গাছের আড়াল ছেড়ে নোভাক ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল।
তার পথরোধ করে দাঁড়িয়েছিল অনেকগুলি লতার বেড়াজাল। সেই ঘন সন্নিবিষ্ট লতার বন্ধন ভেদ করে নোভাক ছুটবার চেষ্টা করলে এবং পরক্ষণেই তার ধীর্ঘ দেহ সশব্দে আছড়ে পড়ল একটা কর্দমাক্ত জলাশয়ের মধ্যে!
কোমর পর্যন্ত জলে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে নোভাক নিজের অবস্থা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলে চারদিকে কর্দমাক্ত জল, আর সেই ঘোলাটে জলের ভিতর এখানে-ওখানে শিকড়বাকড় তুলে দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলি গাছ। বন্দুকটাকে বুক অবধি তুলে ধরলে নোভাক অস্ত্রটা জলে ভিজে অকেজো হয়ে গেলেই সর্বনাশ!…
কাঁধের বোঝাটা তার মাংসপেশীতে কেটে কেটে বসছে।
জলের মধ্যে তার দেহকে আক্রমণ করেছে রক্তপিপাসু জোঁকের দল, আর বোঁ বোঁ শব্দে রণ-সঙ্গীত গাইতে গাইতে তার মাথার উপর উড়ে এল ঝাঁকে ঝাঁকে মশা নোভাকের সর্বাঙ্গ ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল জোঁক ও মশকের মিলিত আক্রমণে!
এইভাবে পদে পদে মৃত্যু-যাতনা সহ্য করার চাইতে যুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া অনেক ভালো- দাঁতে দাঁত দিয়ে নোভাক শত্রুর জন্য অপেক্ষা করতে লাগল…
তারা এল।
নোভাক শুনতে পেল লতার বন্ধন-জাল ভেদ করে তারা সশব্দে আসছে।
ডোবার মধ্যে একটা মরা গাছের গুঁড়ি পড়েছিল।
নোভাক সেই গাছটার উপর আশ্রয় নিলে…
একটু পরেই রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হল তিনজন অকা-যোদ্ধা। হাতের তিরধনুক বাগিয়ে তারা জলে নেমে পড়ল। বদ্ধ জলাশয়ের বুকে সশব্দ আলোড়ন তুলে তিনটি হিংস্র মানব-মূর্তি এগিয়ে এল নোভাকের দিকে।
আক্রমণকারীরা যখন প্রায় দশ গজ দূরে আছে তখন গর্জে উঠল নোভাকের বন্দুক। একজন অকা তৎক্ষণাৎ মারা পড়ল কিন্তু ফলাফল দেখার জন্য নোভাক একটুও অপেক্ষা করলে না, চট করে ঝাঁপ দিলে জলের বুকে গাছের গুঁড়িটার গায়ে আরও অসংখ্য শিকড়বাকড়ের আড়ালে যথাসম্ভব গা-ঢাকা দিয়ে সে চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে।
একটু আগে নোভাক যেখানে ছিল ঠিক সেই জায়গাটায় গাছের গুঁড়িটাকে বিদ্ধ করে কেঁপে কেঁপে উঠছে একজোড়া তির!
