–গাছের গুঁড়িটাকে বিদ্ধ করে কেঁপে কেঁপে উঠছে একঝাক তির!
নোভাকের অভিজ্ঞ চক্ষু একনজরেই বুঝল যে তিরগুলো সাধারণ ধনুকের সাহায্যে নিক্ষেপ করা হয়নি। এগুলো ছোঁড়া হয়েছে ব্লো-গান নামক মারাত্মক যন্ত্র থেকে।
ব্লো-গান বা ব্লো-পাইপ এক ধরনের ফাপা নল। এই নলের মধ্যে তির বসিয়ে সজোরে ঠু দিয়ে রেড-ইন্ডিয়ানরা তিরকে লক্ষ্যপথে চালনা করে। এতক্ষণে নোভাকের জ্ঞান-চক্ষু উন্মীলিত হল
কুইচা দলপতি মালো তাকে মিথ্যা কথা বলে ভয় দেখাবার চেষ্টা করেনি! তিরগুলো যে জিভারো-যোদ্ধাদের ব্লো-গান থেকে উড়ে এসেছে এ বিষয়ে নোভাকের একটুও সন্দেহ রইল না।
তবে জিভারো হোক আর যাই হোক বিনাযুদ্ধে মৃত্যুবরণ করার মানুষ ফ্রাঙ্ক নোভাক নয়
তাবুর ভিতর থেকে বন্দুকটাকে হস্তগত করে সে প্রস্তুত হল।
শু-শু-শুট ট!
আবার ছুটে এল একঝাক তির তাবুর ক্যানভাস ভেদ করে! একটা তির তত আর-একটু হলে তার হাতে লাগত
তিরের চকচকে ফলাটা নোভাকের আঙুল ঘেঁসে মাটিতে কামড় বসাল!
নাঃ! এখানে থাকলে মৃত্যু অনিবার্য! বন্দুক বাগিয়ে ধরে সে নীচু হয়ে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে চলল নদীর দিকে, আর একটু পরেই জঙ্গল আর নদীর মাঝখানে একটা মস্ত পাথরের আড়ালে আত্মগোপন করলে…
অনেকক্ষণ কেটে গেল। নোভাক অপেক্ষা করছে…।
কোথায় কি? জঙ্গলের আড়াল থেকে কোনো সশস্ত্র জিভারো তার দিকে তেড়ে এল না, এমনকী তিরের ছুটোছুটিও হঠাৎ হয়ে গেল বন্ধ।
কিন্তু নোভাক জানত শত্রুপক্ষ আশেপাশে ওত পেতে আছে। সুযোগ পেলেইতির ছুঁড়ে তারা শিকারের প্রাণবধ করবে। শক্ত মুঠিতে বন্দুক বাগিয়ে ধরে সে পাথরের আড়ালে লুকিয়ে রইল…
অনেকক্ষণ পরে খুব সাবধানে একটুখানি মুখ বাড়িয়ে সে একবার চারদিকে দৃষ্টিপাত করার চেষ্টা করেছিল তৎক্ষণাৎ মারাত্মক অভ্যর্থনা জানিয়ে তার দিকে ছুটে এল একঝাক তির!
নোভাক চট করে মাথাটাকে আবার পাথরের আড়ালে টেনে নিলে। এতক্ষণ পরে তার মনে হল মালোর কথা শুনে তার সঙ্গে ফিরে গেলে ভালোই হত; কিন্তু এখন আর অনুতাপ করে লাভ নেই…
সময় এগিয়ে চলেছে।
সকালের সোনালি আলোর পরিবর্তে আকাশে জ্বলছে মধ্যাহ্নসূর্যের রুদ্র দীপ্তি।
ঝলসে যাচ্ছে নোভাকের সর্বাঙ্গ অসহ্য উত্তাপে। কিন্তু স্থান ত্যাগ করে জঙ্গলের ছায়ায় আশ্রয় নেবার উপায় নেই, চতুর্দিকে শরীরী মৃত্যুর মতো হানা দিয়ে বসে আছে জিভাবো-যোদ্ধার দল। সূর্যদেবের জ্বলন্ত আশীবাদ থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য নোভাক তার শার্ট খুলে মাথাটা ঢেকে ফেলল। সঙ্গেসঙ্গে শুরু হল নতুন উপদ্রব!
