মাহবুব সাহেব নিয়মিত নামাজ পড়েন। আসরের ওয়াক্ত শেষ হয়ে যাচ্ছে এটা তিনি লক্ষ্য করছেন কিন্তু এই ব্যাটার পেছনে নামাজ পড়ার অর্থ হয় না। যার উপর রাগ থাকে তার পেছনে নামাজ পড়া যায় না। নামাজ কবুল হয় না।
চারজন শিক্ষক উঠে দাড়ালেন। মাহবুব সাহেবের ক্ষীণ সন্দেহ হলতারা বোধহয় গল্পের হাত থেকে বাচার জন্যেই উঠে গেছে। নামাজটা উপলক্ষ্য। আসর ভেঙে গেল। ভাঙা আসরে গল্প বলার কোন মানে হয় না। কিন্তু মান রক্ষার জন্যে হলেও শেষ করা দরকার। মাহবুব সাহেব বিনয় বাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, চরম বিপদ গিয়েছিল, বুঝলেন, আরেকটু হলে মরেই যেতাম। সাপ ফণা তুলে ফেলেছিল।
বিনয় বাবু অনাগ্রহের সঙ্গে বললেন, ও আচ্ছা।
আমি নিজে কিছুই দেখিনি। আমার মেয়ে প্রথম দেখল, বুঝলেন কি-না সে এক বাটি মুড়ি নিয়ে আসছে। হঠাৎ এক চিৎকার–এইটা কি? এইটা কি? আমি তাকিয়ে দেখি সাপ ফণা তুলে আছে। হাতের খাবার সাইজের এক ফণা।
গল্পে আবার বাধা পড়ল। হরিপদ চা-সিঙ্গাড়া নিয়ে এসেছে। বিনয় বাবু ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন ভাগাভাগিতে। গরম গরম সিঙ্গাড়া, ধোঁয়া উড়ছে। এর স্বাদই অন্য রকম। মাহবুব সাহেবের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। একবার খাবেন না বলার পর আর খাওয়া যায় না। বিনয় বাবুকে দেখা যাচ্ছে পিরিচে তিনটা সিঙ্গাড়া আলাদা করছেন। মাহবুব সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, করছেন কি?
বিনয় বাবু বললেন, হেডস্যারকে দিয়ে আসি।
দিয়ে আসতে হবে না, এখানে এসে খাবেন। আর তিনটা সিঙ্গাড়া দিলেন কোন আন্দাজে? সবাইকে দুটা দিচ্ছেন। তাকেও দুটা দিন। যান খবর দিন। এতগুলি মানুষকে খামাখা কেন বসিয়ে রেখেছেন কে জানে। জরুরী মিটিং, আমি তো জরুরী কিছু দেখি না।
আপনাকে দেই। গরম সিঙ্গাড়া খেতে ভাল লাগবে। এরা জিনিসটা ভাল বানায়।
বললাম তো বাজারের খাবার খাই না।
হেডমাস্টার সাহেবকে আসতে দেখা যাচ্ছে। মাটির দিকে তাকিয়ে হন হন করে হাঁটা। মাহবুব সাহেব চারদিনের পুরনো খবরের কাগজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। হেডমাস্টার সাহেবের সাথে তাঁর ঠাণ্ডা লড়াই চলছে। এই মানুষটার মুখের দিকে তাকাতে ইচ্ছে করছে না।
মাহবুব সাহেব, খবর কি?
ভাল।
নাস্তা-পানির ব্যবস্থা হয়েছে দেখছি, সিঙ্গাড়া কি পরিমলের দোকানের?
বিনয় বাবু হাসিমুখে বললেন, জ্বি স্যার। তিনি হেডমাস্টার সাহেবের দিকে পিরিচ এগিয়ে দিলেন।
এই সিঙ্গাড়া একটা দুটো খেলে হয় না। গোটা দশেক করে খেতে হয়। বিনয় বাবু, হরিপদকে পাঠান তো, আরো কিছু আনুক।
তিনি পকেট থেকে কুড়ি টাকার নোট বের করলেন।
নামাজীরা নামাজ শেষ করে ফিরেছে। বিনয় বাবু খুশি-খুশি গলায় বললেন, হেডস্যার আরো কুড়ি টাকার সিঙ্গাড়া আনতে দিলেন। পারহেড খ্রী পিস।
ফজলুল করিম সাহেব চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, আপনাদের সবার জন্যে একটা সুসংবাদ আছে। এই জন্যেই আপনাদের এতক্ষণ আটকে রাখলাম। সুসংবাদটা কি আন্দাজ করুন দেখি?
