ইঞ্জিন ঠিকই আছে। তেল নেই, ইঞ্জিন চলে না। আপনি যুবক মানুষ। মনে উৎসাহ আছে, চার মাস যখন বেতন পাবেন না তখন আর উৎসাহ থাকবে না।
না থাকারই কথা।
যাই হোক, আছেন যখন নিজের চোখে সব দেখবেন। সরকারী ডি এ আছে বলে কিছু শিক্ষক এখনো আছেন। ডি এ যখন থাকবে না তখন কি হবে?
ডি এ থাকবে না?
থাকবে কি জন্যে ছাত্র নেই স্কুলের আবার ডি এ কি?
ছাত্র কিছুতো আছে।
এও থাকবে না। দেখবেন ফাঁকা স্কুল ঘরে হেড মাস্টার সাহেব বসে থাকবেন। মাছি টাছি মারবেন।
কিছু করার উপায় নেই?
ধ্বস নামলে কিছু করার থাকে না। ধ্বস নেমে গেছে। আপনি বাইরে থেকে এসেছেন। কিছু বুঝতে পারছেন না। গত মাসের বেতন পেয়েছেন?
জি-না।
কোত্থেকে পাবেন? একটা ফুটা পয়সা স্কুলের নাই। হা হা হা।
মামুন বিস্মিত হয়ে বলল, আপনি এত আনন্দিত কেন? আপনিওতো স্কুলের একজন।
মাহবুব সাহেব শুকনো গলায় বললেন, হেসে ফেলেছি দেখে ভেবেছেন আনন্দিত। আসলে তা না, মনের দুঃখে হেসেছি। এক সময় এই স্কুলের কি রমরমা ছিল আর আজ কি অবস্থা। আফসোস। বিরাট আফসোস।
অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার
অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুলে আজ শিক্ষকদের বেতন হচ্ছে। তাও ভাঙ্গা বেতন না। পুরো বেতন। পুরো ব্যাপারটা শিক্ষকদের কাছে অপ্রত্যাশিত। বেতন হবে, এই সম্পর্কে হেড স্যার আগে কিছু বলেন নি। কোন আদায় পত্রও হয়নি। টাকাটা পাওয়া গেল কোথায়? কেউ এ সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করছে না। বেতন হচ্ছে এটাই বড় কথা। কোত্থেকে হচ্ছে, কি ভাবে হচ্ছে সেটা বড় কথা না। জানতে না চাওয়াই ভাল। শিক্ষকরা হেড সারের ঘরে ঢুকছেন, রেভিনিত্যু ষ্ট্যাম্পে সই করে বেতন নিচ্ছেন।
মাহবুব সাহেব বেতন নিতে এলেন শেষে। এসিসট্যান্ট হেড মাস্টার হিসেবে ভার একটা দায়িত্ব আছে। ফান্ড কোথায় পাওয়া গেল তার জানা দরকার। তিনি শুকনো মুখে বললেন, টাকাটা কোত্থেকে দেয়া হচ্ছে?
ইমার্জেন্সি ফান্ড থেকে দিচ্ছি।
স্কুল কমিটির অনুমতি ছাড়াতো স্যার আপনি ইমার্জেন্সি ফান্ড ভাঙতে পারেন না।
অনুমতি পরে নিয়ে নিব। শিক্ষকরা অনেকদিন থেকে কষ্ট করছেন। তিন মাস বেতন হচ্ছে না। তাদের ইমার্জেন্সিওতো ইমার্জেন্সি।
আমাদের তো স্যার আইন কানুন মানতে হবে।
ইমার্জেন্সির সময় কোন আইন কানুন থাকে না। সাধারণ সময়ের সাধারণ আইন। জরুরী সময়ের জরুরী আইন। মাহবুব সাহেব টাকা গুনে Fani
কাজটা স্যার ভুল করলেন।
মানুষ হয়ে জন্মেছি ভুল করব না তাতো হয় না। দশবার শুদ্ধ করব, একবার ভুল করব তবেই না আমি মানুষ। আজ আমি একটা মিটিং দিয়েছি মাহবুব সাহেব।
কিসের মিটিং?
স্কুল বিষয়ে আপনাদের সবার সঙ্গে কিছু কথা বলব। মুক্ত আলোচনা। আপনারও যদি বলার কিছু থাকে আপনিও বলবেন।
মিটিং হবে কখন?
