স্যার আপনার স্কুলের ছাত্র কতজন?
একশ তেইশ। আগামী কাল একজন ভর্তি হবে–একশ চব্বিশ হবে।
স্যার কিছু মনে করবেন না–ব্যক্তিগত কৌতুহল থেকে প্রশ্নটা করছি আপনি কি এই একশ চব্বিশ জন ছাত্রের নাম জানেন?
ফজলুল করিম সাহেব তৎক্ষণাৎ বললেন, জানি।
মামুন সিগারেট ফেলে দিতে দিতে বলল, আমিও এ রকমই অনুমান করেছিলাম।
মওলানা ইরতাজউদ্দিন হেডমাস্টার সাহেবের ঘরে
মওলানা ইরতাজউদ্দিন হেডমাস্টার সাহেবের ঘরে ঢুকলেন। তার পেছনে বোকা বোকা চেহারার এক যুবক। যুবকের গা থেকে বিড়ির কড়া গন্ধ আসছে। তার দাঁত হলুদ হয়ে আছে। দাঁত মাজার ব্যাপারটি সে সম্ভবত জানে না, আর জানলেও তার প্রয়োজন বোধ করে না। মাথা ভর্তি চুল। সেই চুল ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে। এই চুল সে নিশ্চয়ই উকুনের চাষের জন্যে বড় করছে।
মওলানা বললেন, রহমত! স্যারকে সালাম কর।
রহমত টেবিলের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার ঝাপ দেয়া দেখেও ফজলুল করিম সাহেব আঁৎকে উঠলেন। এর চলাফেরা, কাজ কর্ম সব কিছুর মধ্যেই পশু ভাব আছে। পশুদের গায়ে যেমন কড়া গন্ধ থাকে এর গায়েও আছে। টক টক গন্ধ।
মওলানা বললেন, স্যার এর কথাই আপনাকে বলেছিলাম।
কি বলেছিলেন?
ঐ যে রেশমীর সঙ্গে…
ও আচ্ছা আচ্ছা
মোটরের ভাল মেকানিক। ওস্তাদ কারিগর। অন্যের গ্যারেজে কাজ করে, টাকা পয়সা জোগাড় করতে পারলে সে নিজেই নেত্রকোনা শহরে স্বাধীন ব্যবসা করবে।
ভাল খুব ভাল।
আপনাকে দেখানোর জন্যে খবর দিয়ে এনেছি।
ভাল করেছেন খুব ভাল করেছেন।
মওলানা রহমতের দিকে তাকিয়ে বললেন, রহমত তুমি বারান্দায় একটু দাঁড়াও আমি স্যারের সঙ্গে একান্তে দুটা কথা বলি।
রহমত তার সব কটি হলুদ দাঁত বের করে হেসে ফেলল। ফজলুল করিম সাহেব হাসি দেখেও চমকালেন। এটা তো হাসি না, যেন কামড়াতে আসছে। রহমত বারান্দায় চলে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে বিড়ি ধরাল। বিড়ির কড়া গন্ধে ঘরে থাকাই মুশকিল।
মওলানা বললেন, স্যার ওকে এনেছি রেশমীকে দেখানোর জন্যে। দেখে যদি পছন্দ হয় আজ রাতেই আমি বিয়ে পড়িয়ে দেব। রহমত বৌ নিয়ে চলে যাবে।
কি বলছেন আপনি?
ওর সঙ্গে এরকমই কথা হয়েছে।
হুট করে বিয়ে?
গরীব মানুষদের বিয়ে এরকম হুট হাট করেই হয়।
এর সঙ্গে রেশমীর বিয়ে হতে পারে না।
কেন?
ছেলেটাকে আমার পছন্দ না।
আপনার পছন্দের কথা তো এখানে আসছে না। রেশমীর পছন্দ নিয়ে কথা।
ওর তো পছন্দের প্রশ্নই উঠে না। পছন্দ করার মত কি আছে এই ছেলের মধ্যে?
