যেখানে সবটাই ধংস হয়ে যেত সেখানে কায়েদে আজম তবু অর্ধেকটা। বাঁচিয়েছেন।
যুক্তিটা ছিল অধ্যাপক গোলাম কবীরের। নেজামে ইসলামের নেতা অধ্যাপক গোলাম কবীর। নিজেই তিনি নামের আগে অধ্যাপক লেখেন। কিন্তু কখনো নাকি অধ্যাপনা করেন নি–লোকে বলে। অবশ্যই তারা দুষ্ট লোক। এবং ইসলামের শত্রু। প্রকৃতপক্ষে গোলাম সাহেব অধ্যাপনা করেছেন। তবে কোনো কলেজে নয়, মাদ্রাসায়। কোনো এক আলেয়া মাদ্রাসায় তিন বছর তালবিলিম পড়িয়েছেন। ফাজেল ও টাইটেল ক্লাসের তালবিলিম। টাইলের মরতবা কিছু বোঝ? টাইটেল হচ্ছে এম.এ. এর সমান। অতএব এম.এ. ক্লাসের ছাত্র পড়িয়েছেন গোলাম সাহেব। এম. এ. ক্লাসের ছাত্র যিনি পড়িয়েছেন তিনি অধ্যাপক না হবেন কেন? অতএব মৌলভি গোলাম কবীর। অধ্যাপক গোলাম কবীর হয়েছেন। এখন তিনি একজন প্রচন্ড নেতা। এবং ঈমানদার নেতা। তার কথায় চললে ঈমান পাকা হয়। কিন্তু ফিরোজ অধ্যাপক গোলাম সাহেবের কথা মনে নিয়ে ঈমানদার হতে চান নি। বলেছিলেন—
কিন্তু যে অর্ধেকটা আপনাদের কায়েদে আজম বাঁচাতে চান নি, সেই অর্ধেকটাই দেখছি বেঁচে আছে। আর মরে যাচ্ছি আমরা। এই মোজেজাটা ঠিক। বুঝতে পারি নে।
ফিরোজের কথায় বারুদ অবশ্যই ছিল না। কিন্তু গোলাম সাহেবের মনে। তা বারুদের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল। প্রচন্ড স্বরে বলে উঠেছিলেন—
মোজেজা? মোজেজা কি বুঝেন আপনারা? না–পাক জবানে ঐ শব্দ উচ্চারণ করবেন না।
তা না করলেও আমার কথাটার জবাব তো আপনাকে দিতে হবে। না, তাও দেবেন না।
না দেবো না। আবোল-তাবোল একটা কিছু বললেই তার জবাব পাওয়া যায় না। হিন্দুস্থানে খাঁটি মুসলমান হয়ে বাঁচা যায় এ কথা দুনিয়া জাহানে কেউ বিশ্বাস করবে না।
ভারতের অতগুলো মুসলমান তা হলে?
হিন্দুস্থানের মুসলমানগুলো ধীরে ধীরে সব হিন্দু হয়ে যাবে।
একেবারেই হিন্দু হয়ে যাবে। গুণা হবে না তাতে? এবং গুণা হলে সেটা হবে কার? আপনাদের সেই কায়েদে আজমের না?