পাঁচটার সময়।
চারটার দিকে করতে পারেন না? আমার পাঁচটার সময় এক জায়গায় যাবার কথা।
স্কুল পিরিয়ডে ছাত্রদের ক্ষতি করে তো আর মিটিং করতে পারি না। আপনার খুব জরুরী কোন কাজ থাকলে কাজে যাবেন। খুব জরুরী কিছু না থাকলে থাকুন, গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলব।
দেখি।
মাহবুব সাহেবের কাজটা তেমন জরুরী না। আজ নিমখালি বাজারে হাট বার। হাটে গরু-ছাগল উঠে। ছেলের আকীকার জন্যে একটা গরু কেনার কথা। ফজলুল করিম সাহেবের মিটিংয়ের চেয়ে ছেলের আকীকা অনেক জরুরী। দুদিন পর পর ছেলে অসুখে ভুগছে। শরীর হয়েছে পাট কাঠির মত। আকীকা করা থাকলে নিশ্চিন্ত থাকা যায়। তাছাড়া হেড মাস্টার সাহেবের গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতায় আসলে গুরুত্বপূর্ণ কিছু থাকবে না। স্কুল স্কুল বলে চেঁচিয়ে তো কিছু হবে না। তারপরেও মাহবুব সাহেব মিটিং এ থেকে যাওয়াই ঠিক করলেন। আরেক বুধবার পর্যন্ত তাকে অপেক্ষা করতে হবে। উপায় কি?
দপ্তরী হরিপদ বড় একটা ধামায় পেঁয়াজ কাঁচামরিচ দিয়ে মুড়ি মাখছে। কেতলীতে করে চা এসেছে। মুড়ি খাওয়ার পর চা দেয়া হবে। মুড়ি এবং চা দুটার টাকাই হেড মাস্টার সাহেব দিয়েছেন।
খবরের কাগজ বিছিয়ে মুড়ি টেলে দেয়া হয়েছে। মুড়ি চিবানোর কচাকচ শব্দের ভেতর ফজলুল করিম সাহেব ঢুকলেন। শিক্ষকরা উঠে দাঁড়ানোর ভঙ্গি করলেন তবে কেউ পুরোপুরি উঠলেন না।
ফজলুল করিম সাহেব হাসি মুখে বললেন, মুড়ি খাওয়ার কচ কচ শব্দ একটু কমুক তারপর কথা বলি।
মাহবুব সাহেব বললেন, যা বলার এর মধ্যেই বলুন। কথা শুনতেতো অসুবিধা হচ্ছে না। সবারই তাড়া আছে।
করিম সাহেবের জন্যে পিরিচে করে মুড়ি এবং একটা চামুচ এসেছে। তিনি মুড়ির দিকে তাকালেন মুড়ি মুখে নিলেন না।
নীচু গলায় কথা বলা শুরু করলেন। একটা দুঃসময়ের ভেতর দিয়ে আমরা যাচ্ছি। নতুন করে বলার কিছু না সবাই তো জানেন। আমি যা বলতে চাচ্ছি তা হচ্ছে দুঃসময়টা সাময়িক।
মাহবুব সাহেব বললেন, দুঃসময় সাময়িক মনে হবার কারণ কি?
তেমন কোন কারণ অবশ্যি দেখছি না, তবু মনের ভেতর থেকে কে যেন বলছে দুঃসময় থাকবে না।
নতুন সায়েন্স টিচার হঠাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে বললেন, উইথফুল থিংকিং নাতো স্যার!
হতে পারে, উইথফুল থিংকিং হতে পারে। দেখি এক কাপ চা খাওয়া যাক।
হরিপদ চায়ের কাপ এনে সামনে রাখল। করিম সাহেব মামুনের দিকে তাকিয়ে বললেন, সিগারেট খেতে ইচ্ছা হচ্ছে আপনার কাছে কি আছে?
মামুন সিগারেট বের করে দিল। করিম সাহেব সিগারেট টান দিয়ে কাশতে লাগলেন। কাশি থামিয়ে সহজ গলায় বললেন, মামুন সাহেব আমি যা বলছি তা ঠিক উইথফুল থিংকিংও না। কিছু যুক্তি আছে। এত দিনের পুরনো একটা স্কুলতো জলে ভেসে যেতে পারে না।