ঘর থেকে বেরিয়ে গেল দুজনেই। খিল তোলার আওয়াজ শোনা গেল। ফিরে এল অঞ্জন। সঙ্গেসঙ্গে রুষ্টকণ্ঠে বলে উঠল সীমা, আমার এসব ব্যাপার ভালো লাগছে না। দশটা টাকা আমিও দিতে পারতাম। মালতির মাকে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয় বলেই দিইনি। আপনি রাগ করবেন না অঞ্জনবাবু, শুধু মায়ের মত নিলেই চলবে না– এই সংসারে আমারও একটা মতামত আছে জানবেন।
জানি, ভদ্র সমাজের রীতিনীতি আমারও জানা আছে, অঞ্জনের কণ্ঠে পরিহাসের লেশমাত্র নেই, দরকারি কথার মধ্যে তোমাদের কি বাধার সৃষ্টি করছিল, তাই ওকে তাড়াতাড়ি সরিয়ে
দিলাম। এতে রাগ করার কিছু নেই। তুমি না জানলেও তোমার মা জানেন আমার কাছ থেকে কিছু নিলে তোমাদের অমর্যাদা হয় না। কারণটা জানলে তোমারও আমার কাছ থেকে কিছু নিতে বাধবে না।
সীমা দৃঢ়স্বরে বলল, সেই কারণটাই তাহলে আগে জানতে চাই। নিশ্চয়ই জানবে। তবে একটা কথা সর্বাগ্রে জেনে রাখা দরকার অঞ্জনের কণ্ঠস্বর ভয়ানক গম্ভীর, তোমাদের শিয়রে শমন এসে দাঁড়িয়েছে।
৬. কাজল চৌধুরীর কাহিনি
প্রথম স্তব্ধতা ভঙ্গ করলেন শ্রীময়ী, শিয়রে শমন বলছিস কেন? জোসেফ লোকটা কি এতই ভয়ানক? কে সে? গুণ্ডা, না ডাকাত?
অঞ্জনের মুখে বিচিত্র হাসি ফুটল, ডাকাত বা গুণ্ডা হলে ভয় পেতাম না। আমার ক্ষমতার সামান্য পরিচয় তোমার মেয়ে পেয়েছে। কিন্তু জোসেফকে আমিও ভয় পাই। কারণ, জোসেফ হচ্ছে এক ভয়ংকর জীব। সে যে কে এবং কী, তা আমিও ভালো করে জানি না।
সীমা ভয় পেয়েছিল। শ্রীময়ী সহজে বিচলিত হন না, তিনি বললেন, ব্যাপারটা ধাঁধার মতো লাগছে। জোসেফকে ভয় করার কারণ কী? অন্তত স্পষ্ট করে সেকথাটা আমাদের বল। তার সঙ্গে তোরই বা সম্পর্ক কী?
সবই বলব, অঞ্জন চিন্তিত ভাবে বলল, তবে এখন থেকে তোমাদের সব ভারই আমাকে নিতে হবে। জোসেফের নির্দেশ মেনে চললে অবশ্য ভয় নেই। তোমাদের সঙ্গে যদি সম্পর্ক ছিন্ন করি, আমাদের মধ্যে যদি কোনোদিন সাক্ষাৎকার না ঘটে, তাহলে ভয়ের কারণ থাকে না।
সীমা বলল, আপনি তো অনেক আগেই আমায় আপনার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে নিষেধ করেছিলেন। আজ হঠাৎ আমাদের জন্য এমন ব্যস্ত হয়ে উঠলেন কেন?
