হাসিম সেখ তখন একজন বিহারীর ছদ্মবেশে ছিলেন। তার উপর এই অপরূপ উর্দু ভাষার চাবুক। হরমুজ মিয়া সোজা কুকুর বনে গিয়েছিল। বিস্তর লেজ নেড়েছিল এবং আতাউল্লাহ খানের তোয়াজ করেছিল।
চায়ের পেয়ালার সাথে হাসিম সেখের পরিবেশিত সেই হরমুজ-বৃত্তান্ত সকলেই উপভোগ করলেন। হাসিম সেখ প্রশংসা পেলেন সকলের! ভাগ্যিস তিনি উর্দুটা বলতে কইতে পারেন ভালো। এবং ভালো উপস্থিত-বুদ্ধি রাখেন।
বুদ্ধিমান হাসিম সেখ আর একটা প্রসঙ্গ তুললেন, ফিরোজকে বললেন
আপনারও এখানে আর থাকা চলবে না মামা। জমাতে ইসলাম ও মুস লিম লীগের সাথে সেনাবাহিনীর শলা-পরামর্শ চলছে শুনলাম। এটাকে ওরা দ্বিতীয় ইন্দোনেশিয়া বানাতে চায়।
কি রকম?
চার শ্রেণীর মানুষ ওরা দেশ থেকে নির্মূল করবে-বুদ্ধিজীবী, আওয়ামী লীগার, কমিউনিস্ট ও হিন্দু।
চমৎকার প্ল্যান। আওয়ামী লীগ খতম হলে অন্যান্য বামপন্থী দলগুলিকে কমিউনিস্ট, তার মানেই নাস্তিক কাফের আখ্যা দিয়েই দুদিনেই ঠান্ডা করে দেওয়া যাবে। বুদ্ধিজীবী সাবাড় হলে বেহুদা স্বাধীন চিন্তার বালাই দেশে থাকবে না। আর দেশকে হিন্দুশূন্য করতে পারলে তাদের সহায় সম্পত্তি পূর্ব বাংলার পেয়ারা দালাল দোস্তদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে তাদের আনুগত্যকে পাকাপোক্ত করে নেওয়া যাবে। কী মজা! এক ঢিলে মরবে কতগুলো পাখি।
কিন্তু পাখি মারা কি অতই সহজ? ফিরোজ তার চিন্তাকে একটু অন্যদিকে সরিয়ে নিলেন। অন্য কোণ থেকে গোটা ব্যাপারটা একটু তলিয়ে দেখ না? দেশের মধ্যে বুদ্ধিজীবী আছেন কতজন? সঠিক হিসাব কারো জানা নেই। তবে দেশের শতকরা আশি ভাগ জনগোষ্ঠীই যে আওয়ামী লীগের সমর্থক সে তো। নির্বাচনেই বুঝা গেছে, তার সঙ্গে এক কোটি হিন্দু ও কমিউনিস্টগণ যুক্ত হলে সংখ্যাটা কত দাঁড়ায়ঃ ফিরোজ তাই বললেন–
তা হলে তো পঞ্চাশটা ইন্দোনেশিয়া করেও কুল পাবে না।
তা ছাড়াও,-সুদীপ্ত বললেন, ইন্দোনেশিয়ার মতো এখানে চারপাশে সমুদ্র তো নেই। অতএব চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে বসে বসে মারবার সুযোগ তারা পাবে কি করে?–কথাটা বলতে বলতেই সুদীপ্ত একবার চট করে কয়েক দিন আগের একটি সন্ধ্যায় ঘুরে এলেন–বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাবের এক সন্ধ্যা। তার সহকর্মী বন্ধু আহমেদুল হক সেদিন এই ইন্দোনেশিয়া প্রসঙ্গেই কথা বলছিলেন। যে বিদেশী রাষ্ট্রের গোপন হস্তক্ষেপের ফলে ইন্দোনেশিয়াতে অমন নৃশংস কান্ড ঘটে গেছে বাংলাদেশেও তাদেরকে বর্তমানে অত্যন্ত সক্রিয় মনে হচ্ছে। এ নিয়েই আশঙ্কা প্রকাশ পেয়েছিলো সেদিন।
ওরা এতো নির্মম পশু যে, আমাদের দেশের এক কোটি লোকের জীবনের বিনিময়েও ওদের যদি কিছু উপকার হয় ওরা তাকে স্বাগত জানাতে কুণ্ঠিত হবে না।