সঙ্গীর মৃত্যুতে যোদ্ধা দুজন একটুও ভয় পায়নি, তারা আবার ধনুকের ছিলায় তির বসিয়ে নিলে।
আবার গর্জে উঠল আগ্নেয়াস্ত্র পর পর দুবার। ধনুকধারী দুই অকা-যযাদ্ধার প্রাণহীন দেহ লুটিয়ে পড়ল জলার মধ্যে। একজনের ধনুক থেকে জ্যা-মুক্ত তিরে ছুটে গেল উপর দিকে, অদৃশ্য হয় গেল অসংখ্য বৃক্ষশাখা ও পত্রপল্লবের অন্তরালে…।
নোভাক বৃক্ষ কাণ্ডের আশ্রয় ত্যাগ করলে না– তার তিন শত্ৰু নিহত কিন্তু এখনও সে নিরাপদ নয়।
ক্যানোর কাছে নদীর ধারে আর একজন অকা-যোদ্ধার কথা সে ভোলেনি।
একটু পরে বদ্ধ জলাশয়ের এক প্রান্তে অনেকগুলো লতাপাতার ফাঁকে ফাঁকে একখানা মুখ দেখা দিলে চার নম্বর শত্রু।
নোভাক গুলি ছুড়ল– উপরি-উপরি দুবার অগ্নি-উদগার করলে তার বন্দুক।
অকা-যোদ্ধার গুলিবিদ্ধ শরীরটা ঝুঁকে পড়ল জলের উপর কিন্তু অজস্র লতার কঠিন আলিঙ্গন ভেদ করে মৃতদেহটা জলাশয়ের বক্ষ স্পর্শ করতে পারলে না উদ্ভিদের নাগপাশ তার প্রাণহীন শরীরকে শূন্যে ঝুলিয়ে রাখল।
নোভাক গাছের গুঁড়িটার উপর মাথা রেখে চোখ বুজে ফেললে। জলসিক্ত দেহে মশা আর জোঁকের আক্রমণের মুখেই সে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করলে তীব্র উত্তেজনায় তার স্নায়ুগুলি অবশ হয়ে পড়েছিল…
সশব্দে জল ভেঙে নোভাক ডাঙায় উঠল এবং অকাদের বেওয়ারিশ ক্যানোটাতে কাঁধের মালপত্র চাপিয়ে উঠে বসল। আশেপাশে যদি কোনো অকা যোদ্ধা লুকিয়ে থাকে তবে ফাঁকা নদীর বুকে তার শরীটা যে চমৎকার তিরের নিশানায় পরিণত হবে একথা বুঝতে নোভাকের মোটেই অসুবিধা হয়নি। কিন্তু ক্লান্তিতে আর উত্তেজনায় তার শরীর তখন ভেঙে পড়ছে, অকাদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলার ধৈর্য তার ছিল না বন্দুকটাকে তৈরি রেখে আন্দি পাহাড়ের নীচে অবস্থিত পার্বত্যভূমির দিকে সে দ্রুত নৌকা চালনা করলে…
কয়েকঘণ্টা ধরে একটুও না থেমে সে ক্যানো চার্লিয়ে গেল। মাঝে মাঝে দারুণ ক্লান্তি আর অবসাদে তার দুই চোখের পাতা ভারি হয়ে এসেছে তবু সে ঘুমায়নি– অবিরাম অবিরত নৌকা চার্লিয়েছে, এই অরণ্য-আবৃত সবুজ মৃত্যুপুরী থেকে যত তাড়াতাড়ি সরে পড়া যায় ততই মঙ্গল। সারা রাত্রি ধরে সকাল পর্যন্ত সে প্রাণপণে বৈঠা চালাল তারপর আর পারলে না– বিকালবেলার দিকে সে ক্যানোটাকে নদীর তিরে ভিড়িয়ে দিলে।
অমানুষিক পরিশ্রমে তার হাত দুখানা তখন থর থর করে কাঁপছে।
নদীর ধারে ঘাস জমির উপর ক্যানোটাকে তুলে রেখে সে তার মালপত্রের বোঝা সমেত বন্দুকটাকে নিয়ে ধরাশয্যায় শুয়ে পড়ল এবং সেই অবস্থায় গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল…
কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়ে সে যখন জেগে উঠল তখন আঁটার জল সরে গিয়ে আবার নদীতে জোয়ার এসেছে। চারদিকে ব্যগ্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করেও নোভাক ক্যানোটাকে দেখতে পেল না– সে বুঝল জোয়ারের জল তার একমাত্র অবলম্বন নৌকাখানাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে…
এবার আর জলপথে এগিয়ে যাওয়ার উপায় নেই।
অসহ্য কষ্টকর অরণ্যপথেই তাকে অগ্রসর হতে হবে।
নোভাকের চোখ ফেটে জল এসে পড়ল।
ম্যাপ দেখে তার ধারণা হল নদীর স্রোত যেদিকে চলে গেছে সেদিকে কয়েক মাইল হাঁটলেই নদীতীর থেকে ভিতরের দিকে ২০ মাইল দূরে আমেরিকানদের যে উপনিবেশ ও বিমানবন্দর আছে সেখানে সে উপস্থিত হতে পারবে। কোনো রকমে এই পথটা অতিক্রম করতে পারলেই সে নিরাপদ। কিন্তু জঙ্গলের ভিতর দিয়ে আর পথ চলার উপায় ছিল না কারণ তার ম্যাচেটা হারিয়ে গেছে। দুর্ভেদ্য লতার বেড়াজাল ম্যাচেট দিয়ে না কেটে পথ চলা অসম্ভব- নোভাক নদীর ধার দিয়ে হাঁটতে শুরু করল…