সেই রাতটা নোভাক আর তার সঙ্গীরা সেই গ্রামেই থাকল। গাঁয়ের পুরুষরা মৃতদেহগুলির অগ্নি-সৎকার, মেয়েরা দগ্ধ কুটিরের ধ্বংসাবশেষ দিয়ে আবার নতুন ঘর তৈরি করার উদ্যোগে ব্যস্ত হয়ে উঠল।
সকালে উঠেই নোভাক দেখলে গ্রামবাসীদের জীবনযাত্রা হয়ে উঠেছে স্বাভাবিক। নারীপুরুষ সকলের মুখেই হাসি দেখা দিয়েছে, প্রাত্যহিক কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে গ্রামবাসীরা তাদের দেখলে মনেই হয় না যে গতরাত্রে এই গ্রামের মধ্যে খুনোখুনি রক্তারক্তি হয়ে গেছে। নোভাক বুঝল গ্রামবাসীরা দার্শনিক।
তারা বিশ্বাস করে মৃত মানুষ জীবিতের সঙ্গী হতে পারে না তাই মৃতের জন্য শোক না করে খুব সহজভাবেই তারা জীবনযাত্রার সহজ কর্মে লিপ্ত হয়ে পড়েছে।
মালো এবং তার সঙ্গীদের জীবন-দর্শন এত সরল নয়। গ্রামবাসীদের মতো সহজভাবে তারা মৃত্যুকে গ্রহণ করতে পারলে না।
সেদিন সকালবেলা মালো দলের মুখপাত্র হয়ে নোভাককে বললে, জিভারোরা খেপে গেছে। আমাদের মাথাগুলো আর নিরাপদ নয়। মালিক, আমরা ফিরে যেতে চাই।
নোভাক তাদের বোঝাবার চেষ্টা করলে, জিভারোদের সঙ্গে আমাদের কোনো ব্যক্তিগত বিবাদ নেই। তারা আমাদের কেন আক্রমণ করবে? হয়তো এই গ্রামবাসীরা জিভারোদের সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়েছিল তাই এমন ভয়ানক কাণ্ড ঘটেছে। যাই হোক আমি এখানে তেলের সন্ধানে এসেছি, এখন ফিরে যেতে পারব না।
মালো বললে, মালিক তাহলে তুমি থাকো, আমরা চললুম।
নোভাক দেখলে বেগতিক!–ইকুয়েডরের বনপথে একা একা পথ চলা দুঃসাধ্য ব্যাপার, যে। ভাবেই হোক কুইচাদের মত বদল করাতেই হবে। সে এবার অন্য কায়দা ধরলে, তিক্তকণ্ঠে বিদ্রূপ করে বললে, মালো তুমি একটা পুরুষ মানুষ নও! তোমার বুকে মানুষের হৃৎপিণ্ড নেই, আছে একটা মুরগির কলজে! তুমি এদের দলপতি হয়েছে কেন? এখানকার একটা মেয়েমানুষও তোমার চাইতে ভালো সর্দার হতে পারে।
মালোর মুখ চোখের চেহারা ভয়ানক হয়ে উঠল।
সে পিছন ফিরে চলে যাওয়ার উপক্রম করলে, পরক্ষণেই এক পায়ের উপর ভর দিয়ে বিদ্যুৎ বেগে পাক খেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল মালিকের উপর তার দুহাতের দশটা আঙুল বজ্রমুষ্টিতে চেপে ধরলে নোভাকের কণ্ঠনালী!
