গ্রামবাসীরা ক্যানো দুটিকে দেখতে পেল। নদীর তীরে দলে দলে ছুটে এল পুরুষ, নারী, শিশু এবং কুকুর। নোভাক মেয়েদের দিকে এক নজর তাকিয়েই বুঝল দীর্ঘদেহের অধিকারিণী না হলেও এই কৃষ্ণকেশী অর্ধসভ্য জিভারো নারী শ্বেতাঙ্গ সুন্দরীদের চাইতে একটুও কম সুন্দর নয়— নাক-চোখ এবং অধর-ওষ্ঠের এমন নিখুঁত গড়ন ইতিপূর্বে নোভাকের চোখে পড়েনি।
ক্যানো থেকে একটা মোটা দড়ি তীরের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া হল। কয়েকটি মেয়ে বুক জলে নেমে সেই দড়ি শক্ত মুঠিতে চেপে ধরলে। নোভাক দেখলে জিভারো নারী শুধু সুন্দরী নয়, তাদের দেহের শক্তিও অসাধারণ। অবলা হস্তের সবল আকর্ষণে দুটি নৌকাই তীরে এসে ভিড়ল।
নোভাকের মালপত্রগুলি ক্যানো থেকে নামিয়ে ফেলা হল।
দলের সর্দার নোভাকের চুলের মুঠি ধরে টেনে তাকে নৌকো থেকে নামিয়ে আনলে। মেয়েরা তৎক্ষণাৎ ঘিরে ধরলে বন্দিকে লাল চুল তারা কখনো দেখেনি, বন্দি নোভাকের রক্তবর্ণ কেশ তাদের কাছে বিস্ময়ের বস্তু। বন্দি অনুমান করলে জিভারো মেয়েরা বোধ হয় মানুষের চুলে কালো ছাড়া অন্য কোনো রঙ দেখেনি।
বন্দিকে নিয়ে যাওয়া হল একটা কুঁড়ে ঘরের মধ্যে।
ঘরটা প্রায় অন্ধকার, কোনো জানালা নেই শুধু যাতায়াত করার জন্যে আছে একটি চোটো দরজা। সেই দরজা দিয়ে নোভাককে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে জিভারোরা প্রস্থান করলে।
ঘরের চারদিকে একবার নজর বুলিয়ে নোভাক দেখল ঘরের মেঝেটা অতিশয় অপরিষ্কার এবং এখানে সেখানে ছড়িয়েই আছে অনেকগুলি শুষ্ক অস্থি পঞ্জর। তার নাকেও এসে ধাক্কা মারলে একটা বিশ্রী দুর্গন্ধ। অন্য সময় হলে এমন নোংরা পরিবেশের মধ্যে সে হয়তো বমি করে ফেলত কিন্তু এখন সে এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে চাইল না। এমনকী হাড়গুলো মানুষের কি জন্তুর তাও সে পরীক্ষা করলে না কোনোমতে মেঝের খানিকটা জায়গা পরিষ্কার করে সে শুয়ে পড়ল এবং একটু পরেই গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল তার সমগ্ৰ চেতনা…
এইভাবে শুরু হল ফ্রাঙ্ক নোভাকের জীবন জিভারোদের মধ্যে…
.
