মালোর নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করে নোভাক দেখল সত্যিই তাতে পরিশ্রম অনেক কম হয়।
সেদিন অর্থাৎ ডিসেম্বরের তিন তারিখে তারা এসে পৌঁছল পাটাজা নামক স্থানে।
মালো বললে, আজ রাতে এখানেই তাবু ফেলা যাক। কাল সকালে আমরা জলপথে ক্যানো ভাসিয়ে যাত্রা শুরু করব।
নোভাক সম্মতি দিলে। কুইচারা তাবু খাটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। টিনে জমানো শুকনো খাবার কুইচারা বাধ্য হয়ে খায়, কিন্তু ওই শুষ্ক খাদ্য তারা পছন্দ করে না- এ কথাটা নোভাকের জানা ছিল। সে মাথার উপর দৃষ্টির নিক্ষেপ করলে গাছে গাছে বসে আছে অথবা দোল খাচ্ছে অনেকগুলো বাঁদর। নোভাক শুনেছিল এইসব বাঁদরের মাংস নাকি অতিশয় উপাদেয় খাদ্য। অতএব গর্জে উঠল তার হাতের বন্দুক, বৃক্ষশাখা থেকে সশব্দে মাটির উপর আছড়ে পড়ল কয়েকটা বাঁদরের মৃতদেহ।
এমন টাটকা মাংস পেয়ে কুইচারা খুব খুশি। বাঁদরের মাংস খাওয়ার প্রবৃত্তি নোভাকের হল না, সে শুকনো টিনের খাবারেই ক্ষুধা নিবৃত্ত করলে।
রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষ করে তারা শুকনো লতাপাতা দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে তাবুর ভিতর ঢুকে ঘুমিয়ে পড়ল। সকালবেলায় অগ্নিকুণ্ডর আশেপাশে দেখা গেল জাগুয়ার প্রভৃতি বিড়াল জাতীয় হিংস্র জন্তুর পায়ের চিহ্ন।
রাত্রিতে সবাই যখন নিশ্চিন্ত ঘুমে অচৈতন্য ছিল তাঁবুর ভিতরে, অরণ্য-প্রাচীরের অন্তরালে তখনও তাদের লক্ষ্য করেছে ক্ষুধিত, শাপদের জ্বলন্ত চক্ষু!…
কুইচারা কাজের লোক। চটপট নদী থেকে দুটো মস্ত মস্ত মাছ তারা ধরে ফেললে এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই শেষ হয়ে গেল ব্রেকফাস্ট বা প্রাতরাশ। তারপর নদীর জলে ভাসল ক্যানো- শুরু হল জলযাত্রা।
নোভাকের কাছে জলযাত্রা খুব আরামদায়ক লাগল। নদীর উপর সর্বদাই ছুটছে বাতাস; তাতে গরমের কষ্টও কম আর দুরন্ত বাতাসের মাতামাতি দূর করে দিলে উড়ন্ত পতঙ্গদের- কুইচাদের সঙ্গে যোগ নিয়ে নোভাকও দাঁড় বাইতে শুরু করলে।
সেদিন বিকালবেলা যখন তারা নদীর ধারে বিশ্রাম নেবার জন্য থামল, তখন নোভাক অনুভব করলে অরণ্য এখানে অগভীর এবং গরমও খুব বেশি। তারা তখন বনের মধ্যে প্রায় ২৫ মাইল চলে এসেছে। নোভাক সে রাত্রে তার বই খুলে স্থানীয় অধিবাসীদের কথা পড়তে লাগল। রেড-ইন্ডিয়ানদের মধ্যে কয়েকটা জাতি এই অঞ্চলে বাস করে, তাদের নাম- কুইচা, জিভারো, কোকোমা, মুরাট, অকা প্রভৃতি। শুধু বই পড়ে নোভাক ক্ষান্ত হল না, সে এইসব জাতি সম্বন্ধে মালোকে প্রশ্ন করতে শুরু করলে।
মালোর কাছ থেকে যে ধরনের উত্তর এল, তাতে নোভাক খুব সন্তুষ্ট হতে পারলে না। সে বুঝল রেড-ইন্ডিয়ানদের সমস্ত জাতির শাখা-প্রশাখার সঙ্গে মালোর বিশেষ পরিচয় নেই।
অবশেষে নোভাক প্রশ্ন করলে, এরা কি হিংস্র?
