প্রস্তাবটা লোভনীয়। কিন্তু ইকুয়েডরের বনভূমি অতিশয় বিপদজনক। ফ্রাঙ্ক নোভাক দুঃসাহসী মানুষ, স্বর্ণপ্রসূ তৈলখনির জন্য কোনো বিপদের সম্ভাবনাকে সে গ্রাহ্য করলে না– সে রাজি হয়ে গেল।
প্রেসিডেন্ট বললেন, এটা ডিসেম্বর মাস। সামনেই বড়দিনের উৎসব। উৎসবের দিনগুলো দেশে কাটিয়ে ইচ্ছে করলে তারপরেও তুমি ইকুয়েডর-অভিযান শুরু করতে পারো।
নোভাক জানিয়ে দিলে বড়োদিনের উৎসব নিয়ে সে সময় নষ্ট করতে রাজি নয়, এখনই সে যথাস্থানে যাত্রা করবে শুভস্য শীঘ্রং!
দুদিন পরেই নোভাক আকাশপথে ইকুয়েডরের রাজধানী কুইটোর উদ্দেশে যাত্রা করলে। অকাশপথে উড়ে যেতে যেতে উড়োজাহাজে বসে এবং কুইটোর একটা হোটেলের মধ্যে সে ইকুয়েডর অঞ্চলের বিভিন্ন রেড-ইন্ডিয়ান জাতি সম্পর্কে লিখিত অনেকগুলি বই পড়ে ফেললে। তাছাড়া ইকুয়েডরের ভৌগোলিক বৃত্তান্ত এবং তৈলখনি সম্বন্ধেও সে কয়েকটা বই থেকে নানা রকম জ্ঞাতব্য তথ্য সংগ্রহ করলে। তারপর কুইটো থেকে একটা জিপগাড়ি নিয়ে পূর্ব-আন্দির গড়ানো পার্বত্যভূমির উপর দিয়ে সে গাড়ি ছুটিয়ে দিলে। জিপগাড়ির মধ্যে নানা রকম প্রয়োজনীয় জিনিস নিতে অবশ্য সে ভুল করেনি- এই সব দরকারি জিনিসের মধ্যে ছিল অ্যাট্রোপিন, পেনিসিলিন, শুকনো জমাট খাবার, জরিপের যন্ত্র, তেল দেখবার গিয়ার, ডিনামাইট, তাবুর সাজ-সরঞ্জাম এবং একটা আর্মির বন্দুক ও তিনশ টোটা।
পার্বত্যভূমির নীচে একটা গ্রামে পৌঁছে একজন স্থানীয় পাদরির সাহায্যে সে ছজন কুইচা জাতের রেড-ইন্ডিয়ান মাঝি জোগাড় করে ফেললে। বেশ মোটা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কুইচারা ফ্রাঙ্ক নোভাকের মালপত্র বহন করতে এবং প্রয়োজন হলে জলপথে নৌকা চালাতে রাজি হল। ১৯৫৫ সালে ডিসেম্বরের তিন তারিখে কুইচাদের নিয়ে ফ্রাঙ্ক নোভাক তার অভিযান শুরু করলে।
প্রথম প্রথম ধারাল ম্যাচেটের আঘাতে লতাপাতা কেটে এগিয়ে যেতে ভালোই লাগছিল। নোভাক অবাক হয়ে ভাবছিল জঙ্গল কেটে অভিযান চালাতে অভিযানকারীরা এত অনিচ্ছুক হয় কেন? একটু পরেই তার ভুল ভাঙল। ঘন ঘন ম্যাচেট চার্লিয়ে তার হাত হয়ে গেল অবশ, কিন্তু তার সামনে তখনো দুলছে অসংখ্য লতাপাতার সবুজ যবনিকা!–~
নোভাক ক্লান্ত হয়ে পড়ল। তার সঙ্গী কুইচারা সম্পূর্ণ নির্বিকার। তারা খুব সহজেই জঙ্গল কাটতে কাটতে পথ করে এগিয়ে চলেছে।
শুধু কি লতাপাতার বাধা? অসংখ্য মশা আর উড়ন্ত কীট এসে আক্রমণ করলে তাদের। অস্থির হয়ে উঠল নোভাক; তার হাত মুখ প্রভৃতি যে সব জায়গা পরিচ্ছদের আড়ালে ঢাকা পড়ে নি, সেই সব অনাবৃত স্থান পতঙ্গের দংশনে ফুলে উঠে ভীষণভাবে জ্বালা করতে লাগল। কুইচাদের মুখের ভাব নির্বিকার মশককুলের আক্রমণ অথবা কীট-পতঙ্গের দংশন তারা আমলেই আনলে না।
