মওলানা গম্ভীর গলায় বললেন, ও আচ্ছা।
নতুন স্কুলটাও দেখতে চেয়েছিল। দেখায়ে এনেছি।
ভাল।
মওলানা তাদের জীবন বাবুর কাঠের পুল পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। সারা পথে কঠিন দৃষ্টিতে রেশমীর দিকে কয়েকবার তাকানো ছাড়া একটি কথাও বললেন না। ফজলুল করিম সাহেব অনর্গল কথা বলে গেলেন বুঝলেন মওলানা সাহেব, শিক্ষকদের বেতনের একটা ব্যবস্থা করেছি। অস্থায়ী ব্যবস্থা স্থায়ী কিছু চিন্তা করতে হবে। বাজারে যে জমি স্কুলের আছে সেখানে ঘর তুলে দিলে কেমন হয়? ভাড়া যা আসবে তাতে স্কুলের কিছু আয় হবে। কিছু জমি বিক্রির ব্যাপারও চিন্তা করা যেতে পারে। স্কুল কমিটির সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এতদিনের স্কুল বানের জলে ভেসে যেতে পারে না। কি বলেন! তবে সরকারী অনুদানটা চলে এলে অবস্থা অন্য রকম হয়ে যাবে কি বলেন?
মওলানা শুধু মাথা নাড়ালেন, কিছু বললেন না।
ফজলুল করিম সাহেব বললেন, আমার এখন পরিকল্পনা হল স্কুলের ফাইল ঘেঁটে ঘেঁটে পুরানো ছাত্রদের ঠিকানা বের করা। সাহায্য চেয়ে এদের সবার কাছে চিঠি যাবে। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিব।
হুঁ।
আমি আশা হারাবার কিছু দেখছি না।
মওলানা ক্ষীণ গলায় বললেন, মাহবুব সাহেব নীলগঞ্জ স্কুলে এ্যাসিসটেন্ট হেড মাষ্টার হিসেবে জয়েন করেছেন, শুনেছেন বোধ হয়।
ফজলুল করিম সাহেব অবাক হয়ে বললেন, শুনিনি তো।
আজই জয়েন করেছেন।
একটা স্কুল থেকে রিজাইন না করে অন্য স্কুলে জয়েন করবেন কিভাবে?
রিজাইন করেছেন। আমার কাছে রেজিগনেশন লেটার দিয়ে গেছেন।
উনি চলে যাবেন ভাবিনি!
উনার দেখাদেখি আরো অনেকেই যাবে। কে জানে হয়ত আমিও যাব। শুধু আপনি একাই থাকবেন।
রেশমী হাসছে। প্রথমে চাপা হাসি। তারপর মুখে আঁচল মুখে খিলখিল হাসি। ফজলুল করিম সাহেব মেয়েটির হঠাৎ হঠাৎ হাসির কারণ ধরতে পারছেন না। এটা কি হাসির সময়? ভার তীব্র মাথার যন্ত্রণা হচ্ছে। হঠাৎ করে মাথা ব্যথা শুরু হয়েছে। প্রেসার কি বেড়ে গেল?
