সেটা হবে না। একজনের জন্যে যে ব্যবস্থা বাকিদের জন্যেও একই ব্যবস্থা।
মামুন সাহেব বলেছিলেন যে আপনি পাঁচজনের ব্যাপারে রাজি হবেন। সবাইকে নিয়ে একটা পরিকল্পনা করা হয়েছে। সেখানে একটা ক্লাস ঘর খালি করে দিতে হবে। মামুন সাহেব পুরো ব্যাপার দেখবেন।
কলেজের চাকরি নিয়ে চলে যাচ্ছেন–তাহলে দেখবেন কি ভাবে?
এস. এস. সি পরীক্ষা পর্যন্ত উনি থাকবেন। পরীক্ষার পর কলেজে জয়েন করবেন। আমার সঙ্গে সে রকম কধ্যা হয়েছে।
ও আচ্ছা।
খুব কর্মী ছেলে। একাই একশ। উনি থাকলে আর কিছু লাগবে।
উনি নিজে থেকে রাজি হয়েছেন না আপনি বলে কয়ে ঠিক করেছেন?
নিজ থেকে রাজি হয়েছেন। আমাকে কিছু বলতে হয়নি। কলেজের এপয়েনমেন্ট লেটার পেয়ে খানিকক্ষণ খুশীতে খুব লাফালাফি করলেন তারপর আমাকে বললেন–মওলানা সাহেব, আমাদের হেডমাষ্টার সাহেব স্কুলটা নিয়ে একা একা যুদ্ধ করছেন। যুদ্ধে প্রায় পরাজিত। আমি একজন ভাল সৈনিক। এই সময়ে আমি তাকে ছেড়ে চলে যাব তা হয় না। এস, এস, সি পরীক্ষা পর্যন্ত দেখে যাবেন। তার যতটুকু সাধ্য করবেন।
ভাল।
আমার স্যার আরেকটা কথা বাকি, ঐটা শেষ করে চলে যাব।
বলুন।
একটা ভাল ছেলে পাওয়া গেছে স্যার।
ভাল ছেলে পাওয়া গেছে মানে কি? যা বলার গুছিয়ে বলুন।
রেশমীর জন্যে একটা ছেলে পেয়েছি। দোকানে কাজ করে।
ও আচ্ছা।
ছেলেটিকে খবর দিয়ে এনেছি। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। আপনি তার সঙ্গে কথা বলবেন?
না।
অন্য কোন সময় আসতে বলব?
মওলানা ইতস্তত করে বললেন, নানান ধরনের কথা হচ্ছে। নানান রটনা।
কি রটনা?
এইসব কথা মুখ ফুটে আপনাকে বলা সম্ভব না।
বলা সম্ভব না হলে বলবেন না।
জ্বি আচ্ছা।
মওলানা সাহেব এই সমস্যা নিয়ে আপনাকে আর মাথা ঘামাতে হবে। স্কুলের সমস্যা নিয়ে ভাবুন।
জ্বি আচ্ছা।
যাবার সময় দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে যাবেন।
মওলানা সাহেব দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে চলে গেলেন। জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুলের হেডমাষ্টার ফজলুল করিম সাহেবের চোখে পানি এসে গেছে। তিনি চোখের পানি মুছলেন না। কারণ চোখে যে পানি এসেছে তা তিনি নিজে বুঝতে পারেন নি।
ফজলুল করিম সাহেব
ফজলুল করিম সাহেব তেমন কিছু খাচ্ছেন না। প্লেটের ভাত নাড়াচাড়া করছেন। প্লেটে ডাল নিতে গিয়েও নিলেন না। অথচ সজনে দিয়ে ব্রাধা ডাল তার অতি প্রিয়। রেশমী বলল, আপনার কি হইছে?
কিছু হয় নাই। আমার ক্ষিধা একেবারেই নাই।
দুপুরে স্কুলে কি খাইছেন?
দুপুরে কিছু খাইনি। এই জন্যেই মনে হয় পিত্ত পড়ে গেছে। কিছু খেতে ভাল লাগছে না।
জ্বর জ্বারি হয় নাই তো?