নোভাক সশ্রদ্ধ দৃষ্টিতে এই খর্বকায় লোকগুলির দিকে তাকাল। কুইচারা মোটেই দীর্ঘ দেহের অধিকারী নয়, কিন্তু তাদের নাতিবৃহৎ পেশিবহুল শরীর যেন লোহা দিয়ে তৈরি। বিশেষ করে তাদের সর্দার মালোর চেহারাটা সত্যিই দেখবার মতত। সঙ্গীদের মত সে-ও খর্বকায়, তবে তার দৈর্ঘ্যের অভাব পূরণ করে দিয়েছে একজোড়া পেশীবহুল স্কন্ধের প্রশস্ত বিস্তার। নোভাক দেখল মালোর ঘর্মসিক্ত শার্টের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে পৃষ্ঠদেশের সর্পিল মাংসপেশী এবং ঘন সারিবদ্ধ বৃক্ষ ও লতাবঝাপের বন্ধনকে ম্যাচেটের আঘাতে কাটতে কাটতে সে এমন সহজভাবে এগিয়ে চলেছে যে মনে হয় লোকটি এতটুকু ক্লান্তিবোধ করছে না। কিন্তু কুইচারা ক্লান্ত না হলেও নোভাকের শরীর এক ঘণ্টার মধ্যেই অবশ হয়ে এল, হাঁপাতে হাঁপাতে সে চেঁচিয়ে উঠল, আর
বাবা, আর নয়। একটু বিশ্রাম নেওয়া দরকার। মালপত্র নামিয়ে সবাই বসে পড়ল। নোভাক প্যাকেট বার করে সিগারেট ধরালে তারপর প্যাকেটটাকে এগিয়ে দিলে কুইচাদের দিকে। কুইচারা এতক্ষণ একটাও কথা বলেনি, নিঃশব্দে পথ চলেছে। এবার তাদের ভাবলেশহীন মুখে ফুটল হাসির রেখা– তারা হঠাৎ হৈ হৈ করে কথা বলতে শুরু করলে। তাদের কাছেই নোভাক শিখল কেমন করে বনের পথে মালপত্র ঘাড়ে করে হাঁটতে হয়। কুইচারা ভাঙা ভাঙা স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলতে পারে খুব সহজেই নোভাক তাদের কথা বুঝতে পারলে।
নোভাক এবার প্রশ্ন করলে, তোমরা এতক্ষণ একটাও কথা বলনি কেন? গ্রামের মধ্যেও তোমাদের মুখে একটাও কথা শুনতে পাইনি!
মালো দন্তবিকশিত করে বললে, মালিক, তোমাকে আগে ঠিক বুঝতে পারিনি। সাদা চামড়ার অনেক লোক আমাদের মানুষ বলে গণ্য করে না, তাদের কাছ আমরা শুধু ভারবহনকারী জানোয়ার মাত্র। তাই তাদের সঙ্গে আমরা কথা বলি না, কেবল চুক্তিমতো কাজ করে যাই। তুমি আমাদের দু-পেয়ে জন্তু মনে করোনি, তাই তোমার সঙ্গে আমরা গল্প করছি, সহজভাবে মন খুলে কথা বলছি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই গল্প বেশ জমে উঠল। প্রভুভৃত্যের নীরস সম্পর্কের বদলে উভয়পক্ষে গড়ে উঠল বন্ধুত্বের মিষ্ট বন্ধন।
মালো বললে, মালিক! কাঁধের মালটাকে বেশি ঝুলিয়ে না দিয়ে খুব উঁচু করে রাখো আর মেয়েমানুষের কাপড় কাঁচার মতো ধপাস ধপাস করে ম্যাচেট না চার্লিয়ে চলবার সময়ে যখন তোমার বাঁ পা মাটিতে পড়বে, ঠিক তখনই লক্ষ্যবস্তুর উপর কোপ হাঁকড়াবে।