এটাতো স্যার কোন যুক্তি হল না।
তা অবশ্যি হল না।
মাহবুব সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, এটা বলার জন্যেই কি মিটিং ডেকেছেন?
না, আসল কথা বলা হয়নি আসল কথা হচ্ছে–এস, এস, সি পরীক্ষার আর আছে মাত্র তিন মাস। এই তিনমাস আমাদের প্রাণপন খাটতে হবে। এবারে তিনজন খুব ভাল ছেলে আছে। এর মধ্যে একজন তো অসম্ভব। ভাল–বদরুল আলম। এদের ঠিক ঠাক মত কোচিং করতে হবে। অসাধারণ একটা রেজাল্ট ওদের দিয়ে করাতে হবে। স্কুলের পূর্ব গৌরব ফিরিয়ে আনার একটা সুযোগ এসেছে। সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। এদের কোচিং এর বিষয়ে আপনাদের কোন মতামত আছে?
কেউ কোন জবাব দিল না। কোচিং এর বিষয়ে নতুন তো কিছু বলার নেই। আগে যেমন হয়েছে এবারও তেমন হবে।
করিম সাহেব বললেন, আমি চিন্তা করছি দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা এই ছেলেদের মনিটার করলে কেমন হয়। ইরতাজউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে এ নিয়ে কথা হয়েছে। আপনাদের সঙ্গে আলোচনা হয়নি। আমি যা ভাবছি তা হচ্ছে না…
পরীক্ষার্থী যারা সবাই একসঙ্গে থাকবে। একসঙ্গে পড়বে। এতে একটা টিম স্পিরিট তৈরী হবে। দায়িত্ব শিক্ষকদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হবে। যেমন ভোর ছটা থেকে দুপুর বারটা পর্যন্ত একজন শিক্ষক। দুপুর বারটা থেকে সন্ধ্যা ছটা পর্যন্ত একজন এ রকম। প্রতিট বিষয়ের জন্যে আলাদা আলাদা ক্লাস হবে। আইডিয়াটা আপনাদের কাছে কেমন লাগছে।
এবারো কোন জবাব পাওয়া গেল না। করিম সাহেব উৎসাহের সঙ্গে বললেন, এটা যে পুরোপুরি আমার মৌলিক আইডিয়া তাও না। তিব্বতে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের এইভাবে বড় বড় পরীক্ষার জন্যে তৈরী করা হয়।
মাহবুব সাহেব বললেন, এটাতো স্যার তিব্বত না।
আমি জানি এটা তিব্বত না। আমার কথা হল, তিব্বত যদি এই নিয়মে কাজ করে আমাদের দেশেও করবে। একটা বড় কিছুর জন্যে সবাইকে এক সঙ্গে তৈরী করা। একটা টিম স্পিরিট সবার মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া। যদি আমাদের এই গ্রামের দরিদ্র স্কুল অসাধারণ একটা রেজাল্ট করে তার ফল হবে সুদূর প্রসারী। স্কুল তখন টিকে যাবে। দূর দূর থেকে ছাত্ররা আমাদের এই স্কুলে পড়তে আসবে। সরকারী সাহায্য আসবে। দানশীল মানুষেরা এগিয়ে আসবেন।
মাহবুব সাহেব বললেন, আপনার কথা শুনতে ভাল লাগছে। কিন্তু যে আইডিয়া শুনতে যত ভাল সেই আইডিয়ার মূল্য ততকম। তিনমাস পড়িয়ে ছেলেদের ফার্স্ট সেকেন্ড বানাবেন তা হয় না।
হবে না এটা আগে থেকে ধরে নেয়াটা কি ঠিক? চেষ্টাতো করা যেতে পারে।
এতগুলি ছেলে একসঙ্গে থাকবে কোথায় থাকবে। এরা খাবে কি?
এইগুলি নিয়ে আলোচনা করার জন্যেইতো মিটিং। আপনারা বলুন কি ভাবে করা যায়?
চায়ের কাপে চুমুক দেয়ার শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ হচ্ছে না। মাহবুব সাহেব উঠে দাঁড়াতে দাড়াতে বললেন, স্যার আমি তাহলে উঠি?