বলাই বাহুল্য, এ কথায় ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন গোলাম সাহেব। লাঠি উঁচিয়ে তাড়া করেছিলেন। হাঁ, গোলাম সাহেব বেড়াতে বেরুনোর সময় ছড়ি বলে যেটাকে সঙ্গে নেন সেটা জাতে লাঠিই বটে। অমন যার বহর তার নাম ছড়ি হয় কি করে? লম্বায় প্রায় চার ফুট বিশুদ্ধ শালের সেই গোল কাষ্টখন্ডের ব্যাস দেড়। ইঞ্চির কম নয়। ফিরোজ সেদিন হাস্যকরভাবে দৌড় দিয়ে মাথা বাঁচিয়েছিলেন।
আজো কি তেমনি দৌড়াবেন? সেনাবাহিনী আসছে শহর দখল করতে। শহরের রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে সাধারণ মানুষ বাধা দিতে এগিয়েছে। না, ফিরোজের হাসি তো পায় নি। নিরস্ত্র মানুষ ব্যারিকেড দিয়ে গতি রোধ করবে কার? আধুনিক সেনাবাহিনীর? ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে হাস্যকর। এবং বাইরের লোক হলে তিনি হাসতেনই। কিন্তু ফিরোজ হাসবেন কি করে? এ তত খেলা নয়। অসহায় মানুষের বাঁচবার চেষ্টা। সেই সাতচল্লিশ সাল থেকে গায়ের জোরে আমাদের গলায় আঙুলের চাপ কষতে শুরু করেছে ওরা। টুটি টিপে। ধরলে মানুষ কতক্ষণ বাঁচে! বাধা দিতেই তো হবে। হয় মুক্তি না হয় মৃত্যু। দেশবাসী কি বিনা প্রতিবাদে নিঃশব্দে মরবে। অন্ততঃপশ্চিম পাকিস্তানিরা তাই চায়।
ব্যারিকেডের সামনে ফিরোজ গাড়ি থেকে নামলেন। পথের এক পাশ থেকে রাইফেল হাতে একটি যুবক এগিয়ে এলো! সালাম দিয়ে সামনে দাঁড়াল। তাদের পাড়ার ছেলে। এতএব চেনা ছেলে। সস্তা দামের সিগারেট খেত, আর ঘুরে বেড়াত। কাজ কিছু করত কি না ফিরোজ জানেন না। শোনা যায় সিনেমা হলের দ্বাররক্ষকের কাজ পেয়েছিল কিছুদিন আগে। সাতই মার্চের পর তা ছেড়ে দিয়ে আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবক হয়েছিল। ভারি কাজের ছেলে! কিছুকাল আগে একবার কলেজের দুটি ছোকরা পাড়ার একটি মেয়ের পিছু নিয়েছিল, এবং অশালিন মন্তব্য করেছিল। এই ছেলেটাই সেদিন কলেজের ছেলে দুটিকে বেধড়ক মার দিয়েছিল না! হাঁ সে একাই সেদিন দুটি ছাত্রকে পিটিয়েছিল। তোমার সাথে যার পীরিত নেই তার পিছু ধাওয়া করে তাকে নাহক দশ কথা। শোনাবে, আমরা পাড়ার ছেলে হয়ে এটা ছেড়ে দেব। সেদিন কলেজের ছেলে দুটিকে সে অমনি ছেড়ে দেয়নি।
এবং বর্বর পাকিস্তানি সেনাদেরকেও সে আজ অমনি ছেড়ে দেবে না।
ওরা আমাদের মারতে আসছে স্যার। কম করে হলেও পাঁচজনকে মেরে মরব।
ভাই আমার, মৃত্যুকে তুচ্ছ করতে পারার এই সাহসটুকুই তোদের বাঁচাবে। কিন্তু এমন করে মরে কিছু লাভ তো হবে না। শত্রুকে আঘাত করতে হবে তখনি যখন জয়ের সম্ভাবনা থাকবে। নিশ্চিত ধংসের সম্ভাবনার মুখে শক্রকে বাধা দিতে নেই। তখন কেবল খোঁচা দিতে হবে গোপনে গা বাঁচিয়ে। খোঁচা দিয়ে দিয়ে রক্ত ঝরিয়ে কাবু করে ফেলতে হবে। কিন্তু কথাগুলি এই মুহূর্তেই ফিরোজ বলতে পারলেন না। এই প্রচণ্ড উৎসাহের আগুনে জল দেওয়া কিছুতেই উচিত কর্ম বলে তার মনে হল না। তিনি কেবল বললেন—
হাঁ ওরা আসছে। কিন্তু আমাদেরকে মারতেই যে আসছে সেকথা কে বলল? ফিরোজের এ কথায় কোন চাতুরি ছিল না। এবং শুধু তিনি কেন, কারো। মনেই সেই সন্ধ্যায় কোন সন্দেহ ঘুণাক্ষরেও ছিল না যে, ওরা নিবিচার। গণহত্যার প্রতিজ্ঞা নিয়ে আসছে। আস্থা অসামরিক শাসন-কর্তৃপক্ষের আয়ত্তের বাইরে বলে সেনাবাহিনী শাসনভার নিজের হাতে নিতে চায়, কিন্তু সাধারণ নাগরিককে সেজন্য তারা মারতে চাইবে কেন? এ প্রশ্নের জবাব সেই বাউণ্ডেলে ছোকরার জানা নেই। সে নিজের বিশ্বাসকেই ব্যক্ত করল।