একজন বলল, আমরা স্যার যাব না।
ফজলুল করিম সাহেবের ভুরু কুঁচকে গেল। ছেলেটা কথা বলেছে বেয়াদবের মত। উঠে দাড়ায়নি। স্যারের সঙ্গে কথা বললে–উঠে দাড়াবে। যা বলবে স্পষ্ট করে বলবে।
তোমার নাম ফরহাদ উদ্দিন না?
জ্বি স্যার।
শোন ফরহাদ উদ্দিন। তুমি যে বললে, তোমরা যাবে না। শুনে আমি সঙ্গত কারণেই খুশি হয়েছি। কিন্তু কথাগুলি তুমি বলেছে বসে বসে। অত্যন্ত বেয়াদবের মত কাজ করেছ। ভবিষ্যতে আর কখনো করবে না।
জি আচ্ছা স্যার।
এখন বল তোমরা যাবে না কেন?
এই স্কুলই ভাল।
নীলগঞ্জ স্কুল যে খারাপ এটা তো তুমি বলতে পার না। কারণ তুমি ঐ স্কুলে পড়নি। পড়েছ?
জি না।
তাহলে বললে কেন এই স্কুলই ভাল? যা মনে আসে তাই বলে বসবে। কথা বলার আগে অবশ্যই আমাদের অনেক সাবধান হতে হবে। কথা বলাটাও শিক্ষারই একটা অঙ্গ। মনে থাকবে?
জ্বি স্যার!
আজকে আমরা কি পড়ব?
ইংরেজী কবিতা।
কবিতার নাম কি?
The Sands of Dee.
যে কবি কবিতাটা লিখেছেন তার নাম কি? কেউ জান না। জানা উচিত ছিল না-কি? কবির নাম চার্লস কিংসলে। সবাই এক সঙ্গে বল চার্লস কিংসলে।
সবাই এক সঙ্গে বলল, চার্লস কিংসলে।
আবার বল।
ছাত্ররা আবার বলল।
ফজলুল করিম সাহেব বোর্ডের কাছে গেলেন। চক দিয়ে বড় বড় করে লিখলেন Charles Kingsley.কবির নামের নিচে লিখলেন কবিতার নাম The sands of Dee. প্রথমে স্রষ্টা তারপর তার সৃষ্টি। কাজটা কি ঠিক করলেন? সৃষ্টি কি বেশির ভাগ সময়ই স্রষ্টাকে ছাড়িয়ে যায় না? জীবনকৃষ্ণ বাবুর চেয়েও কি জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুল অনেক গুরুত্বপূর্ণ নয়?
তিনি মিষ্টি গলায় কবিতার প্রথম চার লাইন আবৃত্তি করলেন।
O Mary, go and call the cattle home.
And call the cattle home,
And call the cattle home,
Across the sands of Dee.
বাবারা বল Dee মানে কি?
নদীর নাম স্যার।
হ্যাঁ। ইংল্যাণ্ডের একটা নদীর নাম। লিভারপুলের কাছে এই নদী সমুদ্রে পড়েছে। এই কবিতায় অনুপ্রাণিত হয়ে আমাদের দেশের এক কবিও অসাধারণ একটা কবিতা লিখেছিলেন। তোমরা কেউ সেটা জান?