মালো বললে, কে জানে! রেড-ইন্ডিয়ানদের স্বভাব-চরিত্র নিয়ে জোর করে কিছু বলা যায় না। আজ হয়তো তারা শান্ত আবার কাল হয়তো দেখবে সবাই খুনের নেশায় পাগল হয়ে উঠেছে। এদের মধ্যে জিভারোদের সবাই ভয় করে। এখন অবশ্য জিভারোরা শান্ত হয়ে আছে। তবে সবচেয়ে ভয়ংকর হচ্ছে অকা জাতি।
-অকা? তারা অবার কারা?
মালিক, অকা হচ্ছে সবচেয়ে ভয়ানক জাতি। তারা সুযোগ পেলেই নরহত্যা করে। যে জিভারোরা সমস্ত অরণ্যবাসীর আতঙ্ক, তারাও অকাদের যমের মতো ভয় করে। জানো মালিক, কোনো অকা কখনো নরকে যায় না!
–কেন?
–কারণ নরকের রাজা শয়তানও অকাদের ভয় করে।
নোভাক হেসে উঠল।
মালো গম্ভীরভাবে বললে, হেসো না মালিক। কোনো অকার সঙ্গে যদি কখনো তোমার দৃষ্টি বিনিময় ঘটে, তবে সেই মুহূর্তে ধরে নিতে পারো যে তুমি আর বেঁচে নেই। অকা বড়ো ভয়ংকর জাতি।
অকাদের সম্বন্ধে আরও যেসব কাহিনি মালোর মুখ থেকে নোভাকের কর্ণগোচর হল সেগুলো সত্যিই ভয়ানক।
মন্ত্রমুগ্ধের মতো নোভাক শুনতে লাগল সেই রক্তপিপাসু জাতির ভয়াবহ কাহিনি…
অভিযানের চতুর্থ দিনে ক্যানো দুটো উপস্থিত হল একটি গ্রামের কাছে। কিন্তু এ কি দৃশ্য!
নদীর ধারে এখানে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে কতকগুলি দগ্ধ পর্ণকুটিরের ভগ্নাবশেষ, নদীতীরে বালুকাভূমির উপর অবস্থান করছে একাধিক পুরুষের মুণ্ডহীন দেহ এবং ছিন্নস্কন্ধ। মৃতদেহগুলির ক্ষতস্থানে বন বন করে ঘুরছে শবভোজী মক্ষিকার দল- ভয়াবহ দৃশ্য!
কয়েকটি রেড-ইন্ডিয়ান মেয়ে ছুটে এল ক্যানো দুটির কাছে। একজন নোভাকের কাঁধে-ঝোলানো বন্দুকটার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে ক্রন্দন-জড়িত স্বরে চিৎকার করে উঠল। অন্য মেয়েগুলিও কাঁদতে লাগল এবং কথা কইতে লাগল উচ্চৈঃস্বরে। তাদের কথার অর্থ নোভাক বুঝল না, কিন্তু মালোর উদবিগ্ন মুখভঙ্গি দেখে তার ধারণা হল ব্যাপারটা বেশ গুরুতর।
মেয়েটির কথা শেষ হতেই মালো নোভাককে বললে, জিভারো! জিভারোরা হানা দিয়েছে এই গ্রামে তাই ওদের এই দুর্দশা! মেয়েরা বন্দুকটা দেখে খুশি হয়েছে, তারা আশা করছে তুমি জিভারোদের পিছনে তাড়া করবে এবং তাদের শাস্তি দেবে।
–হুম। এটা যদি জিভারোদের কীর্তি হয় তাহলে তাদের শাস্তি হওয়াই উচিত। তুমি কি বল, মালো?
না মালিক, তুমি যেও না। জঙ্গলের মধ্যে তুমি জিভারোদের দেখার আগেই তারা তোমায় দেখতে পাবে। ওই লোকগুলির যা অবস্থা হয়েছে- মালো মুণ্ডহীন দেহগুলির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলে তারপর নোভাকের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল, তোমারও ঠিক ওই অবস্থা হবে।