এ প্রশ্ন তো আমি আপনাকেও করতে পারি। ওদের খায়েশ তো দেখছি সকলকেই নির্মূল করার।
এটা ঠিক বলেছেন। কিন্তু শয়তানদের খায়েশ এবার মেটাতে হবে ভালো করে। দরকার হলে ওপারে চলে গিয়ে সেখান থেকে ভালো করে তৈরী হয়ে এসে বেটাদের বাঙালি-হত্যার খায়েশ মেটাতে হবে।
দরকার হলে ওপারে যেতে হবে-একটা মত। আর-একটা মতও ছিল। সেটা তৃতীয় কণ্ঠে শোনা গেল। খদ্দরের পাঞ্জাবি-পরা ছিপছিপে দৃঢ় চেহারার ভদ্রলোকটি বললেন–
যা কিছু করতে হবে দেশের অভ্যন্তরে থেকে। দেশকে মুক্ত করার জন্য। দেশ ছেড়ে পালানোতে আমরা বিশ্বাসী নই।
দুটি মত পরস্পর বিরোধী। কিন্তু তাহলেও তর্কের অবকাশ বা ইচ্ছা কোনোটাই কারোর ছিল না। সঙ্গের লোকজন লাশ আনতে গেছেন ওপরে। এরা তাঁদের অপেক্ষায় আছেন। এবং মানসিক অবস্থার যে স্তরে আছেন তাতে। দুএকটা মন্তব্যের অতিরিক্ত কিছুর সাধ্য তাঁদের ছিল না।
তা ছাড়াও বিশ্বাস-অবিশ্বাস নিয়ে কোনো কিছু ভাববার অবকাশ তখন সাধারণ মানুষের ছিল নাকি! প্রাণভয়ে ভীত মানুষ যে যেদিক পেরেছে। পালিয়েছে। কোথায় কোনদিকে পালাচ্ছি সে বিবেচনাও তারা বহু ক্ষেত্রে করে নি।
নীলক্ষেত আবাসিক এলাকা ছেড়ে বেরোবার সময় সদর রাস্তায় তাঁরা ডঃ খালেকের গাড়ির মুখোমুখি হলেন। সুদীপ্তকে দেখে হাত ইশারায় গাড়ি থামাতে বললেন ডঃ খালেক। দুটো গাড়ি পাশাপাশি হতেই খালেক সাহেব গলা বাড়িয়ে দিলেন, অগত্যা এদিক থেকেও যতোটা সম্ভব গলা বাড়াতে হল সুদীপ্তকেও। কিন্তু ডঃ খালেক নিজের কথা কিছু বললেন না। তার ভাইয়ের মৃত্যু-সংবাদ পেয়েছেন, ভাবী ও ভাই-ঝিদের সন্ধান এখনো পান নি-সে সব কথাও চেপে গেলেন। অবশ্য কয়েকদিন পরে খালেক সাহেবের মুখেই সুদীপ্ত সব শুনেছিলেন। কিন্তু এখানে আজ শুনলেন ছোট একটি প্রশ্ন–
আপনার খবর কি?
কোন মত বেঁচে গেছি। তবে ডঃ ফজলুর রহমান বাঁচেন নি। ছাদের উপর বস্তির লোক মারা গেছে-বিস্তর। সারা তেইশ নম্বর একেবারে তছনছ করে
আশ্চর্য, ডঃ খালেক ইতিপূর্বেই এসব শুনেছেন। তিনি মন্তব্য করলেন–
আপনাদের দুর্ভাগ্যের কারণ হচ্ছে, আপনাদের বিল্ডিংয়ের ছাদে ওঠে একজন ই. পি. আর. আমাদের পাক-বাহিনীর উপর গুলি করেছিল।
”আমাদের” কথাটা খট করে কানে বাজল সুদীপ্তর। ফিরোজেরও। পাক বাহিনী এখনো আমাদের। কপালে দুঃখ তাহলে এখনো কিছু আছে। ফিরোজ খালেকের অপরিচিত হলেও এ কথা শুনে চুপ থাকতে পারলেন না। সরাসরি দৃঢ় স্বরে প্রতিবাদ জানালেন–
কে বললে আপনাকে এ কথা?