তৈলখনির সন্ধানে গিয়ে ইকুয়েডরের জঙ্গলে জিভারোদের হাতে নোভাক যখন বন্দি হল তখন তার বয়স ৩৫ বৎসর। বন্দি হওয়ার আগে তার জীবনের অধিকাংশ সময়ই কেটেছে তৈল ব্যবসায়ীদের সাহচর্যে! নোভাকের জন্ম হয়েছিল ওকলাহামা প্রদেশের সাপলা শহরে। তার বাবা পাভেল নোভাক ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ তৈলবিশেষজ্ঞ। তেলের খনিতে কিভাবে ডিনামাইট ব্যবহার করতে হয়, হঠাৎ আগুন ধরে গেলে কি করেই সেই আগুনকে নিভিয়ে ফেলা যায়– এই সব খুঁটিনাটি ব্যাপারে প্যাভেল নোভাকের জ্ঞান ছিল অসীম। মাত্র ১৬ বৎসর বয়সে বাপের কাছে তালিম পেয়ে ফ্রাঙ্ক নোভাক বাপকা বেটা হয়ে উঠল। সেই অল্প বয়সেই সে তৈলখনির ভয়ংকর আগুনকে এত সহজভাবে আয়ত্ত করতে পারত যে সেই অঞ্চলের তৈলবিশারদ দক্ষ মানুষগুলিও তার কৃতিত্বে অবাক হয়ে যেত। শুধু তৈলবিদ্যা আয়ত্ত করেই নোভাক খুশি হয় নি। দ্যপও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে সে ভূবিদ্যা শিখল ভালোভাবে। চার বছর ধরে সৈন্য-বিভাগের ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে সে সমস্ত ইউরোপ ঘুরল। বিভিন্ন অয়েল কোম্পানি বা তৈল-প্রতিষ্ঠানগুলি নোভাককে নিয়ে টানাটানি শুরু করলে। মাটির নীচে কোথায় তৈল লুকিয়ে আছে সে খুব সহজেই তা বলে দিতে পারত– এ বিষয়ে তার যষ্ঠ ইন্দ্রিয় ছিল অতিশয় জাগ্রত।
ভেনিজুয়েলায় একবার তৈল-অভিযানে গিয়ে ফ্রাঙ্ক নোভাক স্থির করলে সে আর চাকরি করবে না। তেল সম্বন্ধে যাদের খুব ভালো অভিজ্ঞতা আছে, সেই সব লোক চাকরি না করেও প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে পারে। এই সব তৈল-বিশেষজ্ঞরা মাস মাস বেতন না নিয়ে কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। চুক্তিবদ্ধ তৈল-বিশেষজ্ঞরা যখন নতুন তৈলখনির সন্ধান পায়, তারা সেই খনির ভার দেয় কোনো তৈল ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানকে। উক্ত প্রতিষ্ঠান হয় তেলের খনির মালিক কিন্তু এই আবিষ্কারের বিনিময়ে তৈল-বিশেষজ্ঞ পায় এককালীন প্রচুর টাকা এবং বিভিন্ন বিষয়ে উপদেশ দেবার জন্য কোম্পানি আবিষ্কারকর্তাকে প্রতি বৎসর লভ্যাংশের কিছু অংশ দিয়ে থাকে। এই অর্থের পরিমাণ সাধারণ মানুষের কাছে প্রায় অবিশ্বাস্য। ফ্রাঙ্ক নোভাক সাধারণ মানুষ নয় নিজের সম্বন্ধে তার বিশ্বাস ছিল অত্যন্ত গভীর। নোভাক ঠিক করলে যে সে আর চাকরি করবে না বরং স্বাধীনভাবে বিভিন্ন স্থানে তৈল-খনির গহ্বরে একবার নিজের ভাগ্যকে যাচাই করে দেখবে।
কারাকাস অঞ্চলে নোভাকের সঙ্গে একটা ছোটো তৈল-প্রতিষ্ঠানের যোগাযোগ হল। প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট জানালেন যদি সে তেলের খনির সন্ধানে ইকুয়েডর অঞ্চলে সম্পূর্ণ এককভাবে যেতে সম্মত হয় তাহলে উক্ত প্রতিষ্ঠান তাকে ২৫,০০০ ডলার দিতে রাজি আছে। টাকার অঙ্কটা অবশ্য খুবই বেশি, কিন্তু একটা বিরাট দল নিয়ে অভিযানে চালাতে গেলে আরও দশগুণ টাকা খরচ হওয়ার সম্ভাবনা, তার উপর যদি অভিযান ব্যর্থ হয় তাহলে তো সমস্ত টাকাটাই জলে গেল। প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট ভাবলেন অত টাকার ঝুঁকি না নিয়ে ২৫,০০০ ডলার দিয়ে নোভাকের মতো অভিজ্ঞ লোককে নিযুক্ত করাই বুদ্ধিমানের কাজ। স্থির হল নোভাক যদি সত্যিই কোনো তৈলখনির সন্ধান পায় তাহলে নির্দিষ্ট পারিশ্রমিক ছাড়া ওই তেলের খনি থেকে যে টাকা লাভ হবে, তার একটা অংশ সে চিরজীবন ভোগ করতে পারবে।