উঠবেন? কিছু বলবেন কি?
এখনি বলতে হবে? পরে বলি?
করিম সাহেব ক্লান্ত ভঙ্গিতে বললেন, আচ্ছা বলুন পরেই বলুন।
শেষ পর্যন্ত সরকারি চিঠি এসেছে
শেষ পর্যন্ত সরকারি চিঠি এসেছে। আগের চিঠির মেমো নাম্বার উল্লেখ করে সরকার জানাচ্ছে,
জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুলের ছাত্র সংখ্যা আশংকাজনকভাবে কমিয়া গিয়াছে। শিক্ষক সংখ্যাও অপ্রতুল। এই অবস্থায় সরকারী অনুদান কাজে আসিবে কি আসিবে না তাহা পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন। বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্যে ময়মনসিংহের ডেপুটি কমিশনারকে আহবায়ক করিয়া একটি কমিটি গঠন করা হইয়াছে। পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট এই কমিটিকে আগামী তিন মাসের ভিতর স্কুল সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ বিপোর্ট দেবার জন্যে অনুরোধ করা যাইতেছে।
ফজলুল করিম সাহেব দীর্ঘ সময় চিঠিটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। সব চিঠিই তিনি কয়েকবার করে পড়েন। শুধু এই চিঠিটিই একবার পড়লেন। আগামীকাল থেকে গরমের ছুটি শুরু হবে। আজ শেষ ক্লাস। ছুটির আগের শেষ ক্লাসে ছাত্ররা সব আনন্দ করে। আজ কিছুই হচ্ছে না। সব কেমন মরা। মরা। ছাত্রই নেই প্রাণ আসবে কোত্থেকে, স্কুলের প্রাণ হচ্ছে তার ছাত্র। দালান কোঠা তো স্কুলের প্রাণ না।
মওলানা সাহেব সন্ধ্যাবেলা হেডমাস্টার সাহেবের ঘরে এসে বললেন, স্যার বাসায় যাবেন না?
আপনি চলে যান। আমি একটু পরে যাব।
আপনার কি শরীর খারাপ করেছে?
না। এমনিতেই ভাল লাগছে না।
মামুন সাহেবের একটা চাকরি হয়েছে শুনেছেন বোধহয়।
না শুনিনি–কোথায় চাকরি হয়েছে?
সরকারী কলেজের লেকচারার। বরিশাল বিএম কলেজ। ইন্টারভ্যু দিয়ে এসেছিলেন। গতকাল চিঠি এসেছে।
উনার না এখানে নিরিবিলিতে থেকে বি সি এস পরীক্ষার জন্যে তৈরী হবার কথা। বি, সি,এস দিচ্ছেন না।
আমাকে বললেন–বি সি এস দেবেন না। মাষ্টারী করবেন। খুব খুশী।
খুশী হবারই কথা।
আপনাকে কিছু জানাননি?
প্রথমেই তো বলেছি জানায়নি। একই প্রশ্ন দুবার তিনবার করে কেন করেন।
ভুল হয়ে গেছে স্যার ক্ষমা করে দেবেন। ক্ষমা করলাম। আপনার কথা শেষ হয়ে থাকলে চলে যান। আমি নিরিবিলিতে কিছুক্ষণ বসে থাকব।
দুটা কথা বাকি আছে। বলেই চলে যাব। প্রথম কথাটা হল। এস,এস, সি ছাত্রদের কোচিং এর ব্যাপারে আপনি যা বলেছেন সেটা করা সম্ভব বলে আমার ধারণা। আমি মামুন সাহেবকে নিয়ে একটা পরিকল্পনা করেছি। শিক্ষকদের ডিউটি ভাগ করা হয়েছে। স্কুলের লাইব্রেরী ঘরে ছাত্ররা থাকবে।
এতগুলি ছাত্র লাইব্রেরী ঘরে থাকবে কি ভাবে?
সব ছাত্র না–আমরা ৫ জন বেছে নিব। প্রথম পাঁচ জন।