অসহ্য গরম আর অবসাদে তার চোখের পাতা ফুলে উঠল, বার বার বুজে এল তার দুই চোখ তবু নোভাক একবারও বিশ্রাম নেবার জন্যে থামল না। দুবার তার দৃষ্টিবিভ্রম ঘটল, দুদুবার তার চোখের সামনে ভেসে উঠল মরীচিকা!
প্রথমবার সে দেখলে শিশুক্রোড়ে একটি নারী এগিয়ে চলেছে।
নোভাক চিৎকার করে তাকে আহ্বান জানালে আর সঙ্গেসঙ্গে নারীমূর্তি অদৃশ্য হয়ে গেল!
দ্বিতীয় বার সে দেখলে হলুদ চামড়ার পোশাকে সজ্জিত হয়ে একটি লোক হাঁটছে, তার পিঠে বাঁধা আছে একটা মস্ত বড়ো কড মাছ!
এবার আর নোভাক মরীচিৎকার মায়ায় বিভ্রান্ত হল না, মাথা নীচু করে সে লোকটির পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল– এমনকী একবার পিছন ফিরে সে মৎস্যের অধিকারীকে দেখার চেষ্টাও করলে না।
…সন্ধ্যার ধূসর অরণ্যকে লুপ্ত করে নেমে এল কৃষ্ণা রজনীর যবনিকা… পথের উপর বসে পড়ল নোভাক, তার শুষ্ক কণ্ঠভেদ করে বেরিয়ে এল অবরুদ্ধ ক্রন্দনধ্বনি– দূরে উপনিবেশের কুটিরগুলিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে কাঁটাতারের পাহারা, বাতায়ন পথে ছড়িয়ে পড়েছে আলোর উজ্জ্বল ইশারা— অন্ধকার রাত্রির বুকে!
মুক্তির আনন্দে অনেকক্ষণ ধরে সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল, তারপর কাঁধের বোঝাটাকে ছুঁড়ে ফেলে সে ছুটে গেল কাঁটাতারের বেড়ার দিকে, সোল্লাসে চিৎকার করে উঠল, এই! এই! এদিকে এস।
চটপট নিভে গেল সবগুলি আলো, অন্ধকার কুটিরের দ্বারে দ্বারে আবির্ভূত হল কয়েকটা চলন্ত ছায়ামূর্তি!
এই! এই! এদিকে! আবার চেঁচিয়ে উঠল নোভাক। সঙ্গেসঙ্গে অন্ধকারের গর্ভে এখানে-সেখানে জ্বলে উঠল কয়েকটা চকিত অগ্নিশিখা– ডান দিকের কাঁধে একটা অসহ্য যন্ত্রণা বোধ করলে নোভাক, ছিটকে মাটিতে পড়ে যেতে সে শুনতে পেল যান্ত্রিক কণ্ঠের কর্কশ গর্জন!
আঃ! সে রুদ্ধস্বরে আর্তনাদ করে উঠল, ওরা আমায় গুলি করল!
নোভাক বুঝতে পারলে ধীরে ধীরে তার জ্ঞান লুপ্ত হয়ে আসছে, ভগ্নকণ্ঠে সে একবার বললে, আমাকে গুলি করছ কেন?
তারপরই তার মাথাটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
কাঁটা তারের বেড়ার ভিতর দিয়ে খুব সাবধানে কয়েকজন বন্দুকধারী বাইরে বেরিয়ে এল। বন্দুকের নল দিয়ে খোঁচা মেরে মেরে তারা নোভাকের শরীরটাকে পরীক্ষা করতে লাগল। হঠাৎ একজন চিৎকার করে বললে, আরে! আরে! এ যে সাদা চামড়ার মানুষ!
তৎক্ষণাৎ অনেকগুলি মনুষ্যমুর্তি তার উপর ঝুঁকে পড়ল।
রক্তাক্ত শার্টটা খুলে নিয়ে কয়েকটা হাত সেই জামাটা দিয়েই তার রক্ত মুছিয়ে দিতে শুরু করলে।
মাফ করো, একটা কণ্ঠস্বর নোভাকের কানে এল, আমরা ঠিক বুঝতে পারিনি। আমরা তোমাকে অন্ধকারে অকা-যোদ্ধা বলে ভুল করেছিলুম। অকাদের ভয়ে আমাদের মাথার ঠিক নেই।
হ্যাঁ, অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আগে নোভাক শুধু একটা কথাই বলতে পেরেছিল, আমি জানি। অকাদের আমি জানি।
ওই কথাটা বলেই নোভাক অচৈতন্য হয়ে পড়েছিল…
উপনিবেশের মানুষগুলির সেবা-যত্নে কিছুদিনের মধ্যেই নোভাক সুস্থ হয়ে উঠল। যে উড়োজাহাজটাকে বিধ্বস্ত অবস্থায় সে দেখেছিল তার ইতিহাসও সে জানতে পারলে। কয়েকজন পাদরি ওই বিমানে চড়ে অকাদের দেশে গিয়েছিলেন। তাঁরা নিজেদের প্রাণ বিপন্ন করেও অকাদের মধ্যে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের চেষ্টা করেন।
অকারা প্রথম কয়েকদিন কিছু বলেনি কিন্তু পরে তারা সবাইকে হত্যা করে। বিমানটিকেও তারা ধ্বংস করে দেয়। পরে একদল সৈন্য বিমানপথে ঘটনাস্থলে যায় এবং হতভাগ্য ধর্মপ্রচারকদের মৃতদেহগুলিকে কবরস্থ করে। পাছে তাদের উপর শ্বেতাঙ্গরা আক্রমণ চালায় সেই ভয়ে অকারা গ্রাম ছেড়ে আরও দক্ষিণ দিকে সরে যায়। কিন্তু রাতের অন্ধকারে তারা হানা দিতে শুরু করলে উপনিবেশের উপর সন্ত্রান্ত নাগরিকরা তাই সর্বদা আগ্নেয়াস্ত্র হাতে পাহারা দিতে লাগল। এই সঙ্গীন মুহূর্তেই নোভাক এসে পড়েছিল উপনিবেশে আর তাই তার এই দুর্দশা…
কয়েকদিন বিশ্রাম নিয়ে নোভাক আকাশ পথে উড়ল। উপনিবেশের বিমানবন্দর থেকে একখানা বিমান তাকে পৌঁছে দিলে সেই কুইটো শহরে– যেখান থেকে সে প্রথম যাত্রা শুরু করেছিল।
সভ্য জগতের সংস্পর্শে এসে নোভাক নিঃশ্বাস ছেড়ে বাঁচল।
বিগত কয়েকটা মাস যেন কেটে গেছে এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মতো। তবু অনেক দুঃখের মধ্যেও একটু সুখ, অনেক গরলের সঙ্গে একটু অমৃতের স্বাদও ছিল–
রক্তারক্তি, হানাহানি, ছিন্ন নরমুণ্ডের বীভৎস উৎসব আর তৈল অভিযানের ব্যর্থতা ছাপিয়েও একটুখানি আনন্দের স্মৃতি নোভাকের মনে দাগ কেটেছিল, একটি অস্পষ্ট নারীমূর্তি বারংবার এসে দাঁড়িয়েছিল তার স্মৃতির মণিকোঠায় ম্যাকানি, তার জিভারো বউ!