নিশ্চয়ই, সীমার দিকে তাকালেন না শ্রীময়ী, তবে অঞ্জন না বলে দাদা বলে সম্বোধন করলেই মেয়েকে আমি তুমি বলার অধিকার দিতে পারি।
–সেকি! সীমা কি আমার নাম ধরে উল্লেখ করে নাকি? সামনে তো অঞ্জনবাবু বলে।
আড়ালে সোজাসুজি অঞ্জন বলে। আমি অবশ্য নিষেধ করেছি। এসব অসভ্যতা আমার সহ্য হয় না। কী আর বলব কাজল- আজকালকার মেয়েগুলো যেমন অসভ্য, তেমনি উদ্ধত।
ঠিক কথা, অঞ্জন তৎক্ষণাৎ শ্রীময়ীর সঙ্গে একমত, তবে হাল ছাড়লে চলবে না। অন্তত এই মেয়েটাকে মানুষ করতে হবে।
আমি তো পারলাম না, শ্রীময়ী হাসলেন, এখন দ্যাখ তুই যদি পারিস।
তুই! সীমার ললাটে কয়েকটা রেখা পড়ল- না মা বড় বেশি বাড়াবাড়ি করছে। এতটা গায়ে-পড়া ভাব ভালো লাগল না সীমার।
তার ভালো না লাগলে কী হবে, অপর দুজন পরমানন্দে আলাপ চালাতে লাগল, আমিও কি পারব? তবে চেষ্টা করতে হবে। একটাই যখন মেয়ে তোমার।
–আর তোর কেউ নয়?
–হুঁ। আমার সঙ্গেও একটা সম্পর্ক আছে বৈকি। কিন্তু তোমার বিদুষী কন্যা তো আমার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখতে চায় বলে মনে হচ্ছে না।
ওর ইচ্ছায় কিছু আসে যায় না। যা-খুশি-তাই আর করতে দেওয়া হবে না ওকে।
–আপাতত চাকরিটা ওকে ছাড়তে হবে। নিজে উপার্জন করলেই মেয়েরা অতিরিক্ত স্বাধীনচেতা হয়ে পড়ে। তুমি কি বলো মা?
–আমি আবার কী বলব? তুই যদি ভালো মনে করিস, ও চাকরি ছাড়বে।
অসহ্য! সীমা প্রায় চেঁচিয়েই বলে উঠল, চাকরি ছাড়লে আমরা খাব কী? আপনার ওই বারোশো টাকা দিয়েই সারা জীবন চলবে নাকি?
পাগল! তা কখনো চলে! অঞ্জন হাসল, যা দরকার হয়, আমিই দেব। কি বলো মা?
তুই যদি চালাতে পারিস, তাহলে ও চাকরি করবে কেন? শ্রীময়ী বললেন।
মা! এটা বড় বেশি বাড়াবাড়ি হচ্ছে না? সীমা ক্রোধ গোপন করার চেষ্টা করল না, অঞ্জনবাবু আমায় গুণ্ডার খপ্পর থেকে বাঁচিয়েছেন সেজন্য আমি কৃতজ্ঞ। মেয়েকে বাঁচিয়েছে, মা হিসাবে তোমারও তাকে নিশ্চয়ই ভালো লাগতে পারে, কিন্তু তার টাকায় আমাদের খাওয়া-পরা চলবে একথা ভাবছ কী করে? আমাদের কি মর্যাদাবোধ বলে কিছু নেই? তোমার কাছে এমন অদ্ভুত ব্যবহার আমি আশা করিনি।
শ্রীময়ী মুখ টিপে হাসলেন, এতদিন আমার সঙ্গে রয়েছিস, আমাকে চিনলি না? আমার মর্যাদাবোধ নেই একথা তুই ভাবতে পারলি সীমা?
–সেইটাই তো অদ্ভুত লাগছে। কিছু মনে করবেন না অঞ্জনবাবু। আমি আবার—
অঞ্জনবাবু কেন? ধমকে উঠল অঞ্জন, দাদা বলতে বুঝি মুখে আটকায়?