অনেক কিছুই আছে। ছেলের রোজগার ভাল। ভাল টাকা কামায়। এই জাতীয় ছেলে নেশাভাঙ করে। তার সে বদঅভ্যাস নেই।
ফজলুল করিম সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, খামাখা একটা বিষয় নিয়ে পিড়াপিড়ি করছেন কেন? ছেলেটাকে আমার পছন্দ হয়নি। পও শ্রেণীর মানুষ বলে মনে হয়েছে। জেনেশুনে এমন একজনের সঙ্গে রেশমীর বিয়ে দেয়া যায় না। ওকে চলে যেতে বলুন।
একটু ভেবে বলুন স্যার।
ভেবে বলাবলির কিছু নেই।
জি আচ্ছা স্যার।
স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিড়ি টানছে এটাও তো খুব আপত্তিজনক কথা। আমার নিষেধ আছে শিক্ষকরাও ছাত্রদের সামনে ধূমপান করবেন না। খারাপ ব্যাপারগুলি ছাত্রদের আগে আকৃষ্ট করে। আপনি বের হয়ে রহমত না কি যেন নাম, তাকে একটা কড়া ধমক দিন, তার পর চলে যেতে বলুন।
জি আচ্ছা।
ওকে বিদেয় করে আসুন আপনার সঙ্গে কথা আছে।
জ্বি আচ্ছা।
ইরতাজউদ্দিন ফিরে এলেন। তাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে। ফজলুল করিম সাহেব বললেন, আমাদের নতুন টিচারকে কেমন লাগছে।
ভাল।
এক শব্দে জবাব দেবেন না। কেন ভাল সেটা বলুন।
যুবক মানুষ। উৎসাহ আছে।
পড়াচ্ছে কেমন?
ভাল।
আপনার যে এক শব্দে জবাব দেবার একটা বিশ্রী অভ্যাস হয়েছে তার কি করা যায় বলুনতো। খোঁজ নিয়েছেন ভাল, না-কি খোঁজ না নিয়েই বলেছেন ভাল।
খোঁজ নেই নাই, অনুমানে বলেছি।
অনুমানে কিছু বলবেন না। যা বলবার অনুসন্ধানের পর বলবেন। প্রথমে অনুমান তারপর অনুসন্ধান এই কাজটা করবেন না। প্রথমে অনুসন্ধান। তারপর অনুমান। বুঝতে পারলেন?
জ্বি স্যার। এখন যদি অনুমতি দেন উঠি।
আচ্ছা যান। ভাল কথা ব্যাঙের ডাকের আরবী কি বলুনতো।
বুঝতে পারছি না কিসের আরবী?
ব্যাঙের ডাকের।
ইরতাজউদ্দিন সাহেব চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছেন ব্যাপারটা ধরতে পারছেন না। হেডমাস্টার সাহেব আগ্রহ নিয়ে তাকাচ্ছেন। মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি তিনি ব্যাঙের ডাকের আরবী জানতে আগ্রহী। মানুষটার মাথায় কি গোলমাল হচ্ছে? মাথার অসুখ হঠাৎ করে শুরু হয় না। আস্তে আস্তে শুরু হয়।
সেকেন্ড পিরিয়ড শুরু হবার ঘণ্টা পড়ল। ঘণ্টা ঠিকমত পড়ল। সুন্দর আওয়াজ হল। হরিপদ স্কুলের ঘণ্টা খুঁজে পেয়েছে। ফজলুল করিম সাহেব ফাইন মাফ করে তাকে চিঠি দিয়েছেন। সেকেন্ড পিরিয়ডে ক্লাস নাইনের সঙ্গে তাঁর ক্লাস-ইংরেজী ফাস্ট পেপার। আজ পড়াবেন কবিতা।
তেত্রিশজন ছাত্র ছিল ক্লাসে, আজ সেখানে বারজন ছাত্র বসে আছে। সব কটা বেঞ্চ ফাঁকা। নীলগঞ্জ হাইস্কুল চালু হয়েছে। ছাত্ররা দল বেঁধে চলে যাচ্ছে। মাত্র দুমাসে এই অবস্থা। সারভাইভেল ফর দি ফিটেস্ট। যে ফিট সে টিকে থাকবে। যে আনফিট তাকে চলে যেতে হবে। এটা জগতের কঠিন নিয়মের এক নিয়ম।
ফজলুল করিম সাহেব ডায়াসের চেয়ারে চুপচাপ বসে রইলেন। পড়ানো শুরু করতে ইচ্ছে করছে না। ক্লাস ভর্তি থাকবে ছেলেমেয়ে তবেই না পড়িয়ে আরাম। অল্প কটা ছেলেকে তিনি কি পড়াবেন? তিনি হাসতে চেষ্টা করলেন। পড়ানো শুরু করার আগে শিক্ষকরা হাসি হাসি মুখে থাকলে ছাত্ররা ভরসা পায়। ছাত্ররা তেমন ভরসা পেল বলে মনে হল না। তিনি বললেন, সবাই দেখি নতুন স্কুলে যাচ্ছে। তোমরা যাচ্ছি না কেন?