স্কুলের কত ছাত্র দেশে বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এদের কাছে কোনমতে খবরটা পৌছাতে পারলেও তো কাজ হবে।
রেশমী বলল, কি ভাবেন?
না কিছু ভাবি না।
আপনে দিন রাইত ভাবেন। অত ভাইব্যা ফয়দা নাই। যা হওনের হইব।
ফজলুল করিম জবাব দিলেন না। যা হবার তা হবে ঠিকই–তবু চেষ্টা করে যেতে হবে।
বেতন দিতে না পারলে স্কুলের শিক্ষকরা থাকবেন না। শিক্ষক না থাকলে ছাত্র থাকবে না… আচ্ছা সিরাজ সাহেবের সঙ্গে একবার দেখা করলে কেমন হয়? তিনিও তো সাহায্যের কথা বলেছিলেন। তিনি যদি তার মার নামে স্কুল না দিয়ে কলেজ দিতেন তাহলে খুব ভাল হত। ছাত্ররা তার স্কুল থেকে পাশ করে পাশেই কলেজে ভর্তি হয়ে যেতে পারত।
চা খাইবেন? এটু চা বানাইয়া দেই?
দাও।
রেশমী চা বানাতে বানাতে বলল, চিন্তায় চিন্তায় আফনের চউক্ষের নিচে কালি জমছে। আফনের অত কি চিন্তা? এই ইস্কুল কি আফনের একলার ইস্কুল?
স্কুল সবার। কিন্তু আমি হচ্ছি স্কুলের প্রধান।
বারান্দায় বসে ফজলুল করিম সাহেব চা খাচ্ছেন। একটু দূরে খুঁটিতে হেলান দিয়ে রেশমী বসে আছে। রেশমী হাসছে। অকারণেই খিলখিল করে হাসছে। হাসির কোন কথা তো হয়নি। মেয়েটা হাসছে কেন? ফজলুল করিম সাহেব বললেন, হাস কেন?
রেশমী মুখে আঁচল চাপা দিতে দিতে বলল, নিজেই জানি না ক্যান হাসি। আফনে যখন ঘরে থাকেন না তখন আরো বেশি হাসি। হি হি হি।
হাসি সামলাবার জন্যে রেশমী ঘরে ঢুকে গেল। চায়ের কাপ হাতে অস্বস্তি ও বিস্ময় নিয়ে ফজলুল করিম সাহেব বসে রইলেন। তাঁর ইচ্ছা করছে রাতে একবার স্কুলে যেতে! লাইব্রেরী ঘর খালি করে চারটা ছেলেকে রাখা হয়েছে। ওরা পড়াশোনা কেমন করছে না করছে দেখা দরকার। অবশ্যি শিক্ষকদের ডিউটি ভাগ করে দেয়া হয়েছে। মৌলানা ইরতাজউদ্দিন রাত এগারোটা পর্যন্ত থাকবেন। আবার ফজর ওয়াক্তে ফজরের নামাজের পর ছাত্রদের ঘুম থেকে ডেকে তুলবেন। খুব ভোরবেলা অংক করার জন্য সবচে ভাল সময়। বিনয় বাবু নীলগঞ্জ স্কুলে যোগ দিলেও ভোরবেলা এসে অংক করিয়ে দেন। অনেকদিন বিনয় বাবুর সঙ্গে দেখা হয় না। লজ্জায় পড়েই বোধ হয় বিনয় বাবু তাকে এড়িয়ে চলেন। নীলগঞ্জ স্কুলে গিয়ে একবার বিনয় বাবুর লজ্জা ভাঙ্গিয়ে দিয়ে আসতে হবে। জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুলের সুদিন যদি আসে বিনয় বাবু ফিরেও আসতে পারেন। তার মত অংক জানা একজন লোক থাকা স্কুলের জন্যে বিরাট ব্যাপার।
রেশমী।
জ্বি।
একটু স্কুলে যাচ্ছি।
এই রাইতে?
দেখে আসি ছেলেগুলি কি করে। তাছাড়া রাতের খাবারের পর একটু হাঁটাহাটি করা শরীরের জন্যে ভাল। কথায় আছে আফটার ডিনার ওয়াক এ মাইল।
চলেন যাই।
ফজলুল করিম বললেন, তুমিও যাবে?