প্রত্যক্ষদর্শীর মুখে শোনা। তিনি নিজে দেখেছেন ছাদে একটা ই. পি. আর. এর লাশ পড়ে থাকতে।
আমিও তো নিজে গিয়েছিলাম ছাদে সুদীপ্ত সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন ঐ
রকম কিছু তো দেখি নি।–আপনি চিলেকোঠার ছাদে উঠেছিলেন? সেইখানে ছিল।
উহ্, কি ঘড়েল রে বাবা! সাধারণত চিলেকোঠার ছাদে কেউ উঠবে না। অতএব ঐভাবে সাজানো হয়েছে গল্পটাকে। কিন্তু সুদীপ্ত সেখানেও যে উঠে দেখেছেন। সেখানে ছিল সেই বাপ-ছেলে এক সাথে। বাপ তার বুকের নিচে লুকিয়ে বাঁচাতে চেয়েছিলেন আপন প্রাণপ্রিয় পুত্রকে। নিজের শরীরকে ঢালের মত করে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন পুত্রের উপর। সেই অবস্থাতেই গুলিবিদ্ধ হয়েছেন তাঁরা। গুলি বাপের শরীর ভেদ করে গিয়ে ঢুকেছে ছেলের বুকে। সুদীপ্ত যখন দেখেন তখনও বাপ বুকে জড়িয়ে আছেন ছেলেকে। সেই দৃশ্য! সামান্য কঘণ্টা আগে দেখা। ওদেরই কেউ ই. পি. আর. এর লোক নাকি! সুদীপ্ত হতবাক হয়েছিলেন বিস্ময়ে। এবং বিস্ময় কাটিয়ে কিছু বলার আগেই ডঃ খালেক পুনরায় বলে উঠলেন—
যেখানে সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধ করা হয়েছে কেবল সেখানেই তারা হামলা করেছে। সেনাবাহিনীকে সেজন্য বিশেষ দোষ দেওয়া যায় না।
তাই নাকি। ফিরোজ বললেন, ইকবাল হল, জগন্নাথ হলের ছাত্ররাও সেনাবাহিনীকে বাধা দিয়েছিল নাকি! তারা লাঠি নিয়ে তাড়া করেছিল বুঝি।
ফিরোজের ব্যঙ্গোক্তি খালেক সাহেব গায়ে মাখলেন না। অথবা তা বুঝবার। বোধই তাঁর নেই। তিনি বলে উঠলেন।
ওরে বাবা কী যে বলেন! রাইফেল হাতবোমা এ্যাসিড বাব-এই সবের। ডিপে ছিল ঐ দুটি হল। মর্টারও ছিল কিছু কিছু। সেনাবাহিনী হল থেকে সে সব উদ্ধার করেছে।
কোনো অপরিচিত ব্যক্তিকে সহসা কোনো কড়া কথা শোনানো যায় না। অন্ততঃ ফিরোজ পারেন না শোনাতে। কণ্ঠে প্রবল বিরক্তি প্রকাশ করে তিনি শুধু বললেন–
এইসব গাঁজা বিশ্বাস করতে বলেন! বলেই গাড়িতে স্টার্ট দিলেন।
নিউ মার্কেটের চৌমাথার মোড়ে তাদের গতিরুদ্ধ হল। সামনের দু-তিন খানা গাড়ি দুজন পাকিস্তানি সৈনিকের নির্দেশে দাঁড়িয়ে গেছে। অগত্যা তাদেরকেও দাঁড়াতে হল। পেছনে এসে পর পর দাঁড়াল কয়েকটি গাড়ি।
অতঃপর সৈনিক দুজন এসে প্রত্যেক গাড়ি থেকে পুরুষ আরোহীদের নামাতে শুরু করল। অগত্যা নামতে হল সুদীপ্ত ও ফিরোজকেও। সকলকে সার করে দাঁড় করাল তারা রাস্তার পাশে। প্রায় বিশ-পঁচিশ জন। একজন সৈনিক এসে গুণতে শুরু করল-এক, দো তেন…এগারা, বারা। ব্যস, আর দরকার নেই। এই বারোজন বাদে আর সবাই গাড়িতে গিয়ে ওঠ। সুদীপ্ত। ছিলেন তেরো নম্বরে, চৌদ্দতে ফিরোজ। অতএব রেহাই পেয়ে তাঁরা চলে এলেন। কিন্তু ঐ বারো জন?
তোম লোক রাস্তার জঞ্জাল সাফা কর।
গাড়ি-হাঁকিয়ে চলা মানুষ। কে কোন মর্যাদার লোক কে জানে। সবকে এখন রাস্তার জঞ্জাল সাফ করতে হবে। পায়ে-হাঁটা মানুষের সংখ্যা কিছুক্ষণ আগেও অনেক ছিল এখন যথেষ্ট কম। এবং এখনি ওদের খেয়াল হয়েছে। রাস্তার জঞ্জাল সাফ করতে হবে। জঞ্জাল সাফ মানেই সেই মাজার ভেঙ্গে ফেলতে হবে।