ফজলুল করিম সাহেব আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, মাহবুব সাহেব তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, স্যার আমরা যা করার ইনশাআল্লাহ্ করব। এই বিষয়ে আপনি কোন দুশ্চিন্তা করবেন না। আল্লাহ হাফেজ।
সিরাজ সাহেব বললেন, চায়ের ব্যবস্থা আছে। চা না খেয়ে কেউ যাবেন। বৃষ্টি কিন্তু এখনো পড়ছে। আপনাদের জন্যে নৌকার ব্যবস্থা করেছিনৌকা দিয়ে আপনাদের পৌঁছে দেয়া হবে। হা-হা-হা।
আবারো হাসি শুরু হল।
ফজলুল করিম সাহেব বাসায় ফিরলেন মাঝরাতে। বাইরের বারান্দার উঠোনে হারিকেন জ্বালিয়ে রেশমী বসে আছে। কি সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে। রেশমী উদ্বিগ্ন গলায় বলল, কই ছিলেন?
দাওয়াত ছিল রেশমী।
আমারে কিছু বলে যাবেন না। না-কি আমি কোন মানুষ না?
রেশমী কেঁদে ফেলল। সহজ কান্না না-হাউ মাউ করে কান্না। ফজলুল করিম সাহেব হতভম্ব হয়ে গেলেন। কি করবেন, কি বলবেন বুঝতে পারছেন না। রেশমী ফোপাতে ফেঁপাতে বলল, আমি আপনার কে? আমি আপনার কেউ না।
এই প্রথম ফজলুল করিম সাহেবের নিজেকেই নিজের পায়ে পানি টলিতে হল। ঘরে ঢুকে দেখেন রেশমী তার নিজের ঘরে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিল।
ফজলুল করিম সাহেব বিছানায় শুয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন। তার মন বলছে এক সময় রেশমীর রাগ ভাঙ্গবে। সে দরজা খুলে বের হয়ে এলে তাকে বলবেন, দুকাপ চা কর রেশমী, আমার মনটা খুব খারাপ। কি জন্যে খারাপ তোমাকে বলি।
রেশমী দরজা খুলল না। অপেক্ষা করতে করতে ফজলুল করিম সাহেব ঘুমিয়ে পড়লেন। এক সময় তার ঘুম ভাঙ্গলো–তিনি দেখলেন তার মশারী ফেলা। গায়ের উপর চাদর দেয়া। বাইরে মুষল বৃষ্টি। বৃষ্টির শব্দ শুনেই তার মন ভার হচ্ছে? নিজেকে একা লাগছে? কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। রেশমীকে কি তিনি ডেকে তুলবেন? সেটা কি ঠিক হবে। নিশিরাতে তিনি রেশমীকে ডেকে তুলছেন কথা বলার জন্যে। ডেকে তোলার জন্যে কোন অজুহাত থাকলে ভাল হত। চায়ের পিপাসা হচ্ছে। এই অজুহাতে কি ডাকা যায় না?
ফজলুল করিম সাহেব মশারীর ভেতর থেকে বের হলেন। খাটের পাশে রাখা চেয়ারের সঙ্গে ধাক্কা লেগে শব্দ হয়। ভালই হল শব্দ উব্দ শুনে যদি রেশমীর ঘুম ভাঙ্গে। তিনি হাত দিয়ে চেয়ার টানলেন আরো শব্দ হল। দরজার সিটকিনি খুললেন। বারান্দায় বেশ খানিকক্ষণ বসে থাকবেন, বৃষ্টির শব্দ শুনবেন।
বৃষ্টির ছাটে বারান্দায় রাখা ইজিচেয়ারের কাপড় ভিজে গেছে। ভেজা কাপড়ের উপরই বসে থাকতে হবে। ব্যাঙ ডাকছে। আচ্ছা ব্যাঙের ডাকের ইংরেজী কি? শব্দটা মনে পড়ছে না কেন? ফজলুল করিম সাহেব ভুরু কুঁচকে বসে আছেন। ইংরেজীটা যদি মনে পড়ে। বয়সের সমস্যা শুরু হয়েছে। স্মৃতি নষ্ট হচ্ছে।
ফজলুল করিম সাহেব অপেক্ষা করছেন। ব্যাঙের ডাকের ইংরেজী মনে পড়ার অপেক্ষা এবং সেই সঙ্গে রেশমীর জন্যে অপেক্ষা। তাঁর মন বলছে রেশমী ঘুমায় নি। ঘুমুলেও সাড়া শব্দে ঘুম ভেঙ্গেছে। রেশমী উঠে আসবে।
বৃষ্টির ছাটে বসে থাকার জন্যে রাগারাগি করবে। তখন তিনি রেশমীকে চা করতে বলবেন। চা খেতে খেতে গল্প করবেন। বয়সের অনেক লক্ষণের। একটি হল-~-ঘুম কমে যায়। মাঝ রাতে কারো সঙ্গে গল্প করতে ইচ্ছে করে।
তিনি বসেই রইলেন। রেশমী এল না। বৃষ্টির বেগ কখনো কমছে, কখনো বাড়ছে। ব্যাঙের ডাকের কোন উঠা নামা নেই। ফজলুল করিম সাহেব–জবুথবু হয়ে বসে আছেন। ব্যাঙের ডাকের ইংরেজী কি ভাবতে ভাবতে বৃষ্টি দেখছেন।
মমিন ট্রেন থেকে নামল ঘোর বৃষ্টিতে
মমিন ট্রেন থেকে নামল ঘোর বৃষ্টিতে। তার হাতে একটা সুটকেস, ট্রেনে দুটা প্রকান্ড বোচকা পড়ে আছে–নামাতে হবে। তার একার পক্ষে নামানো সম্ভব না। সে নেমেছে কুলীর সন্ধানে। নেমেই সে তার বোকামী টের পেল। এইসব গ্রামের মায়ে খেদানো, বাপে তাড়ানো টাইপ ষ্টেশনে কুলী থাকার কোন কারণ নেই। কুলী কুলী বলে চেঁচামেচি করতে করতে ট্রেন ছেড়ে দেবে। গার্ড সাহেব জানালা দিয়ে মাথা বের করে ফেলেছেন।
মমিন সুটকেস প্লাটফরমে নামিয়ে আবার ট্রেনে উঠল। মন পড়ে রইল প্লটফরমে। স্যুটকেস কেউ নিয়ে পালিয়ে যাবে নাতো। কাপড় চোপড় যা আছে সবই স্যুটকেসে।
আমি জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল হাই স্কুলের হেড মাষ্টার। ফজলুল করিম। আপনার জিনিসপত্র কি আছে দিন।
মমিন এক ঝলক তাকিয়ে দেখল। সৌজন্য আলাপ পড়ে হবে আগে মালপত্র নামানো যাক। মমিন বলল, স্যার এই পুটলিটা একটু ধরুন।
বেঞ্চের নীচ থেকে পুটলি টেনে বের করা যাচ্ছে না। এমন ওজন।
ফজলুল করিম সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, কি আছে এর মধ্যে?
স্যার বই।
ফজলুল করিম সাহেব সঙ্গে সঙ্গে তৃপ্তির হাসি হাসলেন। যে শিক্ষকের এত বই সে ভাল শিক্ষক না হয়েই যায় না। তিনি মনে মনেই বললেন–গুড, ভেরী গুড।
মমিন বলল, ট্রেন কি ছেড়ে দিচ্ছে স্যার?
ছাড়লেও নামতে পারবেন। গ্রামের ষ্টেশন চলন্ত ট্রেনেই লোকজন ওঠানামা করে।
একটা পুটলি বের হয়েছে। মমিন দ্বিতীয় পুটলি ধরে টানাটানি করছে। ফজলুল করিম বললেন, এর মধ্যেও কি বই?
জ্বি স্যার।
ফজলুল করিম সাহেব আবারো মনে মনে বললেন, গুড ভেরী গুড। ছেলেটি লম্বা, অতিরিক্ত রকমের রোগা, ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয় রাগী হবে। হোক। রাগী শিক্ষকই ভাল। ছাত্ররা ভয় পাবে। ভয়ের সঙ্গে শিক্ষার সম্পর্ক আছে। অদির করে কোলে বসিয়ে শিক্ষা হয় না। প্রাচীন কালে গুরুগৃহে কঠিন শাসন ছিল।