মাহবুব সাহেব বিরস মুখে বললেন, আন্দাজ-ফান্দাজ আবার কি, কি বলতে চান বলুন। আমাদের সবারইতো কাজকর্ম আছে।
সরকার থেকে একটা স্যাংশান পাওয়া গেছে। সাত লাখ টাকা। কনস্ট্রাকশনের জন্য স্যাংশন। আজকেই চিঠি পেলাম। এইবার ইনশাল্লাহ পাকা বিল্ডিং হবে। হোস্টেল হবে। ঘটনাটা কিভাবে ঘটল তার শানে-নজুলটা আপনাদের বলি। শুনলে ভাল লাগবে সে এক ইতিহাস……।
মাহবুব সাহেব অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গে লক্ষ্য করলেন–সাপের গল্প কেউ আগ্রহ নিয়ে শুনছিল না, কিন্তু সাত লাখ টাকার গল্প চোখ বড় বড় করে কনছে।
ঢাকা গিয়েছিলাম এক বৎসর আগের কথা বলছি। শ্রাবণ মাসের শেষ। বায়তুল মোকাররমের সামনে দিয়ে হাঁটছি হঠাৎ শুরু হল বৃষ্টি–দৌড় দিয়ে একটা দোকানে ঢুকলাম। দোকানে এক লোেক কি যেন কিনছে। লোকটাকে চেনা চেনা লাগছে–আবার চেনাও যাচ্ছে না। আমি তাকাতেই সে বলল, আরে স্যার, আপনি। বলেই পা ছুঁয়ে সালাম। তার সঙ্গে ফুটফুটে দুটো মেয়ে। সে মেয়ে দুটোকে বলল, সালাম কর, সালাম কর। আমার শিক্ষক।
মেয়ে দুটো ইতস্তুত করছে। একালের শহুরে মেয়ে, এরা হুট করে পা ছুঁয়ে সালাম করে না। সে দিল ধমক, মারা দাঁড়িয়ে আছ কেন? সালাম কর, সালাম কর। আমার শিক্ষক।
মাহবুব সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, গল্প সংক্ষেপ করুন। আপনি দেখি সাত খন্ড রামায়ন শুরু করেছেন।
হেডমাস্টার সাহেব অপ্রতিভ হলেন না। তিনি হাসিমুখে বললেন, খুবই ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। পুরোটা শুনতে হবে।
–আমাকে ছাড়ল না। জোর করে গাড়িতে নিয়ে তুলল। বাসায় নিয়ে গেল। সে শিক্ষা দপ্তরের বিরাট অফিসার। জয়েন্ট সেক্রেটারী। যেদিন আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে সেদিনই প্রমোশন পেয়েছে। প্রমোশন উপলক্ষে ঘরোয়া খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন–আমি তার মধ্যে বাইরের লোক। অনেক কথা হলো তার সাথে, স্কুলের কথা বললাম, স্কুলের ভগ্নদশার কথা বললাম। মনজুর বলল, স্যার দেখি কি করতে পারি। আমি তার কথায় তেমন গুরুত্ব দেইনি। সরকারী অফিসাররা দেখি শব্দটা প্রচুর বলে কিন্তু কিছু দেখে না। না দেখাটাই তাদের দস্তুর। মনজুর দেখেছে। আশ্চর্য ব্যতিক্রম।
বিনয় বাবু বললেন, সেক্রেটারী সাহেবের নাম মনজুর?
সেক্রেটারী না, জয়েন্ট সেক্রেটারী। মনজুর আহমেদ।
মওলানা বললেন, পাকা বিল্ডিং হচ্ছে এ তো অতি আনন্দের সংবাদ।
ফজলুল করিম সাহেব বললেন, আনন্দ মানে? মহানন্দ। দুপুরের ডাকে চিঠি পেয়েছি। পর পর তিনবার পড়লাম। তারপর দেখি, আমার চোখ দিয়ে আপনা আপনি পানি পড়ছে।