ছাত্ররা চুপ করে আছে। কেউ জবাব দিচ্ছে না। ফজলুল করিম সাহেব বিষণ্ণ গলায় বললেন, কবিতাটা তোমরা ক্লাস সেভেনে পড়েছ। তোমাদের পাঠ্য ছিল
শোন মা আমিনা, রেখে দে রে কাজ, ত্বরা করে মাঠে চল
এল মেঘনায় জোয়ারে বেলা এখনি নামিবে ঢল।
নদীর কিনারা ঘন ঘাসে ভরা,
মাঠ থেকে গরু নিয়ে আয় ত্বরা,
করিস না দেরি আসিয়া পড়িবে সহসা অথই জল।
মাঠ থেকে গরু নিয়ে আয় তৃরা মেম্বনায় নামে ঢল।
ফজলুল করিম সাহেব অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। ভাল লাগছে না। কিছু ভাল লাগছে না। ঘণ্টা পড়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। তিনি বোর্ডের দিকে তাকালেন। ভুল করেছেন। কবির নামের আগে কবিতার নাম থাকা উচিত ছিল।
আজ বৃহস্পতিবার হাফ স্কুল ফজলুল করিম সাহেব ঠিক করে ফেললেন বাসায় যাবেন না। স্কুলেই সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকবেন। রেশমী মন খারাপ করবে। করুক। দুটার দিকে ডাক আসে। ডাকের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। সরকারি অনুদানের চিঠি পেয়েছেন। চেক আসছে না। মনজুরকে কয়েকটা চিঠি দিয়েছেন। মনজুর চিঠির জবাব দিচ্ছে না। একবার ঢাকা যাওয়া উচিত।
গত মাসে শিক্ষকদের বেতন দিতে পারেন নি। সরকারী ডি, এর টাকাটা দিতে পারলেও হত। সেই টাকাও আসেনি। স্কুলের এমন কোন ফান্ড নেই যে সেখান থেকে টাকা ধার করেন। এত দিনের পুরানো একটা স্কুল অনার বোর্ডের দিকে তাকালে মন ভরে যায়। কত বিখ্যাত মানুষ এই স্কুল তৈরি করেছে।
ফজলুল করিম সাহেব ছাত্রদের দিকে তাকালেন। তারা এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি বললেন, আজ পড়াতে ভাল লাগছে না। খুব মাথা ধরেছে …
বলেই তিনি অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। তাঁর মাথা ধরেনি। ছাত্রদের মিথ্যা কথা বলা হল। মাথা না ধরলেও শারীরিকভাবে স্বস্তিবোধ করছেন না। গরম লাগছে। কোটের কারণে গরম লাগছে বোধ হয় …।
ফজলুল করিম সাহেব ক্লাস শেষ হবার ঘণ্টার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন। সময় কাটছেই না।
স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। শিক্ষকরা সবাই চলে গেছেন। শুধু মাহবুব সাহেব এবং বিনয় বাবু বসে আছেন। বিনয় বাবু গোপনে কিছু কথা বলতে চান। তিনি টিচার্স কমনরুমে অপেক্ষা করছেন। মাহবুব সাহেব ফজলুল করিম। সাহেবের সঙ্গে কথা বলছেন। তাঁর কথা শেষ হলেই বিনয় বাবু ঢুকবেন।
মাহবুব সাহেব বললেন, স্যার বেতনের কি ব্যবস্থা?
ফজলুল করিম হাসিমুখে বললেন, হবে হবে।
কি ভাবে হবে?
সরকারি ডি এর জন্য আমি নিজেই ঢাকা যাব।
কবে যাবেন?
দুই একদিনের মধ্যে।
সরকারি ভি, এ টা না হয় হল। বাকি বেতনের কি করবেন?
বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে সাহায্যের জন্যে যাব। স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র …বাজার সমিতি গত বছরের টাকাটা দেয় নি …ওদের…
ওদের কথা ভুলে যান। ওরা কিছু দিবে না।
দিবে না কেন?
আর কত দিবে। দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে গেছে। ওদের একটা প্রস্তাব আছে। স্কুলের কিছু জমি তারা কিনে নিতে রাজি আছে, এ থেকে কিছু টাকা পাওয়া যায়।
সেটা সম্ভব না। জীবন বাবুর দানপত্র করা জমি বিক্রি করা যাবে না।
তাহলে সমস্যার সমাধান কি?
আছে সমস্যার সমাধান অবশ্যই আছে।
সেটা কি বলুন।
স্কুলের ছাত্র বাড়বে, তাদের বেতন থেকে যে আয় হবে…
ছাত্র বাড়বে কিভাবে?
লোকে যখন জানবে এটা ভাল স্কুল তখন দূর দূর থেকে ছাত্ররা আসবে। হোস্টেলে থাকবে…