স্যার, আমার সশ্রদ্ধ সালাম জানবেন
স্যার,
আমার সশ্রদ্ধ সালাম জানবেন। অনেকদিন পর আপনাকে লিখছি। ব্যাঙের ডাকের ইংরেজীটা প্রথমে বলে নেই–Croak স্কুলে থাকার সময়ই ডিকশনারী ঘেঁটে ইংরেজীটা খুঁজে পেয়েছিলাম আপনাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। কিছু কিছু মানুষের জরুরী কথা ভুলে যাবার প্রবণতা থাকে। আমার তো খুবই আছে। আমি আপনাদের ছেড়ে চলে এসেছি আসার আগে সবচে জরুরী কথাটা বলতেও ভুলে গেলাম। সেটা হচ্ছে মানুষ হিসেবে আপনার তুলনা নেই। প্রতিষ্ঠান কখনো বড় হয় না। প্রতিষ্ঠানের পেছনে মানুষরা বড় হয়। জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুল ধ্বংস হতে বসেছে তা আমাকে তেমন আলোড়িত করছে না, ধ্বংস প্রাকৃতিক নিয়মেই হয়। ডাইনোসারের মত বিশাল প্রাণী লোপ পেয়েছে। কিন্তু স্কুল টিকিয়ে রাখার জন্যে আপনি যে একক যুদ্ধ শুরু করেছেন তা আমাকে অভিভুত করেছে।
মানুষ কঠিন পরিশ্রম করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এভারেস্টের চুঁড়ায় উঠতে যায়। ব্যাপারটা সব সময় আমার কাছে হাস্যকর মনে হয়। আপনাকে দেখার পর আর মনে হচ্ছে না। আপনাকে দেখার পর মনে হচ্ছে সব মানুষকেই তার ব্যক্তিগত এভারেষ্টের চূড়ায় উঠতে হয়। মানুষের এই হচ্ছে নিয়তি।
আপনার দুঃসময়ে আমি আপনাকে ছেড়ে চলে এসেছি। তার জন্যে আমি ক্ষমা প্রার্থী। আমি নিতান্তই দরিদ্র একজন মানুষ। বেঁচে থাকার সংগ্রামে আমাকে নামতে হয়েছে। আপনাকে ছেড়ে চলে এসেছি তার জন্যে আমার লজ্জার সীমা নেই।
আপনার ছাত্রদের আমি মোটামুটি ভাবে তৈরী করে দিয়েছি। আমি আমার সাধ্যমত করেছি। শহরের স্কুলগুলির সঙ্গে তারা পারবে কি না বলতে পারছি না। তবুও আশা করছি। শুনেছি দুএকদিনের ভেতর রেজাল্ট হবে। প্রবল আগ্রহ নিয়ে আমি তার জন্যে অপেক্ষা করছি।
স্যার চলে আসার দিন আপনি আমাকে বিদায় দিতে ষ্টেশন পর্যন্ত এলেন। আমার খুব ইচ্ছা করছিল–পা ছুঁয়ে আপনাকে সালাম করি। কেন জানি পারলাম না–ট্রেন ছেড়ে দেবার পর দেখি আপনি চোখ মুছছেন। একজন মানুষের জীবনের সঞ্চয় খুব বেশী থাকে না। আপনার চোখের জল আমার জীবনের পরম সঞ্চয়ের একটি। আপনি ভাল থাকুন–এই শুভ কামনা। আমি দূর থেকে আপনার পা স্পর্শ করে সালাম করছি। সালাম গ্রহণ করবেন-এই আমার বিনীত অনুরোধ।
স্যার আসব?
ইরতাজউদ্দিন সাহেব দরজার বাইরে থেকে উঁকি দিচ্ছেন। ফজলুল করিম সাহেব চিঠিটা ভাজ করে কোটের পকেটে রাখতে বললেন, আসুন। এস. এস. সির রেজাল্ট কবে হবে শুনেছেন কিছু?
যে কোনোদিন হতে পারে।
রেডিওর খবরটা প্রতিদিন মন দিয়ে শুনবেন। আমার রেডিও নেই। রেজাল্ট কেমন হবে মনে করছেন?
মওলানা জবাব দিলেন না। সবচে আশা যার উপর ছিল সেই বদরুল শেষ পরীক্ষার দুদিন আগে জ্বরে পড়ে গেল। শেষ পরীক্ষা দিয়েছে ১০৩ জ্বর নিয়ে। পরীক্ষার হল থেকে বেরুবা মাত্র তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছে।
ফজলুল করিম সাহেব বললেন, রেজাল্ট তেমন কিছু হবে বলে আপনি বোধহয় আশা করছেন না।
জি-না।
হতেও পারে। রেডিওর খবর রোজ শুনবেন।
জ্বি আচ্ছা শুনব।
জ্বর গায়ে পরীক্ষা দিলেও ভুল তো কিছু করেনি? তাই না?
মওলানা জবাব দিলেন না। ফজলুল করিম সাহেব সরকারি চিঠিটা এগিয়ে দিলেন। ইরতাজউদ্দিন সাহেব চিঠি শেষ করে হেডমাস্টার সাহেবের দিকে তাকিয়ে দেখেন তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।