সুন্দর চান্নি পসর রাইত। হাঁটতে ইচ্ছা করতাছে।
ফজলুল করিম সাহেব চুপ করে রইলেন। রেশমী বলল, নয়া ইস্কুলে কি–কি দোলনা বসাইছে–দেইখ্যা আসি।
ফজলুল করিম সাহেব বললেন, দোলনা, সি সো স্লাইড এইসব বসিয়ে পার্কের মত করেছে। ছাত্ররা খেলাধুলা করে। আমরাও ইনশাআল্লাহ্ বসাব। তুমি কি সত্যি যাবে?
হুঁ।
চল তাহলে।
কাপড়টা বদলাইয়া একটা ভাল কাপড় পরি।
রেশমী স্কুল ঘরে ঢুকল না। স্কুলের বাইরে বকুল গাছের নীচে দাঁড়িয়ে রইল। ফজলুল করিম সাহেব একাই গেলেন। মওলানা ইরতাজউদ্দিন আছেন। বারান্দায় জায়নামাজ পেতে তসবি পড়ছেন। ছেলেরা হারিকেন জ্বালিয়ে পড়ছে। হরিপদও আছে। তার এখন দিন রাত্রি ডিউটি। রাতে বারান্দায় মশারি খাটিয়ে শুয়ে থাকে। ছাত্রদের কখন কি দরকার হয়। রাতে তার ভাল ঘুম হয় না। সে ভূতের ভয়ে অস্থির থাকে। লাইব্রেরী ঘরেই সে জীবন বাবুর ভুত দেখেছিল। ছাত্রদের সে এই ঘটনা বলেনি। বাচ্চা মানুষ শুধু শুধু ভয় পাবে, কি দরকার।
মওলানা জায়নামাজ থেকে উঠে এলেন। ফজলুল করিম সাহেব বললেন, পড়াশোনা চলছে ঠিক মত?
জি চলছে। আপনার আসার দরকার ছিল না। অনেকটা পথ। এসেছেন কিভাবে? হেটে?
হুঁ। চাঁদনী আলোয় হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছি। চলুন ছেলেদের দেখে আসি।
চলুন যাই, আপনাকে দেখলে ওরা উৎসাহ পাবে।
ছেলেরা হেড স্যারকে দেখে অভিভূত হয়ে গেল। মওলানা বললেন, তোমরা এমন পাথরের মুর্তির মত বসে আছ কেন? স্যারের পা ছুঁয়ে সালাম কর। দোয়া পাবে। দোয়াটা খুব দরকার। আল্লাহ্ পাক বলেছেন–আমি যাহাকে ইচ্ছা সম্পদ দেই। যাহাকে ইচ্ছা সম্মান কেড়ে নেই।
ছাত্ররা সালাম করতে এগিয়ে এল। ফজলুল করিম সাহেব বললেন, বদরুল তোমার হাতের লেখার অবস্থাটা কি? কিছু উন্নতি হয়েছেঃ
বদরুল মাথা নিচু করে রাখল।
রোজ কুড়ি পাতা করে হাতের লেখা লেখার কথা, লিখছ তো?
জ্বি স্যার।
কই আজকে কি লিখলে দেখি।
বদরুল কাগজের তাড়া নিয়ে এল। হাতের লেখার তেমন উন্নতি হয়নি, তবে আগের চেয়ে পরিস্কার হয়েছে।
ফজলুল করিম সাহেব বললেন, এই স্কুল রক্ষার দায়িত্ব তোমাদের উপর। তোমরা যদি অসাধারণ রেজাল্ট করে সবাইকে চমকে দিতে পার তাহলে আমরা টিকে যাব। পারবে না বাবারা?
কেউ জবাব দিল না। তারা হেড স্যারকে অসম্ভব ভয় পায়। হেড স্যারের সামনে কথা বলা তাদের পক্ষে সম্ভব না।
মওলানা হেড স্যারকে এগিয়ে দিতে আসছেন। বকুল গাছের কাছে এসে চমকে উঠে বললেন, এ কে?
রেশমী চট করে আড়ালে সরে গেল। ফজলুল করিম সাহেব বললেন–ও রেশমী। আমার সঙ্গে এসেছে। চাদনি পসর রাত দেখে তার হাঁটার শখ হয়েছে।