মীনাক্ষী ভাবীর সঙ্গে মেয়েটিকে চেনা মনে হচ্ছে। হাঁ, তারই এক ছাত্রী হামিদা। হামিদার কপালে সেই টিপ নেই। ফিরোজের চাচার বাড়ি টিপ পরে। আসার সাহস হয় নি বোধ হয়। কিন্তু বাড়িতে আসার তার দরকারটাই বা কি? চট করে ফিরোজের চাচার সঙ্গে হামিদার কোনো আত্মীয়তার কথা সুদীপ্তর মনে এল না। হয়ত প্রতিবেশী হবে। হয়ত মীনাক্ষীদের সঙ্গে আগে থেকেই জানাশোনা আছে।
মেয়েটি সুদীপ্তর দিকে তাকাল না। নাকি তাঁর অজ্ঞাতে এক সময় তাকিয়েছিল। তিনি টের পান নি! না না, তা কি হয়? তার কোনো ছাত্র বা ছাত্রী তাঁকে দেখে না চেনার ভান করবে এটা হতেই পারে না। নিশ্চয়ই মেয়েটি তাকে দেখেই নি।
মীনাক্ষী তার স্বামীর সঙ্গে মেয়েটির পরিচয় করিয়ে দিল—
একে চেন? একটু দূর সম্পর্কে আমার মামাতো বোন। তোমার চাচা আবার এর মায়ের খালাত ভাই! এবার অনার্সে সেকেন্ড ইয়ার।
আদাব দুলাভাই।
ও আদাব। এখানে করে এসেছ তোমরা?
তোমরা নয় তুমি। ও একাই এসেছে সপ্তাহ খানেক হল। থাকত রোকেয়া হল-এ।
রোকেয়া হল থেকে অবশ্য নিজের ইচ্ছায় সে এখানে আসে নি। বোনের টেলিগ্রাম পেয়ে ফিরোজের চাচা নিজে গিয়ে হামিদাকে তার বাসায় নিয়ে এসেছেন। অর্থাৎ বাঁচিয়েছেন। হল-এ থাকলে কি দশা হতঃ ফিরোজ জানেন না। আসবার পথে সাহস করে হল-এর মধ্যে ঢুকতে পারলে তবু কিছুটা টের পেতেন। তিনি শুধালেন–
শেষ পর্যন্ত তোমাদের হল-এ কজন মেয়ে ছিল জান নাকি?
ঠিক জানি নে। বারো-চৌদ্দ জন হতে পারে। ওদের ভাগ্যে কি যে ঘটেছে কে জানে।
হাঁ, এখনো সব খবর সকলে জানে না। একটা জনরব ছড়িয়েছে, বারো-চৌদ্দটি মেয়ে মারা গেছে, আর ধরে নিয়ে গেছে দশ-বারো জনকে। কিন্তু হামিদার উক্তিতেই ফিরোজ বুঝলেন, অত মেয়ে হল-এ ছিল না।
স্যারদের খবর কিছু জানেন নাকি দুলা ভাই?
শুনছি বারো থেকে পনেরো জন মারা গেছেন। আমি তো সকলকে চিনিনে। নামও মনে নেই সকলের।
এই অবস্থায় মনে রাখা সম্ভবও নয়। তবু যে কয়েকজনের নাম মনে ছিল ফিরোজ বলে গেলেন—ডঃ গোবিন্দ্রচন্দ্র দেব, অধ্যাপক মনিরুজ্জামান, ডঃ জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, ডঃ ফজলুর রহমান, ডঃ মুকতাদির আর নাম মনে আসছে না। ফিরোজ থামলেন। হামিদা শুধাল–
সুদীপ্ত স্যার?
