বাঘিনী পরিণত হল হরিণীতে উধ্বশ্বাসে ছুটল সেই নারী এবং তাকে লক্ষ্য করে সর্দারের হাত থেকে ছুটে এল অগ্নিময় কাষ্ঠখণ্ড।
জ্বলন্ত কাঠের টুকরোটা এসে পড়ল রমণীর পায়ের উপর।
মেয়েটি মাটিতে বসে পড়ল, যাতনা-বিকৃত মুখে আহত পায়ের শুশ্রূষায় মন দিলে। মাঝে মাঝে তার গলা থেকে বেরিয়ে আসছিল অস্ফুট আর্তস্বর- নিজের দেহের জ্বলন্ত কাঠের কাষ্ঠ-রসিকতা তার একটুও ভালো লাগেনি…
সকাল হল। জেগে উঠল জিভারোরা।
নোভাক জেগে উঠল না, কারণ সে জেগেই ছিল।
সারারাত তার একটুও ঘুম হয়নি।
যোদ্ধারা সকলেই কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়েছিল, তাই মশারা তাদের উপর বিশেষ উৎপাত করতে পারেনি। কিন্তু নোভাককে কেউ কম্বল দেয়নি, ফলে উপবাসী মশককুলের আক্রমণে তার অবস্থা হয়েছে শোচনীয়। তার উপর হঠাৎ এসেছে বৃষ্টি। প্রহার-জর্জরিত শরীরের উপর অসংখ্য মশকের দংশন এবং ডিসেম্বরের বৃষ্টিসিক্ত রাত্রির হিমশীতল স্পর্শ গ্রহণ করে কোনো মানুষই ঘুমোতে পারে না- নোভাকও পারেনি। নিদ্রাহীন চক্ষু মেলে সারা রাত সে অপেক্ষা করেছে। প্রভাতের আলোর…
জিভাবরা যোদ্ধারা নদী থেকে কয়েকটা মাছ ধরলে। সেই মাছ এবং বনের ফল দিয়ে জিভায়রারা সকাল বেলা উপবাস ভঙ্গ করলে।
নোভাকের ভাগ্যে কিছু জুটল না।
একজন শুধু তৃষ্ণা-নিবারণের জন্য তাকে একপাত্র জল এগিয়ে দিলে।
আহারাদির পর্ব শেষ করে নারী ও পুরুষের সম্মিলিত বাহিনী বন্দির সামনে এসে দাঁড়াল সারিবদ্ধ হয়ে।
নোভাক দেখল তাদের স্থিরদৃষ্টি তার দিকেই নিবদ্ধ। সে ভয় পেল এবং অসুস্থ বোধ করলে—
গত কাল রাত্রিবেলা নোভাক দেখেছিল মাত্র একটা ছিন্নমুণ্ড, আজ সকালে তার ভীত চক্ষু আবিষ্কার করলে আরও তিন-তিনটে নরমুণ্ড!
একটা লোকর হাতে ঝুলছে চামড়ার বন্ধনী।
মুণ্ডগুলোর কান ফুটো করে যে ধরনের ফিতা দিয়ে সেগুলিকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে এই চর্মবন্ধনীটাও ঠিক সেই রকম।
তবে এটার সঙ্গে কোনো নরমুণ্ড ঝুলছে না।
নোভাক মনে মনে ভাবলে ওই চর্মরঙ্গুর ফাঁসটা বোধ হয় তার জন্যেই আনা হয়েছে। খুব সম্ভব একটু পরেই তার ছিন্নমুণ্ডটা ধরা পড়বে ওই চর্মরঙ্কুর আলিঙ্গনে!
সে মনে মনে ঈশ্বরের নাম নিলে এবার তার পালা।
হঠাৎ চিৎকার করে উঠল দলের সর্দার। যে মেয়েটি আগের রাতে বন্দিকে জ্বলন্ত কাষ্ঠের আপ্যায়ন জানিয়েছিল, সে এবার এগিয়ে এসে নোভাকের চুলের মুঠি ধরে মাথাটাকে পিছন দিকে টেনে ধরলে।
সেই অবস্থায় চোখের দৃষ্টিকে নাক বরাবর চার্লিয়ে নোভাক দেখল দলপতির ডান হাতখানা স্যাৎ করে কোমরের দিকে সরে এল–
পরক্ষণেই তার দক্ষিণ হস্তে আবির্ভূত হল একখানা ঝকঝকে ম্যাচেট!