রেশমী ফজলুল করিম সাহেবের কপালে হাত রাখল। ফজলুল করিম সাহেবের মনে হল উত্তাপ দেখতে যতটুকু সময় লাগে রেশমী যেন তার চেয়ে বেশি সময় হাত কপালে রাখল।
আপনি কি কিছু নিয়া চিন্তিত? উঁহুঁ।
নতুন স্কুলে না-কি আপনার স্কুলের সব ছাত্র চইল্যা যাইতেছে। তা যাচ্ছে।
রেশমী হাসি মুখে বলল, খালি স্কুল নিয়ে আপনি বইস্যা আছেন। দোকান আছে, দোকানদার আছে সওদা নাই।
হাসি তামশা কিছু হয়নি রেশমী। হসিবে না।
মনের ভুলে হাসছি। পান দাও রেশমী, পান খাব।
রেশমী পান এনে দিল। ফজলুল করিম সাহেব পান মুখে দিতে দিতে বললেন, খালি স্কুল আবার পূর্ণ হবে।
ক্যামনে হবে? এবার এসএসসির রেজাল্ট হলেই দেখবে ছাত্র ছাত্রীরা আবার আসতে শুরু করেছে।
কেন?
ষ্টান্ড করবে। অবশ্যই করবে। গ্রামের স্কুল থেকে স্ট্যান্ড করলে সবার নজর পড়বে স্কুলের দিকে। আমাদের কয়েকজন ভাল ছাত্র এইবার আছে। এর মধ্যে একজন আছে–খুবই ভাল। শুধু হাতের লেখাটা খারাপ। লেখাটা যদি একটু ভাল হত।
ছাত্রটা কে বদরুল আলম
ফজলুল করিম সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন,তুমি জান কিভাবে? রেশমী হাসিমুখে বলল, আপনার স্কুলে কি হইতেছে না হইতেছে আমি জানব না?
অবশ্যই জানবে। কেন জানবে না?
আপনে স্কুল নিয়া অত চিন্তা কইরেন না। অত চিন্তার কি আছে?
চিন্তা করব না কি বল তুমি। স্কুল যদি উঠে যায়?
উঠে গেলে কি আর করণ। দুনিয়ায় কিছু টিক্যা থাকে না।
ফজলুল করিম সাহেব তাকিয়ে রইলেন। রেশমী বলল, একটা স্কুল চইল্যা গেলে চইল্যা যাবে। আরেকটা নয়া স্কুল হইছে। আফনে আমার একটা কথা হুনবেন?
কি কথা?
আফনে গিয়া নীলগঞ্জ ইস্কুলের হেডমাস্টার হন।
নতুন স্কুলের হেডমাস্টার হব?
হুঁ। আপনের ছাত্র পড়ানি দিয়া কথা। কোন ইস্কুল সেইটা দিয়া দরকার কি? তার উপরে এমন না যে এই ইস্কুল আফনে বানাইছেন।
ফজলুল করিম সাহেব আহত গলায় বললেন, এই নিয়ে আমি তোমার সঙ্গে তর্ক করতে চাচ্ছি না। চুপ কর। যা জান না তা নিয়ে তর্ক করাও ঠিক TI
রেশমী আহত গলায় বলল, আমি হইলাম দাসী বান্দি–আমার জানা অজানার দাম কি?
সে তার ঘরে দরজা জানালা বন্ধ করে বসে রইল। রাতে ভাত খেল না। ফজলুল করিম সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, আজকাল তোমার হয়েছে কি বল
তো দেখি–কথায় কথায় রাগ।
রেশমী জবাব দিল না।
এরকম করলে কিন্তু আমি চলে যাব। স্কুল ঘরে রাত কাটাব। সেটা ভাল হবে
রেশমী দরজা খুলে বের হয়ে এল। সে কাঁদছিল। তার গাল ভেজা। ভেজা গাল সে মুছল না। ভেজা গালেই খেতে বসল। ফজলুল করিম সাহেব মোড়া টেনে তার পাশে বসলেন। রেশমী বলল, কেউ চাইয়া থাকলে আমি খাইতে পারি না। আপনে অন্য ঘরে গিয়ে বসেন। তিনি নড়লেন না। রেশমীর কোন কথা তিনি শুনতে পাচ্ছেন বলে মনে হল না। তিনি তাকিয়ে আছেন রেশমীর দিকে, কিন্তু ভাবছেন অন্য কথা। পাশ বই-এ তাঁর কিছু টাকা আছে। গ্রামের বসতবাড়ি-সম্পত্তি বিক্রি করে নগদ টাকা রেখে দিয়েছিলেন ভবিষ্যতের জন্যে। নব্বই হাজারের মত। সুদ টদ নিয়ে সেই টাকা এখন বেড়ে এক লাখ তিরিশ হাজার হয়েছে। এই টাকা ব্যবহার করা যেতে পারে। তার স্ত্রীর কিছু গয়না আছে। সামান্যই–গয়না এখন আর কি কাজে আসবে? সকাজ তো তেমন কিছু তিনি করেননি। সামান্য সৎকাজ করা হল।