ঝাঁকে ঝাঁকে পোকা এসে তার দেহের উপর বসল এবং অনাবৃত ঊ-অঙ্গের নানা জায়গায় হুল ফুটিয়ে রক্তপান করতে লাগল মনের আনন্দে।
অসহ্য যাতনায় সে বালির উপর গড়াগড়ি দিতে শুরু করলে…
পতঙ্গকুলের দংশনে ইতিমধ্যেই নোভাকের দেহ ক্ষতবিক্ষত হয়ে উঠেছে- ক্ষতস্থানগুলি তপ্ত বালুকার স্পর্শে জ্বালা করতে লাগল ভীষণভাবে। তবে একটা উপকার হল। ঘামে-ভেজা দেহের সঙ্গে বালি জড়িয়ে সর্বশরীরে পড়ল বালুকণার নিবিড় প্রলেপ। অজস্র বালুকণার ঘন আবরণ ভেদ করে কীটপতঙ্গরা আর নোভাকের দেহে কামড় বসাতে পারলে না…।
অপেক্ষা করছে নোভাক জিভারোদের জন্য আর জিভাষোরা অপেক্ষা করছে নোভাকের জন্য। দু-পক্ষই জানে যার ধৈর্য বেশি সেই জিতবে।
কিছুক্ষণ পরেই নোভাকের অবস্থা হল শোচনীয়। সে শুয়ে আছে উন্মুক্ত আকাশের নীচে, তার মাথার উপর আগুন ছড়িয়ে হাসছে ইকুয়েডরের মধ্যাহ্ন-সূর্য, কিন্তু জিভাবোরা দাঁড়িয়ে আছে। বনের শীতল ছায়ায়।
একটু পরেই নোভাক পিপাসা বোধ করলে।
ক্রমে ক্রমে অসহ্য হয়ে উঠল তৃষ্ণার যন্ত্রণা।
জলের জন্য তার প্রাণ ছটফট করতে লাগল।
একটু দূরেই নদীর জল, কিন্তু সেখানে গিয়ে তৃষ্ণা নিবারণের উপায় নেই- অরণ্যের অন্তরালে সুযোগের অপেক্ষায় ব্লো-গান বাগিয়ে বসে আছে জিভারো যোদ্ধার দল…
মাটির উপর গাছের ছায়া হল দীর্ঘতর।
আকাশের জ্বলন্ত নীলিমার উপর পড়ল ধূসর অন্ধকারের শীতল প্রলেপ এল সন্ধ্যা।
নোভাকের রৌদ্রদগ্ধ অঙ্গ জুড়িয়ে গেল, কিন্তু সে খুশি হতে পারলে না। জিভারোদের উদ্দেশ্য বুঝতে তার অসুবিধা হয়নি। রাতের অপেক্ষায় বসে আছে জিভারো-যোদ্ধারা। নিবিড় অন্ধকার যখন দৃষ্টিকে করে দেবে অন্ধ, তখনই তারা করবে আক্রমণ।
সব বুঝেও কিছু করার উপায় ছিল না।
সতর্ক ভঙ্গিতে বন্দুকটা চেপে ধরে অর্ধ-শায়িত অবস্থায় সে পাহারা দিতে লাগল…
রৌদ্রদগ্ধ দেহের উপর লাগছে নৈশ-সমীরের স্নিগ্ধ স্পর্শ, গভীর অবসাদে বুজে বুজে আসছে নোভাকের চোখের পাতা। হঠাৎ ডান দিক থেকে ভেসে এল একটা অস্ফুট শব্দ আর সঙ্গেসঙ্গে তার চোখ থেকে পালিয়ে গেল তন্দ্রার আমেজ–
আঙুলের রূঢ় স্পর্শে শব্দ লক্ষ্য করে সগর্জনে অগ্নিবৃষ্টি করলে নোভাকের বন্দুক! আগুনের চকিত ঝলকে এক মুহূর্তের জন্য তার চোখে ধরা পড়ল একটা চতুষ্পদ মূর্তি- শূকর!
জন্তুটা নদীর জলে তৃষ্ণা নিবারণ করতে এসেছিল, তার জলপানের চকচক শব্দেই ঝিমুনি ভেঙে জেগে উঠেছিল নোভাক।
আবার শব্দ হল। এবার বাঁ-দিক থেকে।
নোভাক তাড়াতাড়ি সেদিকে ঘুরল আর হঠাৎ উঁচু পাথরের আড়াল থেকে একটা অদৃশ্য হাত তার বন্দুকের নলটাকে ধরে ফেললে
পরক্ষণেই প্রচণ্ড আকর্ষণে নোভাকের হাতের বন্দুক অন্ধকারের গর্ভে মিলিয়ে গেল।