মেয়েটির হাতের সবল আকর্ষণ নোভাকের মাথাটাকে পিছনে ঠেলে রেখেছে– নোভাক বুঝল তার গলদেশকে শাণিত অস্ত্রের সম্মুখে উন্মুক্ত রাখার জন্যই মেয়েটি তার চুল ধরে টানছে।
জীবনে সর্বপ্রথম সে বুঝতে শিখল যে রমণীর করস্পর্শ সব সময় খুব রমণীয় হয় না।
দারুণ আতঙ্কে এক ঝটকা মেরে নোভাক মাথাটাকে মুক্ত করে নিলে। আবার মেয়েটি চেপে ধরলে নোভাকের চুল, আবার ঝাঁকুনি দিলে নোভাক এবং প্রথমবারের মতো দ্বিতীয়বারও নোভাকের মুণ্ড রমণীর কবলমুক্ত হয়ে ঘাড়ের উপর সোজা হয়েই থাকল।
মেয়েটি এবার অন্য উপায় অবলম্বন করলে। বন্দির দুই কাঁধের মাঝখানে হাঁটু লাগিয়ে সে দুহাত দিয়ে বাগিয়ে ধরলে চুলের মুঠি– পরক্ষণেই একটানে সে নোভাকের মাথাটাকে পিছন দিকে টেনে আনলে।
প্রাণপণ শক্তিতে টানাটানি করেও নোভাক এবার তার মাথাটাকে মেয়েটির কবল থেকে ছাড়িয়ে আনতে পারলে না!
অসহায় ভাবে সে সর্দারের দিকে তাকাল।
শাণিত ম্যাচেটটা তখন সর্দারের হাতে বন বন করে ঘুরছে।
হঠাৎ বন্ধ হল ম্যাচেটের ঘন ঘন আন্দোলন- শূন্যে একবার পাক খেয়ে শাণিত অস্ত্র বেগে নেমে এল নোভাকের গলার দিকে।
নোভাক চোখ বুজল। অস্ত্রাঘাতের প্রতীক্ষায় কেটে গেল কয়েকটা নীরব মুহূর্ত… ঠান্ডা বাতাসের আভাস এসে লাগল তার গালে। নেভাক চোখ খুলল না।
চোখ বুজেই মনে মনে ভাবলে মুণ্ডুটা বোধ হয় এতক্ষণ স্কন্ধচ্যুত হয়েছে- আকস্মিক আঘাতে সে যাতনাবোধের সময় পায়নি।
আরও কিছুক্ষণ কাটল, নোভাক কোনো যন্ত্রণা অনুভব করলে না।
ভয়ে ভয়ে সে চোখ খুলে ফেললে।
সর্দার হাসছে। হাসছে জিভারো-যোদ্ধারা। হাসছে মেয়েরা।
নোভাক বুঝল এটা হচ্ছে ঠাট্টা। প্রাণরক্ষার আনন্দে সেও হেসে ফেললে বোকার মতো।
একটা ব্যাপারে সে নিশ্চিন্ত হল– তার মুণ্ডটা অন্তত আজকের মতো দেহের উপরেই। অবস্থান করবে।
একটু পরে জিভারোরা ক্যানোতে উঠল।
দুখানা ক্যানো নৌকো। একখানায় শুধু পুরুষ, আর একটিতে রয়েছে মেয়েরা। নোভাক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে দেখল পুরুষদের ক্যানোতেই তার স্থান নির্দিষ্ট হয়েছে। পূর্বরাত্রের অভিজ্ঞতা থেকে সে বুঝতে পেরেছিল জিভারো-রমণীরা সুন্দরী বটে কিন্তু স্বভাবে তারা অত্যন্ত নিষ্ঠুর। জিভারো পুরুষ নরহত্যা করলেও অকারণ নিষ্ঠুরতা পছন্দ করে না।
নদীর বাঁক ধরে বৈঠার আঘাতে দুখানা ক্যানো এগিয়ে চলল…
২. জিভারোদের গ্রাম
প্রায় ঘণ্টা পাঁচেক পরে নোভাকের চোখে পড়ল একখানা গ্রাম। এই প্রথম সে জিভারোদের গ্রাম দেখতে পেল
ঘরবাড়িগুলি কাঠের তৈরি, মাথার উপর শুষ্ক লতাপাতার আচ্ছাদন। কুটিরগুলোর চারপাশে বড়ো বড়ো কাঠের খুঁটি দিয়ে বেড়া দেওয়া হয়েছে। বেড়ার খুঁটিগুলোর মধ্যে একটু বৈশিষ্ট্য আছে– খুঁটিগুলো মাথার দিকে বর্শার মতো চোখা। দূর থেকে মনে হয় অনেকগুলি অতিস্থূল কাষ্ঠনির্মিত বল্লম কুটিরগুলিকে ঘিরে পাহারা দিচ্ছে।