এতক্ষণ পরে নোভাক হল নিরস্ত্র।
ক্ষোভে, ক্রোধে সে চিৎকার করে উঠল।
অন্ধকারে আন্দাজ করে একমুঠো বালি নিয়ে নোভাক শত্রুর উদ্দেশ্যে ছুড়ল। তার আশা ছিল চোখে বালি লেগে হয়তো আততায়ীর দৃষ্টি অন্ধ হয়ে যেতে পারে।
সে রকম কিছু ঘটল না।
পাথরের বিপরীত দিকে থেকে অস্পষ্ট চাঁদের আলোতে নোভাকের চোখের সামনে আবির্ভূত হল এক মনুষ্য-মূর্তি- জিভারো!
বিদ্যুৎবেগে লোকটার উদর লক্ষ্য করে নোভাক লাথি ছুড়ল।
আর্তধ্বনি তুলে জিভারো ধরাশায়ী হল আর লম্বমান দেহের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল নোভাক। মাটির উপর গড়াগড়ি খেয়ে দুই শত্ৰু পরস্পরকে আঘাত করতে লাগল দারুণ আক্রোশে।
অকস্মাৎ ভূমিপৃষ্ঠে জাগল ঘন ঘন পদশব্দ।
সচমকে নোভাক দেখল অন্ধকারের মধ্যে আরও-অন্ধকার অনেকগুলি ছায়ামূর্তি তাদের দিকে ছুটে আসছে।
একটা মুগুর শূন্যে দুলে উঠল- নোভাক চেষ্টা করেও আত্মরক্ষা করতে পারলে না, ঠকাস করে মুগুরটা এসে পড়ল তার দেহের উপর। পরমুহূর্তেই অনেকগুলো লোক একসঙ্গে তাকে আক্রমণ করলে।
বৃষ্টির মতো নোভাকের সর্বাঙ্গে পড়তে লাগল ঘুসি এবং লাথি। এমনি দারুণ মার খেলে অধিকাংশ লোকই জ্ঞান হারিয়ে ফেলত, কিন্তু নোভাক পোড়-খাওয়া মানুষ– সমস্ত শরীরটাকে গোল করে পাকিয়ে সে মাটির উপর শুয়ে পড়ল এবং নিঃশব্দে সহ্য করতে লাগল সেই অমানুষিক প্রহার…
নোভাকের দুই হাত বেঁধে ফেলা হল।
দুজন জিভারো-যোদ্ধা শুকনো ডালপালা এনে তাতে অগ্নিসংযোগ করলে। অন্ধকারের গর্ভে যাদের দেহগুলি এতক্ষণ প্রায়-অদৃশ্য ছিল, আগুনের আভায় এবার তারা নোভাকের দৃষ্টিপথে ধরা দিলে।
চারপাশের মানুষগুলোর উপর নোভাক দৃষ্টিনিক্ষেপ করলে
অনেকগুলো অর্ধনগ্ন বলিষ্ঠ মানুষ, কারও হাতে ব্লো-গান আবার কেউ বা বল্লমধারী। অস্পষ্ট আলোতেও বোঝা গেল তাদের চুল কুচকুচে কালো এবং সকলেই দস্তুরমতো সুপুরুষ।
শুধু পুরুষ নয়–জিভারো যোদ্ধাদের সঙ্গে রয়েছে নারীবাহিনী। পুরুষদের মতো মেয়েদের পোশাক-পরিচ্ছদও খুব স্বল্প। অগ্নিকুণ্ড থেকে রক্তাভ আলোকধারা ছড়িয়ে পড়ছে মেয়েদের শরীরের উপর।
আলোছায়ার খেলায় নেচে নেচে উঠছে কয়েকটা ভুতুড়ে ছায়া তাদের সুগঠিত দেহের অঙ্গে অঙ্গে..
নোভাক লক্ষ করলে নারীবাহিনীর প্রত্যেকটি মেয়ে তাকিয়ে আছে তারই দিকে! পুরুষ-যোদ্ধারা তখন নোভাকের মালপত্র নিয়ে টানাটানি শুরু করেছে। যোদ্ধাদের ভিতর থেকে হঠাৎ একটি লোক নোভাকের দিকে এগিয়ে এল। লোকটিকে দেখে নোভাক বুঝল সে একজন ছোটোখাটো সর্দার।
নোভাকের বন্দুকটা তখন সেই সর্দারের পিঠে ঝুলছে। তার চলাফেরার ধরন দেখে মনে হয় বন্দুকের অধিকারী হয়ে সে বিশেষ গর্ববোধ করছে। আরও একটা বৈশিষ্ট্য নোভাকের চোখে পড়েছিল সর্দারের হাত থেকে ঝুলছে দড়িতে বাঁধা একটা তরমুজ।
লোকটা হঠাৎ আগুনের খুব কাছে এসে দাঁড়াল।
সঙ্গেসঙ্গে আঁতকে উঠল নোভাক, তার কণ্ঠভেদ করে বেরিয়ে এল অস্ফুট আর্তধ্বনি!