কী চায় ওরা? চায় এখানে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণের জন্য খানিক জায়গা। সেটা দিলে বাংলার লাভ না ক্ষতি সে বিচার করে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা আর বুদ্ধিজীবীরা। অতএব সেই রাজনীতিবিদ আর বুদ্ধিজীবীদের খতম কর।-ঠিক এই ধরণের কোন প্ল্যান পঁচিশে মার্চের পশ্চাতে থাকতেও পারে। সুদীপ্তর এখন মনে হল ঠিকই বলেছিলেন বন্ধুবর আহমেদুল হক।–
বামপন্থী চিন্তাধারা তো চিরদিনই ঐ সামরিক আঁতাতের বিরোধী। ওদের শেষ ভরসা ছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু শেখ সাহেবকে ওরা চিনতে ভুল করেছিল। ওদের ফাদে, দেখা যাচ্ছে, তিনি পা দিলেন না। অতএব আওয়ামী লীগকে খতম করার জন্য ওরা এবার দেখবেন ইয়াহিয়াকে লেলিয়ে দেবে। এবং সেই সঙ্গে উৎখাত করে ছাড়বে বামপন্থী দলগুলিকেও।
এইসব রাজনীতির ঘোরপ্যাঁচ সুদীপ্ত ভালো বোঝেনা না। অতএব চুপচাপ ছিলেন তিনি। কিন্তু সকলেই চুপ ছিলেন না। পক্ষে বিপক্ষে নানা কথা উঠেছিল। হক সাহেবকে সমর্থন করে যা বলা হয়েছিল তার মধ্যে যুক্তি ছিল–
সে সম্ভাবনা অস্বীকার করা যায় না। সে জন্য বামপন্থী দলগুলিও মনে হয়। বর্তমানে শেখ সাহেবের সঙ্গে এক প্ল্যাটফর্মে আসতে চাইছেন। বিপদটা তারা টের পেয়েছেন।
কিন্তু বামপন্থীরা যে শেখ সাহেবকে বরাবর সমর্থন করে যাবেন সে আশা যেন করবেন না। বর্তমানের সঙ্কট কাটিয়ে উঠলেই দেখবেন ওরা শেখ সাহেবের পেছনে লাগবে।
এইভাবে নানা জনে নানা কথা বলেছিলেন। আলোচনা সুদীর্ঘ হয়েছিল। ক্লাব-প্রাঙ্গনে সায়ংকালের আড্ডায় এমন কতো আলোচনাই তো হয়। কোনোটা তার মনে থাকে, কোনটা থাকে না। কিন্তু ঐ কথাটা সুদীপ্তর মনে থেকে গেছে।
এখন সব দিক থেকে সুবিধা হয় এখানে জামাতে ইসলামকে ক্ষমতায় বসাতে পারলে। ওদেরও লাভ, পাকিস্তানেরও লাভ। গোটা বাঙালি জাতিকে ধর্মের আফিম দিয়ে বুদ করে রেখে ওরা সবাই ওপার থেকে বসে বসে মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে ভেঙ্গে খেতে পারবে।
এইসব কথা এখন হাসিমের কথার সংগে মনে মনে মেলাচ্ছিলেন সুদীপ্ত। কিন্তু ফিরোজ ভাবছিলেন হরমুজ মিয়ার কথা। হরমুজ মিয়া তাহলে এখন এই কামে নেমেছে! হরমুজ মিয়াদের কথা ভাবতেই ফিরোজ বলে উঠলেন–
জানো, আমাদের প্রধান শত্রু পাকিস্তানিরা ততো নয়, যততা হচ্ছে এই দেশীয় দালালরা। এদেরকে আগে খতম করা দরকার। এই শালাদের জন্যই বাঁদীর বাচ্চা আইবা (আউয়ুব শব্দটা ফিরোজের মুখে আইবা হয়ে গেছে) গত দশ বছর আমাদের উপর গোলামীর জোয়াল চাপিয়ে রাখতে পেরেছে।
কী দুঃসাহস! গোটা বাঙালি জাতিকে পশ্চিম পাকিস্তানের…
মীনাক্ষী কখন ঘরে ঢুকেছিলেন, এবং এদের কথা শুনছিলেন। পুরুষ জাতটাই কেমন যেন! এই দুঃসময়ে একটু তোমরা আল্লাহকে ডাক। তা না, কে বাঁদীর বাচ্চা, কে কী-সে সব আলোচনায় তোমাদের কী দরকার! ঐ করে। কি তোমরা বিপদে পার পাবে! তিনি সুদীপ্তর কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বলে উঠলেন–