শ্রীময়ীর মুখের রেখাগুলো কঠিন হয়ে উঠল। তার মনোভাব বুঝেই হাত তুলে তাকে নীরব থাকতে ইঙ্গিত করল অঞ্জন, তারপর দৃষ্টিপাত করল সীমার দিকে, আমি ভুল করেছিলাম, সীমা। তোমাদের নিরাপত্তার কথা ভেবেই সেদিন আমার সঙ্গে সংস্রব রাখতে নিষেধ করেছিলাম। আমার আশঙ্কা অবশ্য পরে সত্য হয়েছে। বিপদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বুঝলাম কাপুরুষের মতো কর্তব্যে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যাওয়া উচিত নয়। শুধু কর্তব্যের কথা বলব কেন? আমার মধ্যেই কি শূন্যতাবোধ ছিল না? মায়ের আদর আর স্নেহের স্পর্শ পাওয়ার জন্য আমার মনেও কি লোভ হয়নি? আমি জানতাম–
বাধা দিয়ে শ্রীময়ী বললেন, টাকাটা রেখে দিয়ে তুই যখন চোরের মতো পালিয়ে গেলি, তখনই মনে হয়েছিল তুই আর এখানে আসবি না। আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চাইলে পরিচয় দিতে কোনো বাধা তো ছিল না। তবে আমাদের জন্য যে তোর প্রাণ কেঁদেছে, টাকাটাই তার প্রমাণ। সেইজন্যই ওই বারো-শো টাকা নিয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ না করলে, কোনো সম্পর্ক না রাখলে, ভবিষ্যতে তোর থেকে আর্থিক সাহায্য গ্রহণ করবনা, এটাও আমি স্থির করেছিলাম।
-জানি মা। তোমাকে আমি চিনি না?… চলে গিয়েছিলাম ঠিকই। কিন্তু মনটা তোমার কাছেই পড়েছিল। একটা অদ্ভুত লজ্জা আর অপরাধবোধের জন্য সেদিন পরিচয় দিতে পারিনি। বাবার মৃত্যুসংবাদও আমায় বিহ্বল করে দিয়েছিল। মনে হয়েছিল, আমি যদি সম্পর্ক রাখতাম তাহলে হয়তো এত তাড়াতাড়ি বাবার মৃত্যু হত না আর তোমাদেরও এমন অভাব-অনটনের মধ্যে পড়তে হত না। বিশ্বাস করো মা, তোমার জন্যই ভীষণ মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল, হয়তো পরে নিজে থেকেই তোমাদের কাছে ফিরে আসতাম তুমি যে আমায় চিনেছ আর ক্ষমা করেছ, প্রকারান্তরে সেটা তুমি আমায় জানিয়ে দিয়েছিলে; কাজেই আসতে বাধা ছিল না কিন্তু অন্য দিক থেকে বাধা এল ভয়ংকর ভাবে। আজও সেই বাধা রয়েছে। তবু সব বিপদ আর ভয় তুচ্ছ করে আমি ফিরে এলাম মা, এখন থেকে তোমাদের সব দায়িত্বই আমার।
আমার কথাটা কিন্তু আপনি ভুলে যাচ্ছেন অঞ্জনবাবু সীমা বলে উঠল, আপনার কাছ থেকে কোনো আর্থিক সাহায্য আমি নিতে রাজি নই। শুধু মা নন, আমার কথাও আপনাকে ভাবতে হবে। আপনি বলেছিলেন আপনার কাছে কিছু গ্রহণ করলে আমাদের অসম্মান নেই। কারণটাও জানাবেন বলেছেন, কিন্তু এখনও জানাননি। সেই কারণটা না জানা পর্যন্ত আমার পক্ষে আপনার কাছ থেকে কোনো আর্থিক সাহায্য গ্রহণ করা সম্ভব নয়।
হ্যাঁ, একথা তুমি বলতে পারো, অঞ্জন মাথা নীচু করে ক্ষণেক চিন্তা করল, তারপর পূর্ণ দৃষ্টিতে চাইল সীমার দিকে, আমি তোমার বড়ো ভাই। আমার কাছ থেকে সব কিছু নেবার অধিকার তোমার তো আছেই, এমন কি দাবিও আছে।
বড় ভাই! দাদা! অস্ফুটস্বরে বলল সীমা। কিছুক্ষণ স্তব্ধ থেকে বোধহয় এই অপ্রত্যাশিত সংবাদটা গ্রহণ করার চেষ্টা করল, তারপর বলে উঠল, কিন্তু আমি তো কোনোদিন আমার কোনো ভাই-এর কথা মা বাবার কাছে শুনিনি।