লোকটির হাতে দড়ি বাঁধা ওটা তরমুজ নয়
অগ্নিকুণ্ডের রক্তিম আলোকে স্পষ্টই হয়ে উঠেছে একটা ছিন্ন নরমুণ্ড! মুণ্ডটার দুই কান ফুটো করে তার ভিতর দিয়ে গলিয়ে দেওয়া হয়েছে একটা সরু চামড়ার ফালি এবং সেই চর্মরঙ্কুর বন্ধনে আবদ্ধ নরমুণ্ডটা সর্দারের হাতে দুলে দুলে উঠছে!
নোভাক অনুমান করলে কুইচাদের সঙ্গে আসার পথে গ্রামের ভিতর যে-সব মুণ্ডহীন দেহ তারা দেখেছে, এই মুণ্ডটা নিশ্চয় তাদের মধ্যেই কোনো হতভাগ্যের শরীর থেকে কেটে নেওয়া হয়েছে।
নোভাকের সর্বাঙ্গে একটা অসুস্থ অনুভূতি পাক দিয়ে উঠল, তিক্তস্বাদে কটু হয়ে উঠল তার কণ্ঠনালী– পরক্ষণেই সে বমি করে ফেললে!
নারী পুরুষের সম্মিলিত জনতা বন্দিকে লক্ষ করে পৈশাচিক উল্লাসে চিৎকার করে উঠল, ত সানটা! ত সানটা!
নোভাক আবার শিউরে উঠল।
রেড-ইন্ডিয়ানদের ভাষা সে কিছু কিছু বোঝে।
ত, সানটা মানে হল শুষ্ক নরমুণ্ড!
জিভারোরা বাক্সের ভিতর থেকে জিনিসপত্র নামিয়ে এনেছিল, সেগুলোকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনেকরকম করে পরীক্ষা করলে, তারপর আবার মালপত্রগুলিকে যথাস্থানে গুছিয়ে রাখতে লাগল।
নোভাক বুঝল, জিভারোদের স্বভাব-চরিত্র হিংস্র হলেও তারা বেশ শৃঙ্খলা-প্রিয় জাতি।
হঠাৎ একটি মেয়ে এগিয়ে এল নোভাকের দিকে।
কিছুক্ষণ তার চোখে চোখ রেখে সে ফিরে গেল অগ্নিকুণ্ডের কাছে এবং একখানা জ্বলন্ত কাঠ নিয়ে আবার নোভাকের সামনে এসে দাঁড়াল।
তার চোখের দিকে তাকিয়ে নোভাকের মনে হল, মেয়েটি দেখতে অপূর্ব সুন্দরী হলেও কিন্তু তার উদ্দেশ্য খুব সুন্দর নয়।
নোভাকের সন্দেহ সম্পূর্ণ সত্য মেয়েটা হঠাৎ জ্বলন্ত কাঠ দিয়েই তার বুকে মারলে এক খোঁচা!
নোভাকের হাত-পা বাঁধা। সেই অবস্থাতেই সে কোনোরকমে পশ্চাদদেশে ভর দিয়ে পিছিয়ে গেল এবং রজ্জবদ্ধ হাত তুলে জ্বলন্ত কাঠটাকে ছিটকে ফেলে দেবার চেষ্টা করলে।
তার চেষ্টা সফল হল না মেয়েটি হেসে উঠল, জ্বলন্ত কাঠটা আবার এসে পড়ল নোভাকের বুকে।
যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল নোভাক।
জিভারো রমণীদের মুখ দেখে মনে হল তারা বেশ আনন্দ উপভোগ করছে। কিন্তু জিভারো দলপতি এই নিষ্ঠুর খেলা পছন্দ করলে না।
নোভাকের চিৎকারে আকৃষ্ট হয়ে যোদ্ধারা ছুটে এল।
জিভারোদের সর্দার নোভাকের নির্যাতনকারিণীর মুখের উপর করলে এক দারুণ চপেটাঘাত। মেয়েটি ভয়ে কুঁকড়ে গেল, তার হাত থেকে খসে পড়ল জ্বলন্ত কাষ্ঠখণ্ড। সর্দার কাঠটা তুলে নিয়ে মেয়েটির দেহে আঘাত করতে উদ্যত হল।