সুদীপ্ত? মানে, সুদীপ্ত শাহিন? তারও মৃত্যু সংবাদ রটেছে নাকি। ফিরোজ বললেন–
কোন সুদীপ্তর কথা বলছ তুমি? তোমার সামনেই তো একজন সুদীপ্ত বসে আছেন।
ওমা, তাই তো! সুদীপ্ত স্যারই তো। হামিদা ভালো করে তাকিয়ে এবার চিনতে পারল। কিন্তু প্রথমে চিনতে পারে নি। এ কি চেহারা হয়েছে স্যারের। হামিদা তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল। ফিরোজ বলল–
হামিদার অন্যায় কিছু হয় নি সুদীপ্ত। এই কদিনে একেবারে অন্য রকম হয়ে গেছ তুমি। তার উপরে আজ শেভও কর নি। এবং দুপুর অবধি ঘুরে ঘুরে চেহারাকেও কেমন ক্লিন্ন করে তুলেছ।
তুই সুদীপ্ত ভাইয়ের ছাত্রী! মীনাক্ষী বললেন, তুই না হিস্ট্রি নিয়েছিলি শুনেছিলাম।
প্রথমে তাই কথা ছিল বটে। তবে শেষ পর্যন্ত ইংরেজিতেই ভর্তি হয়েছে। সে। কিন্তু সে কথা হামিদা আর বলতে পারল না বোনকে। সে ততক্ষণে কেঁদে ফেলেছে। যার মৃত্যু-সংবাদ দ্রুত জেনে সারা চিত্ত বেদনামথিত হয়েছে, সহসা। তাকে জীবিত দেখলে প্রাণে যে আনন্দ বাজে সেই আনন্দের আঘাতে উদ্গত। অশ্রু হামিদার চোখে। কিন্তু হামিদা যা শুনেছিল তা শোনা কি অস্বাভাবিক ছিল? তেইশ নম্বর বিল্ডিং যেভাবে আক্রান্ত হয়েছিল তাতে ওর মধ্যে কারো কি। বাঁচার কথা? ওই বিল্ডিংয়ের সকলেই মৃত বলে খবর রটেছিল। হামিদ নিজেকে সামলে নিয়ে বলল।
স্যার যখন শুনলাম, আমাদের ডিপার্টমেন্টের মুর্শেদ স্যার, গুহঠাকুরতা স্যার এবং আপনি তিনজনেই জল্লাদদের হাতে খতম হয়ে গেছেন তখন কী যে অবস্থা হল আমাদের!
মুর্শেদ স্যার নিখোঁজ, তার সম্পর্কে কেউ কিছু জানে না। তবে আমার ধারণা তিনি বেঁচে আছেন।
আল্লাহ তাঁকে বাঁচিয়ে রাখুন। আফিয়ার কথা মনে আছে স্যার?
আফিয়া? দেখলে চিনতে পারব।
ছাত্র-ছাত্রী অনেককেই দেখলে চেনা যায়। কিন্তু নাম বললেই গোলমাল। বাধে। অনেক মুখ ভেসে উঠে, তার মধ্যে কোন নামটা কার তা ঠিক করা যায় না। স্যারকে নীরব দেখে হামিদা আরো পরিচয় দিল আফিয়ার।–
সেই যে মেয়েটা স্যার, হাত ভরে চুড়ি পরে। আর কখনো ইংরেজিতে কথা বলে না।
হাঁ মনে পড়েছে। হামিদা সেই মেয়ের কথা বলছে, যাকে ইংরেজি বিভাগের ছাত্রী বলে মনে হয় না। বড়ো বেশি বাঙালিনী। আর
আমাদের সঙ্গেই এক গ্রুপে টিউটোরিয়াল ছিল।
আর বলতে হবে না। এবার পুরোপুরি তাকে চিনেছেন সুদীপ্ত। তার স্বামী তো বিশ্ববিদ্যালয়েরই একজন শিক্ষক ছিলেন। কি হয়েছে তার?
ওর স্বামীকে আর্মিরা মেরে ফেলেছে। ঘর থেকে ডেকে নিয়ে বাইরে। আফিয়ার চোখের সামনে গুলি করে মেরেছে। গতকাল পাশের বাড়িতে সে তার ভাইয়ের কাছে এসে উঠেছে।
এ সংবাদের আজ যেন কোনোই গুরুত্ত্ব নেই। কেউই গুরুত্ব দিল না আফিয়ার ট্রাজেডিকে। ছাত্র-ছাত্রীদের কোন দুঃসংবাদ সুদীপ্তকে আদৌ স্পর্শ। করে নি এমন কখনো ইতিপূর্বে হয় নি। কিন্তু আফিয়া তো কেবলি ছাত্রী নয়। তারই এক সহকর্মীর স্ত্রীও। তবু আফিয়ার জন্য মনে তেমন প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। কই? অন্য সময় হলে? ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ সামসুজ্জোহা মিলিটারির গুলিতে মারা গেলে কতো বিক্ষোভ পড়ে গিয়েছিল! এবং তা কেবলি রাজশাহীতেই নয়, প্রদেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়েই। আর। এখন? যাক গে, সে কথা আর ভেবে লাভ কি।