মাহবুব সাহেব হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, স্যার উঠি। হেডমাস্টার সাহেব তৎক্ষণাৎ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, জ্বি আচ্ছা জ্বি আচ্ছা।
দুপুরে কিছু খাওয়া হয়নি, ক্ষিধে জানান দিচ্ছে। বয়স হয়ে গেলে ক্ষিধের কষ্টই প্রবল হয়ে দাড়ায়। হরিপদকে পাঠিয়ে কোন খাবার টাবার আনলে হত। একটা কলা দুটা বিসর্কিট….
বিনয় বাবু বললেন, স্যার আসব?
আসুন বিনয় বাবু। আপনি এখনো যাননি?
আজ্ঞে না। আপনার সঙ্গে সামান্য কথা ছিল।
বলুন।
বিনয় বাবু বসতে বসতে বললেন, আমার সংসারের অবস্থার কথা তো স্যার আপনি জানেন, অভাবে অনটনে পর্যন্ত হয়েছি। ঘরে বিবাহযোগ্যা কন্যা। বিবাহ দিতে পারছি না। পণ ছাড়া হিন্দু মেয়ের বিয়ে হয় না। এক লাখ দুলাখ টাকা পণ চায়। কোথায় পাব এত টাকা?
জ্বি তা তো ঠিকই। বড়ই দুঃসময়। সবার জন্যই দুঃসময়। তবে পৃথিবীর সব দুঃসময়ই সাময়িক। শীতের পরে বসন্ত আসে এটা জাগতিক নিয়ম।
জাগতিক নিয়ম সবার জন্য না স্যার। আমার বেলায় শীতের পর শীত আসে, তার পর আসে আরো শীত। স্যার আমি জানি আপনি মনে কষ্ট পাবেন কিন্তু না বলে পারছি না …
বলুন কি ব্যাপার?
বিনয় বাবু কিছু বললেন না। পাঞ্জাবীর কোণায় চোখ মুছতে লাগলেন। ফজলুল করিম সাহেব বললেন, আপনি কি নীলগঞ্জ স্কুলে যোগ দিয়েছেন?
বিনয় বাবু হা সূচক মাথা নাড়লেন। ফজলুল করিম সাহেব বললেন, আপনাকে ছাড়া আমি স্কুল চালাব কিভাবে? আপনার মত অংকের শিক্ষক আমি কোথায় পাব?
নতুন শিক্ষক যিনি এসেছেন, মামুন সাহেব তিনি ভাল অংক জানেন। শুধু ভাল না। খুব ভাল। আমি ক্লাশ টেনের ছাত্রদের কাছ থেকে খোঁজ নিয়েছি।
ও আচ্ছা।
কারো জনোই কিছু আটকে থাকে না স্যার। আমি যা করেছি না পেরে করেছি। এই অপরাধের জন্যে নরকে আমার স্থান হবে। তা হোক, শুধু আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি ঈশ্বরের ক্ষমা চাই না। আপনার ক্ষমা চাই।
আপনি চলে গেলে আরো অনেকেই যাবে।
তা যাবে।
স্কুলটা কি উঠে যাবে?
