ব্যাপারটা বেশ জটিল, মেয়ের কথার উত্তর দিলেন শ্রীময়ী, উনি মানে মিঃ জোসেফ আমাদের শুভার্থী, আমাদের মঙ্গলের জন্যই উনি কাজলের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক রাখতে নিষেধ করছেন।
স্পর্ধারও একটা সীমা থাকা উচিত, সীমার মুখচোখ লাল হয়ে উঠল, মিঃ জোসেফ আপনার অযাচিত উপদেশের জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু আমাদের পক্ষে আপনার মূল্যবান উপদেশ শিরোধার্য করা সম্ভব নয়।
বলার সঙ্গেসঙ্গে মুখের উপর দরজা বন্ধ করতে চেয়েছিল সীমা। পারল না। জোসেফের একটা হাত দরজা চেপে ধরেছে, আমি চলে যাচ্ছি। আমার কথাটা শুনলে ভালো করতেন। কাজল চৌধুরী মানুষটা ভালো কি মন্দ সেটা প্রশ্ন নয়। তার সাহচর্য আপনাদের পক্ষে মঙ্গলজনক নয়, এই কথাটা মনে রাখবেন।
দরজা ছেড়ে রাস্তায় নামল জোসেফ, তারপর দ্রুত পদক্ষেপে অন্তর্ধান করল…
দরজা বন্ধ করে উত্তেজিত স্বরে সীমা বলল, মা, এই লোকটা কে বলো তো?
জানি না, শ্রীময়ী চিন্তিতভাবে বললেন, লোকটা যে ভালো নয়, তা তো বুঝতে পারছি। নাম শুনে মনে হয় অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। তাও পুরো নামটা বলল না। কাজলের সঙ্গে ওর কী সম্পর্ক জানি না। তবে আমাদের সঙ্গে কাজল মেলামেশা করে, এটা ওর পছন্দ নয়। আমাদের তো একরকম শাসিয়েই গেল।
তাই তো দেখছি, সীমার মুখেও চিন্তার ছায়া, পাড়ার ছেলেরা আমায় চেনে। কারও সঙ্গে আমাদের অসদ্ভাব নেই। চট করে এই বাড়িতে কেউ হামলা করতে পারবে বলে মনে হয় না। কিন্তু কাজলের অর্থাৎ অঞ্জনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক থাকলে এই লোকটার কী ক্ষতি? সমস্ত ব্যাপারটাই কেমন যেন অদ্ভুত আর জটিল মনে হচ্ছে।
একটু থেমে সীমা আবার বলল, এই জোসেফ লোকটিও অঞ্জনকে কাজল বলে উল্লেখ করছিল। তুমিও ওকে কাজল নামে ডাকছ। কারণ হিসাবে বলেছিলে অঞ্জন মানেই কাজল–অর্থাৎ এটা ঠাট্টা। তা ওই লোকটাও কি তোমার সঙ্গে গলা মিলিয়ে ঠাট্টা করছিল?
শ্রীময়ী মেয়ের কথার জবাব দিলেন না; নিরুত্তরে বাইরের ঘর ছেড়ে ভিতরের দিকে চলে গেলেন…
মালতির মা দরকারি কথাটা বলার সুযোগ পাচ্ছিল না। সাহেব আর মায়ের সাক্ষাৎকারের ফল যে খুব সন্তোষজনক হয়নি, সেটা সে বুঝেছিল। দিদিমিণির আবির্ভাব এবং দুপক্ষের কথোপকথন শুনে ব্যাপারটা বুঝতে না পারলেও পরিবেশের উত্তপ্ত আবহাওয়া সে অনুভব করতে পেরেছিল। শ্রীময়ীকে ভিতরের ঘরে এসে বসতে দেখে সে এগিয়ে এল। কিন্তু কপাল ঠুকে টাকার কথাটা বলার আগেই ঘরে ঢুকল সীমা। ওই লোকটা অঞ্জন ঘোষকে শুধু কাজল বলে উল্লেখ করেই ক্ষান্ত হয়নি, পদবিটাও বদলে দিয়ে বলছিল কাজল চৌধুরী। এটা কেমন ব্যাপার হল মা? তুমিও তো প্রতিবাদ করলে না?
