয়েটির জন্যে প্রার্থনা করলেন। এই মেয়েটা ভাল। আল্লাহ এর ভাল কর। বাজী পোড়ানোর শব্দ হচ্ছে। স্কুলে মনে হয় বাজী পোড়ানো হচ্ছে। ঢোল বাজানোর শব্দ আসছে। নিশ্চয়ই হরিপদের কান্ড। ঢোলের শব্দ প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে।