লাইব্রেরী ঘরে শব্দ হচ্ছে, হরিপদের বুক কাপছে। ভরসার কথা এই যে শুধু যে হেডমাস্টার সাহেব আছেন তাই না, মওলানা সাহেবও আছেন। মওলানা সাহেব টিচার্স কমনরুমে নামাজ পড়ছেন।
শুধু যে হরিপদ হেডমাস্টার সাহেবের জন্যে অপেক্ষা করে তাই না। মওলানা সাহেবও অপেক্ষা করেন। এই এক দিকে দুজনের মিল আছে।
নামাজ শেষ করে মওলানা সাহেব ফজলুল করিম সাহেবের ঘরে উঁকি দিলেন।
স্যার যাবেন কখন?
একটু দেরী হবে। সিরাজ সাহেবের ওখানে রাতের খাওয়ার দাওয়াত। নটার সময় যেতে বলেছেন।
নটা বাজতে তো অনেক দেরী, এতক্ষণ বসে থাকবেন?
বসে নেই তো কাজ করছি। এইবার যে কজন ছেলে মেয়ে এসএসসি দিবে ওদের খুব স্পেশাল কোচিং-এর কি ব্যবস্থা করা যায় সেটা নিয়ে ভাবছি। পরিকল্পনা করছি।
আপনি বসুন পরিকল্পনাটা নিয়ে আপনার সঙ্গে ডিসকাস করি।
মওলানা সাহেব বসতে বসতে বললেন–যে বৃষ্টি নেমেছে–চা খেলে কেমন হয় স্যার?
চা খাবেন কিভাবে?
হরিপদ আছে। ওকে ফ্লাক্স দিয়ে পাঠিয়ে দেই।
চা খেতে পারলে মন্দ হয় না অবশ্যি। ফ্লাক্স কোথায় পাবেন?
আমার একটা আছে।
তাহলে তো ভালই হয়। আপনি এখনো যাননি, স্কুলে পড়ে আছেন ব্যাপারটা কি?
একা মানুষ গিয়েই বা কি করব? আপনি আছেন দেখে আমিও থেকে গেলাম।
ভাল করেছেন। আপনার সঙ্গে আমার পরিকল্পনাটা নিয়ে আলাপ করি। বিরাট পরিকল্পনা নিয়েছি।
বলুন শুনি আপনার পরিকল্পনা।
যারা এবার এসএসসি দেবে তারা থাকবে দিন রাত চব্বিশ ঘণ্টা কোচিং-এর আওতায়। লাইব্রেরী ঘরের জিনিসপত্র খালি করে ঐখানে টানা বিছানা করে দেব। সার্বক্ষণিক শিক্ষক থাকবেন। শিক্ষকদের ডিউটি ভাগ করে দেয়া হবে। ব্যবস্থাটা কেমন মনে হচ্ছে?
খুব ভাল মনে হচ্ছে না। সম্ভব না। সম্ভব না কেন?
এইবার চল্লিশজন ছেলে পরীক্ষা দিচ্ছে। ঊনত্রিশটা ছেলে, এগারোটা মেয়ে এদের আপনি কোথায় রাখবেন? এদের খাওয়ার খরচ কে দিবে? শিক্ষকরাই বা বাড়তি ঝামেলা কেন করবেন?
স্কুলের দিকে তাকিয়ে শিক্ষকরা বাড়তি ঝামেলাটা করবেন। এইটা ছাড়া এখন আমাদের উপায় নেই। শহরের স্কুলগুলির সঙ্গে গ্রামের স্কুলগুলি পারছে না। এসএসসির রেজাল্ট হলে আপনি কখনো শুনবেন না গ্রামের কোন স্কুল থেকে একটা ছেলে ফার্স্ট হয়েছে… এমন তো না যে আমাদের ছাত্র খারাপ……
না ছাত্র খারাপ না।
দুটো ছেলে এবার আমাদের ভাল আছে। খুবই ভাল। এদের ঠিক মত তৈরি করতে পারলে……
তাহলে স্যার এই দুজনকে নিয়েই কাজ করুন।
এটাও মন্দ না। আমার নিজের বাড়িতেই রেখে দিতে পারি…. পরের বন্ধুর স্কুলের হোষ্টেল যখন হয়ে যাবে তখন বাধ্যতামুলকভাবে এসএসসির সব ছাত্রকে হোস্টেলে থাকতে হবে….. কি বলেন?
তা করা যাবে।
জোরে সোরে নামতে হবে বুঝলেন মওলানা সাহেব। শহরের স্কুল আমাদের টেক্কা দিয়ে চলে যাবে তা হয় না।
হেডমাস্টার সাহেবের চোখ চকচক করতে লাগল।
তাঁরা স্কুল থেকে বেরুলেন সাড়ে আটটায়। বৃষ্টি থেমে গেছে। রাস্তায় পঁাচ প্যাচ কাদা। সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। পোস্টাপিস পর্যন্ত দুজন এক সঙ্গে এলেন। এখান থেকে দুজন দুদিকে যাবেন! ফজলুল করিম সাহেব বললেন, মওলানা সাহেব যাই।
জ্বি আচ্ছা স্যার।
আপনার কথাটাই রাখব ঠিক করেছি, দুটা ছেলেকেই চব্বিশ ঘণ্টা তত্ত্বাবধানে রাখব। সব টিচারদের ডিউটি ভাগ করে দেব……
ইনশাআল্লাহ্।
মওলানা রওনা হতে গিয়েও হলেন না। দাঁড়িয়ে রইলেন। ফজলুল করিম সাহেব বললেন, আপনি কি কিছু বলবেন?
জি না।
আপনার ভাব ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে কিছু বলতে চান।
যদি কিছু মনে না করেন, স্যার।
কিছুই মনে করব না। বলুন কি ব্যাপার।
আপনার বাসায় কাজের যে মেয়েটা আছে কি যেন নাম?
রেশমী।
হ্যাঁ। রেশমী প্রসঙ্গে একটা কথা।
ওর প্রসঙ্গে কি কথা।
মেয়েটার একটা বিয়ের ব্যবস্থা করলে কেমন হয়?
হঠাৎ বিয়ের কথা উঠছে কেন?
মওলানা ইতস্তত করে বললেন–যুবতী মেয়ে বিয়ে হয়ে যাওয়া উচিত। তাছাড়া……
তাছাড়া কি?
আপনি বিপত্নীক মানুষ–তরুণী এক মেয়েকে নিয়ে বাস করছেন। আমাদের মন তো ছোট, হঠাৎ কেউ কিছু বলা শুরু করলে…… সবাই বিশ্বাস করা শুরু করবে…… সত্য আমরা বিশ্বাস করতে চাই না। অসত্য বিশ্বাস করি, কারণ অসত্য বিশ্বাস করানোর জন্য শয়তান আমাদের সব সময় প্ররোচিত করছে।
ফজলুল করিম সাহেব তীব্র গলায় বললেন, কেউ কি আপনাকে কিছু বলেছে? মওলানা জবাব দিলেন না। ফজলুল করিম সাহেব বললেন, মেয়েটা ছোট থেকে আমার সঙ্গে আছে। আমার স্ত্রীর দেশের মেয়ে। সে দেশ থেকে নিয়ে এসেছিল। আমাকে খালু ডাকে।
জানি। সবই জানি–কথা হলো কি, বিয়ে হলে মেয়েটার জন্যেও ভাল। দরিদ্র মেয়ে বিয়ে হলে জীবনের গতি হয়। আমার হাতে একটা ছেলে আছে। মোটর মেকানিক। ভাল রোজগার করে। সংসারে শুধু মা আছে, আর কেউ নেই। যদি বলেন তো কথা বলে দেখি। বলব?
ফজলুল করিম সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, বলুন। বলে দেখুন। বিয়ের যাবতীয় খরচ দেব। আমার পক্ষে যতটুকু সম্ভব করব। মেয়েটা আমার অতি প্রিয়। তার ভাল বিয়ে হলে আমার চেয়ে খুশি আর কেউ হবে না।
মওলানা চুপ করে রইলেন। ফজলুল করিম সাহেব প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, পরও আমাদের নতুন টিচার আসছে শুনেছেন বোধ হয়। সায়েন্স টিচার।
জ্বি, শুনেছি।
তার থাকার ব্যবস্থা করতে হয়। মাহবুব সাহেবকে অবশ্যি বলেছি।
আমার সঙ্গে রাখতে পারি। আমার ঘরে দুটা খাট আছে। উনি একটাতে থাকতে পারেন। থাকতে রাজি হবেন কি-না কে জানে।