তুই আসার আগেই লোকটাকে অনধিকার চর্চা করতে বারণ করেছিলাম,শ্রীময়ীর কণ্ঠস্বর শান্ত, পদবি-টবি বা নাম নিয়ে ওর সঙ্গে আলোচনা সম্পূর্ণ অনাবশ্যক।
মালতির মা প্রমাদ গুনল। সে বুঝতে পেরেছিল এখন টাকার কথা বলে লাভ হবে না। এমন সময়ে আবার কড়া নড়ে উঠতেই সে ছুটে গেল সেইদিকে। একটু পরে ফিরে এসে বলল, মা, তোমায় একটি ছেলে ডাকতিছে।
শ্রীময়ী আর সীমা পরস্পরের মুখের দিকে চাইলেন। সীমা বলে উঠল, আজ দেখছি ঘনঘন অতিথির আবির্ভাব ঘটছে।
শ্রীময়ী হেসে বললেন, আগের বারে সায়েব এসেছিল। এবার বাবু নয়, লোক নয় ছেলে! দেখে আসি ছেলেটা কেমন।
ছেলেটা খুব খারাপ, বলতে বলতে যে ব্যক্তি ঘরের মধ্যে পা বাড়াল, তাকে দেখে চমকে উঠল মা আর মেয়ে।
আপনি! অস্ফুট উক্তি বেরিয়ে এল সীমার গলা থেকে।
হ্যাঁ, আমি, অঞ্জন হাসল, তোমরা বেশ চমকে গেছ দেখছি।
চমকাবে না?শ্রীময়ী হাসলেন, বলা নেই, কওয়া নেই, বাইরের উটকো লোক অন্দরমহলে ঢুকে গেল। মেয়ে বোধ হয় খেপে গেছে।
ভ্রূ কুঁচকে মায়ের দিকে তাকাল সীমা। নাবলে অন্দরমহলে অঞ্জনের পদক্ষেপ সে পছন্দ করেনি, কিন্তু মুখের উপর সেকথা শুনিয়ে দেওয়া তো দস্তুরমত অপমানকর! এইভাবে অন্দরমহলে আসা যে অন্যায়, সে কথা অন্যভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার ভদ্র উপায়টাও কি শ্রীময়ীর মতো শিক্ষিত মহিলাকে বলে দিতে হবে?… সীমা অবাক হয়ে দেখল মায়ের মুখে একটা হাসির রেখা উঁকি দিচ্ছে। অঞ্জনের মুখের দিকে তাকাল সে– নাঃ, সেখানেও তো অপমানিত মানুষের ক্রোধ বা বিরক্তির আভাস দেখা যাচ্ছে না! বরং তার ওষ্ঠাধরের উপর খেলা করছে একটা তরল হাসির রেখা!
সীমাটা বেশ চটে গেছে, বুঝতে পারছি, হেসে হেসেই বলল অঞ্জন, ওকে দোষ দেওয়া যায় না। বাইরের উটকো লোক না বলে কয়ে অন্দরমহলে এলে একজন ভদ্রমহিলার নিশ্চয়ই রাগ করার অধিকার আছে।
আছেই তো, শ্রীময়ী সহাস্যে বললেন, তারপর ভদ্রমহিলাটি আবার দস্তুরমতো বিদষী। নিজে উপার্জন করেন, আবার মাকেও ভরণ-পোষণ করছেন।
-মা!
মেয়ের ক্রুদ্ধ কণ্ঠ আর জ্বলন্ত দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে শ্রীময়ী আবার বললেন, সে-মহিলাটি সংসারের যাবতীয় দুর্বহ ভার স্কন্ধে বহন করছেন এবং যিনি দস্তুরমতো বিদুষী বলে পরিগণিত, তার শয়নকক্ষে অনুমতি না নিয়ে প্রবেশ করা গর্হিত অপরাধ। অপরাধী শুধু এখানেই ক্ষান্ত হয়নি, উক্ত মহিলাকে তুমি বলে সম্বোধন করার জন্য অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি সে। এখন বলো কাজল, এই অপমানের প্রতিকার করা কি উচিত নয়?
অবশ্যই উচিত, অঞ্জন এখন দস্তুরমতো গম্ভীর, প্রতিশোধ হিসাবে সীমার উচিত আমাকে তুমি বলা। তাই নয় মা?