হ্যাঁ, আটকায়, সীমা ক্রুদ্ধস্বরে বলল, আমি দুদিনের পরিচয়ে দাদা, কাকা এসব বলতে পারি না। এমন গায়ে-পড়া ভাবও আমি পছন্দ করি না।
কথাটা বলেই থেমে গেল সীমা। তার ব্যবহার বড়ো বেশি রূঢ় হয়ে গেছে, এমনকী ভদ্রতার সীমা ছাড়িয়ে গেছে বললেও ভুল হয় না। ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে কিছু বলার জন্য অঞ্জনের মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল সীমা– কী আশ্চর্য! অঞ্জন হাসছে। লোকটার কি মান-অপমান বোধ নেই!
সত্যিই হাসছিল অঞ্জন, তোমার মেয়েটা খুব অসভ্য হয়ে গেছে মা। ওকে শক্ত হাতে শাসন করা দরকার।
শ্রীময়ীকে হাসতে দেখে আবার সীমার মাথা গরম হয়ে উঠল, মা, আমাকে নিয়ে এভাবে কথা বললে আমি সহ্য করব না। অঞ্জনবাবুকে যদি এভাবে প্রশ্রয় দাও, তাহলে জোসেফ কী অপরাধ করল?
অঞ্জনের বিস্মিত চমক লক্ষ করল না সীমা, ক্রোধ উদগিরণ করল মায়ের দিকে তাকিয়ে, জোসেফ কেন অঞ্জনবাবুর সঙ্গে তোমায় সম্পর্ক রাখতে নিষেধ করেছে জানি না; কিন্তু আমি ব্যক্তিগত ভাবে এই ভদ্রলোকের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখতে রাজি নই।
-সীমা!
মায়ের কঠিন স্বরে সীমার চেতনা ফিরে এল। তার পক্ষেও দারুণ অভদ্রতা হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি নিজেকে সংশোধন করে সে বলে উঠল, মানে, আমি কোনো সম্পর্কের বাঁধনে আসতে চাই না একথাই বলেছি। অর্থাৎ দাদা-টাদা বলতে পারব না। একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে মহিলা হিসাবে একটা ভদ্র সম্পর্ক নিশ্চয়ই
সীমার বক্তব্য শেষ হল না, অসহিষ্ণুভাবে বাধা দিল অঞ্জন, জোসেফ এখানে এসেছিল নাকি? কেন এসেছিল?
অঞ্জনের উত্তেজিত কণ্ঠস্বরে কী ছিল বলা যায় না, সীমার সর্বাঙ্গ দিয়ে ছুটে গেল আতঙ্কের শিহরন!
সীমার কথার উত্তরে প্রশ্ন করলেও অঞ্জনের দৃষ্টি রয়েছে শ্রীময়ীর দিকে, কেন এসেছিল জোসেফ?
শ্রীময়ী স্থিরদৃষ্টিতে তাকালে অঞ্জনের দিকে, তোমার সঙ্গে আমাদের সংস্রব রাখতে নিষেধ করেছে জোসেফ। সেইজন্যই এসেছিল সে। বলেছে–
-মা!
সকলেই চমকে উঠল। দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে মালতির মা, আমি এবার যাব মা।
হ্যাঁ, অনেক রাত হয়ে গেছে, শ্রীময়ী ব্যস্ত হয়ে বললেন, চলো, দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে আসি।
মা, মালতির মা এখন মরিয়া, কপাল ঠুকে বলে ফেলল, দশটা টাকার খুব দরকার ছিল। আমার মালতি
বাধা দিয়ে শ্রীময়ী বললেন, তোমার মেয়ে মালতির অসুখ তো? সে তত বারোমাস লেগেই আছে। আমি এখন কিছু
ঠিক আছে অসহিষ্ণু স্বরে অঞ্জন বলে উঠল, দশটা টাকা আমি দিয়ে দিচ্ছি। এই নাও।
পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট মালতির মায়ের দিকে বাড়িয়ে দিল সে।
মালতির মা কুণ্ঠিত দৃষ্টিতে শ্রীময়ীর দিকে তাকাতেই তাড়া দিয়ে উঠল অঞ্জন, মায়ের দিকে তাকাতে হবে না। আমি দিচ্ছি। নিয়ে যাও। চলো, দরজাটা বন্ধ করতে হবে। হাঁ করে তাকিয়ে থেকো না, অনেক কাজ আছে আমার।