না উঠবে না। আপনার মত মানুষ থাকলে স্কুল উঠবে না। স্যার উঠি।
বিনয় বাবু হঠাৎ নিচু হয়ে ফজলুল করিম সাহেবকে প্রণাম করতে গেলেন। ফজলুল করিম সাহেব আঁৎকে উঠে বললেন, করেন কি, করেন কি, বয়সে আপনি আমার বড়ই হবেন।
বিনয় বাবু ধরা গলায় বললেন, আমি তো স্যার আপনাকে প্রণাম করছি। আপনার ভেতর যিনি বাস করছেন আঁকে প্রণাম করছি। তিনি নমস্য।
সরকারি চিঠি আজকের ডাকেও আসেনি। ফজলুল করিম সাহেব তাঁর বড় মেয়ের একটি চিঠি পেলেন। মেয়ের চিঠিটা একটু যেন রহস্যময়। মেয়ে লিখেছে–
বাবা,
আমি প্রচণ্ড ব্যস্ত থাকি বলে তোমাকে নিয়মিত চিঠি লিখতে পারি না। তবে তোমার খোঁজ খবর সব সময় রাখি। সম্প্রতি তোমার বিষয়ে কিছু অস্বস্তিকর খবর পেয়ে অত্যন্ত বিব্রত আছি। আশা করি আমি কি বলছি তুমি বুঝতে পারছ। তোমার সামাজিক মান মর্যাদার দিকে তুমি লক্ষ্য রাখবে এটা আশা করা অন্যায় না। নিঃসঙ্গ মানুষ নিজের নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্যে মাঝে মাঝে উদ্ভট সব কান্ড করে। তোমার এই বয়সে, তুমি এমন কিছু করবে না–এটুক আশা তোমার মেয়ে হিসেবে আমি অবশ্যই করতে পারি।
ফজলুল করিম সাহেব মেয়ের চিঠি কয়েকবার পড়লেন কিন্তু চিঠির মূল বিষয় ধরতে পারলেন না।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। মওলানা ইরতাজউদ্দিন বারান্দায় আজান দিয়ে নামাজ পড়ছেন। হেড মাস্টার সাহেব তার ঘরে একা একা বসে আছেন। মওলানার নামাজ শেষ হলে এক সঙ্গে বেরুবেন।
দপ্তরী এসে ঢুকল। করিম সাহেব বললেন, কিছু বলবি? হরিপদ মাথা চুলকে বলল, নতুন মাস্টার সাব লাইব্রেরি ঘরের বেবাক বই নামাইয়া একটা বিষয় করতাছে।
কি করছেন?
এই ঘাটাঘাটি।
করুক। বই সাজিয়ে রাখার জন্যে না। পড়ার জন্য। ঘাটাঘাটি করার জন্য। বুঝলি?
জ্বি স্যার।
এর মধ্যেই খবর হয়ে গেছে। মামুন সাহেব অতি ভাল শিক্ষক। একজন ভাল শিক্ষক ১০০ হাতীর সমান।
ফজলুল করিম সাহেবের বিষণ্ণ ভাবটা কেটে যাচ্ছে। নতুন শিক্ষক স্কুলের লাইব্রেরীর বই ঘাটাঘাটি করছেন। খুবই ভাল লক্ষণ। স্কুল লাইব্রেরীর দায়িত্ব তাকে দিয়ে দেয়া যায়।
বিনয় বাবুর জন্য মনটা খারাপ লাগছে। অতি সজ্জন। অংকের জাহাজ। যে কোন অংক মুখে মুখে করে ফেলতে পারেন। এ রকম শিক্ষক যে কোন স্কুলের জন্যে স্তম্ভের মত।
মাহবুব সাহেবের বাড়িতে
মাহবুব সাহেবের বাড়িতে আজ মামুনের রাতের খাবার দাওয়াত। মাহবুব সাহেব বলে দিয়েছেন, সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় চলে আসবেন গল্পগুজব করব। বাড়িতে টিভি আছে ব্যাটারীতে চলে। আজ আবার নাটক আছে। মজা করে নাটক দেখবেন।
মামুন বলল, আমি যথাসময়ে উপস্থিত হব। তবে নাটক দেখব না।
টিভির নাটকগুলিতো অতি উত্তম। দেখবেন না কেন?
ভাল লাগে না।
ভাল না লাগলে দেখবেন না। আমরা বারান্দায় বসে গল্প করব। একবার সাপের হাতে জীবন যেতে বসেছিল গল্পটা আপনাকে বলা হয় নাই। বিষধর সর্প।
জ্বি আচ্ছা আপনার বিষধর সর্পের গল্পও শুনব। দাওয়াত কি আমি একা যায়? ইরতাজউদ্দিন সাহেব যাবেন না? দুজন এক সঙ্গে থাকি এর মধ্যে আমি একা দাওয়াত খেতে যাওয়া ব্যাপারটা খারাপ দেখায় না?
আসুন উনাকেও নিয়ে আসুন। অসুবিধা কিছু নাই। খাওয়া দাওয়াতো কোন ব্যাপার না–গল্প গুজব করা।
ইরতাজউদ্দিন সাহেব আসতে রাজি হলেন না। মামুন একাই উপস্থিত হল। মাহবুব সাহেবের বাড়িটা সুন্দর। অনেকখানি জায়গা নিয়ে হাফ বিল্ডিং। উপরে টিনের ছুদি। বাড়ির সামনে দেশী গাছ গাছড়ার বাগান। মামুন মুগ্ধ হয়ে বলল, এটা দেখি ইন্দ্রপুরীর বাগান।