এমন অতর্কিত আক্রমণের মুখে নোভাক সরে গিয়ে আত্মরক্ষা করতে পারলে না, কোনো রকমে মালোর পেটে হাঁটুর গুতো মেরে সে নিজকে ছাড়িয়ে নিল।
দুই প্রতিদ্বন্দ্বী পরস্পরকে ছেড়ে সরে গেল, দুজনেই দ্রুত নিঃশ্বাস ফেলে হাঁফাতে লাগল। অন্য কুইচারা দাঁড়িয়ে রইল নিশ্চল পাথরের মতো- দ্বন্দ্ব যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করবে না।
আবার আক্রমণ করল মালো। নোভাক শত্রুর মাথা লক্ষ্য করে ঘুসি ছুড়ল কিন্তু মালো ক্ষিপ্রপদে সরে গিয়ে ঘুসিটাকে ব্যর্থ করে দিলে। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে নিজের গতির বেগে নোভাক ঝুঁকে পড়ল সামনের দিকে। তৎক্ষণাৎ এক লাফে নোভাকের পাশে এসে দাঁড়াল মালো, হাঁটু দিয়ে ধূর্ত রেড-ইন্ডিয়ান সজোরে আঘাত করলে নোভাকের কিডনিতে। নোভাক ছিটকে পড়ল মাটিতে! মালো ভূপতিত শত্রুর মাথা লক্ষ্য করে লাথি ছুড়ল। নোভাক চট করে প্রতিদ্বন্দ্বীর পা ধরে ফেললে, তারপর দুহাতে গোড়ালি ধরে এক ঝটকায় পা মুচড়ে ভেঙে দেবার চেষ্টা করলে।
কিন্তু মালো মারামারিতে ওস্তাদ, সে সার্কাসের পাকা খেলোয়াড়ের মতো শূন্যপথেই নিজের দেহটাকে ঘুরিয়ে নিলে। মালোর পা ভাঙল না বটে কিন্তু তার দেহটা সশব্দে আছাড় খেল কঠিন মাটিতে আর সমস্ত শরীরের ওজনটা এসে পড়ল পেটের উপর তার দম ফুরিয়ে গেল।
নোভাক মালোকে টেনে তুলল, পর পর চারটি নিষ্ঠুর ঘুসির আঘাতে শেষ হয়ে গেল লড়াই।
নোভাকের প্রথম দুটি ঘুসি পড়ল মালোর পেটে, তৃতীয়টি পড়ল মুখে আর আঘাতের যন্ত্রণায় মালো যখন সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে, তখন চতুর্থ ঘুসিটি তার ঘাড়ের উপর- মালো ভূমিশয্যা গ্রহণ করলে।
আবার তাকে টেনে দাঁড় করিয়ে দিলে নোভাক, হাঁফাতে হাঁফাতে প্রশ্ন করলে মানো, তোমার উপর আমার রাগ নেই। কিন্তু আমার কথা তোমায় শুনতেই হবে। শোনো, আমরা এগিয়ে যাব– ঠিক?
মালো মাথা নাড়লে, ঠিক।
তল্পিতল্পা গুটিয়ে আবার সবাই ক্যানোতে উঠল–শুরু হল জলযাত্রা। প্রথম দু ঘণ্টা কেউ কথাবার্তা বললে না। নদীর চাইতে নদীর তীরের দিকেই কুইচাদের দৃষ্টি বেশি সজাগ দেখা গেল। তারা জানত জিভারোরা যদি নরমুণ্ড শিকার করতে চায়, তাহলে নদীর ধারে জঙ্গলের মধ্যেই তারা গা-ঢাকা দিয়ে সুযোগের প্রতীক্ষা করবে। নোভাক নীরবতা ভঙ্গ করার চেষ্টা করলে না, গুলিভরা বন্দুক কোলের উপর রেখে সে স্থির হয়ে বসে রইল চলন্ত নৌকার উপর শুধু তার প্রখর চক্ষুর তীব্র দৃষ্টি ঘুরতে লাগল নদীর তীরে তীরে বনভূমির বুকে।
সন্ধ্যা হল, চারদিকে ঘনিয়ে এল অস্পষ্ট অন্ধকার।
হঠাৎ একজন কুইচা মাঝি চেঁচিয়ে উঠে নদীর তীরে একদিকে আঙুল দেখাল। তার নির্দেশ অনুযায়ী দৃষ্টি সঞ্চালন করতেই সকলের চোখে পড়ল বালির উপর বিঁধে আছে একটা বল্লম।
খুব তাড়াতাড়ি বৈঠা চার্লিয়ে তারা জায়গাটা পেরিয়ে গেল এবং রাত্রির অন্ধকার যতক্ষণ পর্যন্ত দৃষ্টিকে একেবারে আচ্ছন্ন না করে ফেলল, ততক্ষণ পর্যন্ত নৌকা বেয়ে চলল প্রাণপণে।
সেই রাত্রিতে তারা আগুন না জ্বালিয়ে অন্ধকারের মধ্যেই তাবু খাটাল। ঠান্ডা শুকনো টিনের খাবার চিবিয়ে তার ক্ষুধা শান্ত করলে এবং অন্ধকার তাবুর গর্ভে শয্যাগ্রহণ করে শুয়ে পড়ল। নোভাকের ঘুম এল না। তার চারপাশে কম্বল মুড়ি দিয়ে যে লোকগুলো শুয়েছিল, তাদের অস্পষ্ট কথাবার্তা শুনে নোভাক বুঝল যে আজ রাত্রে তাঁবুর মধ্যে কোনো লোকই নিদ্রাদেবীর আরাধনা করতে রাজি নয়– তীব্র শঙ্কা ও উদ্বেগ সকলের চোখ থেকে ঘুমকে তাড়িয়ে দিয়েছে…